বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৩

কেয়ামত হবে, কেয়ারটেকার হবে না!


আগের দিনে মানুষ ‘ঘ্যাটাল’ বলতে বুঝত খেয়া ঘাটের মাঝিদের। কোথাও কোথাও তাদের ‘চৌধুরী’ বলার প্রচলন ছিল। সেই ঘ্যাটাল বা চৌধুরীরা খেয়াঘাট সরকারের কাছ থেকে সন পত্তন নিত। তখন অন্য কোনো শ্রেণীপেশা বা উচ্চবর্ণের মানুষদের এ কাজে দেখা যায়নি। কেননা ঘ্যাটাল বা ঘাটের চৌধুরীরা খেয়া পারাপারের পয়সা যাত্রীদের থেকে যেভাবে ও যে ভাষায় আদায় করতেন, তা ভদ্র মানুষের পে সম্ভব হতো না। তাই তারা পছন্দ করতেন না কাজটা। তবে জমিদার ও ভূ-স্বামী চৌধুরীদের সাথে ঘ্যাটাল চৌধুরীদের তুলনা করা যায় না। হোটেল রেস্টুরেন্ট, দোকানের দেয়ালে, বাসে লেখা দেখতে পাই, ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’। অর্থাৎ একজন মানুষের রুচি শালীনতা, শিষ্টাচার, কথাবার্তা এবং আচার আচরণে পরিমাপ করা যায় সেই মানুষটির বংশস্তর। পোশাকে কেতাদুরস্ত কোনো মানুষের আচরণ ও কথাবার্তা শালীনতার সীমা অতিক্রম করলে চেনা যায়, তিনি সম্ভ্রান্ত বংশজাত কি না। বস্তির হিংসুটে মুখরা মহিলা পার্লারি মেকআপ নিয়ে তার অভদ্র স্বভাব ঢাকার শত চেষ্টা করেও পারে না। যখন সে পরিপাটি, মার্জিত ও স্বল্পভাষী কোনো মহিলাকে দেখে, তখন তার শরীর হিংসায় জ্বলতে থাকে।

আর অগ্নিকন্যাদের শরীরটাই আগুনে ভরা বলে বক্তৃতার সময় মুখ দিয়ে আগুনের হলকা বের হয়। মুখ থেকে হলাহল বা বিষ ঢেলে রাগ মেটানোর চেষ্টা করেন। গত ৩০ মার্চ বগুড়া শহরের আলতাফুন্নেছা মাঠে জেলা ১৪ দলের জনসভায় একসময়ে অগ্নিকন্যা উপাধি পাওয়া কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর প্রায় কুড়ি মিনিটের ভাষণে প্রতিটি শব্দে ছিল বিরোধী দলের নেতা  ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি তার মজ্জাগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা।
ইউরোপের বিখ্যাত প্যারাসাইকোলজিস্ট বিজ্ঞানী লিড বি’র মতে, ঘৃণা ও গালি এমন অস্ত্র, যা সেই মানুষের অন্তরের মধ্যে আগুন হয়ে অবস্থান করে। আমরা জানি না বেগম খালেদা জিয়ার ওপর এত  ক্রোধ, কেন? কারো বাড়া ভাতে ছাই দেয়ার মানুষ তো খালেদা নন! আর মতিয়া চৌধুরী কৃষিমন্ত্রী বলে তার ‘পাকা ধানে মই’ দিতে যাবেন কেন? কৃষিমন্ত্রী ধান উৎপাদন বৃদ্ধির কথা শোনান; তাতে খালেদা জিয়ার লাভ ছাড়া তি কী? ধান চাল তো আর সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে না যে, তা বেগম জিয়ার সরকারের সস্তার আমলকে ছাড়িয়ে গেছে! বরং নির্বাচনের আগে ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানোর যে কথা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এর বাস্তবায়নে তার সরকারের ব্যর্থতা বিরোধী দলের জন্য সমালোচনা খোরাক জুগিয়েছে। বগুড়ার জনসভায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বললেন, ‘আল্লাহ ওয়াদা খেলাপকারীকে পছন্দ করেন না’। তাও তিনি কুরআনের আয়াত উল্লেখ করে বলেছেন। ধর্ম ব্যবসায়ী কারা? মতিয়া চৌধুরীর ওই কথার জের ধরে জনগণ বর্তমান সরকারকে অপছন্দ করলে তা দোষের হবে কেন? তার কথার জের ধরে বলা যায়, আল্লাহ ওয়াদা খেলাপকারী এই সরকারকে পছন্দ করছেন না। সেখানে বিরোধী দল সরকারকে মতা ছাড়তে বাধ্য করার আন্দোলন করাই তো উচিত? বরং তা না করলে তারা জাতির কাছে দায়ি হবেন বলে অনেকে মনে করেন। তাই বগুড়াবাসীর ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য দেখে বিচলিত নেতাকর্মীদের ভাঙা মন চাঙা করার ল্েয ৩০ মার্চ বগুড়ায় জনসভা করা হয়েছিল বলে মনে করা যায়। কিন্তু নেতাদের বক্তৃতায় ছিল না কোনো পরিমিতি। রুচিবোধ ও শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে কথা বলেছেন নেতানেত্রীরা। মতিয়া চৌধুরী তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বক্তৃতার সময় চোখমুখ খিঁচিয়ে দৃষ্টিকটু নানা অঙ্গভঙ্গি করেছেন। ‘নারী নেতৃত্ব হারাম, কাছে বসলে আরাম’ কথাটা তিনি অঙ্গের ভঙ্গিমা করে আর চোখ বন্ধ করে এমনভাবে বলেছেন, তাতে দর্শক-শ্রোতার মনে হয়েছে তিনি নিজেই যেন এক ধরনের অবাঞ্ছিত সুখানুভূতি অনুভব করছেন। অথচ সেই মানুষটিকে পর দিনই ঢাকায় একটি মিডিয়ার অনুষ্ঠানে ‘পরিমিতিবোধ’ সম্পর্কে নসিহত করতে দেখা গেল। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের ভাষণে ভালো কথার বদলে খিস্তিখেউড় শুনতে হচ্ছে। বগুড়ার জনসভায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম  বড় গলায় বললেন, ‘রোজকেয়ামত হবে কিন্তু কেয়ারটেকার সরকার আর হবে না’। প্রতিটি মুসলমানের বিশ্বাস, কেয়ামত সংঘটনের পর দুনিয়ায় কোনো কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। নাসিমের কথায় মনে হতে পারে, রোজকেয়ামত সংঘটনের পরও মহাজোট সরকার, আর আওয়ামী লীগের লোকজন টিকে থাকবেন। কার সুর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে নাসিম সাহেবদের কণ্ঠে? বগুড়ার জনসভায় বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ বলে আখ্যায়িত করে শুনি বলেন, তিনি জামায়াত নামের সাপের ঝাঁপি মাথায় চলছেন। তারা জিয়াউর রহমান সম্পর্কে তাদের আরেক নতুন আবিষ্কারের কথাও জানালেন। এমনকি তিনি বললেন, নতুন করে রাজাকারের তালিকা হলে তাতে জিয়াউর রহমানের নাম থাকবে এক নম্বরে। তাদের এই আবিষ্কারের পে ১৯৭১ সালের মে মাসে জিয়ার কাছে লেখা কোনো এক বিদেশী সেনা অফিসারের কথিত চিঠির বয়ান  দেন তারা। এ কথা শোনামাত্র জনসভায় আসা অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেন, এমন আজগুবি ও  খাপছাড়া কথা বলে বিএনপিকে জবাব দেয়ার সুযোগ করে দেয়া হলো। তারা বললেন, হাইকোর্ট দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানকে না হয় ঠেকানো হলো, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানকে রাজাকার বলে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেক দফা বিভক্ত করার খেলা শুরু হলো বুঝি!’
বগুড়ার জনসভায় এতসব গিবত ও মিথ্যাচারিতার মধ্যে বড় জোটের ছোট দলের নেত্রী শিরীন আখতার পর্যন্ত অপরিমিত বক্তব রাখা লোভ সামলাতে পারেননি। তিনি বলেন, বগুড়া মিথ্যাচারের ঘাঁটি।’ তার এ অবমাননাকর কথার মানে, আমরা যারা বগুড়ার মানুষ, তারা মিথ্যাবাদী। বগুড়া এখন নাকি শেখ হাসিনার ঘাঁটি। তার এ কথা শুনে আলতাফুন্নেছা মাঠের আশপাশের ভবনে ও বাড়িঘরে বসে যারা বক্তৃতা শুনছিলেন, তারা শুধু হেসেছেন। আর বলেছেন, মাথা… হলো নাকি?’
ওই দিন বগুড়ার ৩৮ লাখ মানুষের মধ্যে জনসভাস্থলে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল ঘরানার মানুষ কত পারসেন্ট ছিলেন? তা ছাড়া, বিভিন্ন গ্রামের স্কুল থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের দলীয় পরিচয়টা কী? তাদের কেন ব্যবহার করা হচ্ছে? এসব ছাত্রছাত্রীকে দেখে অনেকে বলেছেন, ‘তারা আওয়ামী প্রত্যঙ্গ লীগের সদস্য’। এই জেলায় কর্মরত সরকারের কৃষি বিভাগের চাকুরেদের ওপর অলিখিত নির্দেশ ছিল জনসভাস্থল আলতাফুন্নেছা মাঠে জনসভায় আসার। কৃষিমন্ত্রী বলে কথা! তার সভাস্থলে উপস্থিত না হলে গুঁতা খাওয়ার ভয়তো আছেই। মাঠে লোকজন দেখাতে হবে না? তাই সেদিন বগুড়ার কৃষি বিভাগের অফিস ছিল ফাঁকা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads