অবশেষে গ্রেফতার হলেন আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, সাহসী কলম সৈনিক মাহমুদুর রহমান। প্রায় ৪ মাস থেকে গুঞ্জন শুনা যাচ্ছিল, গ্রেফতার হচ্ছেন মাহমুদুর রহমান! বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধিতাকারী মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি নিজামুল হকের গোপন কথাবার্তা স্কাইপ হ্যাকের মাধ্যমে ফাঁস করে ‘দ্যা ইকোনমিস্ট’। আর সেই স্কাইপ কেলেঙ্কারি বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করে ‘আমার দেশ’। যা দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে।
স্কাইপ হ্যাকের মাধ্যমে গোপন কথাবার্তা প্রকাশিত হওয়ার পর এক পর্যায়ে পদত্যাগ করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি নিজামুল হক। সেই সময় থেকে শুনা যাচ্ছিল, যে কোন সময় গ্রেফতার হতে পারেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। এমনকি বন্ধ হয়ে যেতে পারে আমার দেশ!
১১ এপ্রিল। সকালে আমার দেশ পত্রিকা অফিসের চারপাশে অবস্থান নেয় পুলিশ প্রশাসন। সকাল পৌনে ৯টায় সাদা পোশাকে আমার দেশ কার্যালয়ে প্রবেশ করে পুলিশের একটি টীম। অল্প সময়ের মধ্যেই গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। ১৪ ডিসেম্বর ’১২ এ তেজগাঁও থানায় দায়েরকৃত তথ্য প্রযুক্তি ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
সকাল ৯টায় মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ে তাকে নেয়া হয়। পরবর্তীতে সাড়ে ৩টায় তাকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা হয়নি। আমি জানি সরকারের নির্দেশে আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর সে কারণেই আমাকে জামিন দেয়া হবে না। রিমান্ড দেবে। আদালত সরকারের কথায় চলে। আর সে কারণেই আমার পক্ষে কথা বলার জন্য আমি কোন আইনজীবী নিয়োগ করিনি। তেজগাঁও থানায় ৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আমি ভাংচুর করিনি। ফার্মগেট ও কারওয়ানবাজারে ২৬ ও ২৭ মার্চ যে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্য নয়। কারণ আমি আমার দেশ পত্রিকায় অবরুদ্ধ ছিলাম। বিষয়টি হাস্যকর। মিথ্যাচার করছে রাষ্ট্রপক্ষ।’
দ্যা ইকোনমিস্ট সম্পাদক স্কাইপ কথোপকথন হ্যাকের ব্যাপারে বলেছেন, ‘হ্যাক করা ঐ তথ্য তাদের হাতে আসায় জনস্বার্থে সেই তথ্য প্রকাশ তারা সমুচিত বলে মনে করেছে, তাতে হ্যাক করার অপরাধ তাদের ওপর বর্তায় না।’ স্কাইপ সংলাপ প্রকাশের বিষয়ে আমার দেশ’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেছেন, ‘আমার দেশ কারো মনগড়া মন্তব্য প্রকাশ করে না। ইকোনমিস্ট পত্রিকায় স্কাইপ সংলাপ প্রকাশের পর আমার দেশ পত্রিকায় তা প্রকাশ করা হয়।’ অন্যদিকে, গ্রেফতারের পর স্কাইপ কথোপকথন ফাঁস, ফাঁসকারীর তথ্যসহ সার্বিক বিষয়ে অবহিত হওয়ার জন্যই মাহমুদুর রহমানের ১৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।’
পত্রিকা সম্পাদক গ্রেফতার ও তাকে রিমান্ডে নেয়ার পর রাতে আমার দেশ প্রেসে তল্লাশি অভিযান চালায় পুলিশ। এক পর্যায়ে তদন্তের কথা বলে ছাপাখানা জব্দ করে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। এতে বিপাকে পড়ে আমার দেশের প্রকাশনা। প্রিন্টিং প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেশন বিধি অনুসরণ করে বিকল্প ছাপাখানায় সীমিত সংখ্যক পত্রিকা ছাপাবার চেষ্টা করা হয়। পরবর্তীতে তাও বাধার মুখে পড়ে। যার ফলশ্রুতিতে আমার দেশ পত্রিকা ছাপা আপাতত বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে ঐ পত্রিকার গ্রাহক ও পাঠকদের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। উদ্বিগ্ন মহল মনে করছেন, স্থায়ীভাবে আমার দেশ বন্ধের পাঁয়তারা চলছে!
১৬ এপ্রিল। তথ্য অধিদফতরে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, দৈনিক আমার দেশ প্রকাশের অনুমোদন (ডিক্লারেশন) বাতিল করা হয়নি। পত্রিকাটি ছাপাতে কোনো বাধা নেই। তবে আইন মেনে ফরম ‘বি’ স্বাক্ষর করে তারা প্রকাশনা চালাতে পারে। তিনি বলেছেন, ফৌজধারী অপরাধের কারণে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৬ ও ৫৭ ধারায় মামলা করা হয়েছে। এই আইনের ৮০ ধারা অনুযায়ী অপরাধ সংশ্লিষ্ট প্রেসের মালামাল জব্দ করা হয়েছে। এসব কার্যক্রম রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা করেছে। এর সাথে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীন প্রকাশের কোনো সম্পর্ক নেই।
তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ বলেন, ‘বর্তমান সরকার আইন বহির্ভূতভাবে গত ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টায় দৈনিক আমার দেশের তেজগাঁওয়ে অবস্থিত ছাপাখানায় তালা দেয়। ডিবি অফিসের সার্চ ওয়ারেন্টের কথা বলে দুই ঘণ্টা তল্লাশি শেষে অধিকতর তদন্তের অজুহাতে ডিবি পুলিশের একটি দল ছাপাখানা তালা দিয়ে চলে যায়। এরপর বিকল্প ব্যবস্থায় আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেসে আমার দেশ প্রকাশ করা হয়। প্রিন্টিং প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট (ডিক্লারেশন এ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) ১৯৭৩ অনুযায়ী পত্রিকা প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই জেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়। সেখানে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে অভিযান চালিয়ে পত্রিকার প্রকাশিত সব কপি বাজেয়াপ্ত এবং ১৯ জন বাইন্ডারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এমনকি মিথ্যা অভিযোগ এনে দৈনিক আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মাহমুদা বেগম ও দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদকে আসামী করে একটি মামলা করে জেলা প্রশাসন।’ তিনি বলেন, ‘তথ্য মন্ত্রীর কোনো সৎ উদ্দেশ্য থাকলে, অবিলম্বে আমার দেশের ছাপাখানার তালা খুলে দিয়ে এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মাহমুদা বেগম ও দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদের নামে করা মামলা প্রত্যাহার করা হোক।’
মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের পর থেকে নানা প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি। কেউ কেউ সন্তোষ প্রকাশ করে বলছেন, ‘মাহমুদুর রহমান দেশে বিশৃংখলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছেন। তিনি দেশে সাম্প্রদায়িক একটি শক্তির উত্থানে মদদ দিচ্ছেন। তাই এই মুহূর্তে তাকে গ্রেফতার করা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।’
সাংবাদিক ও কলামিস্ট সাদেক খান মনে করেন, ‘স্পষ্টবাদী মাহমুদুর রহমান শাসকগোষ্ঠী দ্বারা নির্যাতিত হয়ে জনসমাজের ‘হিরো’ বা নন্দিত নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন। তবে ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বিষয়টাকে দেখছেন উপসর্গ হিসেবে, তারা বলছেন, এ দেশের রাজনীতিতে অন্য কোনো দেশের মতোই কাঠামোগত পরিবর্তনের পূর্ব লক্ষণÑএসব বেপরোয়া সরকারি পদক্ষেপ।’
নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবির একটি বিদেশী সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমি মাহমুদুর রহমানের মতের সঙ্গে মোটেই একমত নই। তাই বলে তার গ্রেফতার ও রিমান্ড চোখ বুঁজে মেনে নেবো তা হয় না।’ আরেকজন অভিজ্ঞ সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান কয়েকদিন আগে এক টকশোতে মন্তব্য করেন, ‘আমাদের অনেকেই মাহমুদুর রহমানের সমালোচনা করেন। তার পেশাদারিত্ব নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মাহমুদুর রহমান একজন পেশাদার সাংবাদিক না হলেও বর্তমানে তার নির্ভীক ভূমিকা ও আপোষহীন পদক্ষেপের কারণে তিনি আমাদের ছাড়িয়ে অনেক উপরে অবস্থান করছেন।’
সম্প্রতি মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নিজস্ব ওয়েবসাইটে পোস্ট করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর আরেকটি আঘাত আসে গত ১১ এপ্রিল। এদিন পুলিশ গ্রেফতার করে বিরোধী মতের দৈনিক পত্রিকা আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহের এবং হ্যাক হওয়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ১-এর সাবেক এক বিচারক ও প্রবাসে অবস্থান করা এক আইনজীবীর স্কাইপ কথোপকথন প্রকাশের। ওই কথোপকথনে আন্তর্জাতিক আদালতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্যা ইকোনমিস্ট-এ’। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ব্যক্তি বিশেষ এবং মিডিয়াকে আপত্তিকর রিপোর্ট ছাপার অভিযোগে টার্গেট করা বন্ধ করতে হবে সরকারকে। কারণ, সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মিডিয়ার একটি মৌলিক অধিকার। আমরা চাই না, কেউ এই স্বাধীনতাকে অপব্যবহার করুক। তবে, যদি মিডিয়া দেশ ও জাতির কল্যাণে ভূমিকা রাখে, দেশের অগ্রগতিতে সহায়তা করে, গঠনমূলক, যৌক্তিক ও বাস্তব প্রক্রিয়ায় স্বাধীন মতপ্রকাশ করে, তাতে বাধা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন