বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৩

রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রসঙ্গে



সুন্দরবন সংলগ্ন রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ভারতের সাথে সম্প্রতি তিনটি চুক্তি সম্পাদন করেছেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ সংকট নিরসনের জন্য ভারতের সাথে যৌথ উদ্যোগে স্থাপিতব্য এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দেশের অন্যতম বৃহত্তম বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পরিণত হবে বলে সরকারিভাবে দীর্ঘদিন ধরেই প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, এই কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলে বাংলাদেশে আর বিদ্যুৎ সংকট থাকবে না। এর সাথে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন মেঘনাঘাট ডুয়েল ফুয়েল প্লান্টটি চালু হলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে এবং ব্যয়বহুল রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহের কার্যকারিতা অনেক ক্ষেত্রে  হ্রাস পাবে। বাংলাদেশে বিদ্যমান বিদ্যুৎ সংকটের প্রেক্ষাপটে স্থায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প আছে বলে আমরা মনে করি না। কিন্তু তথাপিও ভারতের সাথে যৌথ মালিকানাভিত্তিক (৫০:৫০) এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির যৌক্তিকতা নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে এবং সূচানলগ্ন থেকেই দেশের পরিবেশবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক মহল থেকে এই কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করা হচ্ছে। তাদের বিরোধিতার মূল কারণ তিনটি।
পরিবেশবিদরা শুরু থেকেই বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলে আসছেন যে, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বৃক্ষরাজিসমৃদ্ধ সুন্দরবন সন্নিহিত এলাকায় কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হলে এ থেকে যে ধোঁয়া উদগিরণ হবে তার বিষাক্ত প্রভাবে আশপাশের বিশাল এলাকায় পরিবেশ দূষণ ঘটবে এবং সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। এতে যে ক্ষয়ক্ষতি হবে তা দেশ ও জাতির জন্য হবে অত্যন্ত ভয়াবহ এবং ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন দিয়ে তা পোষানো যাবে না। এখানেও আবার একটি কথা রয়েছে, সমঅংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ভারত ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃক এই কেন্দ্রটি নির্মিত হলেও বাংলাদেশকে ২৫ বছর ধরে এই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে নিতে হবে। বিদ্যুতের ইউনিটপিছু মূল্য কি হবে সে সম্পর্কে অবশ্য কিছু জানা যায়নি। এই অবস্থায় দেশের অর্থনীতিবিদরা আপত্তি তুলেছেন। যে কোন প্রকল্প তা বড় হোক বা ছোট হোক, অনুমোদন এবং নির্মাণের  আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তার ওপর একটি সম্ভাব্যতা জরিপ চালাতে হয় এবং সংশ্লিষ্ট প্রকল্প থেকে দেশ ও জাতি কিভাবে কতটুকু লাভবান হবে তার হিসাব-নিকাশও কষতে হয়। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ মালিকানাধীন যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপিত হবে তার ব্যাপারে বিস্তারিত কোন জরিপ হয়নি। পরিবেশবিদরা এ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে কোন ক্লিয়ারেন্স দেননি। এর অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা সম্পর্কেও  কোন জরিপ হয়নি। এই অবস্থায় সুন্দরবনকে জিম্মি করে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কোন যৌক্তিকতা আমরা খুঁজে পাই না। আবার যৌথ কোম্পানিটি কিসের ভিত্তিতে কোন কোন শর্তে গঠিত হবে, কার দায়-দায়িত্ব কতটুকুন হবে সে সম্পর্কেও জাতিকে অন্ধকারে রেখে তিনটি চুক্তি সম্পাদনের বিষয়কে আমরা অস্বাভাবিক বলে মনে করি। সরকার দেশের মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধানে ইতোমধ্যে বিরাট ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। মেগা আকারের এই প্রকল্প প্রতিষ্ঠার নাটক করে তারা মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন কি না তা আমরা জানি না। যদি তা করে থাকেন তাহলে দেশের মানুষ অবশ্যই তাদের প্রতারণা ধরে ফেলতে পারবেন। তবে বাস্তবতা যাই হোক না কেন রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে সহজভাবে গ্রহণ করা যায় না। আবার আরও একটি প্রশ্নও এখানে রয়েছে। রামপালে স্থাপিতব্য বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে কয়লা ব্যবহার হবে তা ভারত থেকে আমদানি করতে হবে এবং চুক্তিতে এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেয়া আছে। ঐ কয়লার মান এবং দাম সম্পর্কেও আমরা কিছু জানি না। বাংলাদেশে আমরা কয়লার ওপর বসে আছি। একটি কয়লাখনি থেকে ইতোমধ্যে কয়লা উৎপাদন শুরু হয়েছে এবং তার ভিত্তিতে কয়লাখনির নিকটেই একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে। এই কেন্দ্রটির পরিচালনাগত সমস্যাবলী সমাধানের কোন উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করছেন না। অপরাপর কয়লাখনিগুলো থেকে কয়লা উত্তোলনের ফলপ্রসূ উদ্যোগও দেখা যায় না। যদিও বাংলাদেশের কয়লার মান এশিয়া-ইউরোপের অনেক দেশের কয়লার মানের তুলনায় অনেক উন্নত। এই অবস্থায় সরকার দেশী উন্নতমানের কয়লা ব্যবহার না করে ভারতীয় কয়লার ওপর ভিত্তি করে কেন রামপালের ন্যায় একটি সংবেদনশীল এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা জাতির কাছে পরিষ্কার নয়। কাজেই আমরা মনে করি বিদ্যমান বাস্তবাতার আলোকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের  স্থান যেমন পরিবর্তন হওয়া বাঞ্ছনীয় তেমনি আমদানিকৃত কয়লার পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে দেশী কয়লা ব্যবহার করা উচিত।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads