বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৩

ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার


ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবারÑ বর্তমান সময়ের বহুল উচ্চারিত একটি স্লোগান। মন্ত্রী-এমপি-রাজনীতিবিদ-বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে শাহবাগ সমর্থকদের মুখে ঘুরেফিরে উচ্চারিত হচ্ছে স্লোগানটি। উচ্চারণকারীরা বুঝে অথবা না বুঝে এই কথাটি যেখানে সুযোগ পাচ্ছে সেখানেই ব্যবহার করছে। এই স্লোগান উচ্চারণকারীরা সম্ভবত এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বোঝাতে চায় যেখানে নাগরিকেরা তাদের যে যার খুশিমতো ধর্ম পালন করবে, রাষ্ট্র তাতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। রাষ্ট্রের সীমানার ভেতরে যেহেতু বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী নাগরিক থাকে, সেহেতু রাষ্ট্র নামক সঙ্ঘটি পরিচালনার সময় এর হর্তাকর্তারা কোনো ধর্মের প্রতিই পপাতিত্ব করবে না। উদ্বেগের বিষয় হলো, এই সুন্দর ও আপাত নিরীহ ব্যাখ্যার বাইরেও যে এই স্লোগানটির ভেতরে অত্যন্ত ভয়ানক কিছু সত্য কথা লুকিয়ে আছে, স্লোগানদাতারা ভুলেও কখনো তা উচ্চারণ করে না।

বাংলাদেশে নতুন আমদানিকৃত অভিনব এই স্লোগানটি আসলে নতুন বোতলে পুরনো মদ। প্রকৃত পে এই স্লোগানটি সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেতারই নির্যাস ছাড়া আর কিছু নয়। উইকিপিডিয়াতে সেকুলারিজম সম্পর্কে বলা হয়েছে : সেকুলারিজম হলো সরকারি বা সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে এমন প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিত্বকে পৃথক করার নীতি। সহজ কথায়, সেকুলারিজম হলো রাষ্ট্র ও ধর্মকে পৃথক করার নীতি। আরো পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে, সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেতার মূল কথাই হলো ধর্ম থাকবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আর রাষ্ট্র হবে ধর্মহীন। এটি দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার যে, ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’Ñ এ স্লোগানটির যে অর্থ, সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেতার অর্থও হুবহু এক। আসলে সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেতা দর্শনটি ইতোমধ্যে মুসলিম সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে বলেই এই মতবাদের প্রচারকেরা তাদের প্রডাক্টকে ভোক্তা সমাজে চালু করার জন্য অভিনব এই স্লোগানকে বেছে নিয়েছেন। সেকুলারিস্টরা পরীা করে দেখেছেন যে, ধর্মনিরপেতার কথা বলা মাত্র যে মুসলিম নাগরিকটি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকেন, সেই মুসলিম নাগরিকই আবার ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ এই স্লোগানটিকে নির্দোষ মনে করে সহজভাবে গ্রহণ করেন। তাই সম্প্রতি ধর্মনিরপেতাবাদীরা তাদের আদর্শের কথা সরাসরি না বলে ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ এই চটকদার বক্তব্যের মাধ্যমে মুসলিমদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। অথচ পৃথিবীর সব খ্যাতনামা ইসলামিক স্কলার বহু আগেই ঘোষণা দিয়েছেন যে, ধর্মনিরপে মতবাদটি কোনোভাবেই ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যশীল কোনো মতবাদ নয়, বরং এটি একটি ভ্রান্ত মতবাদ।
ধর্মনিরপেতার সাথে ইসলামের প্রথম ও প্রধান সঙ্ঘাতটি সংঘটিত হয় সার্বভৌমত্বের ধারণায়। ধর্মনিরপে ব্যবস্থায় রাষ্ট্র যেহেতু ধর্মমুক্ত থাকে, সেহেতু রাষ্ট্রকে অনিবার্যভাবেই জনগণের সার্বভৌমত্বকে মেনে নিয়েই পথ চলতে হয়। জনগণের সার্বভৌমত্বের মূল কথা হলো, বেশির ভাগ জনগণ যেটিকে ভালো মনে করবে, রাষ্ট্র সেটিকেই গ্রহণ করবে। এমনকি আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশের বিপরীত হলেও শুধু জনগণের ইচ্ছাশক্তির জোরে তা প্রতিষ্ঠিত হবে। আবার বেশির ভাগ জনগণ যেটিকে মন্দ বিবেচনা করবে এই ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সেটি হবে পরিত্যাজ্য বিষয়, এমনকি আল্লাহর দৃষ্টিতে তা যতই কল্যাণকর হোক না কেন, তা গ্রাহ্য করা হবে না। জনগণের সার্বভৌমত্বের এই ধারণা ইসলামের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। বেশির ভাগ  জনগণের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে আইন রচনা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার এখতিয়ার ইসলাম মানুষকে দেয়নি। আল্লাহ বলেন : ‘আল্লাহ ছাড়া কারও বিধান দেয়ার মতা নেই’ (আল কুরআন : সূরা ইউসুফ, আয়াত-৪০)। এই আয়াতে স্পষ্ট হয় ইসলামে আইন-বিধান রচনার এখতিয়ার একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহর এই মতায় অন্য কাউকেও শরিক করার অনুমোদন ইসলাম দেয় না। বিচার-ফয়সালা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছুকে অগ্রাধিকার দেয়ার বৈধতা ইসলাম দেয়নি। আল্লাহ বলেন : ‘হে নবী, আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা এই মর্মে দাবি করে চলেছে যে, তারা ঈমান এনেছে সেই কিতাবের প্রতি যা আপনার প্রতি নাজিল করা হয়েছে এবং সেই সব কিতাবের প্রতি যা আপনার পূর্বে নাজিল করা হয়েছিল; কিন্তু তারা নিজেদের বিষয়সমূহের ফয়সালা করার জন্য তাগুতের (ইসলামবিরোধী সবকিছুই তাগুত) দিকে ফিরতে চায়, অথচ তাদেরকে হুকুম দেয়া হয়েছিল তাগুতকে অস্বীকার করার’ (আল কুরআন: সূরা আন নিসা, আয়াত-৬০)। এ আয়াত থেকেও এটি স্পষ্ট হয় যে, ইসলামে রাষ্ট্রীয় বিষয়ে ফয়সালার জন্য ‘অধিকাংশ জনগণের পছন্দ’ নয়, আল্লাহর বিধানই শেষ কথা। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। ধর্মনিরপে ব্যবস্থায় বেশির ভাগ জনগণ যদি মনে করে যে তাদের রাষ্ট্রে মদ বৈধ হবে, তাহলে তারা সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে মদকে রাষ্ট্রের ভেতর বৈধ করে দিতে পারে, অথচ আল্লাহ তায়ালা মদকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। যে ব্যবস্থা আল্লাহর ঘোষিত অবৈধ জিনিসকে বৈধ, বৈধ জিনিসকে অবৈধ করার এখতিয়ার রাখে সে ব্যবস্থা আর যাই হোক আল্লাহর অনুমোদিত ব্যবস্থা হতে পারে না। এ ব্যাপারে আল্লাহ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন: ‘কোনো মানুষের এ অধিকার নেই যে আল্লাহ তাকে কিতাব, কর্তৃত্ব ও নবুওয়াত দান করবেন আর সে জনগণকে বলবে যে, তোমরা আল্লাহকে পরিহার করে আমার দাস হয়ে যাও। বরং সে শুধু এ কথাই বলবে যে, তোমরা আল্লাহর দাস হয়ে যাও’ (আল কুরআন : সূরা আল ইমরান, আয়াত-৭৯)। আল কুরআনের অন্যত্র আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, ‘যারা আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে অন্য কোনো বিধান দিয়ে, অথবা বেশির ভাগ জনগণের ইচ্ছামাফিক রাষ্ট্র পরিচালনা করে তাদের অবস্থান ইসলামের সীমানার বাইরে, যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না, তারাই কাফের’ (আল কুরআন : সূরা আল মায়িদা, আয়াত-৪৪)।
প্রকৃতপে ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ এই স্লোগানের আড়ালে থাকা ধর্মনিরপে দর্শনটি এবং ইসলাম সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী দু’টি মতাদর্শ। কোনো নন-মুসলিম ব্যক্তি যদি সেকুলারিস্ট হন, তাহলে কোনো কথা নেই। কিন্তু কোনো মুসলিম ব্যক্তি যদি নিজেকে সেকুলারিজমের সমর্থক-প্রচারক-অনুসারী বলে দাবি করেন তাহলে অবশ্যই কথা আছে। কারণ একই সাথে মুসলিম এবং সেকুলারিস্ট থাকা তেমনই অসম্ভব, যেমন অসম্ভব আলো এবং অন্ধকারের এক সাথে থাকা। বাস্তব সত্য হলো, কোনো মুসলিম যেমন ধর্মনিরপেতাবাদী হতে পারে না, কোনো ধর্মনিরপেতাবাদীও তেমনি মুসলিম থাকতে পারাটা প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads