মহাজোট সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের তিনদিন আগেই সারাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটতে থাকে। প্রশাসনে অতি দলীয়করণের কার্যক্রম চলতে থাকায় দেশব্যাপী মাঠ প্রশাসনে স্থবিরতা দেখা দেয়। প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সর্বদা বদলি এবং ওএসডি আতঙ্কে থাকতে হয়। প্রথম থেকেই সচিবালয় কর্মরত এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জেলায় জেলায় ডিসি ও এসপি নিয়োগে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তারা প্রধানত আওয়ামী লীগ সমর্থক হলেও ক্ষমতার পালাবদলে তাদের বদলি করতে মরিয়া হয়ে উঠে কট্টরপন্থী একটি গ্রুপ। প্রশাসনে সরকারদলীয় সমর্থক এ গ্রুপটির বক্তব্য ছিল, কেবল আওয়ামী লীগ সমর্থক হলেই হবে না, ডিসি এবং এসপি হতে হবে সাবেক ছাত্রলীগ ক্যারিয়ারসম্পন্ন। এ যোগ্যতার মধ্যে না পড়লে নিয়োগের পর ৪ মাস বা ৬ মাস যাই হোক না কেন তাদের বদলি করে নতুন নিয়োগ দিতে হবে।
পূর্ত মন্ত্রণালয় সচিবের পিএস প্রশাসনকে অতি আওয়ামীকরণের এ কার্যক্রমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। সারাদেশে প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ছাত্রলীগ ক্যারিয়ারসম্পন্নদের তালিকা সচিবালয়ে ঘষামাজা চলছেÑএমন সংবাদ ছড়িয়ে পড়ায় সরকারদলীয় সাধারণ সমর্থক কর্মকর্তারাও দুশ্চিন্তায় পড়েন। মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে এ বদলি এবং ওএসডি আতংক ও স্থবিরতার আইন-শৃংখলা অবনতির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও তার সব ভূমিকা বা পদক্ষেপ পছন্দ করেননি সচিবরা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ভিশন ২০১১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংস্থাপন সচিবের কক্ষের পাশেই অফিস দেয়া হয় এইচটি ইমামকে। তিনি প্রশাসনের সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিং করেন। কিন্তু উপদেষ্টার অনেক উদ্যোগই পছন্দ করেননি আমলারা। আবার জুনিয়র কর্মকর্তা হয়েও পূর্ত সচিবের পিএস কর্তৃক তালিকা নিয়ে ছোটাছুটি প্রশাসনে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। ফলে সচিবালয়ে নানামুখী বিরোধী দানা বাঁধতে শুরু করে। উপদেষ্টাদের সঙ্গে বিরোধের কারণেই সংস্থাপন সচিব এএসএম আলী কবীরকে বদলি হতে হয়। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯)
৫ বছরে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ছিনতাই, দখলদারিত্ব ও খুুনের মতো গুরুতর অপরাধ বেড়েছে। আগে পেশাদার সন্ত্রাসীরা পাড়া মহল্লা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি করত। কিন্তু পেশাদার সন্ত্রাসীদের সঙ্গে স্থানীয় কিছু মুখচেনা রাজনৈতিক মহাজোট নেতাকর্মীরাও যুক্ত হয়। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা থানায় থানায় পুলিশও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
দখলদারিত্ব ৫ বছরে অতি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন মার্কেট এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গোপালগঞ্জ গ্রুপ, কিশোরগঞ্জ গ্রুপ, বরিশাল গ্রুপসহ নানা আঞ্চলিক গ্রুপ ও সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ফলে এসব গ্রুপ দীর্ঘদিনের ব্যবসায়ীদের তাড়িয়ে তাদের পছন্দের ব্যবসায়ীদের সুযোগ করে দিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব বিষয়ে অবগত হলেও নানা সীমাবদ্ধতায় কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
২০০৮ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। বেড়ে যায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন, ডাকাতি, সন্ত্রাস, দখলবাজি, টেন্ডারবাজির মতো অপরাধ। ছিনতাইকারীরা এতই বেপরোয়া যে, রাতের আঁধারে নয় দিনের বেলাতেই বড় বড় ছিনতাই ও ডাকাতি হচ্ছে। অধিকাংশ ডাকাতি এবং ছিনতাইয়ের ঘটনা থানায় রেকর্ড হয় না। প্রতিকার নেই বিধায় ভুক্তভোগীরা থানা পুলিশকে জানাতে আগ্রহী হয় না।
৫ বছরে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল শোচনীয় পর্যায়ে। একের পর এক হত্যাকা- ঘটেছেই। মারামারি, হানাহানি, দখলবাজি, পূর্বশত্রুতার জেরে প্রতিশোধ নেয়া, প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে হামলাসহ সন্ত্রাসী কর্মকা- চলেছে দেশজুড়ে। বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিকা-, দখলবাজি ও প্রতিহিংসাবশত প্রকাশে খুনের ঘটনা শুরু হয় মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই। যেন একযোগে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মহোৎসব শুরু হয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। প্রকাশ্যে বেরিয়ে পড়ে লাফিয়ে থাকা খুনি ও দাগী সন্ত্রাসীরা। বিদেশে পলাতক সন্ত্রাসীরাও দেশে এসে আশ্রয় নেয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায়।
খুনের তালিকায় রয়েছে রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অবুঝ শিশুসহ সাধারণ নাগরিক।
চাঁদাবাজদের উৎপাত মারাত্মক আকার ধারণ করে। বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হন। মোবাইল ফোন, ল্যান্ড ফোন, চিরকুট এবং সন্ত্রাসী পাঠিয়ে চাঁদাবাজরা হুমকি দেয়। বহু এলাকায় চাঁদাবাজদের হুমকির মুখে মালিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেন না। প্রাণ ভয়ে মোবাইল ফোন বন্ধ করে এক প্রকার আত্মগোপনে আছেন বহু ব্যবসায়ী।
গত কয়েক বছরের তুলনায় ৫ বছরের চাঁদাবাজির প্রকৃতি ভিন্ন। ৪ দলীয় জোট সরকারের সময় প্রভাবশালী সন্ত্রাসী চক্র ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা আদায় করত। র্যাব এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় সন্ত্রাসী চক্রটি গা-ঢাকা দিয়েছিল। তারা দূর থেকে সাঙ্গপাঙ্গ দিয়ে চাঁদা আদাযের চেষ্টা করত। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এই চক্রের অধিকাংশ সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসে। তারা রাজনৈতিক লেবাস নিয়ে জোরেশোরে মাঠে নামে। এই চক্রের সঙ্গে এলাকাভিত্তিক মাস্তান ও রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররাও যোগ হয়। তারা কোনোরকম রাখঢাক না করে প্রকাশ্যেই চাঁদাবাজি শুরু করে। চাঁদাবাজ চক্রটি ব্যবসায়ী ছাড়াও বাড়ির মালিক, ফ্ল্যাটের মালিক, ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ ভাড়াটিয়াদের কাছেও গণহারে চাঁদাবাজি শুরু করে।
ঢাকা-১১ আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান কামালের কাছে চাঁদাবাজরা ৫ লাখ টাকা দাবি করেছিল মোবাইল ফোনে। শীর্ষ সন্ত্রাসী আশিক পরিচয়ে হুমকি দিয়ে চাঁদা চেয়ে তার কাছে কয়েকজন লোকও পাঠানো হয়েছিল। ক্ষমতাসীন দলের এই সংসদ সদস্য বিষয়টি তেজগাঁও থানা পুলিশকে জানিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেন। সংসদ সদস্যের কাছে চাঁদা না পেয়ে কিছুদিন পরই গুলী করে হত্যা করা হয় কাওরান বাজারের তিন ব্যবসায়ীকে। এই তিন ব্যবসায়ী প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের অনুগত লোক ছিলেন।
২০০৯ সালের মে মাসে ঢাকা-১৬ আসনের সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী মোল্লার কাছে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন সন্ত্রাসীরা। শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত পরিচয়ে দু’টি মোবাইল ফোনে তার কাছে চাঁদা চেয়ে তাকে ও পরিবারের সদস্যদের হত্যার হুমকি দেয়া হয়। তিনি জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে পল্লবী থানায় একটি জিডি করেন।
আওয়ামী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর ক্ষমতাসীন দলের দুই প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের কাছে এভাবে চাঁদা চেয়ে হুমকি দেয়ার মতো দুঃসাহস দেখেই অনুমান করা যায় যে, দেশে কিভাবে চাঁদাবাজি চলছে। পুলিশের বিশেষ অভিযান চলাকালেও চাঁদাবাজি চলছেই। চাঁদাবাজদের নিয়ন্ত্রণে পুলিশের বিশেষ সেল গঠন করেও কাজ হয়নি। পাইকারি বাজার, কাঁচামালের আড়ত, মাছ ও ফলের আড়তে নিয়মিত চাঁদাবাজি চলছে। ভুক্তভোগীরা প্রকাশ্যে এর প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। জীবনের নিরাপত্তা না থাকায় মানুষ চাঁদাবাজদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসছে না। কেউ কেউ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানালেও অনেকেই আবার সে সাহসও পাচ্ছে না। নীরবে চাঁদা দিয়ে যাচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানালে প্রাণ নাশের আশঙ্কা থাকায় কেউ জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে না।
বাড্ডায় শিল্পপতি ও গার্মেন্টের মালিক দেলোয়ার হোসেনের কাছে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে চাঁদা দাবি করেছিল। এ ব্যাপারে তিনি পুলিশ কমিশনার, র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অবহিত করেছিলেন। এমনকি বাড্ডা থানায় জিডি করেছিলেন। তাতে কোনো কাজ হয়নি। সন্ত্রাসীরা তার শ্বশুর আলহাজ্ব মোবারক আলীকে দিনেদুপুরে গুলী চালিয়ে হত্যা করে।
প্লট ও ফ্ল্যাট নির্মাতাদের সংগঠন রিয়াল স্টেট এন্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুনের সঙ্গে দেখা করে চাঁদাবাজদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান। তারা বলেন, প্লট পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক পরিচয়ে চাঁদাবাজি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এরকম চাঁদাবাজি চলতে থাকলে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে আনতে হবে।
এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসী চক্রের মধ্যে পুরনো ঢাকার জুরাইন, গেন্ডারিয়া ও আশপাশের এলাকায় ডাকাত শহীদের নামে, মিরপুরে শাহাদাত ও পিয়ালের নামে, রামপুরা-মালিবাগে জিসানের নামে, খিলগাঁওয়ে মানিকের নামে, মোহাম্মদপুরে ও ধানমন্ডিতে শীর্ষ সন্ত্রাসী হারিসের নামে, বিমান বন্দর ও উত্তরা এলাকায় জয়ের নামে, মগবাজারে সুব্রত বাইন ও আগা শামীমের নামে, মহাখালী এলাকায় ইমাম হোসেনসহ বিভিন্ন শীর্ষসন্ত্রাসীর নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি চলে এবং চলছে। এসব সন্ত্রাসীদের অনেকেই কলকাতাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পলাতক রয়েছে। অনেকে কলকাতা কারাগারে আটক রয়েছে। তারপরও তাদের নাম ব্যবহার করেই চলছে বিস্তর চাঁদাবাজি।
শীর্ষ সন্ত্রাসী ছাড়াও স্থানীয় যুবলীগ, আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কতিপয় নামধারী ক্যাডাররাও এলাকাভিত্তিক চাঁদাবাজি এবং দখলবাজি করছে। এসব ক্যাডার এলাকার ধর্নাঢ্য ব্যবসায়ীদের অথবা অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিদের টার্গেট করে। তারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করে। অনেকে প্রাণ ভয়ে গোপনে চাঁদা দেন। ক্যাডার বাহিনীর ভয়ে তারা থানা পুলিশকে এসব বিষয়ে অবহিত করেননি বা করেও কোন ফল হয়নি। উল্টো অভিযোগকারীকেই বিপদে পড়তে হয়।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এবং শেষ সময়ে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে, বিপণিবিতান, কাঁচা বাজার, আড়ত, বাস টার্মিনাল এবং ফুটপাতে এখনও চলছে দখলদারিত্বের মহোৎসব। দখলদারিত্বের প্রধান ভূমিকা পালন করেছে বিভিন্ন গ্রুপের নামে সিন্ডিকেট। রাজধানীতে গোপালগঞ্জ গ্রুপ, কিশোরগঞ্জ গ্রুপ, বরিশাল গ্রুপ শক্তিশালী গ্রুপ হিসেবে কাজ করছে। এছাড়াও বিভিন্ন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাদের নামেও রয়েছে বেশকিছু গ্রুপ। এদের দখলদারিত্বের হাত থেকে ফুটপাতের ছোট টং দোকান, খুপড়ি ঘর, বস্তি, কাঁচাবাজার, আড়ত, ফুটপাত, টার্মিনাল, ঘাটসহ কোনো কিছুই বাদ যায়নি।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি সংবাদ সম্মেলন করে এ খাতে চাঁদাবাজি বন্ধের জোরালো দাবি জানায়। একইভাবে ইসলামপুর কাপড় বিক্রেতা সমিতির নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানান। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি বন্ধ ছিল। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলের পর ব্যাপকভাবে চাঁদাবাজি বেড়ে যায়। এখন চলছে রাজনৈতিক পরিচয়ে চাঁদাবাজি। প্রভাবশালী নেতাদের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজরা মোটা অংকের টাকা দাবি করছে। ফলে চাঁদা না দিলে এর খেসারতও দিতে হয় তাদের।
কেউ বাড়ি নির্মাণের কাজ ধরলেই কয়েকদিনের মধ্যেই সেখানে চাঁদাবাজরা উপস্থিত হয়। প্রথমে তারা খোঁজ করে বাড়ির মালিককে। তাকে না পেলে খোঁজা হয় ঠিকাদারকে। তাকেও না পেলে খোঁজ করা হয় দারোয়ানকে। দারোয়ানের কাছে একটি চিরকুট ও মোবাইল ফোন নম্বর ধরিয়ে দিয়ে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করা হয়, তাদের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে চাঁদা নিয়ে হাজির হতে বলা হয়। কখনো বলা হয়, মালিককে চাঁদার টাকা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে। সময় মতো এসে চাঁদার টাকা নিয়ে যাবে তাদের লোক। এতে কোনো রকম ব্যত্যয় ঘটলেও শুরু হয় এ্যাকশন। দারোয়ান অথবা নির্মাণ শ্রমিককে পায়ে গুলী করে ভয় দেখানো হয়। চাঁদা না দিলে এর পরিণতি কি হতে পারে বাড়ির মালিক ও ঠিকাদারের পরিণতি কি হতে পারে তা বুঝিয়ে দেয় তারা গুলী চালিয়ে। চাঁদা না দেয়ায় ৯ মে ২০০৯ গোপীবাগের ব্যবসায়ী আব্দুস সোবহানকে গুলী করে হত্যার চেষ্টা চালায় সন্ত্রাসীরা। গুলী লক্ষ্যভ্রস্ট হওয়ায় বেঁচে যান তিনি।
১ মে মিরপুর ২০০৯ এক নম্বর গুদারাঘাট এলাকায় বিএনপি নেতা শামসুল কবিরকে চাঁদাবাজরা গুলী করে হত্যা করে।
১৯ মে ২০০৯ মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের সি ব্লকের ১৮ নম্বর নির্মাণাধীন বাড়ির দারোয়ানকে চাঁদা না পেয়ে পায়ে গুলী করে আহত করে সন্ত্রাসীরা।
কাওরানবাজারে রয়েছে বেশ কয়েকটি চাঁদাবাজ গ্রুপ। তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। তারা চাঁদা দিয়েই এখানে ব্যবসা করতে বাধ্য। শীর্ষ সন্ত্রাসী নিহত হলেও বন্ধ হয়নি চাঁদাবাজি। পিচ্চি হান্নান নিহত হওয়ার পর ব্যবসায়ীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। কিন্তু ঘুরেফিরে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপকে চাঁদা দিতেই হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। আর কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিপক্ষ গ্রুপ ঘটাচ্ছে সন্ত্রাসী কর্মকা-। সরকার বদলের পরই কাওরানবাজারে চাঁদাবাজির হাতবদল হয়। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে সেই দলের নেতাকর্মীরাই নিয়ন্ত্রণ করছে চাঁদাবাজি। কাওরানবাজারের ১২/১৩টি কাঁচামালের আড়ত ও ৫/৬টি মাছের আড়তে প্রতি রাতে দূরদূরান্ত থেকে ট্রাক বোঝাই করে মাল আসে। এই মালামাল বিভিন্ন মার্কেট ছাড়াও ফুটপাথের খালি স্থান দখল করে রাতভর বেচাকেনা চলে। সন্ত্রাসী গ্রুপ ফুটপাথ দখল করে প্রতি রাতে ব্যবসায়ীদের কাছে পজেশন বিক্রি করে। প্রতিটি পজেশন একশ’ থেকে পাঁচশ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এ ছাড়াও ট্রাক থেকে মালামাল নামলেই নিয়মিত চাঁদা পরিশোধ করতে হয় প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে। এভাবে প্রতি রাতে লাখ লাখ টাকা বিভিন্নভাবে আদায় করে সন্ত্রাসীরা।
একইভাবে মিরপুর শাহ আলী কাঁচাবাজার, মোহাম্মদপুর টাউন হল কৃষি মার্কেট ও কাঁচাবাজার, কাওরানবাজার, শ্যামপুর কাঁচাবাজার, যাত্রাবাড়ী কাঁচাবাজার ও মেরুলে মাছের আড়তের ব্যবসায়ীরা নিয়মিত চাঁদা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন। স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতা, ওয়ার্ড কমিশনার, কখনো কখনো স্থানীয় সংসদ সদস্যের নামে চাঁদা তোলা হয়। তারা নিয়মিত ব্যবসা করেন, চাঁদা না দিলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে চাঁদা দিতে হয়।
মিরপুর, পল্লবী, কাফরুল, শাহআলী ও দারুসসালাম থানা এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত পরিচয়ে এখানে চাঁদাবাজি চলছে। থানায় মামলা বা জিডি করলে পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তা চাঁদাবাজদের কাছে তথ্য ফাঁস করে দেয়। ফলে থানায় অভিযোগ করলেও ওই ব্যক্তির নাম সন্ত্রাসীরা জেনে যাওয়ায় অনেকেই থানায় যেতে চায় না।
ডাকাত শহীদের নামে পুরান ঢাকায় অধিকাংশ চাঁদাবাজি হচ্ছে। ডাকাত শহীদ ভারতে পলাতক থাকলেও তার সহযোগীরা চষে বেড়াচ্ছে পুরান ঢাকার বিস্তীর্ণ এলাকা। কোতোয়ালি, সূত্রাপুর, শ্যাপুর ও লালবাগ এলাকায় সাধারণ ব্যবসায়ীরা ডাকাত শহীদের সহযোগীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এখানকার স্টিল মিল, রি-রোলিং মিল, নবাবপুরে কাগজের মার্কেট, ইসলামপুরের কাপড়ের মার্কেট, মিটফোর্ডের ওষুধের পাইকারি মার্কেট, চকবাজার জুতার মার্কেটসহ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। আগে এই এলাকায় শহীদ কমিশনারের নামে চাঁদাবাজি বেশি হতো। এখন ডাকাত শহীদের সহযোগীরা ব্যাপকভাবে চাঁদাবাজি করছে। ডাকাত শহীদের নাম শুনলে ভয়ে অনেকে চাঁদা দেয়।
টেলিফোনে চাঁদাবাজি বন্ধে ব্যবস্থা নিতে ২৭ জুন ২০০৯ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিকার চান তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা। তারা জানিয়েছেন, টেলিফোনে চাঁদাবাজির ঘটনা নীরবেই মেনে নিতে হচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী ভয়ে মুখ খুলে কিছু বলতে পারছেন না। গার্মেন্ট মালিকরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান, ঝুট ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই গার্মেন্ট খাতে বেশি সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটছে। বিজিএমইএ’র নেতারা পোশাক শিল্প মালিকদের কাছে নীরব চাঁদাবাজি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান। তারা বলেন, এ খাতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম, চাঁদাবাজি, ঝুট সন্ত্রাস, ছিনতাই ও ভাংচুরের ঘটনা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেই।
সীমান্ত এলাকার মোবাইল ফোনের টাওয়ার ব্যবহার করে বর্তমানে বেশি চাঁদাবাজি হচ্ছে। সীমান্ত এলাকা থেকে ফোন করায় ওই চাঁদাবাজদের চিহ্নিত করা যায় না।
১৩ মে ২০০৯ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ এক সভায় চাঁদাবাজি ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেছিলেন, চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পুলিশকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ৫ জুলাই ২০০৯)
একের পর এক হত্যাকা- ঘটলেও অধিকাংশ ঘটনার কারণই থেকে গেছে অজানা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন যে কোনো মূল্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইজিপিকে নির্দেশ দিলেও কিছুতেই কিছু হয়নি। আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ প্রশাসন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অদক্ষ পুলিশ প্রশাসন, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি, রাজনৈতিকভাবে অপরাধীদের লালন-পালন করায় এ ধরনের নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
মহাজোট সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর সারাদেশে থানার সংখ্যা বাড়ানো হয়। ডিএমপির বেশিরভাগ থানার ওসি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেশিরভাগ একটি বিশেষ জেলার বাসিন্দা। দলীয় বিবেচনায় পুলিশ কর্মকর্তারা যা খুশি তাই করছেন। থানার সংখ্যা বাড়িয়েও কিছুতেই আইন-শৃঙ্খলা পারিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকায় যেসব পুলিশ ইন্সপেক্টর দায়িত্ব পালন করছেন তার বেশিরভাগেরই এর আগে ঢাকায় কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই। নেই তাদের পর্যাপ্ত সোর্স। অনেকে ঢাকা অলিগলিও ভালো করে চেনেন না। ঢাকার সন্ত্রাসী এবং সন্ত্রাসের ধরন সম্পর্কে এসব কর্মকর্তাদের নেই তেমন কোন ধারণা।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঠ পর্যায়ে একটি বিশেষ জেলার পুলিশ অফিসারদের দাপটে সাধারণ অফিসাররা কোণঠাসা। অভিযোগ রয়েছে, বিশেষ জেলায় ক্ষমতাবান এসব অফিসার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাত্তাই দেন না। তারা ঠিকমতো দায়িত্বও পালন করেন না। অনেক সময় সিনিয়র অফিসারদের আদেশও মানেন না। এসব সত্ত্বেও সঙ্গত কারণেই সিনিয়র অফিসাররা জুনিয়র অফিসারদের বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। এমন একটি অবস্থায় চলছে পুলিশ প্রশাসন।
মহাজোট সরকার গঠনের মাস খানেকের মধ্যে শুরু হয়েছে বেশ কয়েকটি হত্যাযজ্ঞ। ২০০৯-এর জানুয়ারি মাসে পুরনো ঢাকায় ডিশ ব্যবসায়ী আজগরকে হত্যা করে লাশ ১৫ টুকরো করে সন্ত্রাসীরা। ১১ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের চরকমলাপুরে চর দখল করা নিয়ে সংঘর্ষে আইয়ুব প্রামাণিক, আমিন প্রমাণিক, শিরজান প্রামাণিক ও মোসলেহ উদ্দিন নিহত হন। ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর দক্ষিণ যাত্রাবাড়িতে মা ও তার দুই মেয়েকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। একই দিন রাতে ফকিরাপুল বাজারের সামনে ৩২নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সালাউদ্দিন সুমনকে আটকে গুলী করে সন্ত্রাসীরা।
৯ এপ্রিল গুলশানে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয় ব্যবসায়ী শ্যামল মিত্রকে। ৪ মার্চ মতিঝিলে মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাককে শ্বাসরোধে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ৭ মার্চ জিয়া বিমানবন্দর সংলগ্ন কাওলায় সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তা কর্মী আসাদুজ্জামান মঞ্জুকে গুলী করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ওইদিন যাত্রাবাড়ীতে অজ্ঞাত এক যুবকের মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৮ মার্চ তেজগাঁওয়ে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে সোহেল মিয়া নামে এক কাঁচামাল বিক্রেতা খুন হন। ১৪ মার্চ পল্লবীতে সন্ত্রাসীদের গুলীতে সবুজ নামে এক যুবক নিহত হয়। ২০ মার্চ ডেমরায় এক রেন্ট-এ কার ব্যবসায়ীকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
২২ মার্চ বাড্ডায় চাঁদা না পেয়ে হালিম নামে এক বৃদ্ধকে গুলী করে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। ২৪ মার্চ যাত্রাবাড়ী ও তেজগাঁওয়ে তরুণসহ দু’জনকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ২৫ মার্চ সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে তরুণীকে হত্যা করে লাশ লাগেজে লুকিয়ে রাখা হয়। ২৬ মার্চ বাড্ডা, তেজগাঁও এবং পল্টনে ব্যবসায়ীসহ তিনজন খুন হয়। ৩১ মার্চ উত্তরা ও দক্ষিণখানে রিকশাচালকসহ দু’জনকে হত্যা করা হয়।
২ মে যাত্রাবাড়ী ও তুরাগে ব্যবসায়ীসহ দুজনকে হত্যা করা হয়। ৫ মে যাত্রাবাড়ী ও তুরাগে ব্যবসায়ীসহ দু’জনকে হত্যা করা হয়। ৫০ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে ১২ মে বাড্ডায় ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেনের শ্বশুর মোবারক আলীকে গুলী করে হত্যা করা হয়। ওইদিন তেজগাঁওয়ে র্যাব পরিচয়ে যুবক রকিবুজ্জামানকে গুলী করে হত্যা করা হয়।
১৬ মে যাত্রাবাড়ী ও কদমতলীতে দুটি দুর্ধর্ষ ডাকাতি হয়। কদমতলী এলাকায় একটি ফিলিং স্টেশনে দুই সিকিউরিটি গার্ডকে কুপিয়ে কাউন্টার থেকে প্রায় এক লাখ টাকা নিয়ে যায়। অপর দিকে যাত্রাবাড়ী থানার মাতুয়াইল এলাকায় থেকে বাড়িতে ঢুকে ডাকাতরা ১১ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। ২১ মে রাজধানীর সূত্রাপুরের টিকাটুলি ও হাটখোলা এলাকায় একরাতে সাতটি ফ্ল্যাটে দুর্ধর্ষ ডাকাতি হয়। ডাকাতরা বাড়ির লোকজনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ও হাত-পা বেঁধে মারধর করে ৪০ ভরি স্বর্ণালঙ্কারসহ প্রায় ২০ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
৩ জুন গুলশানে মানি চেঞ্জ ব্যবসায়ী ফারুক আহম্মদকে হত্যা করা হয়। ২৬ জুন সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার ওসি সৈয়দ মোনায়েমকে সন্ত্রাসীরা গুলী করে হত্যা করে। একই দিন ঢাকার দনিয়ায় কলেজ ছাত্রসহ আমজাদ হোসেন, সবুজবাগে ওসমান গনি ও গৃহবধূ শাহিনুর বেগম খুন হন। ৩০ জুন রাতে মহাখালীতে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ডাকাতরা সিকিউরিটি গার্ডদের হাত-পা বেঁধে আটক করে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা, মোবাইল ফোন ও মূল্যবান কাগজপত্র নিয়ে যায়।
১৫ জুলাই রাতে কাওরানবাজারে আম্বরশাহ মাদ্রাসা মার্কেটে একটি মোবাইল ফোনের দোকানে মালামাল লুট হয়। ডাকাতরা দোকানের শাটার কেটে ভেতরে ঢুকে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা, একটি ল্যাপটপ কম্পিউটার, ১২টি মোবাইল সেট ও প্রিপেইড কার্ডসহ প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকার মালামাল নিয়ে যায়।
২২ আগস্ট বাড্ডা এলাকায় সাবেক এমপি মেজর (অবঃ) আব্দুল মান্নানের সিএনজি ফিলিং স্টেশনে দুর্ধর্ষ ডাকাতি হয়। ভোররাতে একদল ডাকাত ফিলিং স্টেশনে ঢুকে ক্যাশ কাউন্টার থেকে টাকার সিন্দুকটি নিয়ে যায়। সিন্দুকে প্রায় ছয় লাখ টাকা ছিল। ৪ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডিতে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধাকে খুন করে বাসা থেকে ২০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, ৪০ হাজার টাকা, মোবাইল ফোন ও মালামাল লুট করে নেয় দুর্বৃত্তরা।
১৬ অক্টোবর রামপুরা, ডেমরা ও যাত্রাবাড়ীতে জহিরুল হক, ফয়সাল আহম্মদ ও আমির হোসেনকে গুলী এবং কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২৭ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সন্ত্রাসীদের হামলায় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান ও হোসেন মিয়া মারা যান।
৬ নভেম্বর ক্ষিলক্ষেতের নিকুঞ্জ এলাকায় বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তার বাসায় ডাকাতি হয়। ডাকাতরা বাসা থেকে একটি প্রাইভেট কার, ল্যাপটপ, কম্পিউটার ও টাকাসহ বিপুল পরিমাণ মালামাল নিয়ে যায়। চাঁদা না দেয়ায় ১৯ ডিসেম্বর কদমতী থানা এলাকায় সন্ত্রাসীরা বাসায় ঢুকে ব্যবসায়ী হারুন অর রশিদকে গুলী করে হত্যা করে। ২২ ডিসেম্বর পূর্ব কাফরুলের নির্মাণাধীন ভবনে ৭টায় ৬/৭ সন্ত্রাসী যায়। তারা মোটা অংকের চাঁদা চেয়ে মালিকের কাছ থেকে লেখা চিরকুট রাখতে বলে নির্মাণ শ্রমিকদের। ওই চিরকুট রাখতে শ্রমিকরা অপারগতা প্রকাশ করলে শ্রমিক সাগর (২০), বাবুল (১৮) ও আনিসকে (১৯) চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ফেলে রেখে যায়।
২৩ ডিসেম্বর গুলশানে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ডাকাতি ও টায়ারের দোকানে দুর্ধর্ষ চুরি হয়েছে। দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে নগদ টাকাসহ ১৫ লাখ টাকার মালামাল লুট হয়েছে। ২৫ ডিসেম্বর খিলগাঁও আইডিয়াল সিটি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল চন্দন চক্রবর্তী ওরফে সাজ্জাদ হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ২৯ ডিসেম্বর ধলপুরে শামসুল হক রিন্টু এডভোকেটকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।
সরকারের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগের চিত্র দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় বাকি ৪ বছর কিভাবে আমাদের জনগণ ছিলেন।
মহাজোটের ৫ বছরে প্রশাসনকে কম তটস্থ থাকতে হয়নি। সরকারের জেলা প্রতিনিধি তথা ডিসিরা ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ পরিণতির দিকে যাচ্ছে’ বলে সরকারকে অবহিত করেছিলেন। সংস্থাপন সচিবকে ডিসিদের দেয়া গোপন পত্রে ডিসিরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিস্থিতির মোকাবিলায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা প্রদানের জন্য অনুরোধ জানান। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ডিসিদের পাঠানো এসব পত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা না থাকায় জনগণের জরুরি নিরাপত্তা নিয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
দেশের অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মোকাবিলায় সরকার জেলা প্রশাসকদের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বারবার তাগিদ দিলেও কোনো অগ্রগতি না দেখে শীর্ষ পর্যায়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়। সারাদেশে ছিনতাই, খুন ও রাহাজানি বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বয়ং প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতার জন্য সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি অনুরোধ জানান। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।
বরং জেলা প্রশাসকরা মাঠ পর্যায়ের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে সংস্থাপন সচিবকে পৃথক পৃথক গোপন প্রতিবেদন পাঠান। এতে ডিসিরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে উল্লেখ করেন বিচার বিভাগ পৃথকীকরণে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা সীমিতকরণের ফলে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা, সরকারি সম্পত্তি রক্ষা ও জেলার আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিচারিক ক্ষমতা না থাকায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকালে অপরাধীকে পাওয়া না গেলে বা মামলা দায়েরের প্রয়োজন হলে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের শরণাপন্ন হতে হয়। এতে আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না।
পাবলিক পরীক্ষা এবং স্থানীয় নির্বাচনেও একই সমস্যা হচ্ছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৩৮(ক) ধারায় এফিডেভিট গ্রহণ একটি নির্বাহী প্রকৃতির কর্মকা- হওয়া সত্ত্বেও এখন সে ক্ষমতা নেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের। ফলে পাসপোর্ট, লাইসেন্স ইত্যাদি করার ক্ষেত্রে জনসাধারণের ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। গোপন প্রতিবেদনে মাঠ প্রশাসনে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যক্রম সুষ্ঠু এবং সুচারুরূপে সম্পাদনের নিমিত্তে জেলা ম্যাজিস্ট্রেসিতে কর্মরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ১৯০(১) (এ) (বি) (সি), ১৯২ (১), ২৬০-২৬৪ এবং ৫৩৯ (এ) ধারার ক্ষমতা অর্পণ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সংস্থাপন সচিবকে অনুরোধ জানানো হয়। আইনানুগ ক্ষমতা না থাকলে মাঠ পর্যায়ে যেসব জটিল সমস্যার উদ্ভব ঘটে, তা মোকাবিলা কারো পক্ষেই সম্ভব হবে না বলেও উল্লেখ করা হয়।
মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের ক্ষমতাই হচ্ছে মুখ্য। ক্ষমতা না দিয়ে আহ্বান বা অনুরোধে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায় না। কারণ দুষ্কৃতিকারীরা যখন জানে প্রশাসনের ক্ষমতা নেই, তখন তারা আরো বেপরোয়া হয়ে থাকে। যে কোনো পরিস্থিতি দ্রুত মোকাবিলায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কিছু তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ ক্ষমতা অপরিহার্য। কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্যও এমন ধরনের বিধান প্রয়োজন হয়।
উদাহরণ হিসেবে একটি ঘটনা উল্লেখ করার যায়। শাসক দলের এমপি ও জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার এডভোকেট আব্দুল হামিদের ভাতিজা মারধর ও জুতাপেটা করে লাঞ্ছিত করেছিল কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার নির্বাহ কর্মকর্তাকে। এ ঘটনায় সাবেক স্পিকারের ভাতিজাসহ ৫০ জনকে আসামি করে মামলা করেন ইউএনও। তবে জেলা প্রশাসক এ মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেন। কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে স্থানীয় অভিভাবকরা ইউএনওকে বারবার অভিযোগ করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের জানুয়ারির মধ্যভাগে ইউএনও গোপাল চন্দ্র দাস স্কুলের শিক্ষকদের সভায় শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের সচেষ্ট থাকতে বলেন। সভায় তিনি স্কুলে অনুপস্থিতি এবং নিয়মিত ক্লাস না নেয়ায় শিক্ষক মতিউর রহমানকে সতর্ক করেন। প্রয়োজনে তিনি শিক্ষক বদলি করে হলেও স্কুলের শিক্ষার মান ঠিক করার অঙ্গীকার করেন।
এ সভার পরই ওই শিক্ষক (যিনি সাবেক স্পিকারের ভাতিজা) অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হন। ২০ জানুয়ারি ২০০৯ ওই শিক্ষক সাবেক স্পিকারের অপর ভাতিজা হাবিবুর রহমানকে নিয়ে সদলবলে ইউএনও অফিসে ঢুকে পড়েন এবং ইউএনওকে জুতাপেটা করতে থাকেন। এ সময় ইউএনও অফিসের অন্য কর্মকর্তারা এগিয়ে এলে শিক্ষক মতিউর রহমান দ্রুত সরে পড়েন। হাবিবুর রহমান ইউএনওকে কিল ঘুষি মারতে মারতে ভবিষ্যতে শিক্ষকদের নিয়ে মাথা না ঘামাতে শাসাতে থাকেন। এ সময় উপজেলা ভূমি কর্মকর্তাসহ অন্যরা এসে হাবিবুর রহমানকে আটক করে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে হাবিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে।
সাবেক স্পিকারের ভাতিজা মতিউর রহমান সরকারি স্কুলের শিক্ষক হলেও নিয়মিত স্কুলে যান না এবং তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয়। মূলত তার কারণেই স্কুলের অন্য শিক্ষকরাও ছাত্রদের পড়াতে ফাঁকি দেয়ার সাহস করে থাকে। ফলে স্বনামধন্য প্রাইমারি স্কুলটিতে শিক্ষার মান বলতে কিছু নেই। এ কারণেই মূলত অভিভাবকরা স্কুলে শিক্ষার মান ফিরিয়ে আনার জন্য দাবি জানিয়ে আসছিল।
এদিকে ঘটনায় স্পিকারের ভাতিজাসহ ৫০ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন ইউএনও গোপাল চন্দ্র দাস। তবে পুলিশ আর কাউকে গ্রেফতার করেনি। বরং জেলা প্রশাসক মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য ইউএনওকে নানাভাবে চাপ দেন। শাসক দলের এমপি ও সাবেক স্পিকারের ভাতিজা কর্তৃক এ হামলার ঘটনায় কিশোরগঞ্জ জেলায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ পর্যন্ত দেশের বেশিরভাগ জেলা প্রশাসকই গোপন পত্রের মাধ্যমে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে ক্ষমতা প্রদান করতে কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ জানান। অন্যথায় এক পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অচলাবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন