দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেফতার হলেন আলোচিত-সমালোচিত জনপ্রিয় সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। গত ১১ এপ্রিল পুলিশ ও সাদা পোশাকধারী গোয়েন্দা কর্মকর্তারা একপ্রকার টেনে-হিঁচড়ে কারওয়ান বাজারের পত্রিকা অফিস থেকে তাকে তুলে নিয়ে গেলেন মিন্টু রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে। ১৩ দিনের রিমান্ডে তার অবস্থা কেমন হয়েছে তা সহজে অনুমান করা যায়। এখন তিনি পিজি হাসপাতালে সঙ্কটজনক অবস্থায়। কূটকৌশল প্রয়োগ করে দ্বিতীয়বারের মতো বন্ধ করে দেয়া হলো পত্রিকাটির প্রকাশনা। গত ১৫ এপ্রিল থেকে মায়ের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা, আমার দেশ জব্দ ও ১৯ জন সংবাদকর্মী গ্রেফতারের প্রতিবাদে আমরণ অনশন শুরু করেছেন মাহমুদুর রহমান। যখন লেখাটি প্রেসে যাচ্ছে তখন পর্যন্ত অনশন অব্যাহত রেখেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্রযুদ্ধের অগ্রনায়ক জাসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, আমার দেশের ডিকারেশন বাতিল করা হয়নি। তাহলে কেন পুলিশ পত্রিকা প্রকাশে বাধা দিলো? পত্রিকা কর্তৃপক্ষ বলেছে প্রিন্টিং অ্যাক্টের নিয়ম মেনেই তারা পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিল। মাহমুদুর রহমানকে যারা চেনেন তারা স্বীকার করবেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন তিনি। মহাজোট সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে দেশে আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, দুর্নীতি, দলীয়করণ, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, হত্যা, গুম, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতারসহ সরকারের স্বেচ্ছাচারী ফ্যাসিবাদী আচরণের বিরুদ্ধে দৈনিক আমার দেশের কঠোর সমালোচনা, সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনা প্রভৃতি কারণে পত্রিকাটির কাটতি দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে।
মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুদ্দিন নাসিম ও সুইজারল্যান্ড প্রবাসী ঘাদানিক নেতা ড. জিয়াউদ্দিনের মধ্যকার স্কাইপ সংলাপ ব্রিটেনের অন্যতম শীর্ষ পত্রিকা দি ইকোনমিস্ট প্রকাশ করে দেয়, যা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক বির্তকের জন্ম দেয়। যুদ্ধাপরাধের বিচার ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারপতির স্কাইপ সংলাপের কথোপকথন বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার মর্যাদা, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। প্রকাশিত স্কাইপ সংলাপটি জনস্বার্থে মাহমুদুর রহমান তার পত্রিকা দৈনিক আমার দেশে প্রকাশ করেন। স্কাইপ সংলাপটি আমার দেশে প্রকাশিত হওয়ার পর বিচারপতি নিজামুদ্দিন নাসিম ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগ করেন।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। ওই দিন বিকেলে কয়েকজন ব্লগার শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি দেয়। এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ গণমাধ্যমের বিশেষ আগ্রহের বদৌলতে দেশবাসী মোটামুটি ওয়াকিবহাল। জনজাগরণ মঞ্চ থেকে ইসলামি ও ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং শিশুদের মুখ দিয়ে ফাঁসির দাবিতে স্লেøাগান দেয়া হয়। গণজাগরণ মঞ্চের সাথে সংশ্লিøষ্ট কিছু নাস্তিক ব্লগার তাদের ব্লগে ইসলাম, আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ কটূক্তি প্রকাশের অযোগ্য ভাষা ব্যবহার করে তা ব্লগে ব্লগে ছড়িয়ে দেয়। তবে ঘটনার প্রধান সূত্রপাত ঘটে একজন ব্লগার রাজীবের খুন হওয়ার মধ্য দিয়ে। রাজীব খুন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী বিশেষ আগ্রহে তার বাসায় যান। তাকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ ঘোষণা করেন। দৈনিক ইনকিলাব সর্বপ্রথম নিহত ব্লগার রাজীবের ব্লগ থেকে আল্লাহকে অবমাননা করে, রাসূল সা:-এর চরিত্রহনন করে অশোভন, অশালীন বক্তব্যগুলো প্রকাশ করে দেয়। পরবর্তী সময়ে নয়া দিগন্ত ও দৈনিক আমার দেশ আরো কিছু নাস্তিক ব্লগারের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা সেসব লেখা প্রকাশ করে, যা ৮৫ শতাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার করে। মানুষ গণজাগরণ মঞ্চ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। হেফাজতে ইসলাম নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তির দাবিতে মহাসমাবেশের ডাক দেয়। ৬ এপ্রিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশের লোকসমাগম ঠেকাতে সরকারের সমর্থনে হরতালের ডাক দেয় কয়েকটি সংগঠন। সরকারি নির্দেশে বন্ধ করে দেয়া হয় দূরপাল্লার বাস, লঞ্চ, স্টিমার ও রেল চলাচল। ছোট ছোট স্পিড বোট ও নৌকাও সরিয়ে নেয়া হয় নদীপথ থেকে। সব বাধা উপেক্ষা করে ভোর থেকে মানুষ জড়ো হতে থাকে শাপলা চত্বরে। ইতিহাসের বৃহত্তম সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় সে দিন। ধর্মীয় অনুভূতি রক্ষায় দৈনিক আমার দেশের ভূমিকা ছিল একজন বিচক্ষণ নাবিকের মতোই। প্রতিকূল পরিবেশে মাহমুদুর রহমানের দৃঢ় মনোবল সেদিন ‘নষ্টদের’ সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছিল।
মাহমুদুর রহমান একজন পরিচ্ছন্ন মেধাবী সাংবাদিক। পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে আসার আগে তিনি দেশের একটি বৃহত্তর শিল্পগোষ্ঠীর শীর্ষ ব্যক্তি ছিলেন। বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকার আমলে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান ও জ্বালানি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান বাংলাদেশের বৃহত্তম সম্ভাবনাময় সিরামিক শিল্পের সাথে এক যুগের বেশি সময় কাজ করেছেন। তার বিশাল কর্মময় জীবনে সততা ও পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে কোনো অভিযোগ নেই।
এক-এগারোর অসাংবিধানিক মইন-ফখরুদ্দীনের সরকারের বিরুদ্ধে কলম চালিয়েছেন তিনি নির্ভীকভাবে। প্রকাশ্যে তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তব্য দিয়েছেন ক্ষমতাসীনদের রক্তচু উপেক্ষা করে সাহসিকতার সাথে। ভয়-ভীতি প্রদর্শন, হুমকি-ধমকি তাকে টলাতে পারেনি এতটুকুও। মইন-ফখরুদ্দীনের সরকার অসাংবিধানিক হলেও এই অকুতোভয় কলম সৈনিককে গ্রেফতারের সাহস দেখায়নি।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার অঙ্গীকার, জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকারের চার বছরের শাসনামলে রাষ্ট্রের সব গুরত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর চেন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে। দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল করেছে বিশ্বব্যাংক। হলমার্ক কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘুষের বস্তাভর্তি টাকা আটকের ঘটনাসহ সরকারের সব অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সত্য, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনা, যা শেষ পর্যন্ত মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সরকারের আরো একটি ফ্যাসিবাদী আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটল। সত্য প্রকাশে সাহসী ভূমিকার কারণে প্রতিদিন বাড়ছিল পত্রিকাটির প্রচার সংখ্যা। দৈনিক আমার দেশের জনপ্রিয়তা দেশের প্রচার সংখ্যায় শীর্ষ দৈনিকটির ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছিল, যা সরকারের নীতিনির্ধারকদের রীতিমতো বিচলিত ও ভীত করে তুলেছিল। মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার ও কূটচালের মাধ্যমে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করতে পেরে আপাতত তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছেন।
সাংবাদিকদের একটি অংশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। দেশের একটি জনপ্রিয় পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেফতার এবং ১৩ দিনের রিমান্ড দিয়ে যে মামলাগুলো তার বিরুদ্ধে দেয়া হলো সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কোন ধারা রক্ষা করতে তারা সরকারকে সমর্থন করছেন? গণমাধ্যম, সংবাদকর্মীদের এমন অদ্ভূত আচরণ সবাইকে ব্যথিত করেছে।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংবাদপত্রের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা প্রদান বা বিরোধী দলকে দমনের অপচেষ্টাই হলো ফ্যাসিবাদী শাসন। সরকারের এই ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ মাহমুদুর রহমান এখন সরকারের বন্দিশালায়। সরকারের বিরুদ্ধে মত প্রকাশে অসহিষ্ণু হয়ে সম্পাদককে গ্রেফতার করে পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে পারে তা অবাধ তথ্য প্রবাহের এই যুগে বর্তমান বিশ্বের কোথাও কল্পনা করা যায় না। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সেই অকল্পনীয় অপকর্মটিই করে দেখাল। তাদের পূর্বসূরিদের শাসনকালে শত শত সাংবাদিককে চাকরি হারাতে হয়। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরকারের দমন-পীড়ন, নির্যাতন, হয়রানি যে অশুভ পরিণাম ডেকে আনে সেটি এখনকার শাসকেরা ভুলে গেছেন অথবা ক্ষমতার মোহে পরোয়া করছেন না। ইতিহাস বলে দেশের মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কখনো ভুল করেনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাহমুদুর রহমানের প্রতিবাদী কলম বৃথা যেতে পারে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন