বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

প্রতিহিংসার রাজনীতি বনাম জাতীয় সংহতি


ঐতিহাসিক একটি ঘটনা দিয়েই লেখা শুরু করছি। অষ্টম হিজরি সাল। মক্কার মুশরিকদের বিরুদ্ধে ইসলামের বিজয় হয়েছে। মহানবীর কূটনীতির ফলে এ বিজয়ে এক ফোঁটা রক্তও ঝরেনি। মক্কার বিজিত মুশরিকগণ ঐসব লোক যারা হিজরতের আগে তেরটি বছর মহানবী ও সাহাবিদের ওপর অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন করেছে, মহানবীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছে। তাদের জুলুম-নির্যাতনে বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত মহানবী ও সাহাবিগণ ঘর-বাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিত্যাগ করে মদীনায় চলে গিয়েছেন। মুশরিকরা মদীনায়ও তাঁদেরকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। আটটি বছর তারা বার বার ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।
মহানবীর চার পাশে সমবেত মুশরিকদের মধ্যে আছেন তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীগণ এবং বদর, উহুদ প্রভৃতি যুদ্ধের নায়কগণ। তাদের মধ্যে আরো আছেন মহানবীর অতি প্রিয় চাচা হামযা, (রা.)-এর ঘাতক ওয়াহ্শি এবং হিন্দা নামক ঐ মহিলা যিনি প্রতিহিংসাবশত তাঁর কলিজা চিবিয়ে খেয়েছিলেন। সমবেত মুশরিকদের মধ্যে উৎকণ্ঠা ও শঙ্কার সীমা নেই। মহানবী তাদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেন, তা তাদেরকে দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। মহানবী তাদেরকে কী বললেন? তিনি বললেন, যাও, তোমরা সবাই আযাদ। (উল্লেখ্য, ঐ সময় সারা বিশ্বে নিয়ম ছিল, যুদ্ধে পরাজিত নারী-পুরুষ সবাই বিজয়ীদের দাস হবে।)
মহানবী কোনো প্রতিশোধ তো নিলেন না বরং পরাজিত শত্রুদের মধ্যে যারা বিশেষভাবে সম্মানিত ছিল তাদেরকে বিশেষ মর্যাদা দিলেন। ইসলামের ঘোর শত্রু আবু সুফিয়ানের ব্যাপারে তিনি বললেন, যেকেউ আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ। তিনি আরও বললেন, জাহিলিয়াতের (অজ্ঞতার) যুগে যারা শ্রেষ্ঠ, ইসলামেও তারা শ্রেষ্ঠ। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) প্রমুখ ইসলাম গ্রহণের পর এ কথার সত্যতা চমৎকারভাবে প্রমাণ করেছিলেন। পরাজিত শত্রুদের ব্যাপারে মহানবী যে নীতি অবলম্বন করেছিলেন, তার ফলে অচিরেই ইসলাম কেবল সারা আরবে বিস্তার লাভ করেনি, সারা বিশ্বে একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে দেখা দিয়েছিল।
প্রতিহিংসা পরিহারের এই যে মহান নীতি তা বিশ্বের প্রজ্ঞাবান, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ সব সময় অবলম্বন করে থাকেন। কারণ, প্রতিহিংসা কেবল হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানির জন্ম দেয়, এতে দেশের বা জাতির ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হয় না। এর ফলে শত্রুদের মোকাবিলায় জাতি কেবল দুর্বল হতে থাকে এবং ক্রমে ক্রমে জাতীয় অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যায়।
এ যুগের এক মহানায়ক নেলসন ম্যান্ডেলার কথা আমরা জানি। নিজ দেশে ঔপনিবেশিক শক্তির বর্ণবাদভিত্তিক শোষণের শিকার হয়ে জীবনের সাতাইশটি বছর তিনি কয়েদখানায় কাটিয়েছেন। জেল থেকে মুক্তি লাভ করে যখন তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তখন শ্বেত শোষকদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বরং বর্ণবাদী গোষ্ঠীর একজন নেতাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। সামাজিক শান্তি ও দেশের উন্নয়নের খাতিরে তিনি প্রতিহিংসার বদলে জাতীয় সংহতি ও ঐক্যকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তাঁর এ নীতির ফলে দেশের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। বরং অব্যাহত রয়েছে। উদারতা ও বিশাল ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়ে তিনি নিজেও বিশ্বে নন্দিত হয়েছেন। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো পিতৃহত্যার বিচার না করে যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা প্রশংসিত হয়েছে। ফিলিপিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর একুইনোও তাঁর স্বামী (যিনি সে দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন) হত্যার বিচার না করে অতি বড় মনের পরিচয় দিয়েছেন। আমাদের দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এ ধরনেরই কাজ করেছেন। এতে তাঁর সুনাম ক্ষুণœ হয়নি বরং বেড়েছে।
দেশ ও জাতীয় নেতৃত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত, তারা শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিলে বা প্রতিহিংসামূলক কাজ করলে চরম পর্যায়ে এর ফল ভাল হয় না বরং লাভের চেয়ে ক্ষতি হয় বেশি। বৃটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ঔড়যহ ষঁননধপশ বলেছেন, জবাবহমব ফড়বং সড়ৎব যধৎস ঃযধহ ঃযব রহলঁৎু রঃংবষভ. অর্থাৎ, প্রতিহিংসার দ্বারা মূল ক্ষতির চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়।
ওপরের উদাহরণগুলো ব্যক্তিবিশেষের সাথে সম্পৃক্ত। জাতীয় নীতি নির্ধারণে সময়ও প্রজ্ঞাবান রাজনীতিকগণ অতীত শত্রুতার প্রতিশোধ নেয়ার পেছনে অর্থ ও সময় ব্যয় না করে কেবল জাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। মার্কিন সেনারা ভিয়েতনামে লাখ লাখ লোক হত্যা করেছে, কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পর ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এর ফলে দেশটি অতি কম সময়ে অভাবিত উন্নতি লাভ করতে পেরেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান তার সবচেয়ে বড় শত্রু আমেরিকার সাথে সখ্যতা স্থাপন করতে মোটেই দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি বরং সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। মার্কিন সহযোগিতার ফলেই জাপান অতি অল্প সময়ে যুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এবং দ্রুতগতিতে উন্নতি লাভ করতে পেরেছে।
অতীত তিক্ততাকে ঘাটাঘাটি করে যে জাতির কোনো লাভ হয় না, এ উপলব্ধি আমাদের অঞ্চলেও দেখা গিয়েছে। যে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি প্রায় দু’শ’ বছর এ উপমহাদেশকে শোষণ করেছে, তার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ‘ঈড়সসড়হ বিধষঃয-এর সদস্য হতে স্বাধীন পাকিস্তান ও স্বাধীন ভারত সংকোচ বোধ করেনি। বর্তমান ভারতের বহু স্থানের মুসলমান পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষে থাকার কারণে ভারতে তাদের কোনো বিচার হয়নি। যে মুসলিম লীগ পাকিস্তান রাষ্ট্রের  জন্য এককভাবে সংগ্রাম করেছে, তা এখনও ভারতের কেরালা প্রদেশের রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক শক্তি। অনুরূপভাবে, পকিস্তানী এলাকায় যেসব লোক অখ- ভারতের পক্ষে কাজ করেছেন, স্বাধীনতা লাভৈর পর তাদের বিরুদ্ধেও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস পাকিস্তানে অবাধে কাজ করেছে এমনকি কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্রনাথ পাকিস্তানের প্রথম মন্ত্রীসভায় স্থান পেয়েছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভের পর জাতীয় পরিষদে কায়দে আযম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন, আজ থেকে আমাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই, আমরা সবাই পাকিস্তানী।
বর্তমান বাংলাদেশকেও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পরিহারের উদাহরণ আছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিরোধীতা যারা করেছিলেন, জাতীয় সংহতির খাতিরেই মরহুম শেখ মুজিব তাদের ক্ষমা করেছিলেন। এমনকি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীকে তিনি ক্ষমা করেছিলেন এবং বলেছিলেন, আমরা দেখিয়ে দিলাম, বাঙালী ক্ষমা করতে জানে। জাতীয় স্বার্থেই তিনি বাংলাদেশের ঘোর শত্রু পাকিস্তানের সাবেক প্রধান মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে এ দেশে আমন্ত্রণ করে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক স্থাপনে এ মহানুভবতা বিরাট কাজ করেছিল।
স্বাধীনতা লাভের প্রায় চল্লিশ বছর পর বর্তমান বাংলাদেশে ‘দেশকে কলঙ্কমুক্ত করা’র নামে ‘যুদ্ধাপরাধ’ বা ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’-এর বিচার চলছে। ক্ষমতাসীন সরকারের কোনো কোনো নেতার কথায় মনে হয়, এ বিচার হচ্ছে একটা চলমান প্রক্রিয়া, এটা চলতেই থাকবে। আদালতের প্রতি যথাযথ সম্মানপূর্বক বলা যায়, এ ধরনের বিচার প্রক্রিয়া সমাজে অশান্তি ও হানাহানি বৃদ্ধি করে জাতীয় ঐক্য ও সংহতিকে কুরে কুরে নিঃশেষ করে দিচ্ছে কিনা তা ভেবে দেখারও দরকার আছে। যদি আবেগের তাড়নায় বা রাজনৈতিক স্বার্থের খাতিরে এ ধরনের কাজ করা হয় তবে তার পরিণতি জাতির জন্য শুভ নাও হতে পারে।
পরিশেষে আমেরিকার বিশ্বনন্দিত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন-এর দুটো বাণী উদ্ধৃত করছি। তিনি বলেছেন : : A house divided against itself cannot stand. তিনি আরও বলেছেন : United we stand, divided we fall.
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

তত্ত্বাবধায়ক দাবির আদি নেতাদের বন্দি রেখে অর্থবহ সমঝোতা-সংলাপ-শান্তি অসম্ভব


১.
১/১১-এর সময়কালের ঘটনা প্রবাহ এখন  দুঃখ ও বেদনার স্মৃতি। লগি-বৈঠার তা-বে মানুষ হত্যা করে লাশের উপর উল্লাস নৃত্য করার প্রেক্ষাপটে এসেছিল আজ থেকে সাত বছর আগের ১/১১ সেই কালো অধ্যায় এসেছিল রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবরের নৃশংসতার মধ্য দিয়ে। তৎকালীন বিরোধী দল (আওয়ামী-নাস্তিক্যবাদী জোট) রাজনৈতিক ধারা ও স্বাভাবিকতাকে নস্যাৎ করে চরম অরাজকতা সৃষ্টি করায় পরিস্থিতি সকলের হাতছাড়া হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় বিশেষ পরিস্থিতি। তখন জরুরি অবস্থা ছিল, সাংবিধানিক নিয়ম-কানুন স্থগিত ছিল। প্রয়োজনের খাতিরে অনেক কিছুই উলট-পালট করা হয়েছে সে সময়। সুপ্রিম কোর্টের রায়েও উদ্ভুত পরিস্থিতিকে বলা হয়েছিল ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’। সেই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তির একটি সুপ্ত প্রচেষ্টা কায়েমী মহলের মধ্যে এখনও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে বলে অনেকেই বলাবলি করছেন।
বর্তমানে আবার জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে যে, গত ২৭ অক্টোবরের পর ঘটনা প্রবাহ কি তেমনই পরিস্থিতির দিকে চলে যাচ্ছে? সে প্রশ্ন অনেকেই উত্থাপন করতে শুরু করেছেন। কারণ, ২৭ অক্টোবরের পর ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের সাংবিধানিক বাধ্য-বাধকতার মধ্যে শাসন ব্যবস্থা প্রবেশ করেছে। এরই মধ্যে শেখ হাসিনার সরকার নিজের মতো করে সংবিধান সাজিয়ে রেখেছেন। ‘নির্বাচিত উত্তরাধিকার’ না আসা পর্যন্ত তিনি তাঁর পছন্দের মন্ত্রিসভাসহ স্বপদে বহাল থাকবেন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৭(৩), ৫৮(৩) ও (৪) মোতাবেক। এই পরিবর্তন স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে উত্তীর্ণ নয়। যেভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে একদলীয় বাকশাল কায়েম করেছিল শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ; তেমনভাবেই অতি তাড়াতাড়ি বিদ্যমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বদলে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান একতরফা কায়েম করেছে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। জনগণের একটি বিরাট অংশ বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এই পরিবর্তন মেনে নেয় নি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে সর্বাত্মক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।  
শুধু তা-ই নয়, প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২৭ তারিখের পর থেকে বর্তমান সরকারকে ‘অবৈধ’ বলে ঘোষণা করেছেন। এখন ‘অবৈধ’ শব্দটিকে যদি তিনি প্রকৃত অর্থেই ‘মিন’ করেন, তাহলে সে সরকারের সঙ্গে সংলাপ, সমঝোতা বা আলোচনার অবকাশ থাকে না। তাঁর ভাষায়  যে সরকার ‘অবৈধ’ হিসাবে উল্লেখিত, তার সঙ্গে আলোচনা করে ‘বৈধ’ দাবি আদায় করার বিষয়টি নৈতিক ও আইনগত দিক থেকে কতটুকু স্বচ্ছ হবে, সে প্রশ্নও থেকেই যাচ্ছে। ফলে পুরো পরিস্থিতিই একটি জটিল রাজনৈতিক ও সংবিধান সঙ্কটে নিপতিত হতে বাধ্য। এ অবস্থায় সরকারের অপরাপর প্রতিষ্ঠান যেমন, নির্বাচন কমিশন, আমলাতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সামনে চলে আসবে নতুন দৃশ্যপট। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পালনের প্রশ্নে সমস্যার সম্মুখীন হওয়াও তাদের পক্ষে বিচিত্র কিছু হবে না। ইতোমধ্যে খবর পাওয়া যাচ্ছে প্রশাসনের নানা বিভাগে ও স্তরে আনুগত্যের অদল-বদল হচ্ছে; নিদেন পক্ষে দোদুল্যমানতা এসে ভর করছে। রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভাজনজনিত চাপ এবং বৈধতার প্রসঙ্গটি কে কিভাবে সামলায় তার উপরও অনেকাংশে নির্ভর করছে সামনের দিনের শাসনের রূপ, চরিত্র, ধরন ও প্রকৃতি। বিশেষত নির্বাচন কমিশন, যাদের উপর রয়েছে জাতীয় নির্বাচনের মতো একটি বিশাল যজ্ঞ, তারা সরকার ও বিরোধী দলের দিক থেকে ধেয়ে আসা চাপ কতটুকু সমন্বয় করতে বা সামাল দিতে পারবে, সেটাও এক বড় প্রশ্ন। নির্বাচন কমিশনে চিত্তবৈকল্য ও বাইরের চাপের প্রভাবজনিত লক্ষণ দেখা গেলে আর যাই হোক, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন কোনওভাবেই সম্ভব হবে না। ফলে সামনের দিনগুলোতে অবধারিতভাবেই ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি দলের রাজনীতিবিদদের দীর্ঘসূত্রিতা ও সিদ্ধান্তহীনতা ঠেলতে ঠেলতে পরিস্থিতিকে যে খাদের কিনারে নিয়ে এসেছে, সেটা তারাই এখন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছেন।
প্রসঙ্গত ২৬ তারিখ শেখ হাসিনা যে টেলিফোন কলটি বেগম খালেদা জিয়াকে করেছেন, সে ফোনকলটিই যদি আরও আগে করা হতো, তাহলে আলোচনা ও সমঝোতার অনেকটাই স্পেস বা জায়গা বা সুযোগ পাওয়া যেতো। এতো আন্দোলন, সংগ্রাম, আত্মত্যাগের দরকার হতো না। এখন আলোচনার স্পেস যেমন কমেছে, তেমনিভাবে পাল্লা দিতে হচ্ছে  ৯০ দিনের কাঠামোর মধ্যে সব কিছু যথাযথ ও  দ্রুততায় সম্পন্ন করার তাগিদের সঙ্গেও। সকল দলের অংশ গ্রহণ ছাড়া দেশ ও বিদেশে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে নাÑএই স্বতঃসিদ্ধ ও সর্ব মহলে উচ্চারিত কথাটিকে মান্য করার জন্য আলাপ-আলোচনা চালানো আর সেই আলাপকে সার্থক করে ৯০ দিনের বাধ্য-বাধকতার সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার দ্রুতলয় কাজ বিদ্যমান সরকার দলীয় অনঢ় রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বিভেদের পটভূমিতে কতটুকু সম্ভব হবে? যদি সেটা সম্ভব না হয়, তবে শুরু হয়ে যাবে সরকার কর্তৃক পরিকল্পিত একদলীয় নির্বাচনের বিরুদ্ধে সকল বিরোধী দলের অসহযোগ আন্দোলন। যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। অতএব শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার ভাষণ এবং ফোনালাপের পরেও যে সঙ্কট বিরাজমান ছিল, সেটা থেকেই গেল। সরকারের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত পর্যায়ে অর্থপূর্ণ আলোচনার লক্ষ্যে সরাসরি উদ্যোগ গ্রহণের বদলে ভাষণ-পরবর্তী ফোনালাপ বা নৈশভোজের দাওয়াত বিরোধী জোটের সর্বাত্মক আন্দোলনের গভীরতার সামনে জোরদার পদক্ষেপ বলেও বিবেচিত হচ্ছে না। তদুপরি, বিশেষজ্ঞ মহল থেকে বলা হচ্ছে শেখ হাসিনার প্রস্তাব সংবিধানসম্মত নয়। পক্ষান্তরে বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাব সংবিধানসম্মত। সরকার দুই প্রস্তাবকে সামনে রেখে কোনও হোমওয়ার্ক করেনি। বিরোধী দলের দাবি ও প্রস্তাব না-মানার মধ্যেই তাদের মানসিকতা ও আচরণ ঘুরপাক খাচ্ছে। অতএব বিরোধী জোটকে আস্থা ও বিশ্বাসের মধ্যে এনে তাদের দাবিকে সম্মান জানানোর মাধ্যমে সঙ্কট সমাধান করা এবং পরিস্থিতিকে সামাল দেয়ার সরকারি উদ্যোগ সামান্যতম আশার সঞ্চার করতে ব্যর্থ হয়েছে। তদুপরি সরকারি দলের নেতা-পাতি-নেতারা যে উস্কানিমূলক ও বলদর্পী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে পরিস্থিতি তারা নিজেরাই বিগড়ে দিচ্ছেন। প্রতিনিয়ত বিরোধী দল ও জোটকে হামলা-মামলায় জর্জরিত এবং অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা ও অসম্মান করছেন। একই সঙ্গে ছলে-বলে, আইনে-বেআইনে নেতৃবৃন্দকে নিধন করার প্রক্রিয়াও তারা জোরালোভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। এই আগ্রাসী, স্বৈরতান্ত্রিক, একগুঁয়েমিপূর্ণ তৎপরতা গণতান্ত্রিক সহনশীলতা ও সমঝোতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং বিরাট অন্তরায়।   
২.
৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের কাউন্ট-ডাউন শুরু হওয়ায় সমঝোতায় উপনীত হওয়ার সময় ও স্পেস, উভয়টিই হ্রাস পাচ্ছে। এমন অবস্থায় আন্দোলন ও সংলাপ এক সঙ্গে চালানোর লক্ষ্যে বিরোধী দল ৬০ ঘণ্টার যে টানা হরতাল ডেকেছে সেটা গত (মঙ্গলবার) সন্ধ্যায় শেষ হয়েছে। অতীতের হরতালের চেয়ে এবার বিরোধীরা অনেক সক্রিয় ও সহিংস আচরণ করেছে এবং আরও হরতালমুখী হয়ে রয়েছে। সরকারও বিপুলভাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসনিক শক্তি নিয়োজিত করেছে। প্রশাসনযন্ত্র সর্বত্র বিরোধী নেতা-কর্মীদের যেভাবে ধাওয়া করছে, তাতে তারাও সমঝোতার প্রশ্নে সরকারের উপর আস্থা রাখতে পারছে না। আন্দোলনের পথ ছাড়া তাদের সামনে অন্য কোনওভাবে সঙ্কট সমাধানের পন্থা খোলা রাখে নি সরকার। এমন কি, হাসিনার ফোন পেয়ে খালেদা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার ফুরসতও পান নি। কারণ নেতাদের বাসায় বাসায় তখন পুলিশ হানা দিচ্ছিল এবং তারা তখন প্রবল পুলিশী চাপে বিচ্ছিন্ন ও বিব্রত ছিলেন। তাছাড়া অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় বিরোধী নেতা রয়েছেন কারাগারে। তাদেরকে ছাড়া ১৮ দলের পক্ষে অর্থবহ সংলাপে যাওয়াও সম্ভব নয়। ফলে সংলাপের পূর্বশর্ত ও সফলতার জন্য আটক নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দেয়ার বিষয়টি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণভাবে সামনে চলে এসেছে।
সর্বশেষ অবস্থায় সংঘাত ও উত্তেজনার সঙ্গে সঙ্গে জনজীবনে এসে যুক্ত হয়েছে চরম ভীতি, আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা। সাধারণ নাগরিক জীবন হরতালের চাপে ও সরকারের অবস্থানের মাঝখানে ‘পাটা-পুতার ঘষায় মরিচের জান শেষ’ অবস্থায় পড়ে গেছে। ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষা, শিল্প, আমদানি-রফতানিসহ সর্বক্ষেত্রে পড়ছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। দ্রব্য-সামগ্রীর যোগান কমে দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামনে দেশব্যাপী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমান কয়েক লক্ষ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা ঘোরতর অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয়েছেন। অনুমান করা যাচ্ছে যে, রাজনৈতিক সঙ্কট সুনামী বা ক্যান্সারের মতো সমাজ, শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্যসহ সর্বত্র আঘাত হানছে। রাজনৈতিক অচলাবস্থার নেতিবাচক প্রভাব সমাজ ও অর্থনীতির প্রায়-সকল ক্ষেত্রকেই অচল কিংবা ভীতিপূর্ণ বা অনিশ্চিত বা সংঘাতময় করে ফেলছে। এই আত্মঘাতী ধারার পরবর্তী পর্যায় কি হবে, তা ভেবে সকলেই আকুল। আরও সংঘাত, আরও সঙ্কট, আরও অচলাবস্থা, জরুরি অবস্থা? নাকি হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো সমঝোতা?
মনে রাখা দরকার যে, সমঝোতার ট্রেন সময়মতো ধরতে পারেন নি সরকারপক্ষীয় রাজনীতিবিদগণ। তাদেরকে বার বার সংলাপ ও সমঝোতার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে বলা হয়েছে।  সময় থাকতে তারা ‘এক চুল’ ছাড় দেবেন না বলে হুঙ্কার দিয়েছিলেন। ছাড় না দিলে আলোচনা, সংলাপ বা সমঝোতার অর্থ কি! বিরোধী দল সরকারকে ‘অবৈধ’ বলেও তাদেরকে সম্মান জানিয়ে সংলাপে সাড়া দিচ্ছে। এটা তো এক ধরনের ছাড়।  অর্থাৎ বিরোধীরা সংলাপ ও আন্দোলনের উভয় পথই খোলা রেখেছে। এমন কোনও ছাড়ের নজির এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষে রাখা হয়নি। সরকারকে এখন প্রমাণ করতে হবে যে, জনদাবির প্রতি তারা কতটুকু সম্মান জ্ঞাপনকারী ও সহানুভূতিশীল। এবং যে বিরোধী দল ও জোটের সঙ্গে তারা আলোচনা করবে, তার নেতৃবৃন্দকে হয়রানি বন্ধ করে এবং আটক শীর্ষ নেতাদের মুক্তি দিয়ে সংলাপে বসার সুযোগ দিতে সঙ্কট মোচনে তারা কতটুকু সদিচ্ছা পোষণ করেন। কারণ, নেতাদের ছাড়া কর্মীরা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আন্তরিক সংলাপ অনুষ্ঠানের জন্য উল্লেখিত কাজগুলো সম্পন্ন করার মাধ্যমে সরকারকে বিরোধী দলের আস্থা ও বিশ্বাসভাজন হতে হবে। বিশেষত রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলায় কারাবন্দি শীর্ষ নেতাদের মুক্তির ব্যাপারে সরকার এখন পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বরং দেশ-বিদেশে সমালোচিত বিচার প্রক্রিয়াকে একদল পথভ্রষ্ট নাস্তিক-মুরতাদ-দেশবিরোধী তরুণের সাজানো চাপের মাধ্যমে জোরদার ও ন্যায়ভ্রষ্ট করা হচ্ছে। সরকার এখনও ব্যাপক জনতার দাবি আর ক্ষুদ্র কুচক্রীদের দাবির মধ্যে পার্থক্য করতে পারছে না। বরং অতিক্ষুদ্র ও নিন্দিত কুচক্রীদের দোসর হয়েই তারা পরিস্থিতিকে রসাতলে পাঠাচ্ছে। এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের জন্য খোদ সরকারেরই বিরাট ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। দেশব্যাপী যেভাবে গণআন্দোলন সূচিত হচ্ছে, সেটার কবল থেকে সরকারকে ক্ষুদ্র কুচক্রীরা রক্ষা করতে পারবে না।
প্রসঙ্গত পাকিস্তানের সাবেক স্বৈরাচার আয়ুব খান যদি আলোচনার স্বার্থে চরম রাজনৈতিক শত্রু শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়ার নজির স্থাপন করতে পারে; তাহলে বর্তমান শাসকরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মুক্তি দিয়ে আলোচনা করতে পারবে না কেন? তাছাড়া বিশেষ আদালত, বিশেষ বিচারিক ব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে বিশেষ একটি দল (জামায়াত)-এর নেতাদের বেছে বেছে শাস্তি দেয়ার উদ্যোগ যেখানে সর্বমহলে সমালোচিত, সেখানে তাদেরকে মুক্তি না-দেয়ার তো কোনও কারণ থাকতে পারে না। সমঝোতা ও সংলাপে বিশ্বাসী হলে এবং অর্থবহ সমাধান চাইলে কারাবন্দি শীর্ষ নেতাদের অতিদ্রুত মুক্তি দিয়ে সরকারকে সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে হবে।
৩.
দেশের ভয়ানক ক্রান্তিকালে এখন নিম্ন পর্যায়ে কথা-বার্তা বা কালক্ষেপনের বিন্দু মাত্র ফুরসত নেই। সব কিছু করতে হবে শীর্ষ ও সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কেননা, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এবং পরিস্থিতিও ছাই-চাপা আগুনের মতো হয়ে অচলাবস্থার শেষ প্রান্তে অবস্থান করছে; যেখানে রয়েছে অনিশ্চয়তার ঘোরতর কালো অন্ধকার। পুরো দেশ ও জাতিকে অচলাবস্থায় রেখে অন্ধকার অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়া যায় না। ফলে এখন শীর্ষ পর্যায়ে সিদ্ধান্তমূলক আলোচনা একান্ত জরুরি বিষয়। এক্ষেত্রে বিএনপি, আওয়ামী লীগ তথা সরকার ও বিরোধী জোটের শীর্ষ নেতৃত্বকে মুখোমুখি বসতে হবে। এই পরিস্থিতিতে একদলীয় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শক্তি জামায়াত শীর্ষ নেতৃত্বহীন অবস্থায় আছে। এরশাদের বিরুদ্ধে যখন তিনজোট ও জামায়াত যুগপদ আন্দোলন করেছে, তখন জামায়াতসহ সকলেই শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা, সংলাপ ও যোগাযোগ করেছে। যে কারণে স্বৈরশাহী এরশাদকে হটিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করে গণতন্ত্রের নবঅভিযাত্রা সম্ভব হয়েছিল। আজকে যখন জাতীয় প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের ঐতিহাসিক আন্দোলন চলছে, তখন অত্যন্ত বিদ্বেষমূলক কারণে তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলনের আদি নেতৃবৃন্দ কারাগারে আটক রয়েছেন। সেদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন জামায়াতের তৎকালীন আমির অধ্যাপক গোলাম আযম। আন্দোলনের মাঠে সরব ছিলেন জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং তৎকালীন ঢাকা মহানগর আমির আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদ। রাজনৈতিক যোগাযোগ ও লিয়াজোঁর কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা। গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও কুরআনের মর্যাদার জন্য বাংলার পথে-প্রান্তরে, আনাচে-কানাচে জনমত গঠন করেছিলেন গণমানুষের নন্দিত কণ্ঠস্বর মুফাসসিরে কুরআন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। নব্বই-এর সেই আন্দোলনের পর আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে শেখ হাসিনা নিজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে। সেই আন্দোলনে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সাথী ছিলেন জামায়াত নেতৃবৃন্দ। আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদসহ জামায়াতের বহু নেতা-কর্মী সেই আন্দোলনে কারা নির্যাতন ভোগ করেন। শত-শত নেতা কর্মী হতাহত হন। জামায়াত ও শিবির অকাতরে আন্দোলন করে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করেন। সেই শেখ হাসিনা যখন নিজের নেতৃত্ব দেয়া তত্ত্বাবধায়ক দাবি থেকে সরে এসে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করতে উদ্যত হন, জামায়াত তখনও সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করে। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের এই হলো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। দেখা যাচ্ছে, এদেশের গণতন্ত্রের প্রয়োজনে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী এবং এর নেতৃবৃন্দ অবিচল ভূমিকা পালন করেছেন। এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থার বিকাশে অব্যাহতভাবে ঐতিহাসিক অবদান রেখে চলেছেন।
বর্তমানে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলন চলছে তখন এ আন্দোলনের সূচনাকারী, আদি ও অগ্রণী নেতৃবৃন্দ প্রায়-সকলেই কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের শাস্তিমূলক রায়ও ঘোষিত হয়েছে। একদিকে যখন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার আন্দোলন আর অন্যদিকে এ্ আন্দোলনের মূল চিন্তাবিদ ও নেতৃত্বের তখন কারাভোগ এক সামঞ্জস্যহীন ঘটনা। এর ফলে রাজনৈতিক সঙ্কট মোচনে শীর্ষ স্থানীয় জাতীয় নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণের পথ রুদ্ধ করা হয়েছে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আন্দোলনের আদি ও অভিজ্ঞ নেতৃবৃেন্দর অবদানকে নস্যাৎ করা হয়েছে। কোনও কার্যকরী ও অর্থবহ সংলাপ বা সমঝোতার জন্য উভয় ব্যবস্থাই ক্ষতিকর। তাছাড়া আমরা যখন সংলাপ ও সমঝোতার কথা বলি তখন সেটা বিভিন্ন পক্ষের মধ্যেই সম্পন্ন হওয়ার তাগিদ প্রদান করি। একটি পক্ষকে কোণঠাসা ও বন্দি রেখে সংলাপ বা সমঝোতা হলে সেটা সকল পক্ষের মধ্যে হয়েছে, তা-ও বলা যায় না এবং নৈতিক ও আইনগতভাবে সিদ্ধ হয়েছে বলেও উল্লেখ করা যাবে না। এ অবস্থায় অর্থবহ ও কার্যকর সংলাপ এবং সমঝোতার জন্য জামায়াতের নেতৃবৃন্দের মুক্তি অপরিহার্য পূর্বশর্ত।  
১৮ দলের নেতৃত্ব দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া যে আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতিতে নিয়ে এসেছেন, সেখানে শত শত জামায়াত-শিবির কর্মী জীবন দিয়েছেন; আন্দোলনকে ধরে রেখেছেন হাজার হাজার কর্মী এবং বেগবান করেছেন লক্ষ লক্ষ সমর্থক। সরকারের দলীয় ও প্রশাসনিক বাহিনীর চরম আক্রমণের মুখেও এই সংগঠিত জনশক্তি বিরোধী দলের আন্দোলন-সংগ্রামকে সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়েছেন। জোট নেত্রী এই বিশাল কর্মী-সমর্থক বাহিনীর আবেগ ও হৃদস্পন্দন নিশ্চয় অনুধাবন করবেন। তিনি কখনই জোটের নির্যাতিত নেতাদের প্রতি যে জুলুম-নির্যাতন করা হয়েছে, সেটাকে ভুলে যাবেন না এবং তাকে বিবেচনায় রেখেই আন্দোলন ও সংলাপের রূপরেখা প্রণয়ন করবেন। তিনি অবশ্যই চাইবেন, তাঁর নেতৃত্বাধীন ১৮টি গণতন্ত্রমনা দল তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের অংশগ্রহণে চলমান আন্দোলনকে জোরদার ও সফল করবে এবং জোট নেত্রী হিসাবে তাঁর শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। ফলে বন্দি জামায়াত নেতৃবৃন্দ মুক্ত হলে তাঁর শক্তি প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে। তাঁর সংগ্রামের সাফল্যের সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হবে।
শেখ হাসিনার পক্ষে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দিয়ে আলোচনা-সংলাপ-সমঝোতার পথ উন্মুক্ত করা আরও সহজ। তাঁর সংগ্রামী পিতার জীবনেই এ রকম বহু ঘটনা ঘটেছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ মাথায় নিয়েই তাঁর পিতা আয়ুব খানের বন্দি দশা থেকে মুক্তি পেয়ে নানা সংলাপ-আলোচনা ও সমঝোতা প্রচেষ্টায় অংশ নিয়েছিলেন। দেশ-বিদেশের পর্যবেক্ষণ ও আইনের কার্যক্রম দৃষ্টে জামায়াত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে পরিচালিত মামলার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আজ আর কারও কাছে অজানা নয়। ইতিহাসের নানা পর্যায়ে ষড়যন্ত্রমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার শেষ পরিণতি একই রকম হয়েছে। হয় জনতা এসব মামলা আন্দোলনের তোড়ে ভাসিয়ে দিয়েছে; নয়তো সরকার আপস ও সমঝোতার লক্ষ্যে মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। এই দুই ঐতিহাসিক বিকল্পের বাইরে অন্য কোনও পন্থা অবলম্বন করা হলে সেটা সংলাপ-সমঝোতার প্রেক্ষাপটে আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়াতে পারে। অতএব সরকার যদি আসলেই সংলাপ ও সমঝোতা চায়, তাহলে জামায়াতের কারা নির্যাতিত নেতৃবৃন্দের মুক্তি দিয়ে সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়েই সেটা চাইবে।
৪.
বাংলাদেশ ও বিশ্বের সকলের মতো আমরা অবশ্যই বিশ্বাস করি, সংঘাত নয়, সমঝোতাই সঙ্কট উত্তরণের একমাত্র পথ। সমঝোতার জন্য প্রয়োজন পরিবেশ, উদারতা। বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা সাদা মানুষদের কারাগারে ২৭ বছর বন্দি থেকেও তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে কেবল দেশটির নেতাই হন নি, তাবৎ বিশ্বের নেতায় রূপান্তরিত হয়েছেন। সংলাপ ও সমঝোতার অর্থই হলো প্রতিপক্ষের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে সৌহার্দ্য বিস্তার করা। এই সৌহার্দ্যকে বাদ দিয়ে হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিপক্ষ নিধনে মদমত্ত হলে সংলাপ বা সমঝোতার সুযোগই থাকে না। যে সরকার দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বাড়িছাড়া করেছে, তাঁর পুত্র তরুণ নেতা তারেক রহমানকে দেশছাড়া করেছে, প্রতিপক্ষকে হত্যা-নির্যাতন-বন্দি করেছে, সে সরকারকে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমা ঘোষণা করে তাদের সঙ্গে সমঝোতার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বেগম জিয়া রাষ্ট্রনায়কোচিত উদারতা ও মহত্ত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশ ও উন্নত বিশ্বের গণতন্ত্রের সংগ্রামের ইতিহাসে বেগম জিয়ার এই স্মরণীয় অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। দেশ ও জাতিকে সংঘাত ও বিভেদের কবল থেকে উত্তরণের জন্য বেগম জিয়ার ত্যাগ এবং সমঝোতা ও সমন্বয়ের উদ্যোগ ইতিহাসের সত্যরূপে চিহ্নিত হবে। এখন শেখ হাসিনাকেও উদার, সার্বজনীন মনোভাবের পরিচয় দিতে হবে। কারাবন্দি নেতাদের মুক্তি দিয়ে আলোচনার টেবিলে নিয়ে এসে সমঝোতার পথ বের করতে হবে। তাহলেই সঙ্কট সমাধানে তাঁর কৃতিত্ব প্রমাণিত হবে। সকলের মতো তাঁকেও এ সত্য অনুধাবন করতে হবে যে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার আন্দোলনের আদি ও অগ্রণী নেতাদের কারাবন্দি রেখে এ সংক্রান্ত অর্থবহ সংলাপ বা সমঝোতা সম্ভব হবে না। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটেরও অবসান হবে না। সকলের মধ্যে বাস্তবসম্মত চিন্তার উদয় ও সূত্রপাত হলেই বিদ্যমান অচলাবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটবে। নচেৎ আন্দোলন-সংগ্রামের পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকে, সেটা কেউই আগাম বলতে পারবে না। পরিস্থিতি এখন একেবারেই খাদের শেষ কিনারে চলে এসেছে। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে অতিদ্রুত। চলমান সঙ্কট-সমস্যা ঘনীভূত হয়ে ক্রনিক হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আশু বোধোদয় ও শুভ বুদ্ধির উন্মেষ ঘটলেই দেশ-জাতি-সমাজ-মানুষ নিস্তার পাবে। সবাই শান্তি ও সুস্থিরতার সন্ধান পাবে। আশাবাদী মানুষ এখনও এমনভাবেই ইতিবাচক চিন্তা করছে। এবং প্রত্যাশা করছে ইতিবাচকতা সকলের মধ্যে বিস্তার লাভ করুক। এই ইতিবাচক প্রত্যাশাকে নস্যাৎ করে নেতিবাচক, হিংসাত্মক, আক্রমণাত্মক ও প্রতিপক্ষ নিধনমূলক আচরণ ও মানসিকতা বিজয়ী হলে পরিণতি কারও জন্যই মঙ্গলময় হবে না।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

দুই নেত্রীর টেলিসংলাপ এবং সংবিধান ও আইনের নির্দেশনা


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার টেলিসংলাপ নিয়ে অপরাজনীতির চেষ্টা চালাতে গিয়ে ক্ষমতাসীনরাই উল্টো ফেঁসে গেছেন বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন জোর আলোচনা চলছে। কারা এই সংলাপ প্রকাশ করেছে ক্ষমতাসীনদের বিভিন্ন বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সে জিজ্ঞাসারও উত্তর বেরিয়ে এসেছে। একই সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সংবিধানের নির্দেশনা লংঘন এবং তথ্য-প্রযুক্তি আইন অমান্য করার গুরুতর অভিযোগও উঠেছে। কারণ, আইন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদের (খ) উপ-অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের চিঠি-পত্র ও যোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লেই কেবল সরকার কারো টেলিসংলাপ রেকর্ড করতে পারে। সেদিক থেকে দুই নেত্রীর টেলিসংলাপ অবশ্যই রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকির পর্যায়ে পড়ে না। তা সত্ত্বেও প্রধানত অশুভ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রেকর্ড ও প্রচার করার মধ্য দিয়ে কেবল সংবিধানই লংঘন করা হয়নি, তথ্য-প্রযুক্তি আইনও অমান্য করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালের তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৬৩ (১) ধারায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সম্মতি বা অনুমতি না নিয়ে এ ধরনের কোনো কিছু রেকর্ড বা প্রচার করাকে ‘দ-নীয় অপরাধ’ বলা হয়েছে। তাছাড়া চলতি বছর তথ্য-প্রযুক্তি আইনে সংশোধনী এনে এ সংক্রান্ত অপরাধগুলোকে আমলযোগ্য ও জামিনের অযোগ্যও করেছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সব মিলিয়েই টেলিসংলাপ যারা রেকর্ড এবং প্রকাশ ও প্রচার করেছেন তাদের বিরুদ্ধে সংবিধান ও তথ্য-প্রযুক্তি আইনের অধীনে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তারা দ-নীয় অপরাধ করেছেন। বলা দরকার, এ ব্যাপারে প্রথম থেকেই আঙুল উঠেছে ক্ষমতাসীনদের দিকে। কারণ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু থেকে ‘কালো বিড়াল’ নামে পরিচিত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তো বটেই, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হাছান মাহমুদ এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ পর্যন্ত অনেকেই বলেছেন, দুই নেত্রীর এই টেলিসংলাপ নাকি ‘রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি’ এবং সে কারণে তা প্রকাশ ও প্রচার করা এবং জনগণকে জানতে দেয়া উচিত। এ ব্যাপারে সবশেষে জানান দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।  গত বুধবার গণভবনে অনুষ্ঠিত এক দলীয় সমাবেশে কোনো লুকোছাপা না করে তিনি বলেছেন, বিএনপির তরফ থেকেই অনেক কিছু নাকি পত্রিকায় ছাপিয়ে দেয়া হয়েছিল।  সেজন্যই প্রধানমন্ত্রী মনে করেছেন, সংলাপের পুরোটাই মানুষের শোনা ভালো। 
বিষয়টি দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের বলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথার পিঠে কথা বাড়ানোর পরিবর্তে এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার, ঘটনাপ্রবাহে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে ক্ষমতাসীনরাই ওই টেলিসংলাপ রেকর্ড এবং প্রকাশ ও প্রচার করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কারণ, সরকারের বিশেষ আয়োজন ও নির্দেশনা ছাড়া দুই নেত্রীর টেলি-সংলাপ রেকর্ড করা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। যে সংস্থা বা দফতরই করে থাকুক না কেন, তাদের দিয়ে সরকারই করিয়েছে। তাছাড়া কয়েকজন মন্ত্রী ও নেতার বক্তব্য থেকেও বোঝা যাচ্ছে, এর পেছনে আসলে ক্ষমতাসীনরাই ছিলেন। আমরা বিষয়টিকে গুরুতর মনে করি। কারণ তারা শুধু ‘রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি’ বলে দুই নেত্রীর টেলি-সংলাপ প্রচার করেননি, করেছেনও যথেষ্ট সতর্ক সম্পাদনার পর। অভিযোগ উঠেছে, সম্পাদনার কাঁচি বেশি চালানো হয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেও তাকে রীতিমতো খলনায়িকা বানিয়ে ফেলার ন্যক্কারজনক চেষ্টা করেছেন তারা। এজন্যই খালেদা জিয়ার কথাগুলো অনেক বেশি জোরে শোনা গেছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীকে মনে হয়েছে বিড়াল ছানার মতো মিউ মিউ করছেন তিনি। তাই বলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবশ্য খুব সুবিধা করতে পারেননি। কারণ, হরতালের মতো গণতন্ত্রসম্মত কর্মসূচি সাংবিধানিক অধিকার হলেও তার সরকার প্রথম থেকেই কঠোরভাবে দমন করার পদক্ষেপ নিয়েছে। হরতাল তো বটেই, বিরোধী দলগুলো এমনকি মিছিল-সমাবেশ ও মানববন্ধন পর্যন্ত করতে পারছে না। প্রতিটি কর্মসূচিতে পুলিশ ও র‌্যাবের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গু-া-সন্ত্রাসীরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ৬০ ঘণ্টার হরতাল চলাকালেও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হাত-পা ভেঙে ফেলার হুকুম জারি করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পরপর প্রধানমন্ত্রী নিজেও তার দলের নেতা-কর্মীদের রাজপথে পুলিশের ‘সঙ্গে সঙ্গে থাকার’ এবং পুলিশকে ‘সহযোগিতা করার’ হুকুম জারি করেছেন। এই ‘সহযোগিতা’ কীভাবে করা হবে এবং কীভাবে অনেক আগে থেকেই করা হচ্ছে সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। একই কথা বলা যায় প্রধানমন্ত্রীর অন্য একটি জিজ্ঞাসার জবাবেও। কারণ,  দেশের মানুষও দেখেছে, ৬০ ঘণ্টার হরতাল চলাকালে ‘অনেক মায়ের কোল’ কারা খালি করেছে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী যতোই ‘ধৈর্য’ ধরার কথা শোনাতে চান না কেন, মানুষ হত্যা আসলে কার ‘একমাত্র খেলা’ সে কথাটা দেশের মানুষ ভালোভাবেই জেনেছে। তাছাড়া টেলিসংলাপের কোনো পর্যায়েই খালেদা জিয়া ‘একেকবার একেক কথা’ বলেননি, ‘কন্ডিশন’ও নানা রকমের দেননি তিনি। বিরোধী দলের নেত্রী মূলত দুটি মাত্র কথাই বলেছেনÑ এক. ১৮ দলীয় জোটের নেতারা যেহেতু পুলিশের ধাওয়ার মুখে রয়েছেন সেহেতু একবারে শেষ মুহূর্তে তার একার পক্ষে হরতাল প্রত্যাহার করে প্রধানমন্ত্রীর দাওয়াত রক্ষা করা সম্ভব নয়। এবং দুই. প্রথমে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীকে নীতিগতভাবে সম্মতি জানাতে হবে। এই সম্মতি জানালেই খালেদা জিয়া ৬০ ঘণ্টার হরতালের পর যে কোনোদিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি আছেন। এখানে ‘একেকবার একেক কথা’ বললেন কখন বেগম জিয়া? ‘কন্ডিশন’ও তো মাত্র একটাই দিয়েছেন তিনিÑ সেটা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নে নীতিগতভাবে সম্মতি জানানোর জন্য। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী এই কন্ডিশনের ব্যাপারে ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে রেখেছেন, একটি কথাও বলেননি।
সব মিলিয়েই টেলিসংলাপের মধ্য দিয়ে তেমন কিছু অর্জন করতে পারেননি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। লাল টেলিফোন নিয়ে মিথ্যাচার করা থেকে খালেদা জিয়াকে অভিযুক্ত করা এবং সংবিধান ও তথ্য-প্রযুক্তি আইন লংঘন করে টেলিসংলাপ প্রকাশ করে দেয়া পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে তিনি বরং পরাজিত ও নিন্দিত হয়েছেন। এসব নিয়ে কথা বাড়ানোর পরিবর্তে আমরা শুধু বলতে চাই, সংবিধান এবং তথ্য-প্রযুক্তি আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া দরকার, যারা দুই নেত্রীর ব্যক্তিগত টেলিসংলাপ রেকর্ড ও প্রকাশ করেছে। সে ব্যবস্থা না নেয়া হলে জনগণ একথাই জানবে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য একই দেশে দু’ রকমের আইন প্রয়োগ করে চলেছে সরকার।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

যে কারণে সরকার এত অনীহ


সিরাজুর রহমান
আপনাদের মনে আছে কি ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের কথা? সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দারুণ মার খেয়েছিল। শেখ হাসিনা তার স্বভাবসুলভ রূঢ় ভাষায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং রাষ্ট্রপতিকে গালাগাল করেছিলেন। নির্বাচনে জয়ের নীলনকশা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকার গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী পদগুলোতে নিযুক্ত আমলাদের নিয়োগ ও বদলি করেছিল। প্রধান উপদেষ্টা হয়েই বিদায়ী প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান সেসব আমলার মধ্যে মাত্র ১২ জনকে আবার বদলি করেন। তখন থেকেই শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ মরা কাঁদুনি শুরু করেন। বিদায়ী সরকার দুর্নীতিপূর্ণ পন্থায় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার যে ষড়যন্ত্র করেছিল সেটা সবার কাছে ফাঁস হয়ে যায়। 
দেশবাসী সবচেয়ে মর্মাহত হয়েছে, রাষ্ট্রপতিকে গালাগাল করতে গিয়ে শেখ হাসিনা যে ভাষা ব্যবহার করেছিলেন তাতে। হাসিনা বিচারপতি লতিফুর রহমান ও রাষ্ট্রপতিকে বিশ্বাসঘাতক বলেও গালি দিয়েছিলেন। অথচ সে রাষ্ট্রপতি ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে গদিচ্যুত সামরিক স্বৈরশাসক লে. জে. এরশাদ তার কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে তখন তিনি যেভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং যেভাবে ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করেছেন দেশে ও বিদেশে সবাই তখন তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং মনে রাখতে হবে যে, ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনাই বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য মনোনীত করেছিলেন। 
আশা করি আপনাদের আরও মনে আছে, নির্বাচনে পরাজিত হয়েও শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনের দখল ছাড়তে রাজি ছিলেন না। নানা অছিলায় তিনি কেবলই কালক্ষেপণ করছিলেন। শেষপর্যন্ত যেভাবে তাকে প্রায় টানাহেঁচড়া করে গণভবন ছাড়তে বাধ্য করা হলো, সেটা অনিচ্ছুক পাঁঠাকে বলি দেবার যূপকাষ্ঠে নিয়ে যাওয়ার সাথে তুলনা করা যেত। 
একটা মাস্টারপ্ল্যানের সাজানো নির্বাচনে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা প্রথমেই বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে তার দীর্ঘকালের পারিবারিক বাসভবন থেকে বের করে দেয়ার জন্য অত্যন্ত অশোভনভাবে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তখন আমার ২০০১ সালের গণভবনের ঘটনাটি বারবার মনে পড়ছিল। হাসিনা গণভবন ছাড়তে রাজি ছিলেন না। ভবনটা অবশ্যই তার ভালো লেগেছিল। সেটা সে ভবনের স্থপতি ও প্রকৌশলীদের প্রতি প্রশংসার কারণে ছিল না। হাসিনা নিজেকে বাংলাদেশের রানী ও সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার মতো বলেই মনে করেন। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের মসনদ তার পৈতৃক সম্পত্তি। এ সম্পত্তিতে আর কারো অধিকার নেই। সুতরাং তার পছন্দের বাড়ি গণভবন বরাবরই তার নিবাস হবে। 
ঘুরেফিরে নাটকের সে অঙ্কটি আবার ফিরে এসেছে। সবার কাছেই এখন স্পষ্ট, এ সরকার গদিতে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। জনগণ অনেক দিন আগেই অনানুষ্ঠানিকভাবে তাকে ও তার সরকারকে বিদায় দিয়েছে। আনুষ্ঠানিক বিদায়ের প্রক্রিয়া নির্বাচনটা শেখ হাসিনা ঠেকিয়ে রাখছেন। মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তাকে আবারো গণভবন ছাড়তে হবে। সে সম্ভাবনাকে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। শেখ মুজিবের মেয়ে তিনি, তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকবেন না, এটা কী করে হতে পারে? গণতন্ত্রকে মনে মনে তিনি অনবরত শাপ-শাপান্ত করছেন। মুখ ফুটে অবশ্যি বলা যাবে না। নানা ধানাইপানাই তিনি করছেন সেজন্য। যেকোনোভাবেই হোক অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা প্রয়োজন। তেমন অবস্থায় নীলনকশা আর মাস্টারপ্ল্যানগুলোকে কাজে লাগানো যাবে। 

ভারত-আওয়ামী লীগ ষড়যন্ত্র 
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সব দেশের প্রস্তাবই নাকচ করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এমনকি বিরোধী দলের সাথে সংলাপের ব্যাপারে জাতিসঙ্গকেও উপেক্ষা করেছেন। এখন তার একমাত্র ভরসা ভারত। অনেক কিছু পেয়েছে ভারত গত পাঁচ বছরে। আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং আমাদের জমিজমাও (ভৌগোলিক এলাকা) পুরোপুরি সাফকবলা না হলেও অন্তত বর্গা নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু পুরোপুরি কবলা না হওয়া পর্যন্ত ভারতকে শেখ হাসিনার ওপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে। যেকোনো মূল্যে ভারত তাই শেখ হাসিনাকে গদিতে রাখতে চায়। গোল্লায় যাক বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আর তাদের অবাধ ভোটদান! 
কিন্তু সফল হবে কি এই ভারত-আওয়ামী লীগ ষড়যন্ত্র? আমার মনে হয়, ‘না। আগে না হোক অন্তত বিগত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের মানুষ খেলাটা বুঝে গেছে। এখন তাদের বোধোদয় হয়েছে। দেশ বিক্রি করে গদি রাখা এখন আর তাদের সম্মানজনক মনে হয় না। তা ছাড়া মীর জাফরদের দাপট তো আর চিরদিন বজায় থাকতে পারে না। তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ আর ভোলাগঞ্জ থেকে মোরেলগঞ্জ পর্যন্ত দেশের সর্বত্র মানুষ লাখে লাখে খালেদা জিয়ার পেছনে কাতারবন্দী হয়ে প্রমাণ দিয়েছে যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ছাড়া কোনো সাজানো-পাতানো নির্বাচনে তারা বিশ্বাস করে না। সমস্যা হচ্ছে সেখানে। তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি আর নিরপেক্ষ নির্বাচনকে গণভবনের বর্তমান ভাড়াটিয়া যমের মতো ভয় করেন। 
প্রাণপণে গদির পায়া আঁকড়ে ধরে রক্ষা পেতে চাইছেন এ সরকার ২০০১ সালের মতো। দুনিয়ার সব দেশ, এমনকি জাতিসঙ্ঘও বলছে বিরোধীদের সাথে সংলাপ করো, সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে রাজি হও। সেগুলো বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর চোখে পড়ে না। তার দৃষ্টিশক্তি আঠা দিয়ে এঁটে আছে দিল্লির দিকে। দিল্লি গণতন্ত্র চায় নিজ দেশে, কিন্তু বাংলাদেশে নয়। তাদের ফতোয়া, বাংলাদেশের নির্বাচন হবে শেখ হাসিনার অধীনে; ফলাফল তো তৈরি করেই রেখেছেন তিনি। শেষ মুহূর্তে এসেও অসাধুতা আর ধূর্তামি দিয়ে পার পেতে চাইছেন তিনি। 
শুক্রবারের (২৫ অক্টোবর) জনসভায় খালেদা জিয়া ঘোষণা দিলেন, সেদিন এবং পর দিনের (২৫ ও ২৬ অক্টোবর) মধ্যেই অর্থবহ সংলাপে বসতে হবে, নইলে ২৭ তারিখ ভোর ৬টা থেকে লাগাতার হরতাল। সরকার ও গণভবন ২৫ তারিখে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। ২৬ তারিখ বিকেলে খবর দেয়া হলো প্রধানমন্ত্রী অনেক চেষ্টা করেও বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার সাথে টেলিফোন সংযোগ করতে পারেননি। খালেদার মিডিয়া সচিব মারুফ কামাল খান ব্যঙ্গ করে বললেন, ১২ হাজার মাইল দূরে নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ থেকে মহাসচিব বান কি মুন টেলিফোন করে খালেদা জিয়াকে পেলেন, আর ঢাকায় বসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি সেটাও করতে পারলেন না। 
পরে জানা গেল আসল রহস্যটা। বিরোধী দলের নেতার যে রেড টেলিফোন থাকে সেটা কয়েক মাস ধরেই অচল। (সরকার কি ইচ্ছা করেই অচল করে দিয়েছে?) খালেদা জিয়ার কার্যালয় থেকে সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগে বারবার যোগাযোগ করেও অচল লাল টেলিফোন সচল করা যায়নি। সেই অচল টেলিফোনেই প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতার সাথে নাকি কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে ঢাক পেটানো হলো শেখ হাসিনা সন্ধ্যা ৬টায় আবার খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করার চেষ্টা করবেন। সে চেষ্টা তিনি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার আগ পর্যন্ত করেননি। 

প্রধান অভাব সদিচ্ছার 
সেটাও যে সদিচ্ছার বশবর্তী হয়ে করা হয়েছিল তা নয়। কার্যত তার বক্তব্য ছিল : গণভবনে আসুন, খানাপিনা হবে, সংলাপ হবে, ইতোমধ্যে আপনি হরতালটা তুলে নিন। ঢাকার একটি টিভি-চ্যানেল এখন দুই নেত্রীর ৩৭ মিনিট স্থায়ী টেলিফোন কথোপকথনের বিবরণ প্রকাশ করেছে। স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ১৮ দলের জোটের নেত্রীকে বেকায়দায় ফেলে ৬০ ঘণ্টার হরতাল ঠেকানোই ছিল হাসিনার উদ্দেশ্য। বহু দেশের বহু নেতার একান্ত টেলিফোন সংলাপের খবর জানার সুযোগ আমার হয়েছে। কিন্তু সেসব আলাপের সময় টেলিভিশন ক্যামেরা চালু রাখার কথা এই প্রথমবার শুনলাম। প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলো টেলিভিশনে ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার কোনো ক্যামেরা ছিল না। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, বিরূপ প্রচারণা দিয়ে খালেদা জিয়াকে অপদস্থ করা, বেকায়দায় ফেলাই ছিল হাসিনার উদ্দেশ্যÑ দেশের সঙ্কটের অবসান নয়। 
কিন্তু সরকারের ফাঁস করা টেলিভিশন ছবিতেও প্রমাণ হয় যে, খালেদা জিয়া কাঁচা খেলোয়াড় নন। প্রধানমন্ত্রী তাকে ফাঁদে ফেলতে পারেননি। বর্তমানে গণভবনে মেহমানদারির বাজেট কয়েক কোটি টাকা। খালেদা জিয়ার সামর্থ্য বোধ হয় অত বেশি নয়। কিন্তু তিনি অনাহারে-অর্ধাহারে আছেন বলে শুনিনি। জিয়াফতের লোভে তিনি আত্মহারা হয়ে যাননি। পোলাও আর কোফতার সুঘ্রাণ নিয়ে আলোচনায় মজে যেতে তিনি চাননি। তিনি, তার দল ও জোট এবং বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক কথাটা যদি ভাশুরের নাম হয়, প্রধানমন্ত্রীর জিহ্বায় আটকায়, তাহলে অন্য যেকোনো নামে একটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতেও খালেদা জিয়া রাজি আছেন। কিন্তু সব আলোচনারই একটা ভিত্তি থাকা দরকার। ভিত্তিই যদি না থাকল তা হলে সংলাপ-সংলাপ খেলায় সময় নষ্ট করে কী লাভ? 

সরকারের আসল খেলা 
সরকারের আসল খেলাটা স্পষ্ট হতে দেরি হয়নি। খানাপিনার আগে খালেদা জিয়াকে ১৮ দলের লাগাতার হরতাল তুলে নিতে হবে। দেখুন তো! কী ঝামেলা! হরতাল ডেকেছে ১৮ দল। ১৮ দল তো আর বাকশাল নয়, আর খালেদা জিয়া তো বাকশালী মহাপ্রভু নন যে, তিনি এক কথায় সে হরতাল তুলে নেবেন। তা ছাড়া স্পষ্ট হয়ে গেল যে, খালেদা জিয়াকে বেকায়দায় ফেলতেই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে পারলেন না। আন্তরিকতা থাকলে তার আগে তিনি হেঁটেই চলে যেতে পারতেন খালেদা জিয়ার গুলশানের অফিসে! আসলে বিরোধী জোটের নেতাদের সাথে যাতে তিনি আলোচনার সময় না পান সে জন্য ইচ্ছা করেই অতি দেরিতে তাকে টেলিফোন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। 
ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। আঠারো দলের হরতাল যথারীতি হয়েছে। দেশ অচল ছিল। ব্যবসায়-বাণিজ্য অর্থনীতি তালাবন্ধ। দলীয়কৃত পুলিশ, বিডিআরের পরিবর্তে গড়া (দলীয়কৃত) বিজিবি আর আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের সরকার ময়দানে নামায় মন্ত্রীদের উক্তিমতো কঠোরহস্তে বিএনপির হরতাল ভণ্ডুল করতে। মিডিয়ায় ফটো ছাপা হয়েছে র‌্যাবের সাথে অপরিচিত (বিদেশী কি?) লোকেরাও একে ৪৭ রাইফেল নিয়ে গুলি চালাচ্ছে হরতালকারীদের ওপর। সরকারের লোকেরা বোমা ফাটাচ্ছে, আগুন লাগাচ্ছে, মানুষ খুন করছে। আর উল্টো দোষ চাপাচ্ছে হরতালকারীদের ওপর। মন্ত্রীরা যার যা খুশি উল্টোপাল্টা বিবৃতি দিচ্ছেন। তাদের সাথে মাঝে মাঝে ফুটুস কাটছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। আজেবাজে কথা বলার জন্য হানিফ বরখাস্ত হয়েছেন। এই মন্ত্রীগুলোকেও সে রকমই বরখাস্ত করা উচিত ছিল। সরকারের হাতে মিডিয়া আছে, আছে সরকারি প্রচারযন্ত্র এবং শূন্য ভাণ্ডের মতো বাকসর্বস্ব আর মাকাল ফলের মতো অপদার্থ পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি আছেন। দেশের মানুষ আর এই সরকার ও তাদের মন্ত্রীদের কোনো কথাই বিশ্বাস করে না। কিন্তু বিদেশীদের তারা বোঝাতে চাইবে তাদের সংলাপের প্রস্তাবে বিরোধী দলের নেতা সাড়া দেননি, তারা অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে, দেশের সর্বনাশ করছে ইত্যাদি ইত্যাদি। 
কিন্তু কোনো লাভ হবে কি গণভবনের ভিত্তিস্তম্ভ দুহাতে আঁকড়ে থেকে? গণজোয়ার দুর্বার হয়ে উঠেছে। বিদেশী সমর্থন আর বিদেশী দালালদের দিয়ে সে জোয়ার ঠেকিয়ে রাখা চলবে না। সরকার যদি ভালোয় ভালোয় বিদায় হতেন তা হলে দেশের সর্বনাশ কিছুটা কমানো যেত। খালেদা জিয়া ও ১৮ দলের নেতা-নেত্রীরা গণতন্ত্রের সংগ্রামে ব্যস্ত। সে সংগ্রামে বিজয়ের পর দেশকে এবং দেশের ইনস্টিটিউশনগুলোকে নতুন করে গড়ে তোলার চিন্তা করার সময় এখন তাদের নেই। কিন্তু চিন্তা কাউকে না কাউকে অবশ্যই করতে হবে। আসুন, চিন্তাগুলো আমরাই শুরু করি। 

দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ 
গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশে প্রকৃতই দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধ প্রথম মুক্তিযুদ্ধ থেকে মোটেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। একাত্তরে আমরা পাকিস্তানের দখলকার থেকে মুক্ত হতে, গণতন্ত্র স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব পেতে চেয়েছিলাম। প্রভু বদল করা মোটেই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। দুর্ভাগ্যবশত বর্তমান সরকারের আমলে গণতন্ত্র লাঠিপেটা খেয়ে পালাই পালাই করছে। আমাদের স্বাধীনতা ফিকে হয়ে গেছে, সার্বভৌমত্বেরও অনেকখানি হাতছাড়া হয়ে গেছে। আমাদের সড়ক, রেল, নদ-নদী, বন্দর সবই বিনামূল্যে ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। আমাদের সম্পদ খোলা ও চোরাপথে ভারতে চলে যাচ্ছে। 
হাজার হাজার, হয়তো লাখ লাখ ভারতীয় বিনা পারমিটে বিনা ভিসায় বাংলাদেশে বাস করছে, চাকরি করছে আয়কর না দিয়েই। তারা হয়তো চোরাগলি দিয়ে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংকেও ঢুকে গেছে। সবচেয়ে ভয়ের কথা, ভেতর থেকে তারা স্যাবোটাজ আর নাশকতা চালাচ্ছে, আমাদের তৈরী পোশাক শিল্প এবং অন্যান্য উৎপাদন যন্ত্রগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমাদের তৈরী পোশাক রফতানির বাজার এখন প্রতিবেশী দেশের হাতে চলে যাচ্ছে। অন্য দিকে সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশীদের অবলীলায় গুলি করে মারছে বিএসএফ। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিবাদ এরা কানে তুলছে না। মোট কথা, ভারতীয়রা বর্তমানে আমাদের সরকারের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরায়, কর্তালি করে। 
এসবই করা হচ্ছে এই আশায় যে, ভারতীয়রা কোনো-না-কোনোভাবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের মতো মাস্টারপ্ল্যানের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করবে, শেখ হাসিনাকে আবারো প্রধানমন্ত্রী করা হবে। তার পরিণতির কথা কেউ ভেবে দেখেছেন? বিগত প্রায় পাঁচ বছরে ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডোর ও ট্রানজিটের পথ এবং আমাদের সামুদ্রিক বন্দর দুটি ব্যবহারের অধিকার আদায় করে নিয়েছে। আমাদের অবকাঠামোগুলো এখন ভারতের নিয়ন্ত্রণে। ভারতের অনুগ্রহে এ সরকার যদি আবারো গদি পান তা হলে সম্ভবত বাংলাদেশকে সিকিমের মতো একটা করদ রাজ্যে পরিণত করা হবে। আমাদের স্বাধীনতা এখন সত্যি সত্যি বিপন্ন। 
বিএনপির নেতা বেগম খালেদা জিয়া ১৯৮২ সাল থেকে ৯ বছর ধরে সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে উৎখাত করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য আপসবিহীন সংগ্রাম করেছেন। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এর বেশির ভাগ সময়ই জেনারেল এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সাথে সহযোগিতা করেছেন। না হলে গণতন্ত্রের সংগ্রাম আরও স্বল্পস্থায়ী হতে পারত। বিএনপি এবং বেগম জিয়াকে বর্তমানে সংগ্রাম করতে হচ্ছে আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের জনসাধারণ যেভাবে তার পেছনে কাতারবন্দী হয়েছে তাতে মনে হয় অবশ্যই তিনি ১৯৯০ সালের মতো স্বৈরতন্ত্রকে পর্যুদস্ত করতে পারবেন, ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারির মতো গণতন্ত্রকে বিজয় দিতে পারবেন। 
কিন্তু শত্রু এবারে সংখ্যায় ভারী এবং আন্তর্জাতিক একটা ষড়যন্ত্র জাল তারা ছড়িয়ে রেখেছে। আমরা যারা দেশে কিংবা প্রবাসে আছি, আমরা সম্মিলিতভাবে খালেদা জিয়ার আন্দোলনে সক্রিয় এবং সোৎসাহ সমর্থন দিতে আত্মীয়-বন্ধুদেরও প্রভাবিত করতে পারি। প্রবাসে আমরা গণতন্ত্রের সপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে পারি, রাজনীতিকদের ও মিডিয়া সমর্থন সংগ্রহ করতে পারি। তা হলে এবারেও আমরা গণতন্ত্রের সংগ্রামকে জয়যুক্ত করতে পারব। 

গণতান্ত্রিক সরকারের প্রায়োরিটি কর্তব্য 
কিন্তু কর্তব্যের এখানেই শেষ নয়। বিজয় দিবসের পরবর্তী বছরগুলোতে আমাদের স্বাধীনতাকে সংহত করা হয়নি। ইউফোরিয়া, স্তবস্তুতি আর ফুলের মালা দিয়ে নেতাকে বুঁদ করে রাখা হয়েছিল। সে অবকাশে দেশের সম্পদ লুণ্ঠিত হয়েছে, বাকস্বাধীনতা স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে, গণতন্ত্র আর গণতন্ত্রীদের হত্যা করা হয়েছে। নিজের চোখে দেখা পরিস্থিতি থেকে বলতে পারি বাহাত্তরে যারা শেখ মুজিবুর রহমানকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছিল তাদের সবাই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিও ছিল না। আর এ কথাও সত্যি যে, স্তবস্তুতি যদি পুরস্কৃত হয় তাহলে দেশপ্রেম পিছিয়ে যায়। এবার যখন গণতন্ত্রের সংগ্রাম জয়ী হবে অতীতের ভুলের যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় সেদিকে এখন থেকেই মনোযোগ দিতে হবে। গদির লোভে নেতানেত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্যই যারা রাজনীতি করেন তাদের সম্বন্ধে পরবর্তী সরকারের নেতাদের বিশেষ সতর্ক হতে হবে। একাত্তরে যারা নিজের শ্রম, নিজের সময় ও নিজের সম্পদ দিয়ে মুক্তিসংগ্রাম করেছেন আমার জানা মতে তাদের অনেকে আজো যথাযোগ্য স্বীকৃতি পাননি। অন্য দিকে ঘটা করে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে ভুল লোকেদের, এমনকি মুক্তিযুদ্ধে যারা এক পাশে সরে গেছে তাদেরও। এবারেও দেশে এবং প্রবাসে কারো কারো কথা জানি যারা সমান আন্তরিকতা নিয়ে গণতন্ত্রের সংগ্রামে কাজ করেছেন। প্রকৃত এবং আন্তরিক কর্মীরা যদি পুরস্কৃত না হন তাহলে ভবিষ্যতে কেউ দেশের জন্য প্রাণ দিতে এগিয়ে আসবে না। ছলনা দিয়ে যারা পুরস্কৃত হয়, পদে পদে তারা প্রতারণা করবেই। 
প্রথমেই ২০১০ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা দিল্লিতে গিয়ে যে গোপন চুক্তিগুলো করে এসেছিলেন সেগুলো নির্বাচিত সংসদে পেশ করতে হবে। চুক্তিগুলোর যেসব অংশ আমাদের জাতীয় স্বার্থের অনুকূল সেগুলো অবশ্যই রাখা হবে। কিন্তু যেসব চুক্তি আমাদের জাতীয় স্বার্থের কিংবা আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতিকূল বিবেচিত হবে সেসব চুক্তি অথবা চুক্তির ধারা স্বাক্ষরের তারিখ থেকেই বাতিল করে আইন পাস করতে হবে। 
বাংলাদেশে ন্যায়বিচার অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকারকে অবিলম্বে একটা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে যেসব বিচারক পক্ষপাতদুষ্ট তাদের দায়িত্বচ্যুত করতে হবে। 
অবৈধভাবে অভিজ্ঞ সিনিয়র কর্মকর্তাদের ডিঙিয়ে ডবল কিংবা ট্রিপল পদোন্নতি দিয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের প্রশাসন, পুলিশ, ডিজিএফআই এবং এনএসআই প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রযন্ত্রে স্থাপন করা হয়েছে। একটা প্রশাসনিক কমিশন গঠন করে তাদের খুঁজে বের করতে এবং অপসারণ করতে হবে। 
বর্তমান সরকারের আজ্ঞাবহ দুর্নীতি দমন কমিশন ভেঙে দিয়ে উপযুক্ত এবং নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নতুন একটা দুদক গঠন করতে হবে। বিগত পৌনে পাঁচ বছরের ব্যাপক দুর্নীতি সম্বন্ধে তদন্তের জন্য একটা জাতীয় কমিশন গঠনের প্রয়োজন হতে পারে। তবে সেসব দুর্নীতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি এবং সংশ্লিষ্ট অর্থ রাষ্ট্রীয় তহবিলে ফেরত আনার ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। 
নির্বাচন কমিশনও পুনর্গঠনের প্রয়োজন হতে পারে। সরকারের ভোট ব্যাংকের ভোটার তালিকার মধ্যে লাখ লাখ ভারতীয় নাগরিক আছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সম্যক তদন্ত করতে হবে। 
নতুন গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর সীমিত সময়ের মধ্যে প্রারম্ভিকভাবে উপরোল্লিখিত ব্যবস্থাগুলো নেয়া হলে প্রশাসনের ওপর জনসাধারণের আস্থা ফিরে আসবে এবং জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় সরকারের যাত্রাপথ সুগম হবে। 

সুষ্ঠু মিডিয়ানীতি 
আমি আগেও লিখেছি বিএনপির বড় দুর্বলতাগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে সুষ্ঠু মিডিয়ানীতি ও মিডিয়া সম্বন্ধে সম্যক উপলব্ধির অভাব। এ দলের কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি মিডিয়ার সমর্থন ছাড়াও বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। কিন্তু তারাও অবশ্যই স্বীকার করবেন, ক্ষমতা পাওয়ার জন্য না হলেও ক্ষমতা রাখার জন্য মিডিয়া সমর্থন অত্যাবশ্যকীয়। শেখ হাসিনার পূর্ববর্তী সরকার এবং বর্তমান সরকারের আমলেও একটা অনুগত মিডিয়া গঠন ও লালন করার যথাসাধ্য চেষ্টা হয়েছে। আওয়ামী লীগ মিডিয়ার গুরুত্ব বোঝে। বিরোধী মিডিয়াকে ধ্বংস করার কোনো সুযোগ তারা ছাড়ে না। তাদের আন্দোলনের ফসল বর্ণচোরা সামরিক সরকারের আমলে যায়যায়দিন পত্রিকাটি বেহাত করা হয়েছিল এ লক্ষ্যেই। 
বর্তমান ও পূর্ববর্তী সরকারের আমলে তারা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় অনুগত টেলি-চ্যানেল চালু করেছে। অন্য দিকে বিরুদ্ধ মতাবলম্বী টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্রিকা বন্ধ করা আওয়ামী লীগের মৌল আদর্শের অন্তর্ভুক্ত। এরা জানে মুক্ত ও স্বাধীন মিডিয়াকে প্রশ্রয় দেয়া হলে তাদের স্বৈরতন্ত্রী শাসন সম্ভব হবে না। সে কারণেই বাকশাল প্রতিষ্ঠার প্রারম্ভেই শেখ মুজিব চারখানি সরকারি পত্রিকা ছাড়া অন্য সব পত্রপত্রিকা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। ঠিক একই লক্ষ্যে বর্তমান সরকার গদি লাভের প্রায় প্রথম দিন থেকেই বিরোধী মিডিয়ার কণ্ঠরোধের কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল। মিডিয়ায় সমালোচনা বন্ধ করার কোনো চেষ্টা এরা ছাড়েনি। মেহেরুন রুনি আর তার স্বামী সাগরসহ ২৩ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন এ সরকারের আমলে। আহত হয়েছেন অনেকে। দেশের মানুষকে সত্য কথা বলার দায়ে মাহমুদুর রহমান নির্যাতিত, নিগৃহীত হচ্ছেন। আমার দেশ পত্রিকাটির মুদ্রণ বন্ধ করার সবরকম ব্যবস্থা করেছে এই সরকার। দিগন্ত টেলিভিশন আর ইসলামী টেলিভশনও সেই একই কারণে বন্ধ রয়েছে। 
দেশের মানুষ আশা করে আছে যে, দেশে শিগগিরই নতুন সরকার আসবে, খালেদা জিয়া আবারো প্রধানমন্ত্রী হবেন। দেশের মানুষ আবারো আশা করবে যে, বিএনপি অতি বিলম্বে হলেও একটা সুষ্ঠু মিডিয়ানীতি তৈরি করবে। ইতোমধ্যে বর্তমান সরকারের আমলে যেসব মিডিয়া এবং মিডিয়াব্যক্তিত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণদানের ব্যবস্থা নতুন সরকারকে অবিলম্বে করতে হবে। 


বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সফল সংলাপের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিবেশ


দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের মুসলমানরা বেশ আন্তরিকতার সাথে হজ্জ পালন করে থাকেন। এবারও বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ হজ্জ পালন করতে সউদি আরব গেছেন। তাঁদের অনেকেই দেশে ফিরে এসেছেন, অনেকেই এখনো রয়ে গেছেন পবিত্র ভূমি মক্কা ও মদিনায়। আর কিছুদিনের মধ্যেই সবাই চলে আসবেন স্বদেশে। হজ্জে গেলে সবার কর্মকা-ে এক অভূতপূর্ব ঐক্য লক্ষ্য করা যায়। সবাই চেষ্টা করেন মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে মহানবী (সা:)-এর সুন্নার অনুসরণে হজ্জ পালন করতে। হজ্জ পালন করতে গিয়ে কারো যে কোনো ভুল-ত্রুটি হয় না তা কিন্তু নয়। ভুল-ত্রুটি জ্ঞানের অভাবের কারণেও হয়, অসতর্কতার জন্যও হয়। মুসলমানরা যে আল্লাহর ইবাদাত করেন, ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমাও চান তাঁরই কাছে। মহান আল্লাহ বেশ ভালভাবেই জানেন যে, মানুষ ভুল করতে পারে।  তাই তিনি খোলা রেখেছেন তওবার পথ। তওবা করে ভুল থেকে প্রত্যাবর্তন করলে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।
হজ্জে ‘লাব্বাইকা’ ধ্বনি উচ্চারণের মাধ্যমে আমরা যে তালবিয়া পাঠ করে থাকি, তা মুসলমানদের কাছে খুবই পরিচিত। কিন্তু আমরা সবাই কি এই তালবিয়ার অর্থ জানি। কিংবা এর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছি? তালবিয়ার সরল অর্থ হলো, “হাজির হয়েছি হে আল্লাহ! তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে আমি হাজির হয়েছি। আমি হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি তোমার কোনো শরীক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা ও নেয়ামত তোমারই এবং রাজত্বও। তোমার কোনো শরীক নেই।”
তালবিয়ায় এক আল্লাহ তথা তাওহিদের সাক্ষ্য, ¯্রষ্টার প্রশংসা ও নেয়ামত এবং তাঁর রাজত্বের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। হজ্জের পবিত্র ভূমিতে গিয়ে তালবিয়ার মাধ্যমে আমরা যে সাক্ষ্য দিয়ে এসেছি, হজ্জ পরবর্তী সময়ে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনে তার প্রতিফলন কতটা ঘটে? অথবা পবিত্র কাবা শরীফ তাওয়াফ শেষে আমরা যখন সাফা ও মারওয়া পর্বত সায়ী করি তখন হযরত ইবরাহীম (আ:) এর ত্যাগ ও মহান আল্লাহর আদেশ পালনের ইতিহাস আমরা কতটা স্মরণ করি? হযরত ইবরাহীম (আ:) এর আদর্শ স্মরণ করতে গেলে যে বিষয়টি বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয় তা হলো, আল্লাহকে ভালবাসার পথে কিংবা তার আনুগত্যের পথে যা কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাকে সর্বশক্তি দিয়ে সরিয়ে দিতে হবে। আল্লাহ ও বান্দার এ দৃঢ় সম্পর্কের মধ্যে কোনো বাধাকেই মেনে নেয়া যাবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, হজ্জ পরবর্তী সময়ে আমরা পবিত্র কাবা তাওয়াফ এবং সাফা-মারওয়া সায়ীর সাথে হযরত ইবরাহিম (আঃ) ও তাঁর পরিবারের যে ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আনুগত্য জড়িয়ে আছে সেসব ঘটনার মর্ম কতটা উপলব্ধি করি? আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীক ও বৈশ্বিক জীবন-যাপনে কাবাকেন্দ্রিক জীবনের আদর্শ ও নৈতিকতা কতটা প্রতিফলিত হয়? হজ্জ শেষে স্বদেশের মাটিতে পা রেখে আমরা যদি চারিদিকে একটু গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করি তাহলে আমাদের মনে অবশ্যই প্রশ্ন জাগবে যে, আমরা কী ধরনের মুসলিম? হজ্জ থেকে কি আমরা কোনো শিক্ষাই নিতে সমর্থ হলাম না?
আমরা জানি যে, আমাদের রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করছেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং সমাজ ও বিভিন্ন পেশায় যারা কর্তৃত্ব করছেন তাদের প্রায় সবাই শুধু একবার নয়, একাধিকবার হজ্জ করে এসেছেন। কিন্তু তাদের জীবন যাপনে এবং আচরণে হজ্জের বার্তা কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে? হজ্জের ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং অপরকে অগ্রাধিকার দেয়ার চেতনা তারা কতটা লালন করতে পারছেন?
কাউকে ছোট করার জন্য আমরা এইসব প্রশ্ন উত্থাপন করছি না। বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানির যে চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা তো হজ্জের ভ্রাতৃত্ববোধ কিংবা উম্মাহ চেতনার সাথে মোটেও মিলছে না। জানি না জাতির কালান্তরের এই সময়ে নিজের এবং আপন অঙ্গনের আত্মসমালোচনার দায়িত্ব আমরা কতটা পালন করতে সক্ষম হবো?
কিছুদিন আগে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মদিনা সনদের কথা উল্লেখ করেছিলেন। আইয়ামে জাহেলিয়াতের সে যুগে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সঃ) ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে এক আলোকিত ও শান্তির সমাজ গড়ে তুলেছিলেন। তার ঐতিহাসিক এ সাফল্যের মূলে ছিল সততা, বিশ্বস্ততা, নিরপেক্ষতা, আইনের যথার্থ প্রয়োগ এবং ঐশীগ্রন্থ আল কুরআনের আলোক রশ্মি। কিন্তু শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে আমরা নবীর উম্মত হিসেবে তাঁর আদর্শ কতটা অনুসরণ করছি? মদিনা সনদের কথা উল্লেখ করলেও বাস্তবে আমরা তার প্রতিফলনে কতটা আন্তরিক? আন্তরিকতার অভাবের কারণেই আমাদের সমাজে আজ এত হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি আর আস্থার সঙ্কট। দেশ তো পরিচালনা করেন রাজনীতিবিদরা। রাজনীতিবিদদের মধ্যে জনগণের ভোটে যারা সরকার গঠন করেন, তারা যদি অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী না হয়ে দেশ শাসন করেন তাহলে সুশাসনের বিকাশ ঘটতে পারে। এর সুফল জনগণ ভোগ করলে দেশের প্রগতি ত্বরান্বিত হতে পারে। এছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠার কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সঙ্কট কাটতে পারে এবং দৃঢ়মূল হতে পারে গণতন্ত্রের ভিত্তি। কিন্তু বর্তমান সময়ে তো আমরা এমন কাক্সিক্ষত চিত্র লক্ষ্য করছি না। বরং লক্ষ্য করছি হরতাল, রাজপথে গোলাগুলী, পুলিশের নিষ্ঠুর আচরণ ও নাগরিক হত্যার অনাকাক্সিক্ষত দৃশ্য। মদিনা সনদের যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, তার সাথে এসব চিত্রের কোনো মিল নেই। জানি না আমাদের রাজনীতিবিদরা এ বিষয়টি কতটা উপলব্ধি করেন। মানুষ মরণশীল এ কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু মৃত্যুর পর প্রতিটি মানুষকে যে, নিজ নিজ দায়িত্ব ও আচরণ সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে মহান ¯্রষ্টার কাছে, সে বিষয়ে আমরা আদৌ সচেতন আছি কি? সচেতন থাকলে আজ রাষ্ট্র ও সমাজের এই হাল কেন?
আমরা হরতাল চাই না, চাই না রাজপথে নাগরিকদের ওপর পুলিশের গুলীর বৃষ্টি। নাগরিকদের এমন আকাক্সক্ষার অনুকূলে অন্য অনেকের মত সুশীল সমাজ ও সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপের কথা বলছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো টিভি-টকশোতে কিংবা পত্রিকার পাতায় সংলাপের আকাক্সক্ষা উচ্চারণ করলেই তো সংলাপ সফল হয়ে যাবে না। একটি সফল সংলাপের জন্য প্রয়োজন সরকার ও বিরোধী দলের দায়িত্বপূর্ণ আচরণ। এর সাথে আরো প্রয়োজন জনগণের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন তথা জয় কিংবা পরাজয়কে মেনে নেয়ার মতো গণতান্ত্রিক চেতনা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, দেশ ও জাতির স্বার্থে একটি সফল সংলাপের ক্ষেত্রে বিরোধী দলের চাইতে সরকার এবং সরকারি দলের দায়িত্ব বেশি। ধৈর্য ও উদারতার উত্তম উদাহরণ তারাই সৃষ্টি করতে পারে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই চলে আসে সংলাপের পরিবেশ তৈরির কথা। রাজনৈতিক অঙ্গনে তো মতপার্থক্য, তর্ক-বিতর্ক ও প্রতিযোগিতা থাকতেই পারে। কিন্তু একথার অর্থ এই নয় যে, এসব মতপার্থক্য ও প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরোধী দল কোনো নিয়ম-নীতি মানবে না, আর সরকারি দল বিরোধী দলের উপর জুলুম-নির্যাতন চালাবে। তাদের সভা সমাবেশ করতে দিবে না এবং জেলে পুরে স্তব্ধ করে রাখতে চাইবে। গণতান্ত্রিক সমাজে তো সব নাগরিকের রাজনৈতিক ও আদর্শিক মতামত ব্যক্ত করার অধিকার থাকে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার রাজনীতির চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হলো, জনগণের মত প্রকাশের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা। এ দায়িত্ব পালনে সরকার ব্যর্থ হলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়। বর্তমান সময়ে আমরা হরতাল এবং রাজপথে ককটেল বিস্ফোরণের যে চিত্র লক্ষ্য করছি, তার মূলে রয়েছে গণতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতার বিষয়টি। রাজনৈতিক দলগুলো যখন মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, অপশাসনের শিকার হবে এবং ভিন্নমতের গণমাধ্যমগুলো যখন বন্ধ করে দেয়া হবে, তখন দেশে গণতন্ত্রের বদলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় ফ্যাসিবাদী শাসন। বর্তমান সময়ে পুলিশ যেভাবে রাজনৈতিক দলের নেতাদের গ্রেফতার ও হয়রানি করছে, গুলী করে পাখির মত মানুষ হত্যা করছে এবং মিডিয়া জগতে আমার দেশ পত্রিকা, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি ও চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে রেখেছে তাতে আমরা কী করে বলবো সরকার সঠিক পথে চলছে? বর্তমান সময়ে হরতালসহ রাজপথে সংক্ষুব্ধ আন্দোলন বন্ধ করতে হলে প্রথমেই সরকারকে সফল সংলাপের জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আর তা করতে হলে সরকারকে বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার বন্ধ করতে হবে, জলুম-নির্যাতন বন্ধ করে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মুক্তি দিতে হবে এবং অবিলম্বে বন্ধ পত্রিকা ও টিভিগুলোকে মুক্ত করে দিতে হবে। সরকার এমন উদাহরণ সৃষ্টি করলে তাতে শুধু দেশেরই মঙ্গল হবে না, ইমেজ সংকট কাটিয়ে সরকারও লাভবান হতে পারে। একথা সবাই স্বীকার করেন যে, সামনের সংসদ নির্বাচনটি এখন জাতির কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। বর্তমান সময়ে তেমন পরিস্থিতি বিরাজমান নেই। সরকারের নানা ভুল নীতির ও চালাকির কারণে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়ে গেছে। সরকার চাইলে খুব সহজেই সেই সমস্যাগুলো দূর করতে পারে। আমরা জানি, বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশন বসবে নবেম্বরের ৭ তারিখে। হাতে সময় আছে খুবই কম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি বর্তমান সঙ্কটপূর্ণ সময়ে কোনো শুভ সিদ্ধান্ত নিতে চান তাহলে তাকে তা জাতীয় সংসদেই নিতে হবে। কারণ বর্তমান সঙ্কট থেকে জাতিকে উদ্ধার করতে হলে সংবিধানে কিছু সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে। যেমন সংশোধন ইতিপূর্বে খালেদা জিয়ার সরকার করেছিলেন জাতীয় স্বার্থে। সরকার যদি জাতীয় স্বার্থে সঙ্কট থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে অগ্রসর হয়, তাহলে তাতে অনুকূল সাড়া দেয়া বিরোধী দলের কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। জনগণ কিন্তু নীরবে সবই লক্ষ্য করছে। রাজনীতিবিদরা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কিংবা সীমা লঙ্ঘন করলে জনগণ ইতিহাসের অমোঘ ধারায় সরব হয়ে ওঠে এবং যার যা প্রাপ্য তা বুঝিয়ে দেয়। আমরা আশা করবো এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির আগেই আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবেন। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে তো মদীনা সনদের কথা উচ্চারিত হয়েছে। সেই চেতনার কিছুটা চর্চাও যদি আমাদের রাজনীতিবিদরা করেন, তাহলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিকই ফিরে পেতে পারেন কাক্সিক্ষত শান্তির সমাজ। হজ্জের পবিত্র এই মাস এমন আকাক্সক্ষার প্রকাশ কি খুবই স্বাভাবিক নয়?
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বল আবার প্রধানমন্ত্রীর কোর্টে


দুই নেত্রীর ফোনালাপ এখন সবার জানা। তাদের পালস রেটও বোঝা হয়ে গেছে। দাওয়াত দেয়ার জন্য ফোনালাপে তারা এত কথা বলতে গেলেন কেন? তারা কি ফোনেই সংলাপ-সমঝোতা-আপসরফা শেষ করতে চেয়েছেন। না, তা চাননি। তাহলে কি মনের ভেতর জমাট বাঁধা ক্ষোভগুলো উগড়ে দেয়াটাই লক্ষ্য ছিল। যেভাবেই মূল্যায়ন করা হোক, বিরোধীদলীয় নেতা ফোনালাপে বেশি সিমপ্যাথি পাবেন। এটা পাবেন বাগি¦তণ্ডায় জিতে যাওয়ার জন্য নয়, বিরোধীদলীয় অবস্থানের জন্য। রাজনৈতিভাবে মজলুম হওয়ার কারণে। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্যও। আমরা ভুলে যেতে চাই নাÑ সংলাপের পথ ধরে এ দেশে রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান হওয়ার তেমন কোনো নজির নেই। তারপরও আমরা সংলাপ ও সমঝোতার পক্ষে। এই পক্ষে থাকার যুক্তি একটাই, ‘যদিসমাধানের কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যায়। হতেও তো পারেÑ এ প্রক্রিয়ায় বরফ গলবে। 
এখন রাজনীতি যেখানে এসে ঠেকেছে সেখান থেকে সঙ্কট উত্তরণের সহজ পথ বেরোবে বলে মনে হয় না। এর কারণ ১৪ দল বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটকে বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের ধারায় ফেলার একটা ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। বর্তমান সমস্যাকে রাজনৈতিক সঙ্কটের পর্যায়ে রেখে সমাধানের পথ খুঁজলে রাজনৈতিক দিশা মিলতো। সাংবিধানিক সঙ্কটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে ভাবলেও নিস্তার ছিল। দুই দল ও জোটের ভেতর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বললেও একটা আশাবাদ জন্ম নিত। বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের প্রশ্ন ওঠার পর এখন আর সহজ পথে কোনো আশাবাদ নেই। 
বিপ্লবীরা অর্থাৎ ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট বিপ্লব রক্ষার সংগ্রামের ব্রত নিয়ে প্রতিবিপ্লবী শক্তি অর্থাৎ বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটকে ঠেকানোর যুদ্ধে নেমেছে। এ যুদ্ধ আর সংলাপ দিয়ে শেষ হবে না। রাজপথই বলে দেবে কারা বিপ্লবী, কারা প্রতিবিপ্লবী। ১৪ দল যে বিপ্লবের কথা শোনাচ্ছে তা যদি কালমার্কস, লেনিন কিংবা চেয়ারম্যান মাও শুনতেন তাহলে আত্মহত্যা করতে চাইতেন। এখন সম্ভবত তারা কবরেও অস্বস্তিবোধ করছেন। 
বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯০ সালে রাজপথ মাড়িয়ে একটি সফল গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়ার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। চারবার বিরোধী দলে থেকে লড়াই করার অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। দুই দফা পূর্ণকালীন, আরেক দফা খণ্ডকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যাদের সাথে তিনি রাজনীতি করে রাজপথে ও ক্ষমতায় সময় অতিবাহিত করেছেন তারা এখন তাকে বিপ্লব শেখাচ্ছেন। এরাই এরশাদকে বরণ করেছিলেন। এরশাদের পাতানো নির্বাচনে খালেদা জিয়াকে রাজপথে রেখে এরাই অংশ নিয়েছেন। আগের দিন ফতোয়া দিয়েছিলেন, যারা স্বৈরাচারের পাতানো নির্বাচনে যাবে তারা মীরজাফর বা জাতীয় বেঈমান হিসেবে চিহ্নিত হবে। এর পরেও তারাই মইন-ফখরুদ্দীনদের মতো লোকদেরও আশীর্বাদ নিয়েছেন। সেই ছদ্মবেশী সামরিক সরকারকে তাদের আন্দোলনের ফসল বলেছেন। এখন সেই ১৪ দলীয় শক্তি যাদের মধ্যে পতিত বাম, উচ্ছিষ্টভোগী কমিউনিস্ট, বোল পাল্টানো তথাকথিত সমাজতন্ত্রীরাই বিপ্লবী সেজে গেছেন। যারা বড় দলের কোলবালিশ হওয়া ছাড়াও রাজনৈতিকভাবে গণবিছিন্ন, চরিত্রগতভাবে উঁচু স্তরের চাঁদাবাজ, শ্রেণিচরিত্র যাদের বুর্জোয়া, অবস্থা যাদের স্খলিত আদর্শবাদী তারাই এখন ফ্যাসিবাদ, আধিপত্যবাদ ও স্বৈরাচারের তৈরি করা নর্দমার ডোবায় আপাদমস্তক নিমজ্জিত। 
বর্তমান সরকার মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া সরকার। বর্তমান সংসদ মেয়াদপূর্ণ হওয়া সংসদ। এই সরকার নৈতিকভাবে দেউলিয়া। তারা যখন কাচের ঘরে বসে অন্যদের ঢিল ছুড়ে মজা পান তখন অদূরে কোথাও বসে শয়তানও পিশাচের মতো কুটিল হাসি হাসে। আর ১৪ দল যখন সংবিধান রক্ষা ও কাতুকুতু মার্কা বিপ্লবের গল্প শোনায় তখন ভূতপ্রেতও অট্টহাসি দিয়ে গড়াগড়ি খায়। বাস্তবে দেশে এখন কোনো নির্বাচিত ও গণস্বীকৃত সরকার নেই। যারা আছেন তারা তাদের ইচ্ছায় একতরফা সংবিধান সংশোধন করে ক্ষমতা জবরদখল করে আছেন। দেশকে আজ সাংবিধানিক সঙ্কট ও শূন্যতায় ফেলে দিয়েছেন। 
খালেদা জিয়া কোন পথে হাঁটবেনÑ সেটা তার ব্যাপার। তবে রাজপথে শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি করতে না পারলে কোনো সুফল ঘরে তোলা যাবে না। যারা মনে করছেনÑ শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন করলেও ১৮ দলীয় জোট বিজয় লাভ করে সরকার গঠন করবেÑ তারা একটা মৌলিক ভুলের রাজ্যে বসবাস করছেন। কারো ভুলে যাওয়া উচিত নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিকে দিল্লির দরবারে কারা সঁপে দিয়েছেন। মেয়াদ শেষেও ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার একরোখা জিদ কাদের। এখন সমঝোতার নাটাইটাও ড্যান মজিনারা দিল্লির কাছে সোপর্দ করতে চান। খেলাটা যেন সাম্রাজ্যবাদের সাথে আধিপত্যবাদের মেলবন্ধনের খেলা। ১৬ কোটি মানুষ পিন্ডিকে সালাম দিয়ে দিল্লিকে কুর্নিশ করবে, আর সেটাকে বলা হবে প্রতিবিপ্লবী ঠেকিয়ে বিপ্লব রক্ষা করাÑ এটাকে হজম করা কিভাবে সম্ভব? দিল্লি যখন একজন নেত্রীকে তাদের জন্য ১৬ কোটি মানুষের চেয়েও বেশি প্রয়োজনীয় ভাবে, অন্যজনকে দুশমন বিবেচনা করে, তখন সবাইকে ভাবতে হবে আধিপত্যবাদের রাডার আমাদের নাকের ডগার কত দূর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এমনিতে অর্থনৈতিক শোষণ গলা পর্যন্ত পৌঁছেছে। সাংস্কৃতিক গোলামির বিরাট হাঁ আমাদের স্বকীয় অস্তিত্ব গিলে খাচ্ছে। তার ওপর কূটনৈতিক আধিপত্য ও রাজনৈতিক নিপীড়ন যোগ হলে আমাদের সার্বভৌমত্বের অহম ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে, যা ইতোমধ্যে অংশত হয়ে গেছে। 
আগেই উল্লেখ করেছি, মহাজোট সরকার ঠাণ্ডা মাথায় আদালতের দোহাই দিয়ে দেশে একটি সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। এখন সেটাকে আঁকড়ে থাকার জন্য হেন অপচেষ্টা নেই করছে না। সঙ্কট যারা সৃষ্টি করেছে, তাদেরই সমাধান করা উচিত। নিজেদের সৃষ্ট সঙ্কট থেকে নিজেরা উত্তরণের পথ না খুঁজে বিরোধী দলকে দায়ী করে কোনো লাভ নেই। সব বিতর্ক সামনে রেখেও আমাদের পরামর্শÑ বর্তমান সঙ্কটকে সাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক সঙ্কট হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই সঙ্কটের জন্ম দেয়া হয়েছে অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে, যেমনটি বাকশাল করার প্রেক্ষাপটে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্র হত্যা করা হয়েছিল। এখন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির মতো সংবিধানের দোহাই অর্থহীন। এখনো ছিটানো থুথু গিলতে না চাইলে প্রধানমন্ত্রীকে সসম্মানে আঁকড়ে থাকা পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতে হবে। নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে সবার অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচনের পথ করে দেয়া ছাড়া সহজ কোনো পথ খোলা নেই। 
আমরা জানি, রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে আধিপত্যবাদের আশীর্বাদ নিয়ে একটা পাতানো ভোটারবিহীন নির্বাচন করে ফেলা হয়তো অসম্ভব নয়; কিন্তু ক্ষমতাকে নিরাপদ করা, ১৬ কোটি মানুষকে পোষ মানানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আরো রক্ত ঝরার আগে বোধোদয় না ঘটলে খেসারত অনেক বেশি অসহনীয় হয়ে যেতে পারে। এখন সংলাপের পথে সমঝোতা চাইলে প্রধানমন্ত্রীকেই আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিতে হবে। এক দিকে দায়টা সরকারের, অন্য দিকে বিরোধীদলীয় নেত্রী বল প্রধানমন্ত্রীর কোর্টে ঠেলে দিয়েছেন। 
বিরোধী জোট অবশ্যই চাইবেÑ সরকার মিটিং, মিছিল ও জনসভার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তা ঘোষণা দিয়ে প্রত্যাহার করুক। বিরোধী দলের যেসব নেতা ও কর্মীকে রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার করেছে, হুলিয়া জারি করে রেখেছে, মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে তা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিক। বন্ধ করে দেয়া বিরোধীদলীয় কিংবা ভিন্নমতের মিডিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করাও সঙ্গত। প্রধানমন্ত্রীর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে নীতিগত একমত হওয়ার ঘোষণা দেয়ার দায়ও বাড়ল। দমন-পীড়ন বন্ধ করে পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর হস্তক্ষেপ না করে তাদের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দেয়া সময়ের দাবি। নির্বাচন কমিশনের ওপর প্রভাব বিস্তারের যে দৃশ্য-অদৃশ্য ধারা চলছে তা বন্ধ হোক। ১৪ দলীয় পাল্টা কর্মসূচি দেয়ার এবং বিভিন্ন নেতার অশোভন মন্তব্য দেয়া বন্ধ করা প্রয়োজন। বিরোধী দলকে আলোচনায় বসাতে চাইলে সরকারকে নমনীয় হতেই হবে। নমনীয় না হয়ে বিদেশীদের আশীর্বাদে ও এরশাদকে বি টিমে খেলার সুযোগ করে দিয়ে একতরফা নির্বাচনের দিকে এগোলে দেশের ভাগ্য নির্ধারণে তৃতীয় শক্তির উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে যাবে। এর দায় পুরোটা প্রধানমন্ত্রীকে নিতে হবে। 

Ads