আমাদের এক বন্ধু। মাথায় গোলমাল। একাডেমিতে থাকতে এবং পরে জাহাজে
যোগদানের পর কিছু লক্ষণ স্পষ্ট হলেও আমরা তখন তা ঠিকভাবে ধরতে পারিনি। একবার
জাহাজের সেলুনে (রিক্রিয়েশন রুম) টুয়েন্টি নাইন খেলার সময় উত্তেজনার বশে এক ভাবীর
ঊরুতে থাপ্পড় মেরে বসে। তার তাসের পার্টনার ভাবী অপ্রত্যাশিতভাবে একটা ওভার-ট্রাম
করে বসেছিলেন। উত্তেজিত হলে সে বন্ধুদের ঊরুতে এমন নির্দোষ থাপ্পড় মারত। তবে
স্থান-কাল-পাত্র বলে কথা। তখনো সে পাগলের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে পারেনি। ফলে
ঘটনাটির নির্দোষ ব্যাখ্যা জটিল হয়ে পড়ে। এমন ধরনের আলামত বেড়ে গেলে সে জাহাজের
চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কারণ জাহাজ তো আর ‘এমভি বঙ্গদেশ’ নয়, যে মাথাটি বিলকুল খারাপ হলেও
তা চালাতে অসুবিধা হবে না। মাথা আর পেশা খোয়ানোর পর তৃতীয় যে সম্পদটি খোয়ানোর কথা, সেটিও খুইয়ে ফেলেছে। ডাক্তার বউ একমাত্র ছেলেটিকে সাথে নিয়ে
যথাসময়ে সরে পড়েছেন।
ও এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে। বন্ধুবান্ধব জুনিয়র-সিনিয়র যে ক’জনের সাথে কিছুটা সখ্য সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় সবাইকে ওয়ানটাইম ডিসপোজেবল প্লেটের মতো ব্যবহার করে ফেলেছে। কারণ টাকা-পয়সা ধার নিয়ে সে নিজে ভুলে গেলেও যাদের কাছ থেকে নিয়েছিল ওরা কেউ ভোলেনি। ওর জন্য কিছু করার উদ্দেশ্যে আমরা ক’জন বেশ ক’টি উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু তার অতীতের ওই সব শিকাররা ভেটো দিয়ে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়েছে। পোশাক-আশাক বাস্তব কারণেই মলিন হয়েছে। তার পরও কথাবার্তায় হাবভাবে এলাকার সবচেয়ে ধনবান ব্যক্তি। ও আসলে এক ধরনের পরাবাস্তব জগতের বাসিন্দা। তাকে অনেক কিছু বোঝানো গেলেও তার মাথায় যে আসলেই গোলমাল তা বোঝানো যায় না। চিকিৎসার কথা বললেই কেটে পড়ে।
সরকারের কিছু মন্ত্রীকে দেখলে মনে হয় তারাও যেন আমাদের এই বন্ধুটির মতো একটা পরাবাস্তব জগতে বাস করছেন। খাজেগানে মজলিস যা-ই উত্থাপন করে, সরকার বলে আমরা করে ফেলেছি। মুশকিলটি হলো, এত কিছু করার পরও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনটি দিতে ভয়ঙ্করভাবে ভয়টি পাচ্ছে। জনগণ চায় নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। ওরা দেখায় উন্নয়নের বিলবোর্ড। বিলবোর্ড চমকে চমকিত জনগণের সামনে জয় ঘোষণা করলেন আবারো চমক দেখাবেন। অন্য অনেকের মতো আমিও ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। কী কী চমক হতে পারে তা নিয়ে মগজের স্ক্যানারটিকে ঘুরাতে লাগলাম। কারণ জাপানে অতি সম্প্রতি অভিনব ধরনের বিলবোর্ড চালু হয়ে গেছে। নারীদের উন্মুক্ত ঊরুকে বিলবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করছে।
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলব্যাপী এ ধরনের বিলবোর্ড ছড়িয়ে দিলে আসলেই একটা দারুণ চমক হতে পারত। জাপানের পর বাংলাদেশ হতো এই প্রমীলা বিলবোর্ডের দ্বিতীয় দেশ। হাঁটুর উপরে স্কার্ট পরলে বাঙালিত্ব নষ্ট হয়ে যাবে আমার মনে হয় না কোনো মিতা হক এমন কথা বলবেন। কারণ স্কার্ট পরা মেয়ে এ দেশে এখন আর ডুমুরের ফুল নয়। এই আইডিয়াটিতে শুধু চমক নয়, সারা দেশে ঝলকও সৃষ্টি হতো। এর মাধ্যমে সরকারের অন্যতম পরিকল্পনা জঙ্গি ধরাও সহজ হয়ে যেত। এগুলো দেখে যারাই উসখুস করত, তাদেরকেই জঙ্গি হিসেবে চালিয়ে দেয়া যেত। বে-তেঁতুল ঠাকুরদের তেঁতুল হুজুরদের আইডেন্টিফাইংয়ের কাজটিও অনেকখানি সহজ হয়ে পড়ত।
সজীব ওয়াজেদ জয় মাদরাসাছাত্রের সংখ্যা কমানোর কৃতিত্ব দাবি করলেও তার মায়ের দাবি ইসলামের খেদমত। এই খেদমত যা করার তা করেছে একমাত্র আওয়ামী লীগ। শাজাহান খান, মোহাম্মদ নাসিমসহ বেশ কয়েকজন নেতাও এ ব্যাপারে সরব হয়েছেন। তাদের বদ্ধমূল ধারণা যে এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা একমাত্র শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব। অন্যদের জন্য ইসলাম প্রতিষ্ঠা হারাম ঘোষণা করে নিজেরাই এখন তা প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রাখার কথাগুলো তুলে দিয়েছেনÑ তাতেও ইসলামের সাঙ্ঘাতিক রকমের খেদমত হয়েছে। অতীত ও বর্তমান আওয়ামী সরকার কর্তৃক ইসলামের এ ধরনের খেদমতের তালিকাটিও অনেকখানি লম্বা। দেশ চালাচ্ছেন মদিনার সনদ অনুসরণ করে; কিন্তু বেয়াড়া জনগণ মনে করছে এটা দিল্লির সনদ। সরকার যা দেখে জনগণ তা দেখতে পায় না। আবার জনগণ যা দেখে সরকার তা দেখতে পারে না।
ইসলাম প্রতিষ্ঠা এবং মদিনার সনদমতো রাষ্ট্র চালানোর এসব দাবির সাথে দ্বিমত পোষণ করা আসলেই কঠিন। কখনো কখনো বিপজ্জনক বটে। টকশোতে গিয়ে শাজাহান খানদের পাশাপাশি বসে এসব বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলে দু’টি চোখ খোয়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। আবার হরতাল ডাকলে লতিফ সিদ্দিকীরা হরতালকারীদের ঘরে গিয়ে খুন করার হুমকি দিয়েছেন। সেই সভায় আবার গণতন্ত্রের মানসকন্যা উপস্থিত ছিলেন।
শুধু পরকালের খেদমতই নয়Ñ ইহলোকের রাস্তাঘাট, ব্যবসায়-বাণিজ্য, আইনশৃঙ্খলা সব কিছুতেই খেদমতের সেই একই নমুনা। এবার শুধু দুই প্রজন্ম অর্থাৎ মা-মেয়েকে একসাথে (ফেনীতে কয়েক দিন আগে) খেদমত করা হয়েছে। আগামীবার তিন প্রজন্ম অর্থাৎ নানীদেরকেও এই খেদমতের আওতায় আনা হবে। সারা দেশ এ রকম এনালগ খেদমতে সয়লাব হয়ে গেছে। সঙ্গত কারণেই সরকার মনে করছে যে, দেশটি প্রায় ডিজিটাল করে ফেলেছে। সামান্য একটু বাকি আছে। সামনের বার আসতে পারলে ইসলামের বাদবাকি খেদমতের সাথে ডিজিটাল করার কাজটিও শতভাগ সম্পন্ন করে ফেলবে। বেগম খালেদা জিয়া দেশ ও জাতির স্বার্থেই এই মাথা খারাপ হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। বদরুদ্দিন উমরসহ আরো অনেকেই বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়া ঠিক হবে না। দুয়েকটি লক্ষণ আবারো উল্লেখ করা যেতে পারে।
সারা দেশের মানুষ জেনে গিয়েছিল যে রানা প্লাজার রানা কে ছিলেন। সরকারদলীয় এমপি রানার কপালে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিচ্ছেনÑ এমন একটি ছবিও পুরো জাতি তথা জনগণকে বিনোদিত করে। সাভার এলাকায় উড্ডীন শত শত পোস্টার তখনো বলছে রানা কার। এত কিছুর পরও বলা হলো যে ‘রানা য্বুলীগের কেউ না’।
সারা দেশ দেখল ও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করল যে বিশ্বজিতের খুনিরা কাদের সোনার ছেলে ছিল। কিন্তু সরকারের ব্যাখ্যা সবার পিলে চমকে দিলো। কারণ খুনিদের কারো চাচা, কারো মামা বা ফুফা বিএনপি বা জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত। কাজের সময় নিজের ছেলে, ধরা খেলে পরের ছেলেÑ এই বাতিকটি সত্যিই মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
রানা প্লাজায় যখন তিন-চার হাজার মানুষ জীবিত ও মৃত অবস্থায় চাপা পড়ে রয়েছে তখনো সংসদের পবিত্র অঙ্গনে দাঁড়িয়ে বলা হলো, ‘সবাইকে ওই ভবন থেকে আগেভাগেই বের করে আনা হয়েছে। শুধু কয়েকজন নিজেদের মালপত্র আনার জন্য সেখানে গিয়ে আটকা পড়েছে।’ এই কয়েকজন অচিরেই কয়েক হাজার হয়ে পড়ল। এমন জলজ্যান্ত অসত্য কথা বলে ধরা খেলে একজন সাধারণ মানুষের কানও লজ্জায় লাল হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের সরকারের তেমন ধরনের কোনো বিক্রিয়াই সৃষ্টি হলো না। দেখা গেছে, কোনো ঘটনা ঘটা মাত্রই দলের সাফাই গেয়ে প্রথম বিবৃতি দেয়া হয় সরকারপ্রধানের পক্ষ থেকে। উপরিউক্ত সিম্পটমগুলো নিয়ে ভাবনার জন্য সবার কাছে অনুরোধ রাখছি। আমার অভিযোগটি রাজনৈতিক নয়, শতভাগ মেডিক্যাল কমপ্লেইন।
একটি বিমানের পাইলট বা জাহাজের ক্যাপ্টেনের মাথায় গল্ডগোল আছে সন্দেহ হলে তাকে কখনোই সেই বিমান কিংবা জাহাজ চালাতে দেয়া হবে না। আমার বন্ধুটি একই কারণে জাহাজের ক্যাপ্টেন হতে পারেননি। কারণ সামান্য আক্কেল জ্ঞানসম্পন্ন কোনো যাত্রী এ ধরনের বিমানে ওঠার সাহস করবেন না। কিন্তু সরকারের মাথায় গোলমাল স্পষ্ট হওয়ার পরও ১৬ কোটি যাত্রীর এই জাহাজটি চালাতে দেয়া হচ্ছে! আরো একটি উদাহরণ এখানে টানা যেতে পারে। এ ধরনের কাহিনী অবশ্য নেতাজীর ভাইয়ের নাতনী শর্মিলা বসুকে ছাড়া উপমহাদেশের অন্য কোনো লেখক লেখার সাহস করেন না। নদীর দুই পাড়ের মতো মানবতা নামক নদীটিরও দু’টি পাড় রয়েছে। শর্মিলা বসুর মতো দুয়েকজন ছাড়া অনেকেই এই দু’টি পাড় একসাথে দেখতে পারেন না। কোনোরূপ রাজনৈতিক সুড়সুড়ি দেয়ার মতলবে নয়, মনোবিজ্ঞানের ছাত্রদের গবেষণার স্বার্থেই ঘটনাটি তুলে ধরছি।
পাকিস্তান শিপিং করপোরেশনের জাহাজের একটি সত্য ঘটনা। একটি ব্র্যান্ড নিউ জাহাজ তার মেইডেন ভয়েজ শুরু করেছে। সন্ধ্যা ৮টা-১২টার শিফট। সবচেয়ে জুনিয়র অফিসার তখন ব্রিজের ডিউটিতে। জাহাজের ক্যাপ্টেন তখনো ঘুমাননি। কেবিনে বসে টুকটাক কিছু কাজ করছিলেন। হঠাৎ ভীষণ একটা ধাক্কা খেয়ে জাহাজটি থেমে যায়। পোর্টহোল দিয়ে তাকিয়ে দেখেন তার কেবিনের সম্মুখেই আস্ত একটা পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। শরীরে চিমটি কেটে ক্যাপ্টেন বুঝতে পারলেন যে তিনি দুঃস্বপ্ন দেখছেন না। সজাগ থেকেই এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখছেন। দৌড়ে ব্রিজে গিয়ে দেখতে পান যে একটু আগে রেখে যাওয়া তার পরিচিত সেই অফিসারটি নন, বরং ভয়ঙ্কর চেহারার পুরোদস্তুর এক উন্মাদ সারা ব্রিজে দৌড়াচ্ছে। অথচ তরুণ এই নেভিগেটরটি পাকিস্তান মেরিন একাডেমির এক কৃতী ক্যাডেট। জাহাজেও সর্বদা ছিল অত্যন্ত স্মার্ট ও বিনয়ী।
অনুসন্ধানের পর বেরিয়ে এলো পারিবারিক এক ট্র্যাজেডি। ১৯৭২ সালে অন্যান্য বিহারি পরিবারের মতো তার পরিবারও ঢাকার মিরপুরে আটকে পড়ে। বাবা-মা এবং বড় কয়েক বোনকে অত্যন্ত নির্মমভাবে অত্যাচারের পর হত্যা করা হয়। নিজে কোনোভাবে সেই হত্যা থেকে বেঁচে যান। কিন্তু সেই ভয়াবহ স্মৃটি মন থেকে মুছতে পারেননি। সেই ভয়াবহ স্মৃতি স্মরণ হলে এ রকম উন্মাদ পয়ে পড়েন। সেদিন হঠাৎ সেই স্মৃতিটি স্মরণ হলে এই জাহাজটিকে সরাসরি সাগরের বুকে ভাসমান একটি পাহাড়ের সাথে এমন ভয়ঙ্করভাবে ধাক্কা লাগিয়ে দেন।
রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও যেকোনো পারিবারিক ট্র্যাজেডির সাথে এই নেভিগেটরের পারিবারিক ট্র্যাজেডির অনেক মিল রয়েছে। সত্য কথা হচ্ছে, পারিবারিক ট্র্যাজেডির পর স্বাভাবিক থাকাই কোনো মনুষ্য সন্তানের জন্য অস্বাভাবিক। এমন পরিস্থিতিতে আবেগ বা আক্রোশ নয়Ñ প্রজ্ঞা দিয়েই সব কিছু বিচার করা উচিত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই উচ্চারণটি কঠিন হলেও আমাদের সম্মুখে বিকল্প ভাবনা আসলেই অত্যন্ত সীমিত।
ধরুন, বিমানের এক পাইলট তার পুরো পরিবারসহ এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। এখন পাইলট দম্পতির জীবিত এক কন্যাকে সাথে সাথেই পাইলট বানিয়ে সেই জাহাজে চড়ে বসা কতটুকু বুদ্ধিমানের কাজ হবে? বিশেষ করে যখন বিভিন্ন ‘সিম্পটম’ দৃশ্যমান হয়ে পড়েছে।
এ কারণেই সরকারের মুখপাত্র ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ডক্টর আকবর আলি খান, এ বি এম মূসা, ডক্টর ইউনূসসহ যখন যেই কিছু উপদেশবাণী নিয়ে এগিয়ে এসেছেন তার ওপরই ভয়ানকভাবে চড়াও হয়েছেন। এই মারাত্মক রোগটিকে এক তৈলবাজ দেখেছেন ভিন্নভাবে। যে পজিশনে উঠে গেলে সব দুর্বলতা গুণ হিসেবে কীর্তনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় সেখানে এই রোগ থেকে মুক্তি কতটা সম্ভব? জাতি পড়েছে এমনই এক ভয়ঙ্কর বিপদে।
অনেক চড়াই-উতরাই পার হওয়ার পর দেশ নামক এ জাহাজটি চলার জন্য মোটামুটি ট্রাফিকমুক্ত সমুদ্র দেখা গিয়েছিল। দেশের রাজনীতিতে যে দুর্বৃত্তায়ন শুরু হয়েছে তাকে কার্যকরভাবে জব্দ করার জন্য নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচনটিকে জনগণ লুফে নেয়। রাজনৈতিক বাজিকর বা রাক্ষস-খোক্ষসদের আত্মা যে কৌটায় রক্ষিত থাকে তার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ অন্ততপক্ষে প্রতি পাঁচ বছর পর একবারের জন্য হলেও জনগণের হাতে আসবে। জনগণ ইচ্ছেমতো তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবে। জাতির সামনে এমন একটি পরিষ্কার সমুদ্র থাকলেও হঠাৎ একটি পাহাড়ের সাথে এমন করেই ধাক্কা লাগানো হচ্ছে। আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি।
দেশের ৯০ ভাগ মানুষের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারটিকে হাইকোর্টের দোহাই দিয়ে বাতিল করা হয়েছে। কাজেই দেশের সব বুদ্ধিমান ও বিবেকবান মানুষকে জেলখানায় কিংবা পাগলা গারদে পাঠানোর আগেই সম্মিলিতভাবে আওয়াজ তোলা উচিত। তা না হলে সত্যিই ভয়ঙ্কর সময় অপেক্ষা করছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মার্টিন নিমোলারের সেই বিখ্যাত উক্তিটি আমাদের বারবার স্মরণ করা উচতিÑ জার্মানিতে নাৎসিরা প্রথমে কমিউনিস্টদের ধরতে এলো আমি কিছু বলিনি, কারণ আমি কমিউনিস্ট ছিলাম না। যখন তারা সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের বন্দী করতে এলো তখনো আমি নীরব থাকলাম, কারণ আমি সোস্যাল ডেমোক্র্যাট ছিলাম না। যখন তারা ইহুদিদের ধরার জন্য এলো তখনো আমি কোনো শব্দ উচ্চারণ করলাম না, কারণ আমি ইহুদি ছিলাম না। যখন তারা আমাকে ধরতে এলো তখন আমার পক্ষে কথা বলার জন্য কেউ রইল না।
তরুণ এমপি রনিকে দিয়ে ওপরের বাক্যটি বসিয়ে একটি প্যারা রচনা করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী রনি যুদ্ধাপরাধ থেকে যোজন যোজন দূরে ছিলেন। কাজেই যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় গ্রেফতার শুরু করলে আইনের ছাত্র রনি এখানে আইনের শাসনের কোনো ব্যত্যয় দেখতে পেলেন না।
সম্পাদক রনি ‘বাইচান্স’ সম্পাদক ছিলেন না। কাজেই ‘বাইচান্স’ সম্পাদকগণ বিভিন্ন চান্সে গ্রেফতার হলে বাকস্বাধীনতার প্রবক্তা রনি চুপ করে থাকলেন। রনি বিএনপি-জামায়াতের এমপি ছিলেন না। কাজেই বিরোধীদলীয় এমপি ও হুইপকে পুলিশ চ্যাংদোলা করে টেনে নিলে রনি সঙ্গত কারণেই চুপ থাকলেন।
পিটাপিটির এই জমানায় অনেক নেতা-এমপিই সাংবাদিকদের পিটিয়েছেন। তাদের কিছু না হলেও একই অপরাধে এই রনি যখন গ্রেফতার হলেন তখন সে সম্পর্কে দু’টি কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া গেল না। এই অধম অবশ্য পুরো একটি কলাম এই রনির জন্য সে সময় খরচ করেছিল। কলামটির নাম দিয়েছিলাম, সময়ের বরপুত্র অসময়ের মেহমান।
দেশের সবচেয়ে পুরনো এই রাজনৈতিক দলটিসহ অন্যান্য জায়গায় যে ক’জন বিবেকবান মানুষ এখনো অবশিষ্ট আছেন তাদের কাছে নিবেদনÑ দয়া করে সোচ্চার হোন। সব জায়গার চেনা বাবাজীরা মিলে আমাদের এই মুখগুলো যেন বন্ধ না করে দেয়। যার মাথাই খারাপ হোক ওপরে উল্লেখিত সাংবিধানিক দাবিটি যেন তুলতে পারি। দৌড়ে ফার্স্ট হয়ে যে আবুলই (ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা জাতীয়তাবাদী) মন্ত্রী হোকÑ নির্ভয়ে সেই গল্পটি যেন জাতিকে শোনাতে পারি।
ও এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে। বন্ধুবান্ধব জুনিয়র-সিনিয়র যে ক’জনের সাথে কিছুটা সখ্য সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় সবাইকে ওয়ানটাইম ডিসপোজেবল প্লেটের মতো ব্যবহার করে ফেলেছে। কারণ টাকা-পয়সা ধার নিয়ে সে নিজে ভুলে গেলেও যাদের কাছ থেকে নিয়েছিল ওরা কেউ ভোলেনি। ওর জন্য কিছু করার উদ্দেশ্যে আমরা ক’জন বেশ ক’টি উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু তার অতীতের ওই সব শিকাররা ভেটো দিয়ে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়েছে। পোশাক-আশাক বাস্তব কারণেই মলিন হয়েছে। তার পরও কথাবার্তায় হাবভাবে এলাকার সবচেয়ে ধনবান ব্যক্তি। ও আসলে এক ধরনের পরাবাস্তব জগতের বাসিন্দা। তাকে অনেক কিছু বোঝানো গেলেও তার মাথায় যে আসলেই গোলমাল তা বোঝানো যায় না। চিকিৎসার কথা বললেই কেটে পড়ে।
সরকারের কিছু মন্ত্রীকে দেখলে মনে হয় তারাও যেন আমাদের এই বন্ধুটির মতো একটা পরাবাস্তব জগতে বাস করছেন। খাজেগানে মজলিস যা-ই উত্থাপন করে, সরকার বলে আমরা করে ফেলেছি। মুশকিলটি হলো, এত কিছু করার পরও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনটি দিতে ভয়ঙ্করভাবে ভয়টি পাচ্ছে। জনগণ চায় নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। ওরা দেখায় উন্নয়নের বিলবোর্ড। বিলবোর্ড চমকে চমকিত জনগণের সামনে জয় ঘোষণা করলেন আবারো চমক দেখাবেন। অন্য অনেকের মতো আমিও ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। কী কী চমক হতে পারে তা নিয়ে মগজের স্ক্যানারটিকে ঘুরাতে লাগলাম। কারণ জাপানে অতি সম্প্রতি অভিনব ধরনের বিলবোর্ড চালু হয়ে গেছে। নারীদের উন্মুক্ত ঊরুকে বিলবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করছে।
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলব্যাপী এ ধরনের বিলবোর্ড ছড়িয়ে দিলে আসলেই একটা দারুণ চমক হতে পারত। জাপানের পর বাংলাদেশ হতো এই প্রমীলা বিলবোর্ডের দ্বিতীয় দেশ। হাঁটুর উপরে স্কার্ট পরলে বাঙালিত্ব নষ্ট হয়ে যাবে আমার মনে হয় না কোনো মিতা হক এমন কথা বলবেন। কারণ স্কার্ট পরা মেয়ে এ দেশে এখন আর ডুমুরের ফুল নয়। এই আইডিয়াটিতে শুধু চমক নয়, সারা দেশে ঝলকও সৃষ্টি হতো। এর মাধ্যমে সরকারের অন্যতম পরিকল্পনা জঙ্গি ধরাও সহজ হয়ে যেত। এগুলো দেখে যারাই উসখুস করত, তাদেরকেই জঙ্গি হিসেবে চালিয়ে দেয়া যেত। বে-তেঁতুল ঠাকুরদের তেঁতুল হুজুরদের আইডেন্টিফাইংয়ের কাজটিও অনেকখানি সহজ হয়ে পড়ত।
সজীব ওয়াজেদ জয় মাদরাসাছাত্রের সংখ্যা কমানোর কৃতিত্ব দাবি করলেও তার মায়ের দাবি ইসলামের খেদমত। এই খেদমত যা করার তা করেছে একমাত্র আওয়ামী লীগ। শাজাহান খান, মোহাম্মদ নাসিমসহ বেশ কয়েকজন নেতাও এ ব্যাপারে সরব হয়েছেন। তাদের বদ্ধমূল ধারণা যে এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা একমাত্র শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব। অন্যদের জন্য ইসলাম প্রতিষ্ঠা হারাম ঘোষণা করে নিজেরাই এখন তা প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রাখার কথাগুলো তুলে দিয়েছেনÑ তাতেও ইসলামের সাঙ্ঘাতিক রকমের খেদমত হয়েছে। অতীত ও বর্তমান আওয়ামী সরকার কর্তৃক ইসলামের এ ধরনের খেদমতের তালিকাটিও অনেকখানি লম্বা। দেশ চালাচ্ছেন মদিনার সনদ অনুসরণ করে; কিন্তু বেয়াড়া জনগণ মনে করছে এটা দিল্লির সনদ। সরকার যা দেখে জনগণ তা দেখতে পায় না। আবার জনগণ যা দেখে সরকার তা দেখতে পারে না।
ইসলাম প্রতিষ্ঠা এবং মদিনার সনদমতো রাষ্ট্র চালানোর এসব দাবির সাথে দ্বিমত পোষণ করা আসলেই কঠিন। কখনো কখনো বিপজ্জনক বটে। টকশোতে গিয়ে শাজাহান খানদের পাশাপাশি বসে এসব বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলে দু’টি চোখ খোয়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। আবার হরতাল ডাকলে লতিফ সিদ্দিকীরা হরতালকারীদের ঘরে গিয়ে খুন করার হুমকি দিয়েছেন। সেই সভায় আবার গণতন্ত্রের মানসকন্যা উপস্থিত ছিলেন।
শুধু পরকালের খেদমতই নয়Ñ ইহলোকের রাস্তাঘাট, ব্যবসায়-বাণিজ্য, আইনশৃঙ্খলা সব কিছুতেই খেদমতের সেই একই নমুনা। এবার শুধু দুই প্রজন্ম অর্থাৎ মা-মেয়েকে একসাথে (ফেনীতে কয়েক দিন আগে) খেদমত করা হয়েছে। আগামীবার তিন প্রজন্ম অর্থাৎ নানীদেরকেও এই খেদমতের আওতায় আনা হবে। সারা দেশ এ রকম এনালগ খেদমতে সয়লাব হয়ে গেছে। সঙ্গত কারণেই সরকার মনে করছে যে, দেশটি প্রায় ডিজিটাল করে ফেলেছে। সামান্য একটু বাকি আছে। সামনের বার আসতে পারলে ইসলামের বাদবাকি খেদমতের সাথে ডিজিটাল করার কাজটিও শতভাগ সম্পন্ন করে ফেলবে। বেগম খালেদা জিয়া দেশ ও জাতির স্বার্থেই এই মাথা খারাপ হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। বদরুদ্দিন উমরসহ আরো অনেকেই বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়া ঠিক হবে না। দুয়েকটি লক্ষণ আবারো উল্লেখ করা যেতে পারে।
সারা দেশের মানুষ জেনে গিয়েছিল যে রানা প্লাজার রানা কে ছিলেন। সরকারদলীয় এমপি রানার কপালে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিচ্ছেনÑ এমন একটি ছবিও পুরো জাতি তথা জনগণকে বিনোদিত করে। সাভার এলাকায় উড্ডীন শত শত পোস্টার তখনো বলছে রানা কার। এত কিছুর পরও বলা হলো যে ‘রানা য্বুলীগের কেউ না’।
সারা দেশ দেখল ও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করল যে বিশ্বজিতের খুনিরা কাদের সোনার ছেলে ছিল। কিন্তু সরকারের ব্যাখ্যা সবার পিলে চমকে দিলো। কারণ খুনিদের কারো চাচা, কারো মামা বা ফুফা বিএনপি বা জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত। কাজের সময় নিজের ছেলে, ধরা খেলে পরের ছেলেÑ এই বাতিকটি সত্যিই মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
রানা প্লাজায় যখন তিন-চার হাজার মানুষ জীবিত ও মৃত অবস্থায় চাপা পড়ে রয়েছে তখনো সংসদের পবিত্র অঙ্গনে দাঁড়িয়ে বলা হলো, ‘সবাইকে ওই ভবন থেকে আগেভাগেই বের করে আনা হয়েছে। শুধু কয়েকজন নিজেদের মালপত্র আনার জন্য সেখানে গিয়ে আটকা পড়েছে।’ এই কয়েকজন অচিরেই কয়েক হাজার হয়ে পড়ল। এমন জলজ্যান্ত অসত্য কথা বলে ধরা খেলে একজন সাধারণ মানুষের কানও লজ্জায় লাল হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের সরকারের তেমন ধরনের কোনো বিক্রিয়াই সৃষ্টি হলো না। দেখা গেছে, কোনো ঘটনা ঘটা মাত্রই দলের সাফাই গেয়ে প্রথম বিবৃতি দেয়া হয় সরকারপ্রধানের পক্ষ থেকে। উপরিউক্ত সিম্পটমগুলো নিয়ে ভাবনার জন্য সবার কাছে অনুরোধ রাখছি। আমার অভিযোগটি রাজনৈতিক নয়, শতভাগ মেডিক্যাল কমপ্লেইন।
একটি বিমানের পাইলট বা জাহাজের ক্যাপ্টেনের মাথায় গল্ডগোল আছে সন্দেহ হলে তাকে কখনোই সেই বিমান কিংবা জাহাজ চালাতে দেয়া হবে না। আমার বন্ধুটি একই কারণে জাহাজের ক্যাপ্টেন হতে পারেননি। কারণ সামান্য আক্কেল জ্ঞানসম্পন্ন কোনো যাত্রী এ ধরনের বিমানে ওঠার সাহস করবেন না। কিন্তু সরকারের মাথায় গোলমাল স্পষ্ট হওয়ার পরও ১৬ কোটি যাত্রীর এই জাহাজটি চালাতে দেয়া হচ্ছে! আরো একটি উদাহরণ এখানে টানা যেতে পারে। এ ধরনের কাহিনী অবশ্য নেতাজীর ভাইয়ের নাতনী শর্মিলা বসুকে ছাড়া উপমহাদেশের অন্য কোনো লেখক লেখার সাহস করেন না। নদীর দুই পাড়ের মতো মানবতা নামক নদীটিরও দু’টি পাড় রয়েছে। শর্মিলা বসুর মতো দুয়েকজন ছাড়া অনেকেই এই দু’টি পাড় একসাথে দেখতে পারেন না। কোনোরূপ রাজনৈতিক সুড়সুড়ি দেয়ার মতলবে নয়, মনোবিজ্ঞানের ছাত্রদের গবেষণার স্বার্থেই ঘটনাটি তুলে ধরছি।
পাকিস্তান শিপিং করপোরেশনের জাহাজের একটি সত্য ঘটনা। একটি ব্র্যান্ড নিউ জাহাজ তার মেইডেন ভয়েজ শুরু করেছে। সন্ধ্যা ৮টা-১২টার শিফট। সবচেয়ে জুনিয়র অফিসার তখন ব্রিজের ডিউটিতে। জাহাজের ক্যাপ্টেন তখনো ঘুমাননি। কেবিনে বসে টুকটাক কিছু কাজ করছিলেন। হঠাৎ ভীষণ একটা ধাক্কা খেয়ে জাহাজটি থেমে যায়। পোর্টহোল দিয়ে তাকিয়ে দেখেন তার কেবিনের সম্মুখেই আস্ত একটা পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। শরীরে চিমটি কেটে ক্যাপ্টেন বুঝতে পারলেন যে তিনি দুঃস্বপ্ন দেখছেন না। সজাগ থেকেই এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখছেন। দৌড়ে ব্রিজে গিয়ে দেখতে পান যে একটু আগে রেখে যাওয়া তার পরিচিত সেই অফিসারটি নন, বরং ভয়ঙ্কর চেহারার পুরোদস্তুর এক উন্মাদ সারা ব্রিজে দৌড়াচ্ছে। অথচ তরুণ এই নেভিগেটরটি পাকিস্তান মেরিন একাডেমির এক কৃতী ক্যাডেট। জাহাজেও সর্বদা ছিল অত্যন্ত স্মার্ট ও বিনয়ী।
অনুসন্ধানের পর বেরিয়ে এলো পারিবারিক এক ট্র্যাজেডি। ১৯৭২ সালে অন্যান্য বিহারি পরিবারের মতো তার পরিবারও ঢাকার মিরপুরে আটকে পড়ে। বাবা-মা এবং বড় কয়েক বোনকে অত্যন্ত নির্মমভাবে অত্যাচারের পর হত্যা করা হয়। নিজে কোনোভাবে সেই হত্যা থেকে বেঁচে যান। কিন্তু সেই ভয়াবহ স্মৃটি মন থেকে মুছতে পারেননি। সেই ভয়াবহ স্মৃতি স্মরণ হলে এ রকম উন্মাদ পয়ে পড়েন। সেদিন হঠাৎ সেই স্মৃতিটি স্মরণ হলে এই জাহাজটিকে সরাসরি সাগরের বুকে ভাসমান একটি পাহাড়ের সাথে এমন ভয়ঙ্করভাবে ধাক্কা লাগিয়ে দেন।
রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও যেকোনো পারিবারিক ট্র্যাজেডির সাথে এই নেভিগেটরের পারিবারিক ট্র্যাজেডির অনেক মিল রয়েছে। সত্য কথা হচ্ছে, পারিবারিক ট্র্যাজেডির পর স্বাভাবিক থাকাই কোনো মনুষ্য সন্তানের জন্য অস্বাভাবিক। এমন পরিস্থিতিতে আবেগ বা আক্রোশ নয়Ñ প্রজ্ঞা দিয়েই সব কিছু বিচার করা উচিত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই উচ্চারণটি কঠিন হলেও আমাদের সম্মুখে বিকল্প ভাবনা আসলেই অত্যন্ত সীমিত।
ধরুন, বিমানের এক পাইলট তার পুরো পরিবারসহ এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। এখন পাইলট দম্পতির জীবিত এক কন্যাকে সাথে সাথেই পাইলট বানিয়ে সেই জাহাজে চড়ে বসা কতটুকু বুদ্ধিমানের কাজ হবে? বিশেষ করে যখন বিভিন্ন ‘সিম্পটম’ দৃশ্যমান হয়ে পড়েছে।
এ কারণেই সরকারের মুখপাত্র ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ডক্টর আকবর আলি খান, এ বি এম মূসা, ডক্টর ইউনূসসহ যখন যেই কিছু উপদেশবাণী নিয়ে এগিয়ে এসেছেন তার ওপরই ভয়ানকভাবে চড়াও হয়েছেন। এই মারাত্মক রোগটিকে এক তৈলবাজ দেখেছেন ভিন্নভাবে। যে পজিশনে উঠে গেলে সব দুর্বলতা গুণ হিসেবে কীর্তনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় সেখানে এই রোগ থেকে মুক্তি কতটা সম্ভব? জাতি পড়েছে এমনই এক ভয়ঙ্কর বিপদে।
অনেক চড়াই-উতরাই পার হওয়ার পর দেশ নামক এ জাহাজটি চলার জন্য মোটামুটি ট্রাফিকমুক্ত সমুদ্র দেখা গিয়েছিল। দেশের রাজনীতিতে যে দুর্বৃত্তায়ন শুরু হয়েছে তাকে কার্যকরভাবে জব্দ করার জন্য নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচনটিকে জনগণ লুফে নেয়। রাজনৈতিক বাজিকর বা রাক্ষস-খোক্ষসদের আত্মা যে কৌটায় রক্ষিত থাকে তার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ অন্ততপক্ষে প্রতি পাঁচ বছর পর একবারের জন্য হলেও জনগণের হাতে আসবে। জনগণ ইচ্ছেমতো তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবে। জাতির সামনে এমন একটি পরিষ্কার সমুদ্র থাকলেও হঠাৎ একটি পাহাড়ের সাথে এমন করেই ধাক্কা লাগানো হচ্ছে। আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি।
দেশের ৯০ ভাগ মানুষের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারটিকে হাইকোর্টের দোহাই দিয়ে বাতিল করা হয়েছে। কাজেই দেশের সব বুদ্ধিমান ও বিবেকবান মানুষকে জেলখানায় কিংবা পাগলা গারদে পাঠানোর আগেই সম্মিলিতভাবে আওয়াজ তোলা উচিত। তা না হলে সত্যিই ভয়ঙ্কর সময় অপেক্ষা করছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মার্টিন নিমোলারের সেই বিখ্যাত উক্তিটি আমাদের বারবার স্মরণ করা উচতিÑ জার্মানিতে নাৎসিরা প্রথমে কমিউনিস্টদের ধরতে এলো আমি কিছু বলিনি, কারণ আমি কমিউনিস্ট ছিলাম না। যখন তারা সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের বন্দী করতে এলো তখনো আমি নীরব থাকলাম, কারণ আমি সোস্যাল ডেমোক্র্যাট ছিলাম না। যখন তারা ইহুদিদের ধরার জন্য এলো তখনো আমি কোনো শব্দ উচ্চারণ করলাম না, কারণ আমি ইহুদি ছিলাম না। যখন তারা আমাকে ধরতে এলো তখন আমার পক্ষে কথা বলার জন্য কেউ রইল না।
তরুণ এমপি রনিকে দিয়ে ওপরের বাক্যটি বসিয়ে একটি প্যারা রচনা করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী রনি যুদ্ধাপরাধ থেকে যোজন যোজন দূরে ছিলেন। কাজেই যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় গ্রেফতার শুরু করলে আইনের ছাত্র রনি এখানে আইনের শাসনের কোনো ব্যত্যয় দেখতে পেলেন না।
সম্পাদক রনি ‘বাইচান্স’ সম্পাদক ছিলেন না। কাজেই ‘বাইচান্স’ সম্পাদকগণ বিভিন্ন চান্সে গ্রেফতার হলে বাকস্বাধীনতার প্রবক্তা রনি চুপ করে থাকলেন। রনি বিএনপি-জামায়াতের এমপি ছিলেন না। কাজেই বিরোধীদলীয় এমপি ও হুইপকে পুলিশ চ্যাংদোলা করে টেনে নিলে রনি সঙ্গত কারণেই চুপ থাকলেন।
পিটাপিটির এই জমানায় অনেক নেতা-এমপিই সাংবাদিকদের পিটিয়েছেন। তাদের কিছু না হলেও একই অপরাধে এই রনি যখন গ্রেফতার হলেন তখন সে সম্পর্কে দু’টি কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া গেল না। এই অধম অবশ্য পুরো একটি কলাম এই রনির জন্য সে সময় খরচ করেছিল। কলামটির নাম দিয়েছিলাম, সময়ের বরপুত্র অসময়ের মেহমান।
দেশের সবচেয়ে পুরনো এই রাজনৈতিক দলটিসহ অন্যান্য জায়গায় যে ক’জন বিবেকবান মানুষ এখনো অবশিষ্ট আছেন তাদের কাছে নিবেদনÑ দয়া করে সোচ্চার হোন। সব জায়গার চেনা বাবাজীরা মিলে আমাদের এই মুখগুলো যেন বন্ধ না করে দেয়। যার মাথাই খারাপ হোক ওপরে উল্লেখিত সাংবিধানিক দাবিটি যেন তুলতে পারি। দৌড়ে ফার্স্ট হয়ে যে আবুলই (ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা জাতীয়তাবাদী) মন্ত্রী হোকÑ নির্ভয়ে সেই গল্পটি যেন জাতিকে শোনাতে পারি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন