নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত না থাকলে জাতীয় নির্বাচনে একটি দলের অংশ নেয়ার যোগ্যতা হারাতে হয়। তিন বছর পরপরকাউন্সিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। এমন বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিএনপির কাউন্সিল কয়েকবার পিছিয়ে দিতেহয়েছে নানা কারণে। এখন পর্যন্ত দলটি সবচেয়ে বেশি সময় ধরে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। নানাঘাত-প্রতিঘাত ও বিপর্যয়ের মুখেও দলটি এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিপুলসংখ্যক মানুষের সমর্থনপুষ্ট।
যেকোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন তপ্ত কড়াইয়ে ফুটন্ত তেলের মতো। মতাসীন ও বিরোধী দল রীতিমতোমুখোমুখি অবস্থানে। সারা দেশ দুই ভাগে বিভক্ত। এক দিকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের জোটেরনেতৃত্বে রয়েছে বিএনপি। এ জোটের সমর্থক হিসেবে রয়েছে পীর-মাশায়েখ, আলেম-ওলামা ও অরাজনৈতিক ইসলামি শক্তি। অপর পেরয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ধর্মনিরপে গোষ্ঠী এবং তাদের সমর্থক সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গোষ্ঠী। মস্কোপন্থী সেকুলারকমিউনিস্টরাও এদের সঙ্গী। দ্বিতীয় ভাগের নেতৃত্বে রয়েছে মতাসীন আওয়ামী লীগ। মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের খপ্পরে পড়ে উদারগণতন্ত্রী আওয়ামী লীগ এখন রীতিমতো ‘কমিউনিস্ট লীগে’ রূপান্তরিত হয়ে দেশ এবং দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের ওপরফ্যাসিবাদের নগ্নথাবা বিস্তার করেছে। গণতন্ত্রের আলখেল্লায় আচ্ছাদিত বর্তমান শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভÑ আইন, প্রশাসনও বিচার বিভাগ এখন দেশ-বিদেশে রীতিমতো প্রশ্নবিদ্ধ। এসবে মাত্রাতিরিক্ত দলীয়করণে দেশের মানুষ আজ সুশাসনবঞ্চিত।একদলীয় শাসনের অবয়বে চলছে দেশ। বিরোধী দল, বিরুদ্ধমত শুধু দলনের শিকারই হচ্ছে না- মতাসীনদের নির্মূল অভিযানের একঅব্যর্থ নিশানার শিকার। বিএনপির পঞ্চম কাউন্সিলের প্রাক্কালে দেশে যে প্রোপট ছিল এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি তারও চেয়েশত গুণ গণতন্ত্র বৈরী-শ্বেতসন্ত্রাসের বিষাক্ত মারণছোবলে দেশে গণতন্ত্রের প্রাণবায়ু রীতিমতো ওষ্ঠাগত। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এমএরশাদ তো বলেই ফেলেছেন, ‘দেশ এখন আইসিইউতে, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে’।
প্যানডোরার বাক্স থেকে বের হয়ে আসা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখন সারা দেশকে রক্তস্নাত করছে। শুধু ফেব্র“য়ারি ২০১৩, একমাসেই শতাধিক প্রতিবাদী নাগরিক আত্মাহুতি দিয়েছে। বিশ্বখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে‘দেলোয়ার শিকদার’ ওরফে ‘দেইল্যা’ রাজাকারের যুদ্ধকালীন অপরাধের অভিযোগে দু’টি মামলায় ফাঁসির রায় ঘোষণার সাথে সাথেদল-মত নির্বিশেষে সারা দেশের সাঈদীভক্তরা পুরো দেশ অচল করে দিয়েছিলেন। প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ৬০ জন নাগরিক গত ২৮ফেব্র“য়ারি এক দিনে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা কেউ কেউ বলছেন, গত দেড় শ’ বছরের দেশের ইতিহাসে নেই। বেগমজিয়া বলছেন, এটা গণহত্যা। একে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব সহিংসতা বলে যারা হালকাভাবে উপস্থাপন করার চেষ্ট করছেন,তাদের বিনয়ের সাথে নিবেদন করছি, দয়া করে তথ্য সংগ্রহ করে দেখুন, ৫৬ হাজার বর্গমাইলে সাঈদীভক্তের সংখ্যা কত? প্রশ্নকরতে চাই কোন দলে নেই সাঈদীভক্ত?
বিরোধী দলের সীমাবদ্ধতা?
পঞ্চম কাউন্সিলের পর থেকে এ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়াকে এক কাপড়ে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলোআদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে। ইলিয়াস আলীকে গুম করা হলো। গাড়ি পোড়ানো মামলায় জামায়াতের ক’জন শীর্ষ নেতাকেগ্রেফতার করে পরে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে সোপর্দ করা হলো। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিকে হত্যা করা হলো। আদালতের ঘাড়েবন্দুক রেখে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা হলো। আদালতের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিল করা হলো। সরকার এখনঅপোয় রয়েছে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করার রিট পিটিশনের রায়ের অপোয়।
কুইক রেন্টালের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, শেয়ারবাজার জালিয়াতি, পদ্মা সেতু দুর্নীতি করে বিশ্ব দরবারেদুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিতি, হলমার্ক-ডেসটিনি-ইউনিপে টুর ব্যাংকিং খাতের অর্থ ডাকাতি, রেলের নিয়োগবাণিজ্যে কালোবিড়ালের দৌরাত্ম্য, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে নোবেল বিজয়ী ড. মো: ইউনূসকে অপসারণ, অর্ধশতাধিক মামলা দিয়ে আমার দেশসম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কারা নির্যাতন, বৌদ্ধ জনপদে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বিশ্বজিৎকে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা,এতসব কুকর্মের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বিরোধী দল ব্যর্থ হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলা
৭ মার্চ ২০১৩ পল্টন এলাকায় ভাঙচুর ও হামলার ঘটনায় বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ এমপি, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমান উল্লাহআমান, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী এমপি, বরকত উল্লাহ বুলু এমপি, মির্জা আব্বাস, যুুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনআলাল, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরব, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, সাধারণসম্পাদক মীর সরাফত আলী সপুসহ ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আজিজুল বারীহেলাল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল বারী বাবু, আমীরুল ইসলাম খান আলীম, আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল,হাবিবুর রশীদ হাবিবসহ ৪৪ জনের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে একটি মামলা হয়েছে। অন্য দিকে জামায়াতের ৩৫ জন নেতাকেঅভিযুক্ত করে একই ধরনের আরেকটি মামলা হয়েছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে ১৫ মে ২০১২ প্রথমবার গ্রেফতারের সময় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনাহয়েছিল, দেশের সবচেয়ে সুরতি এলাকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে ফ্যালকন টাওয়ারের সামনে গত ২৯ এপ্রিল ২০১২ একটিমোটরযানে অগ্নিসংযোগের পরিকল্পনা ও উসকানি দিয়েছিলেন তিনি। এম কে আনোয়ার, ব্রি. জে. (অব হান্নান শাহ এবং ড.খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগে মামলা করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, ২৯ এপ্রিল ২০১২ সকাল৯টায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, দু’জন বিএনপি সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ওমাহবুব উদ্দিন খোকন; বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি প্রধান আন্দালিব রহমান পার্থ এমপি অন্যদের সাথে নিয়ে বাসে অগ্নিসংযোগ করতেসেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিকে পঙ্গু ও ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে জিয়াপরিবার এবং বিএনপিরশীর্ষনেতাদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা অসাংবিধানিক মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকার রুজু করে গিয়েছিল, সেসব এখনো আদালতেবিচারাধীন রয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ মতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তারা তথাকথিত ওয়ান-ইলেভেনের পর যেসবমামলা রুজু করেছিল, সেগুলো ইতোমধ্যে মতার দাপটে সাফসুতরো হয়ে গেছে। এ মামলাগুলোর দ্রুত রায় দিয়ে দোষী সাব্যস্ত করেআগামীতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়াসহ বিরোধী দলের অনেক ডাকসাইটে নেতাকে নির্বাচনের বাইরে রাখারকূটকৌশল হিসেবে ঝাঁকে ঝাঁকে মামলা রুজু হচ্ছে বলে অভিজ্ঞমহলের ধারণা।
ইলিয়াস আলীসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে হত্যা ও গুমের মাধ্যমে নির্বাচনী আসনগুলোতে মতাসীন দলের বিজয় নিশ্চিত করাই একমাত্রউদ্দেশ্য।
দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র কখনো সুসংহত থাকে না। মতাসীনদের একদলীয় তাণ্ডবে গণতন্ত্রের নাভিশ্বাস ওঠে।এখনই বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি মজবুত ভিতের ওপর দাঁড় করানো না গেলে এক দফার আন্দোলন কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারপুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাফল্য সুদূরপরাহত। আপাদমস্তক সৎ, নিখাদ দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতিজিয়াউর রহমানের আদর্শ এখনো দলটির অনুপ্রেরণার যাবতীয় উৎস। বেগম খালেদা জিয়ার প্রশংসনীয় নেতৃত্ব তৃণমূল কর্মীদেরকাছে সমাদৃত। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী দলটিকে আধিপত্যবাদী শক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রেররাকবচ হিসেবে দেশপ্রেমিক নাগরিকেরা ভাবতে পচ্ছন্দ করে। বৃহৎ দলটির কোনো কোনো স্থানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা কদাচিৎঅভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টি করে। সেসব স্থানে কাউন্সিল করে ভোটাভুটির মাধ্যমে দলীয় নেতৃত্ব ঠিক করাই অধিকতর গণতান্ত্রিক।চেয়ারপারসনের অফিস থেকে কমিটি করে দেয়ায় অন্তর্কলহ বাড়ে বই কমে না। জানবাজ তৃণমূল কর্মীদের আন্দোলন-সংগ্রামেঅবদান বিবেচনায় রেখেই ইনসাফমাফিক পদ-পদবির বিলিবণ্টন হলে কোন্দল না থাকারই কথা। তৃণমূল সংগঠনের কর্মীদেরপ্রাধান্য দেয়ার তারেক জিয়া অনুসৃত নীতি এখনো অনুসরণীয়। আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে মামলা মোকদ্দমায় জর্জরিত,শারীরিকভাবে পঙ্গু তৃণমূল কর্মীদের কেন্দ্র থেকে সার্বণিক সাহায্য-সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে না বলে যথেষ্ট অভিযোগ রয়েছে। দলেরমহাসচিব আর কত কাল ‘ভার’ বইবেন? মিডিয়ার খোঁজখবর নেয়ায় এ দলটি এত কৃপণই বা কেন? বিএনপিকে মনে রাখতে হবে,জামায়াত-শিবির নির্মূলের পরই এ দলটি হবে নির্মূলকারীদের একমাত্র নিশানা। এ মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই।বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিল শিগগির অনুষ্ঠিত হোক ও সফল হোক!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন