রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৩

মুজিবনগরের বাখানি


এবনে গোলাম সামাদ

ইতিহাসকে নানাভাবেই বিকৃত করা হচ্ছে। মুজিবনগর দিবস প্রসঙ্গে আমাদের দেশের বেশির ভাগ পত্রপত্রিকায় যা লেখা হলো এবং বেশিরভাগ টেলিভিশন থেকে যা প্রচার করা হলো, আমার কাছে তা মনে হচ্ছে সাদা মিথ্যা। মুজিবনগর ছিল একটা গল্প-কাহিনী। ১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা নামক জায়গায় পড়া হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। মাত্র ৪৫ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়েছিল বৈদ্যনাথতলার সব অনুষ্ঠান। বৈদ্যনাথতলা জায়গাটা হলো একেবারেই ভারত সীমান্তের লাগোয়া। ভারতীয় সৈন্যরা জায়গাটিকে রেখেছিল ঘিরে। সব সময় আশঙ্কা করা হচ্ছিল পাক বাহিনী সেখানে যেকোনো মুহূর্তে এসে বোমা বর্ষণ করতে পারে। তাই খুব স্বল্প সময়েই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করে শেষ করা হয় অনুষ্ঠান। বৈদ্যনাথতলার আমবাগানের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের ক্রিয়াকাণ্ড।
প্রকাশ থাকে যে, রবার্ট কাইভ এই আমবাগানের পথ ধরেই গিয়েছিলেন পলাশীর সমরক্ষেত্রে। কিছুটা এই ইতিহাসকে কাজে লাগানোর চেষ্টা হয়েছিল এ অনুষ্ঠানে। কেউ কেউ বলেছিলেন, পলাশীর আম্রকাননে ঘটেছিল সিরাজের পরাজয়, এখন আবার বৈদ্যনাথ তলার আম্রকাননে হতে যাচ্ছে আর এক যুদ্ধের সূচনা, যা বাংলাদেশকে পরিণত করবে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে। কিন্তু এসব কিছুই ছিল বাখানি মাত্র। অনুষ্ঠান শেষ হয়েছিল খুবই দ্রুত। মুজিব নগরের ঘোষণাপত্র থেকে আমি কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি। কারণ, আমার মনে হচ্ছে, এই ঘোষণাপত্র সম্পর্কে অনেকেই যথাযথভাবে অবগত নন : “যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাঙলা দেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হইয়াছিল এবং যেহেতু এই নির্বাচনে বাঙলা দেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করিয়াছিলেন; এবং যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহবান করেন এবং যেহেতু আহূত এই পরিষদ স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন এবং পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাহাদের প্রতিশ্রুতি পালন করিবার পরিবর্তে বাঙলা দেশের গণপ্রতিনিধিদের সহিত পারস্পরিক আলোচনা চলাকালে হঠাৎ ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং যেহেতু উল্লেখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উ™ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাঙলা দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাঙলা দেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান এবং যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করিয়াছেন এবং এখনও বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজীরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাইতেছেন এবং যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্যা ও নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের একত্রিত হইয়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিয়া জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছেন; এবং যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাহাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাহাদের কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন; সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়াছেন, সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করিয়া পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাঙলা দেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্যবোধে আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণ-প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি এবং উহার দ্বারা পূর্বাহ্ণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করিতেছি।”
ওপরের ঘোষণাপত্রটি পড়লে বোঝা যায় যে, প্রেসিডেন্ট আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া যদি ভোটের রায় মেনে নিতেন, তবে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা ঘোষণা করত না। তাই আজ যারা বলছেন, হাজার বছরের বাঙালিদের স্বাধীন হবার ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছিল শেখ মুজিবের মাধ্যমে, সেই ধারণাকে যথেষ্ট যুক্তিবহ বলে ধরা যায় না। ওপরের স্বাধীনতার ঘোষণায় নেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা। নেই সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা। আছে কেবল মানব সমতা, মানব মর্যদা ও সামাজিক সুবিচারের বাণী। আওয়ামী লীগ ১৯৭১ সালে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলেনি। বললে এই স্বাধীনতার বিখ্যাত ঘোষণাপত্রে তার উল্লেখ অবশ্যই থাকত। কিন্তু এ বছর ১৭ এপ্রিলে আমাদের দেশের বেশিরভাগ পত্রপত্রিকায় যা লেখা হলো এবং বেশিরভাগ টেলিভিশনের সম্প্রচার থেকে মনে হলো, আওয়ামী লীগ ১৯৭১-এ চেয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে অগ্রসর হতে; যেটা সত্য নয়। শেখ মুজিব চেয়েছিলেন, সাবেক পাকিস্তানের গণপরিষদে প্রধানমন্ত্রী হতে। কেবল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অভীষ্ট লক্ষ্য তার তখন পর্যন্ত ছিল না।
শেখ মুজিব তার ১৯৭১-এর ৭ মার্চের বিখ্যাত ভাষণে বলেছিলেনÑ আমি পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা। তিনি কেবলই নিজেকে দাবি করেননি বাংলাদেশের নেতা হিসেবে। কিন্তু বর্তমানে ইতিহাস লেখকেরা যেন চাচ্ছেন না এই বিশেষ বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিতে। আমি তাই বলছিলাম যে, ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে। মুজিবনগর দিবস প্রসঙ্গে আমাদের দেশের বেশিরভাগ পত্রপত্রিকায় ও বেশিরভাগ টেলিভিশন থেকে যা প্রচার করা হলো, আমার কাছে তা মনে হচ্ছে সাদা মিথ্যা। কী হলে কী হতে পারত, তা ভেবে লাভ নেই। কিন্তু তবুও মানুষ ভাবে। আজ পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে অনেক কিছু বলা হচ্ছে। পাক বাহিনীকে বলা হচ্ছে খান সেনা। কারণ, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সাবেক পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর যে অংশ ছিল তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল পাঞ্জাব থেকে আসা। এ সময় তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে বাঙালি সৈন্য ছিল ২৯ হাজার। এর মধ্যে এক হাজার ছিল অফিসার পর্যায়ের। আর বাদবাকি ২৮ হাজার সৈন্য ছিল সাধারণ পদাতিক। এই সৈন্যরা যদি পশ্চিম পাকিস্তানে না থেকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে থাকত তবে ইতিহাস কী হতে পারত, সেটা বিশেষ জল্পনারই বিষয়। পাকিস্তান থেকে এসব বাঙালি সৈন্য ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে আসে বাংলাদেশে। এরপর ঘটে ১৯৭৫ সালের ক্যুদেতা, যাতে নিহত হন শেখ মুজিব তার দুই কন্যা ছাড়া সপরিবারে। খান সেনারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেনি। তিনি নিহত হন বাঙালি সেনা বাহিনীর হাতে। বাঙালি সেনাবাহিনী দ্বিতীয়বার ক্যুদেতার মাধ্যমে ক্ষমতায় আনেন জিয়াউর রহমানকে।
জিয়াউর রহমান কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেছিলেন। পরে তিনি দেশ ছেড়ে যান ভারতে। কিন্তু ভারতে যেয়ে তিনি ছিলেন গৃহবন্দী। ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের পর দেশে ফিরে তিনি হয়ে ওঠেন বিশেষভাবে ভারতবিরোধী। কারণ, তিনি চান না বাংলাদেশ হয়ে উঠুক ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য। তিনি যোগ দেন পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা বাঙালি সেনাবাহিনীরই সাথে। আমরা এখন বিশেষভাবে শুনতে পাচ্ছি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা; কিন্তু সেটা সত্য হলে আমাদের ইতিহাসের গতিপথ অনেক ভিন্ন হতেই পারত। নিহত হতেন না শেখ মুজিব, আর ক্ষমতায় আসতেন না মোশতাক এবং পরে জিয়াউর রহমান। আমাদের ঘাদানিকের বুদ্ধিজীবীরা ইতিহাসকে এখন যেভাবে চিহ্নিত করছেন তা সত্য হলে আমাদের ইতিহাসের ওপরে উল্লিখিত এই অনুচ্ছেদ অব্যাখ্যাত থাকতে বাধ্য। জানি না, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা মোশতাক ও জিয়া ক্ষমতায় আসবার ঘটনাকে ঠিক কিভাবে ব্যাখ্যা করতে চান। ইতিহাসে যা ঘটে তা ঘটনা। যে বাংলাদেশের মানুষ একদিন এসে দাঁড়িয়েছিল শেখ মুজিবের নেতৃত্বে রাজপথে, তারা সরে গিয়েছিল শেখ মুজিবের নেতৃত্ব থেকে; সমর্থন জানিয়েছিল সেনা অভ্যুত্থানকে। দিয়েছিল রাজপথে নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর ধ্বনি। এর অনেক কারণই ছিল। শেখ মুজিব সারা জীবন উদার গণতন্ত্রের কথা বলে শেষে গঠন করেন কম্যুনিস্ট কায়দায় বাকশাল, যেটা মেনে নিতে পারেননি এ দেশের মানুষ। শেখ মুজিব বলেছিলেন, বাংলাদেশের দুঃখ-দুর্দশার কারণ হলো পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন ও শোষণ। কিন্তু শেখ মুজিবের শাসনামলে ১৯৭৪ সলে ঘটেছিল বিরাট দুর্ভিক্ষ। একটি হিসাব অনুসারে, এই দুর্ভিক্ষের সময় মারা গিয়েছিল প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। শেখ মুজিবের শাসনামলে এ দেশের মানুষের কাছে মনে হতে পারেনি সাবেক পাকিস্তান আমলের চেয়ে অধিক গ্রহণীয় হিসেবে। তাই সারা দেশে জেগেছিল আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের বিপক্ষে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া। কিন্তু, এ বছর ১৭ এপ্রিল আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবীর বক্তৃতা শুনে মনে হলো, এ দেশের মানুষ ছিল শেখ মুজিবের পক্ষে। আর মোশতাক ও জিয়াকে সেনাবাহিনীর যে অংশ ক্ষমতায় এনেছিল, তারা ছিল পাকিস্তানপন্থী। কিন্তু এরা সবাই ছিল বাংলাভাষী। কেন এরা পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন হতে পারল, তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হচ্ছেন না এ দেশের বাঙালিত্ববাদী বুদ্ধিজীবীরা। অন্তত তারা এই ব্যাখ্যা দেয়া থেকে থাকছেন বিরত।
শোনা যাচ্ছে, আজকের আওয়ামী লীগ বিশেষভাবে পরিচালিত হচ্ছে এককালের মস্কোপন্থী কম্যুনিস্টদের ঐতিহ্যবহদের দ্বারা। আমরা জানি না। তবে আমাদের মনে পড়ে কম্যুনিস্টরা একসময় বলেছিলেন, ভারত হলো একটা প্রগতিশীল রাষ্ট্র, পাকিস্তান তা নয়। কাশ্মির পাকিস্তানের অংশ না হয়ে ভারতের অংশ হয়ে উপকৃত হয়েছে। সাবেক সিলেট জেলা আসামে থাকবে না পাকিস্তানে আসবে, তা নিয়ে ১৯৪৭ সালে হয়েছিল গণভোট। এ সময় কম্যুনিস্টরা বলেছিল সিলেটের থাকা উচিত আসামে। কারণ, ভারত হতে যাচ্ছে একটি প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এদের কথা শুনে সাবেক সিলেটের নাগরিকেরা যদি আসামে থাকার পক্ষে ভোট দিতেন, তবে বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগোলিক আয়তন ১২ হাজার ৫৯৬ বর্গকিলোমিটার কম হতো। বাংলাদেশের কম্যুনিস্টরা সিলেটের গণভোট নিয়ে কোনো আলোচনায় এখন আর যেতে চান না। কারণ, এই আলোচনায় গেলে তাদের পড়তে হবে বিপাকে। তারা এখন বলছেন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশকে একটি মুসলিম মৌলবাদী দেশে পরিণত করতে চাচ্ছে। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম আসলে যা চাচ্ছে তা হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে।
(লেখার বাকি অংশ আগামীকাল প্রকাশিত হবে )

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads