মাত্র পাঁচ মাস আগের কথা। এই
কয়েক মাসে হাজারো সমস্যার ভিড়ে আমরা অনেকেই সাভারের রানা ভবন ধসের সেই ভয়ঙ্কর
স্মৃতির কথা ভুলে যেতে বসেছি। সেদিনের বীভৎসতার শিকার হতাহত পঙ্গু এবং ক্ষতিগ্রস্ত
শ্রমিক পরিবার ও তাদের সদস্যদের কথা কি আমরা চিন্তা করেছি? অথবা সরকার কতটুকু চিন্তা করছে? ২৪ এপ্রিল
সাভারের তৈরী পোশাক কারখানা রানা ভবন ধসে পড়ার পর এক হাজার ১৩২টি লাশ এবং দুই
হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিতাবস্থায় উদ্ধার (তন্মধ্যে ১২ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায়
মৃত্যুবরণ) করা হয়। রানা প্লাজা ধসের আগেও পোশাক কারখানার শ্রমিকদের ওপর মালিকেরা
বহুবার নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছেন। শ্রমিকেরা চাকরি হারানোর ভয়ে সব কিছুই
নীরবে সহ্য করেছেন এত দিন। মালিকদের খামখেয়ালিপনার কারণে ভবন ধস আর অগ্নিকাণ্ডের
ফলে শ্রমিকদের লাশের সারি দেখে গণমাধ্যম কয়েক দিন সচিত্র সংবাদ প্রকাশ করে আর
কলামিস্টরা লেখার খোরাক পেয়ে যান, মধ্য রাতের
বুদ্ধিজীবীরা টকশোতের ইস্যু পান, শ্রমিক নেতারা
সুযোগ পান রাজপথ কাঁপিয়ে বক্তৃতা করার। কিন্তু শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন
ঘটে না। সাভারের রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ওই এলাকার সংসদ সদস্যের অত্যন্ত
আস্থাভাজন। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে চলতে অভ্যস্ত।
এখন সে আপাদমস্তক যুবলীগের স্থানীয় নেতা। ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের স্থানীয়
শীর্ষপর্যায়ের নেতা ও এমপিদের স্নেহভাজন হওয়ার সুবাদে সোহেল এত দিন যা ইচ্ছা তাই
করেছেন। জানা গেছে, রবীন্দ্র সরকার সাভার উপজেলার
ছোট বলিমেহের মৌজার ১৫, ১৬, ১৭ ও ২৩ নং দাগের ১২৬ শতাংশ জমি ১৯৮৯ সালে কিনে সীমানা প্রাচীর
দিয়েছিলেন। সোহেল রানার বাবা বড় দলের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে মোটা অঙ্কের টাকার
মালিক বনে যান। এরপর রবীন্দ্র সরকারের পাশেই তিন কাঠা জমি ক্রয় করেন। ২০০৪ সালে
ক্ষমতাসীন দলীয় এমপির প্রশ্রয়ে সোহেল রানা রবীন্দ্র সরকারের ২৭ শতাংশ জমিসহ তার
বাবার ক্রয়কৃত তিন কাঠা নিচু ডোবা জমি ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ শুরু করেন।
অসহায় রবীন্দ্র সাভার পৌরসভা, থানা, রাজউকসহ সরকারের তদারকি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লিখিতভাবে জানিয়েও
কোনো বিচার পাননি। একাধিক দলের এমপিদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে সোহেল রানা বিগত ১০ বছরে
শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন। গত ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের পর চতুর রানা
আত্মগোপনে থাকলেও পুলিশ তাকে, তার বাবাকে, ওই ভবনের গার্মেন্ট মালিকদের, সাভার পৌরসভার
প্রকৌশলীদের আটক করেছে। ২০০৪ সালে যখন রবীন্দ্র সরকারের জমিতে সোহেল রানা অবৈধ
বহুতল ভবন নির্মাণ করে ক্ষমতার অপব্যবহার করেন তখন রবীন্দ্র সরকারের লিখিত আবেদন
সত্ত্বেও রানার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিতে স্থানীয় এমপি সাভার থানা
পুলিশকে নির্দেশ দেয়ায় সে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে বলে অভিযোগ রয়েছে। অপকর্মে
প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা এবং রানা প্লাজা নির্মাণে ক্ষমতার অপব্যবহার করার দায়ে ওই
এমপিকে আটক করা হলো না কেন? বর্তমান এমপি রানার সহযোগী
অপরাধী হিসেবে আটক হওয়ারই কথা। সাভার থানা পুলিশের তৎকালীন ও বর্তমান
ইন্সপেক্টরদ্বয় রানাকে অন্যায়ভাবে সহযোগিতা করার দায়ে তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা
উচিত। কিন্তু রানার সহযোগী হিসেবে কেউ বিচারের মুখোমুখি হবেন বলে মনে হয় না। কারণ
তাদের হাত অনেক লম্বা। রানা প্লাজা ধসের পর দেশের মানুষ বিস্ময়ে লক্ষ করেছে
সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনীর প্রশিক্ষিত উদ্ধারকারী দলের সাথে তাল মিলিয়ে
কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই তরুণ যুবকেরা কিভাবে উদ্ধার তৎপরতায় সাহায্যের হাত
বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা প্রমাণ করে, আমাদের মানবিক
মূল্যবোধ এখনো ধসে যায়নি। তবে বিলীন হয়ে গেছে আমাদের ভোটে নির্বাচিত এমপি-মন্ত্রীদের
মূল্যবোধ। তাই তারা রানাদের মতো ব্যক্তিদের সাথে দহরম মহরম গড়ে তোলেন। ক্ষমতালোভী
ও স্বার্থপর নেতানামের গডফাদারের কারণেই রানা গং সারা দেশে প্রকাশ্যে অবৈধ ও
অসামাজিক-অনৈতিক কাজ করার পরও পুলিশ তাদের গ্রেফতার করার বদৌলতে সালাম ও স্যালুট
দেয়। বলা যায়, অবৈধ ব্যবসায় নির্বিঘেœ চালিয়ে যেতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সহযোগিতা করে থাকেন। অসৎ
কর্মকর্তারা মনে করেন, ধূর্ত লোকদের অন্যায় কাজে
সহযোগিতা করলে ‘শান্তিতে’ চাকরি করা যাবে এবং নিরীহ মানুষজনকে অত্যাচার করেও প্রতিবাদহীনভাবে
বহাল তবিয়তে কর্মস্থলে থাকা যায়। এত কিছুর পরও এসব দুর্নীতিবাজ পুলিশ ও অন্যান্য
কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধিরা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। রানা
প্লাজার সহস্রাধিক পোশাক শ্রমিক নিহত হওয়ার পর দেশবাসী তাকিয়ে আছে, কর্তৃপক্ষ শুধু কি রানা, ওর বাবা, ওই ভবনের কারখানাগুলোর মালিক এবং সাভার পৌরসভার মেয়র ও
প্রকৌশলীদের বিচার করবে? নাকি রানাকে যারা জিরো থেকে
হিরো বানিয়েছে এবং এ কাজে দীর্ঘ দিন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে তাদের
প্রত্যেককেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে? রানার সহযোগী
সব অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে সরকার দৃঢ় থাকলে ভবিষ্যতে আর কোনো
এমপি ওদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তুলবে না। প্রয়োজন সরকারপ্রধানের
দিকনির্দেশনা ও আন্তরিকতা। এ ধরনের সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিয়ে মাননীয়
প্রধানমন্ত্রী প্রমাণ করতে পারেন, তিনি একজন
মমতাময়ী মা, তিনি শোকার্ত স্বজনদের বুকভরা
আর্তনাদের ভাষা বোঝেন এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে জানেন। এতে কিছু ব্যক্তি
সংুব্ধ হলেও পোশাক কারখানার লাখ লাখ মেহনতি শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা
সরকারের ওপর আস্থা ফিরে পাবে। রানা প্লাজায় আহত শত শত শ্রমিকের ভবিষ্যৎ কী, তা আমরা কেউ জানি না। পঙ্গু ও মারাত্মকভাবে অসুস্থ শ্রমিকেরা কত
দিনে স্বাস্থ্যসেবা এবং পুনর্বাসনের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাবেন, সেটাও চিন্তার বিষয়। নিহত ও আহত শ্রমিকদের সন্তানদের পড়াশোনার
দায়িত্ব কে নেবে? উদ্ধারকর্মীদের অনেকেই মানসিকভাবে
বিপর্যস্ত। তাদের সংসারের হাল কে ধরবে? অনেকেই এখনো
স্বজনের লাশ পাননি। তাদের সান্ত্বনা দেয়ার দায়িত্ব কে নেবে? খেটে খাওয়া পঙ্গু ও শোকার্ত শ্রমিকদের উৎকণ্ঠা আর অসহায়ত্বের কথা
দেশের ক’জন রাজনীতিক চিন্তা করছেন? রানা প্লাজায় নিহত শ্রমিকদের পরিবারের দায়িত্ব কে নেবে, আহত শ্রমিকদের বৈধ ওয়ারিশদের ভবিষ্যতের দায়িত্ব কে নেবে, স্বজনের খোঁজে এখনো যারা সাভারে আসছেন, কে তাদের স্বজনের অন্তত লাশের সন্ধান দেবে? আমাদের সস্তা শ্রমিকদের আর কতকাল এভাবে বাঁচার কষ্টসাধ্য লড়াই
চালিয়ে যেতে হবে? ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার
সমর্থিত সোহেল রানার দায়ভার স্বাভাবিকভাবেই সরকারের ওপর বর্তায়। মানব সৃষ্ট এই
মহাদুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য পরম করুণাময় আমাদের সবাইকে সাহস ও শক্তি দান
করুনÑ এই প্রার্থনা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন