ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মানুষ অনেক চড়ামূল্যে কিছু অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞান অর্জন করেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো ওইসব অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞান থেকে কল্যাণ লাভের সৌভাগ্য সবার হয় না। তেমন চিত্রই আমরা লক্ষ্য করছি বর্তমান বাংলাদেশে। পারিবারিক জীবনে তো আমরা লক্ষ্য করেছিÑ স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের অধিকার ও কর্তব্যের প্রতি সচেতন না থাকলে, দোষ-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে বিবেচনা না করলে, বাদ-বিসংবাদ ও তিক্ততাকে ভুলে না গেলে, সীমাবদ্ধতাকে উপলব্ধি করে পরস্পরের প্রতি সদয় না হলে, পরস্পরকে সম্মান না করলে এবং আস্থার বদলে পরস্পরের চরিত্র হননে ব্যস্ত হলে সংসার সুখের হয় না বরং নরকে পরিণত হয়। অবশেষে ভেঙ্গে যায় স্বপ্নের সংসার। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র কি এর চাইতে ব্যতিক্রম কিছু? একথা ঠিক যে, পরিবারের চাইতে সমাজ বড়, সমাজের চাইতে রাষ্ট্র আরও বড়। এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের সমস্যা ও সমাধানের নানা পার্থক্যের কথা স্বীকার করেও বলা যায়, যে মৌলিক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবারকে সুখের সংসারে পরিণত করতে পারে; সেই দৃষ্টিভঙ্গি সমাজ ও রাষ্ট্রকেও সাফল্যের শিখরে উন্নীত করতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে আজ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির যেন দুর্ভিক্ষ চলছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে হিংসা-বিদ্বেষ, দমন-অবদমন, ব্লেমগেম আর চরিত্র হননের প্রপাগা-ায় যেন নরকে পরিণত হয়েছে। রাজনীতির ছলনায় শান্তিতে নেই সাধারণ মানুষ। তারা আর এই নরকে থাকতে চায় না। কিন্তু তাদের উদ্ধার করবে কে? জাতির সামনে এই প্রশ্ন যখন প্রকট হয়ে উঠেছে, তখন গত ১৩ এপ্রিল যেন মুক্তির বার্তা শুনতে পেল দেশের জনগণ। বিগত বছরগুলোতে জনগণ সরকার প্রধানের কাছ থেকে অনেক সান্ত¦নার বাণী শুনেছে, অনেক আশার কথা শুনেছে কিন্তু এমন কথা আর শোনেনি। এবার যে কথা তারা শুনেছে, সে কথা তাদের প্রাণের কথা। এমন কথার জন্যই জনগণ দীর্ঘকাল ধরে অপেক্ষা করছিল।
গত ১৩ এপ্রিল শনিবার গণভবনে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় সূচনা বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ হবে অসাম্প্রদায়িক দেশ। যে দেশে সব ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর মদিনা সনদ ও বিদায় হজের ভাষণে যেভাবে বলে গেছেন, ঠিক সেভাবেই দেশ চলবে।’ লক্ষণীয় বিষয় হলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য প্রচলিত ধারার কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, তাঁর বক্তব্যে রাষ্ট্র পরিচালনার আদর্শ ও মূলনীতি যেমন ব্যক্ত হয়েছে, তেমনি উচ্চারিত হয়েছে শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের আকাক্সক্ষাও। আদর্শ ও শান্তির এমন আকুতি আমরা সাম্প্রতিককালে আর কোনো সরকার প্রধানের কাছ থেকে শুনিনি। তাই তাঁর বক্তব্যকে আমরা বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে চাই। দেশের জনমনেও তাঁর বক্তব্য বিশেষভাবে দাগ কেটেছে। দেশের মিডিয়াগুলোতেও তাঁর বক্তব্য বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। তবে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তার বক্তব্যকে আস্থার সাথে গ্রহণ করা হয়নি। অনেকেই মহানবীর মদিনা সনদ ও বিদায় হজ্জের ভাষণের আলোকে দেশ পরিচালনার বক্তব্যকে রাজনৈতিক স্বার্থে ও জনসমর্থন আদায়ের কৌশল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অনেকেই প্রশ্ন রেখেছেন, বর্তমান সংবিধানের আলোকে এবং সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ইহলৌকিকতার বাতাবরণে প্রধানমন্ত্রী কি করে মদিনা সনদের আলোকে দেশ পরিচালনা করবেন? অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, প্রধানমন্ত্রীর দলে এবং সরকারে যেসব বাম ও নাস্তিক্যবাদী মানুষ রয়েছেন তারা কি মদিনা সনদ ও বিদায় হজের ভাষণের আলোকে দেশ পরিচালনায় অনুকূল ভূমিকা রাখবেন? এসব কারণে নাগরিকদের অনেকের মনেই কৌতূহলের সাথে সাথে এক ধরনের সংশয়ও সৃষ্টি হয়েছে। আলোচনা-সমালোচনা ও সংশয় প্রকাশের এমন ধারা আমাদের দেশে নতুন নয়। আর নানা কারণে আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট তো আমাদের দেশে এখন প্রকট। নেতিবাচক চেতনা আমাদের রাজনীতির আকাশকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে। এমন বাতাবরণ থেকে একটু বাইরে এসে আস্থার পথে হাঁটতে দোষ কী? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দলে এবং সরকারে নানা পথের, নানা মতের মানুষ আছে সে কথা আমরা জানি কিন্তু মদিনা সনদ বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক যে উপাদান প্রয়োজন তা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আছে। তিনি আস্তিক এবং ধর্মবিশ্বাসী মানুষ। মিডিয়ার কল্যাণে আমরা একথাও জেনেছি যে, তাঁর দিন শুরু হয় নামায ও পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে। নামায ও কুরআনের সঙ্গে যার দৈনন্দিন সম্পর্ক রয়েছে, তাঁর তো মদিনা সনদ ও বিদায় হজের নীতিমালার সাথে দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। এমন একজন মানুষ যখন দলের প্রধান হন, হন প্রধানমন্ত্রী এবং তার সিদ্ধান্তই যখন কার্যকর হয়, তখন তো তিনি মদিনা সনদের আলোকে দেশ পরিচালনার কাজে অগ্রসর হতেই পারেন। কাজটি সহজ নয় একথা আমরা জানি। কারণ মহানবী (সা.) এর মত মহামানবের জন্যও মদিনা সনদ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার কাজটি সহজ ছিল না। কিন্তু মহানবী (সা.) এবং তাঁর সাথীরা পৃথিবীর সামনে একথা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জবাবদিহিতার চেতনার আলোকে আদর্শ ও নীতিমালার ক্ষেত্রে নিষ্ঠাবান হলে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। ফলে তাঁরা আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে নরকতুল্য এক অন্ধকার সমাজকে আলোকিত ও শান্তিময় সমাজে পরিণত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এই যুগে মদিনা সনদের চেতনা অনুপস্থিত থাকায়, উজ্জ্বল আলোকমালার নিচে আমরা যেন ঝলমলে এক জাহেলিয়াতে বসবাস করছি। আস্থা-বিশ্বাস ও মানবিক বিবেচনার বদলে চাতুর্যের এ জাহেলিয়াতে আমরা ব্লেম-গেম ও কৌশলের নানা কসরত লক্ষ্য করে যাচ্ছি। এমন বাস্তবতায় কথা ও কাজের গরমিলের বর্তমান ভুবনে মদিনা সনদের মানবিক চেতনার কোনো বিকল্প আছে কী? এ কারণেই হয়তো দ্বন্দ্ব সংঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ, শঠতা ও প্রতারণার বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় তিত-বিরক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী দলীয় নেতা-কর্মীদের সামনে খোলামেলাভাবে তার বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করেছেন। এখানে আমরাও আমাদের আন্তরিক উপলব্ধির কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে পারি। পৃথিবীর ইতিহাসে মদিনা সনদ যে শুধু প্রথম লিখিত সংবিধান তাই নয়, যেসব কারণে মানব সমাজে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ ও অশান্তির সৃষ্টি হয়, তার মূল উৎপাটন করা হয়েছে, মদিনা সনদ ও বিদায় হজের ভাষণে। আর একথাও যে কোনো সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে, যে ¯্রষ্টা মহানবী (সা.)কে মদিনা সনদ ও বিদায় হজের ভাষণের অনুমোদন দিয়েছেন তিনি তা শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের কল্যাণের জন্যই দেননি। বরং তা দিয়েছেন সমগ্র মানব জাতির কল্যাণের জন্য। মদিনা সনদে ইহুদি, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য সম্প্রদায়গুলো ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে একটি সাধারণ জাতি গঠনের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল এবং এই চুক্তির মাধ্যমে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, ইসলামের শাশ্বত ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির অধীনে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারে। পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে আজ এই প্রশ্ন স্পষ্ট করেই উত্থাপন করা যায় যে, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মানুষ যদি সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী আদর্শের রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারে, তাহলে অন্যান্য ধর্ম ও মতের মানুষ ইসলামী আদর্শের রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারবে না কেন? মদিনা সনদের আলোকে তো অন্যান্য ধর্মমতের মানুষরা ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে একটি সাধারণ জাতি গঠনের লক্ষ্যে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার ব্যর্থতা এবং স্বদেশে রাজনৈতিক হিংসা-বিদ্বেষ ও নানা সঙ্কটের মুখোমুখি হয়ে মুক্তির আকাক্সক্ষায় হয়তো প্রধানমন্ত্রীর মনে মদিনা সনদের কথা বার বার দোলা দিয়ে যাচ্ছে। হয়তো সেই উপলব্ধি থেকেই প্রধানমন্ত্রী মদিনা সনদের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করার পর কিছু কর্তব্য পালন তাঁর জন্য অনিবার্য হয়ে উঠেছে। মদিনা সনদের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যেমন সংবিধান সংশোধনের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে, তেমনি দৃষ্টি দিতে হবে দল পুনর্গঠন ও নেতাকর্মীদের নৈতিক চরিত্র গঠনের দিকেও। রাসূল (সা.) মদিনা সনদের বাস্তবায়নে যেভাবে আদর্শের আলোকে সমাজ সংস্কার ও মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠনের কাজে অগ্রসর হয়েছিলেন, সে পথে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অগ্রসর হলে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে তাঁর জনসমর্থনের কোনো অভাব হবে না ইনশাআল্লাহ। তাই প্রসঙ্গত এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, একজন মুসলিম হিসেবে মদিনা সনদের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রত্যয় ব্যক্ত করার পরেও তিনি যদি আন্তরিকভাবে তাঁর শক্তি-সামর্থ্য ও যোগ্যতা এ পথে ব্যয় না করেন তাহলে মহান আল্লাহর কাছে তাঁকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। শুধু তিনি নন, মুসলিম হিসেবে অন্যান্য রাজনীতিবিদরাও যদি মহানবীর নির্দেশিত পথে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজ নিজ শক্তি, সামর্থ্য কাজে না লাগান, তাহলে তাদেরও জবাবদিহিতা থেকে মুক্তি নেই। জবাবদিহিতার এমন চেতনাই বর্তমান সঙ্কট থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে পারে। বিষয়টি উপলব্ধি করলেই সবার মঙ্গল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন