প্রধানত রাজনীতি নিয়ে লিখি বলে পুনরাবৃত্তি করে হলেও বিশেষ কিছু বিষয় নিয়ে বারবার লিখতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্ক সফর সাম্প্রতিক সময়ের এমন একটি বিষয় যাকে সঠিকভাবেই ‘প্রমোদ ভ্রমণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নিজের সিদ্ধান্ত থেকে ‘এক চুলও’ নড়বেন না বলে দেয়া ঘোষণার কারণে কিছুদিন ধরে ‘বিখ্যাত’ হয়ে ওঠা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৮তম অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করতে নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন। সেখানে ভাষণ দিয়েছেন তিনি ২৭ সেপ্টেম্বর। এর আগে-পরে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-এর সঙ্গে ‘একান্ত’ বৈঠকে বসেছেন তিনি। একটি সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। এসব প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে শেষদিক থেকে শুরু করা যাক।
রাজধানীতে যারা বসবাস করেন তাদের জন্য যানজট প্রতিদিনের বিষয় হলেও গত ৩০ সেপ্টেম্বর তারা নাকাল হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরা উপলক্ষে। জাতিসংঘের অধিবেশনে অংশ নেয়ার পর সেদিন বিকেলে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরেছেন। কিন্তু অতি স্বাভাবিক এই প্রত্যাবর্তনকেই আওয়ামী লীগ মহাধুমধামের এক উপলক্ষ্য বানিয়ে ছেড়েছে। মিথ্যা একটি কারণও প্রচার করেছে দলটি। বলেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকি জাতিসংঘের ‘সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন এবং বিরাট এ অর্জনের জন্যই তাকে গণসংবর্ধনা দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আদৌ তেমন কোনো আওয়ার্ড বা পুরস্কার পেয়েছেন কি না সেটা একটি গুরুতর ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু তাকে গণসংবর্ধনা দেয়ার নামে পুরো রাজধানীকেই সেদিন স্থবির করে ফেলা হয়েছিল। ট্রাকে আর বাসে চেপে আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতা-কর্মী ও সমর্থক দুপুর থেকেই বিমানবন্দর অভিমুখীন সব সড়ক বন্ধ করে দিয়েছিল। বিমানবন্দর থেকে গণভবন পর্যন্ত দীর্ঘ পথ চলে গিয়েছিল তাদের দখলে। ফলে সাধারণ যানবাহন এবং মানুষের চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে লেগেছে তিন-চার ঘণ্টা। বহু মানুষকে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত হাঁটতে হয়েছে। মৃত্যুর মুখোমুখি এসে যাওয়া রোগী বহনকারী কোনো অ্যাম্বুলেন্সকেও যেতে দেয়নি আওয়ামী লীগের মারমুখী নেতা-কর্মীরা। সব মিলিয়েই সেদিন নাকাল হয়েছেন রাজধানীবাসী। এ অবস্থা চলেছে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত।
সচেতন প্রত্যেক মানুষই বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরা এবং কথিত একটি পুরস্কার পাওয়ার জন্য গণসংবর্ধনা দেয়ার নামে এ ধরনের বাড়াবাড়ি এবং মানুষের ভোগান্তি কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। ঘটনাপ্রবাহে আপত্তির কারণ হিসেবে এসেছে পুরস্কার পাওয়া সম্পর্কিত মিথ্যাচার। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড’ নামের কোনো পুরস্কার এবার শেখ হাসিনাকে দেয়া হয়নি। দারিদ্র্য বিমোচনসহ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেয়া পুরস্কারটি এবার পেয়েছেন কোস্টারিকার প্রেসিডেন্ট লরা শিলশিলা মিরান্ডা, বাহরাইনের প্রধানমন্ত্রী খলিফা বিন সালমান আল খলিফা এবং ফিজির প্রধানমন্ত্রী জোমাইয়া বরেক বাইনমারামা। ‘সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড’ যে সংস্থাটি দিয়ে থাকে সে সংস্থার ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামই নেই। প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি ‘অ্যাওয়ার্ড’ অবশ্য যোগাড় করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি পেয়েছেন ‘সাউথ সাউথ নিউজ’ নামের একটি ওয়েবসাইটের পুরস্কারÑ যেটা আসলে ‘সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড’ নামক সংস্থার খবর ভাগাভাগির একটি প্রতিষ্ঠান এবং যার সঙ্গে জাতিসংঘের দূরতম কোনো সম্পর্কও নেই। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর কথিত পুরস্কার অর্জন নিয়ে দেশবাসীর সঙ্গে বড় ধরনের প্রতারণা ও মিথ্যাচার করা হয়েছে। এর চাইতে নিন্দনীয় তামাশা আর কিছু হতে পারে না। এই প্রেক্ষাপটে এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার। যেহেতু তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন এবং কথায় কথায় ‘ডিজিটাল’ দেশ বানাবেন বলে পাড়া মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন সেহেতু ক্ষমতাসীনদের জানা উচিত, বর্তমান বিশ্বে সব খবরই মুহূর্তের মধ্যে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে এবং জেনে যায় এমনকি স্কুল-কলের্জে ছেলেমেয়েরাও। এজন্যই জনগণকে তীব্র যানজটে ফেলে ভোগান্তির শিকার বানানো এবং কথিত ‘অ্যাওয়ার্ড’ সংক্রান্ত মিথ্যাচার করা তাদের মোটেও উচিত হয়নি।
এবার শুরুতে ফিরে যাওয়া যাক। ‘শেষ পর্যন্ত’ নিউইয়র্ক গেছেন কথাটা বলার কারণ হলো, জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রতিবছর গেলেও এবার সে যাওয়া নিয়েই প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার তুফান তুলতে চেয়েছিলেন। হঠাৎই ঘাড় বাঁকিয়ে বসেছিলেন তিনি। কয়েকদিন পর্যন্ত যাবেন না যাবেন না বলে সিদ্ধান্তও জানিয়েছিলেন। দৃশ্যত এর কারণ ছিল বাংলাদেশকে নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের উদ্বেগ। কারণ ছিল তার পরামর্শও। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ আগস্ট বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছিলেন। টেলিফোনের আলাপে একদিকে তিনি নিজের উদ্বেগের কথা জানিয়েছিলেন, অন্যদিকে সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রকাশিত খবরে জানা গিয়েছিল, দুই নেত্রীকে বান কি মুন বলেছেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। এজন্য নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে প্রধান দুই দলের মধ্যে আলোচনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন তিনি। উল্লে¬খ্য, ২৩ আগস্ট নিজে সরাসরি প্রথম কথা বললেও বেশ কিছুদিন ধরেই বান কি মুন সমঝোতার জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। গত জুন মাসে জাতিসংঘের অতিরিক্ত মহাসচিব (রাজনৈতিক) ফার্নান্দোজ তারানকো ঢাকায় এসে দুই নেত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে গেছেন। সে সময় তিনি বান কি মুনের একটি চিঠিও তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ওই চিঠিতেও মহাসচিব সংলাপে বসার এবং সমঝোতায় পৌঁছানোর একই আহ্বান জানিয়েছিলেন। এসবের সূত্র ধরে বান কি মুন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির দু’জন করে চারজন প্রতিনিধির সঙ্গে নিউইয়র্কে বৈঠক করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিএনপি সে প্রস্তাবে রাজি হয়েছিল। এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। মহাসচিবের প্রস্তাবকে তো নাকচ করেছেনই, তিনি এমনকি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতেও অস্বীকৃতি জানিয়ে বসেছিলেন। সেই থেকে প্রচারণায় বলা হচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রী এবারের অধিবেশনে যাবেন না।
সুকৌশলে প্রচারণা চালানো হলেও প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত অবশ্য সচেতন কোনো মহলই বিশ্বাস করেননি। না করার কারণ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর ব্যাপারে শেখ হাসিনার অনেক ‘সুনাম’ রয়েছে। সংশয় থাকলে পাঠকরা জেনালের মইন ও ড. ফখরুদ্দিনদের অবৈধ শাসনের দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে পারেনÑ যখন বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার দিনটিতেই তিনি দেশ ও জনগণকে ফেলে সোজা ওয়াশিংটনের উদ্দেশে উড়াল দিয়েছিলেন। এটা ২০০৮ সালের জুন মাসের ঘটনা। অমন একজন নেত্রী নিউইয়র্ক যাওয়ার এবং দেশী প্রবাদ অনুসারে ‘পাড়া বেড়ানোর’ এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করবেনÑ কথাটা কারো কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। কয়েকদিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নিজেই সচেতন মহলগুলোর ধারণাকে সত্য প্রমাণিত করেছেন। এখানে অন্য একটি তথ্যও উল্লেখ করা দরকার। বান কি মুন শুধু নন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও মাঝখানে প্রধানমন্ত্রীর জন্য পরিস্থিতিকে ‘জটিল’ করার ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছিলেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের পরপর তিনিও সমঝোতার একই আহ্বান জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীর কাছে। এর ফলেও প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্ক যাওয়ার প্রশ্নে দ্বিধায় পড়েছিলেন। কারণ, জাতিসংঘ মহাসচিবকে পাশ কাটানো গেলেও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাটা শেখ হাসিনার পক্ষে সহজ ছিল না। এজন্যই এড়িয়ে যাওয়ার এবং নিজেকে আলোচনার বিষয়বস্তু বানানোর কৌশল হিসেবে তিনি জাতিসংঘে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
অনেক নাটকীয়তা করলেও শেখ হাসিনা অবশ্য যথাসময়েই গিয়ে বিমানে উঠেছিলেন। খবর শুধু এটুকুই নয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যঙ্গাত্মকভাবে বেশি আলোচিত আসল খবর হলো, প্রধানমন্ত্রী নিজে তো গেছেনই, সঙ্গে নিয়ে গেছেন প্রতিনিধি ও সফরসঙ্গী নামের বিরাট এক বহরও। ‘মাত্তরই’ ১৪০ জন গিয়েছিলেন তার সঙ্গে। প্রত্যেকের নামের আগে ‘বিশিষ্ট’ বিশেষণ যোগ করে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের নেতা ও এমপি এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা থেকে ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক পর্যন্ত এমনজনেরাই ওই বহরে ছিলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যাদের কোনো ভূমিকাই থাকার কথা নয়। তেমন সুযোগ এবার রাখাও হয়নি। কারণ, প্রধানমন্ত্রী যখন সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিয়েছেন তখন বাংলাদেশের ১০ জনের বেশি প্রতিনিধি অধিবেশন কক্ষে থাকার অনুমতি পাননি। এরপর ছিল মহাসচিবের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক। দু’জনের বৈঠকটি হয়েছে মাত্রই মিনিট বিশেকের। সেখানেও জনা পাঁচেকের বেশি সফরসঙ্গীকে থাকতে দেয়া হয়নি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে যেখানে মাত্র ১৫ জন অংশ নিতে বা উপস্থিত থাকতে পেরেছেন প্রধানমন্ত্রী সেখানে ১৪০ জনকে নিয়ে গেছেন। এজন্যই বলা হয়েছে, জাতিসংঘে যাওয়ার নামে প্রধানমন্ত্রী আসলে বিলাসিতাপূর্ণ এক প্রমোদ ভ্রমণের আয়োজন করেছিলেন। যারা গিয়েছিলেন তারা নাকি শপিং করে টাকা উড়িয়ে এসেছেন। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ‘বিশিষ্ট’ এই সফরসঙ্গীদের জন্য রাষ্ট্রকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বিমান ভাড়া, দৈনিক ভাতা এবং ট্রানজিট ও টার্মিনাল ভাতা মিলিয়ে প্রত্যেকের জন্য সরকারের ব্যয় হয়েছে পাঁচ লাখ ৫২ হাজার ৬৮৯ টাকা। এসবের বাইরে ছিল হোটেল ভাড়া। সব মিলিয়ে গরীব জনগণের কয়েক কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর এই সফর উপলক্ষে।
জাতিসংঘে গিয়েও সব দিক থেকেই দেশ ও জাতিকে ডুবিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী। উদাহরণ দেয়ার জন্য সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের উল্লেখ করা যায়। ২৭ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদের ৬৮তম অধিবেশনে পাওয়া মাত্র ১৬ মিনিটের পুরো সময়টুকুই তিনি তার সরকারের গুণকীর্তন করে পার করেছেন। রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সরকারের বইয়ে দেয়া উন্নয়নের জোয়ারের গালগল্পও যথেষ্টই শুনিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী একই নিঃশ্বাসে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং চারদলীয় জোট সরকারের সমালোচনাও করেছেন যথেচ্ছভাবে। বলেছেন, ওই সরকারের আমলেই বাংলাদেশ নাকি জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের রাজ্যে পরিণত হয়েছিল এবং তারা ক্ষমতায় আসার পরই নাকি সব জঙ্গি গোষ্ঠীকে দমন ও উৎখাত করা হয়েছে! প্রধানমন্ত্রী জানাননি, জেএমবি নেতা শায়খ আবদুর রহমান কোন দলের কোন নেতার আপন দুলাভাই এবং বাংলা ভাই ও শায়খ রহমানসহ জেএমবি নেতাদের গ্রেফতার ও বিচারের ব্যবস্থা আসলে চারদলীয় জোট সরকারই করেছিল। ভাষণে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন প্রধানমন্ত্রী। শুধু তা-ই নয়, এই বিচারে আন্তর্জাতিক সমর্থনও চেয়ে বসেছেন তিনি। কিন্তু বলেননি, কোন পন্থায় ও আন্তর্জাতিক ঠিক কোন আইনের অধীনে বিশ্ব বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ একটি বিষয়ে তাকে সমর্থন দেবে। প্রধানমন্ত্রী লক্ষ্যই করেননি, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ কিংবা পল্টনের মতো কোনো ময়দান নয়। ৬৮তম অধিবেশনও আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন ছিল না। একই কারণে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেয়ার গালগল্প করাটা প্রধানমন্ত্রীর জন্য শোভনীয় হয়নি। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারও প্রধানমন্ত্রীর রুচি এবং আন্তর্জাতিক রীতিনীতি সম্পর্কে তার জ্ঞানের বহর সম্পর্কেই জানান দিয়েছে। কারণ, জাতিসংঘের যে কোনো অধিবেশনে সাধারণত এমন সব বিষয়েই বলতে হয় যেগুলোর সঙ্গে নিজ দেশের এবং বিশ্বশান্তির কোনো না কোনোভাবে সংশ্লি¬ষ্টতা থাকে। যেমন পাকিস্তান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা কাশ্মীর সমস্যাসহ দু’দেশের অমীমাংসিত বিষয়ে বলেছেন। তারা সেই সঙ্গে যুদ্ধ এড়িয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজেদের পরিকল্পনা ও অঙ্গীকারের ঘোষণা দিয়েছেন। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রূহানী বলেছেন পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কে। তিনিও বিশ্বকে শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
অন্যদিকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকেই শুধু তুলোধুনো করেননি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিকেও এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন এর সঙ্গে বিশ্বশান্তির বিরাট কোনো সংশ্লিষ্টতা রয়েছে! লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বিএসএফ-এর হত্যা, অপদখলীয় ভূমিসহ সীমান্ত সমস্যা এবং তিস্তা চুক্তি না করা ও ভারতের পানি আগ্রাসনের মতো কোনো একটি বিষয় সম্পর্কেই বিশ্ববাসীকে জানতে দেননি। তার এই পাশ কাটানোর কৌশল থেকে মনে হতে পারে যেন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সমস্যাই নেই! নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কেও প্রধানমন্ত্রী ঠোঁটে আঙুল চেপে রেখেছেন। অথচ এই সংকট কাটিয়ে ওঠার উদ্দেশ্যে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছেন। একই আহ্বান জানিয়ে দুই নেত্রীকে চিঠি লিখেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও। চীন, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সব দেশ ও সংস্থাও একই আহ্বান জানিয়েছে। পরামর্শ দিয়েছে। সে কারণে সমঝোতার ব্যাপারেই অন্য দেশগুলোর আগ্রহ অনেক বেশি ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এত বড় একটি বিষয়কেও পাশ কাটিয়ে গেছেন। অর্থাৎ বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ কোনো সুফলই অর্জন করতে পারেনি। সব মিলিয়েই বাংলাদেশের ভাবমর্যাদাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে এসেছেন তিনি।
নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনেরও উল্লেখ করা দরকার। ২৮ সেপ্টেম্বরের এই সংবাদ সম্মেলনে দেশ, জাতি ও জনগণের স্বার্থে ‘যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন শেখ হাসিনা। বলেছেন, তিনি ‘গ্যারান্টি’ দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করবেন। জাতিসংঘ চাইলে প্রতিনিধি পাঠিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলীয় নেত্রীর সঙ্গে চা খাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, তবে তাকে যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গ ছেড়ে আসতে হবে। সব সংকটের জন্য ‘সুশীল বাবুদের’ দায়ী করলেও একই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী আবার দেশে কোনো রাজনৈতিক সংকট নেই বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সংবিধান অনুযায়ী এবং তার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই। নতুন একটি কথাও শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘কখনোই’ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। সেটাই করে ‘দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করতে চান তিনি। বলা দরকার, ‘কখনোই’ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি কথাটার মধ্য দিয়ে অজান্তে হলেও প্রধানমন্ত্রী নিজের মরহুম পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সে নির্বাচন এতটাই ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ হয়েছিল যে, তিনশ আসনের মধ্যে বিরোধী দলের ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মাত্র সাতজন জিততে পেরেছিলেন। ‘ওরে জিতাইয়া দে’ এবং ‘ওরে আসতে দিস না’ ধরনের হুকুমের কারণে ভোটের পরদিন সকাল পর্যন্ত গণনায় অনেক এগিয়ে থাকা অনেকেও সেবার কুপোকাত হয়েছিলেন। বলা হচ্ছে, ‘কখনোই’ কথাটার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার নিজের পিতাকেও চরমভাবে অসম্মানিত করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে ‘দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করার জন্য তার গোঁ ধরে বসার কারণে। কেননা, জনগণ কি চায় সে কথাটা নিউইয়র্কে গিয়েও প্রধানমন্ত্রীকে টের পেতে হয়েছে। জাতিসংঘ সদর দফতর থেকে হিলটন হোটেলের সামনে পর্যন্ত প্রতিটি স্থানেই বাংলাদেশীরা তাকে চমৎকার ‘সংবর্ধনা’ দিয়েছেন। এমনকি আলোচ্য সংবাদ সম্মেলনেও ‘সুশীল বাবুদের’ খোঁচা মারতে গিয়ে তাকে কম বিব্রত হতে হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে যথারীতি তিনি নিজেদের ইচ্ছামতো সংশোধিত সংবিধানকে জাপটে ধরেছেন এবং ওই সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন একটি ‘দৃষ্টান্ত’ স্থাপনের ঘোষণা শুনিয়েছেন।
এখনও ক্ষমতায় আছেন, সুতরাং যা কিছু তিনি বলতে ও করতে চাইতেই পারেন। কিন্তু তার একার চাওয়াটাই সব নয়। কারণ, দেশে বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাও যার যার অবস্থান থেকে প্রধানমন্ত্রীর জন্য পরিস্থিতিকে ক্রমাগত কঠিন ও জটিল করে চলেছেন। এমনকি তার মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মুখেও আজকাল অন্যরকম কথাই শোনা যাচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়া তো দাবি মেনে নেয়ার জন্য ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছেন। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী চাইলেই নতুন ‘দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করতে পারবেন এমন মনে করার কোনো যুক্তি নেই। একই কারণে দেশ, জাতি ও জনগণের স্বার্থে ‘যে কোনো ত্যাগ স্বীকার’ করতে চাওয়ারও কোনো অর্থ থাকতে পারে না। পর্যবেক্ষকরা বরং মনে করেন, ত্যাগ স্বীকারের নামে নতুন পর্যায়ে নাটকীয়তা করার কষ্ট না করে প্রধানমন্ত্রীর উচিত বিরোধী দলের দাবি মেনে নেয়া এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া। কারণ, শেয়ার বাজারের মহালুণ্ঠন থেকে পদ্মাসেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি ও কেলেংকারি পর্যন্ত অনেক ‘দৃষ্টান্ত’ই জনগণকে দেখতে হয়েছে। জনগণ তাই নির্বাচনের নামে নতুন আর কোনো ‘দৃষ্টান্ত’ দেখতে চায় না। তারা চায়, প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের কথা শুনুন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে দেশকে সংকট ও সংঘাতের অশুভ পরিণতি থেকে রক্ষা করুন। এতেই ‘ধন্য’ হয়ে যাবে জনগণ!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন