বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৩

আর নয় শোক এবার করুন বিচার


এবার ডেকে এনে শত শত মানুষকে হত্যা করা হলো। এরা কেউ বাংলাদেশের শত্রু ছিল না। এরা সবাই অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চারকারী পোশাক শিল্প শ্রমিক। আমাদের পরম বন্ধু। হোমরাচোমরা যারা অর্থনীতির ৭ শতাংশের প্রবৃদ্ধির হইচই খবর দিচ্ছেন, সেটি মূলত নির্ভর করছে এদের রক্ত ঘামের ওপর। ২০২১ সালে একটি পরিপূর্ণ ডিজিটাল বাংলাদেশ আর মধ্যম আয়ের স্বপ্নমাখা রাজনীতিক বাগাড়ম্বর এদের ওপর নির্ভর করেই করছি। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, এরা এখন আমাদের গিনিপিগ। আমরা যেনতেনভাবে এদের নিয়ে খেলছি।

কোনো ব্যাংক কর্তাকে অথবা গার্মেন্ট মালিককে রানা প্লাজায় ঢোকানো যায়নি বৃহস্পতিবার। মালিকেরা নিজেদের জীবনকে অপরিহার্য মনে করেন। কিন্তু সামান্য বেতনের গরিব গার্মেন্ট শ্রমিকদের জীবনকে এরা একই নিক্তিতে মাপেন না। ভবনটি ছিল ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার। স্থানীয় প্রশাসন তাই যেচে ঘোষণা করেছে এ ভবন সম্পূর্ণ নিরাপদ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসে যুবলীগের রানার ভবনটিতে কোনো সমস্যা নেই বলে জোরালো ভাষণ দেন। সরকারি কর্মকর্তা এখন জনগণের সেবক নয়; সেবক ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীদের।
আগের দিনই সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে সঙ্কেতটি দেয়া হয়েছিল। তোমরা সরে যাও যেকোনো সময় এটি ধসে যেতে পারে। ভবনটি পরিত্যক্ত হলে যুবলীগ নেতা রানার কী হবে! নয় নয়টি তলা, কোটি কোটি টাকার ভাড়া আদায় বন্ধ হয়ে যাবে! খবরে প্রকাশ রানার আরো কয়েকটি ভবন রয়েছে। সবচেয়ে মজবুতভাবে তৈরি ভবনটিতে তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে থাকেন। কারণ তাকে যেকোনোভাবে বেঁচে থাকতে হবে। অত অত কোটি টাকার নগদ আয় ভোগ করতে হবে; ফুর্তি আরাম আয়েশ তাকে করতেই হবে!
ভবন নির্মাণের নিয়ম-কানুন মেনে রানা প্লাজা তৈরি করা হয়নি। অনুমোদন ছিল ছয়তলার। কিন্তু নয়তলা করলে আরো কোটি টাকা বেশি আয় হবে। তাহলে উপায় কী, মানুষের জীবন দিয়ে রানার কী হবে? তাকে নয়তলাই বানাতে হবে। উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া প্রকৌশলীরা বলছেন, যথেষ্ট পরিমাণ রড সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়নি এ ভবনে। ইট বালি সুরকিও মানসম্পন্ন ছিল না। কেনইবা হবে, ভালো জিনিস ব্যবহার করলে টাকা বেশি খরচ হয়ে যাবে না? সে ক্ষেত্রে রানার কী লাভ? ভবন তৈরিতে ব্যয় কমাতে গিয়ে এখন শত শত গরিব নিরীহ শ্রমিককে প্রাণ দিতে হলো।
সরকারের ছায়ায় থেকে যুবলীগ নেতার লোভের জিহবা হাজার মাইল লম্বা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ কী জবাব দেবেন? ভবন বানানোর সময় পৌরসভা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল বিভাগ কী করেছে? কিংবা মঙ্গলবার যখন ভবনটিতে ভয়ঙ্কর ফাটল দেখা দিলো, স্থানীয় প্রশাসন ভবনটিতে কাজে নিযুক্ত হাজার হাজার মানুষের জীবন রক্ষায় কী উদ্যোগ নিয়েছেন? তারা কি শুধু যুবলীগ নেতার আয় রোজগার ঠিক রাখার দায়িত্ব পালন করেছেন! সরকারি কর্তৃপক্ষই তো ঘোষণা দেয়, এ ফাটল এমন কিছু নয়; আপনারা নির্দ্বিধায় ভবনে অবস্থান নিয়ে কাজ করতে পারেন।
আরো পেছনে রয়েছে সংখ্যালঘুদের জমি হারানোর আর্তনাদ। আজকের প্রিন্স রানা তখন তেলের ঘানি ঠেলেছেন। সরকারি দল করার কারণে ১৯৯৮ সালে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন বিরাট প্রভাবশালী। স্থানীয় রবীন্দ্রনাথ সাহার জমির ওপর তার লোভ হয়। জোর করে দখল করে নেন রানা প্লাজার বর্তমান জমিটি। জমি দখল থেকে শুরু করে অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ এবং সর্বশেষ ভবন ধসে যাওয়ার পর তাকে পালাতেও সহযোগিতা করা হয়েছে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন এমনকি এলিট ফোর্স র‌্যাবও তার জন্য সহযোগিতার হাত নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। অন্য দিকে জমির মালিক রবীন্দ্রনাথ সাহা সম্পত্তি হারিয়ে এখন পাগল। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যখন হিন্দুদের জমি দখল, তাদের উৎপাটন ও নির্যাতন করা হয়, সেটা কখনো সংখ্যালঘু নির্যাতন হিসেবে চিহ্নিত হয় না।
শত শত নাগরিককে হত্যা ও হাজার হাজার নাগরিককে আহত করার পর মানুষ এখন জানতে চাচ্ছে দোষীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। যে নির্বাহী কর্মকর্তা যুবলীগ নেতার প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে ভবনটি নিরাপত্তার ব্যাপারে সনদ দিলেন, যারা শ্রমিকদের পিটিয়ে জোরপূর্বক ভবনে ঢোকালেন, আর যারা ভবন নির্মাণে যথাযথ কোড না মানার পরও ভবনটি হতে দিলেন তাদের কাউকে কি আইনের আওতায় আনা হয়েছে? সম্প্রতি গার্মেন্টে বড় বড় হতাহতের ঘটনার দিকে তাকালে পাওয়া যাবে একেবারেই হতাশার চিত্র। এই সাভারেই স্পেকট্রাম গার্মেন্ট ধসে ৭৬ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছিলেন। তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লেগে মারা যান ১১৪ জন। রাষ্ট্র শোক জানিয়েছে, জাতীয় সংসদে আলাপ আলোচনা হয়েছে; এটুকুই সান্ত্বনা। ঘটনার কারণ উদঘাটন করা হয়েছে; কোনো মালিক বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন; কেউ শাস্তি পেয়েছেন আমরা দেখিনি।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী হতাহত শ্রমিকদের প্রতি আবেগ দেখিয়েছেন। উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে দাবি করে হরতাল প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতার প্রতি। জাতির চরম শোকের দিন অন্ততপক্ষে দুই নেত্রীকে কিছুটা কাছাকাছি আনার জন্য ভূমিকা রেখেছেন। বিরোধী নেতা হরতাল প্রত্যাহার করেন। প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান না জানালেও সম্ভবত হরতাল এভাবেই প্রত্যাহার করা হতো। সরকার বৃহস্পতিবার জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
সরকারের বিভিন্ন বাহিনী উদ্ধার অভিযানে নেমেছে। বিএনপি নয়াপল্টনে দলীয় ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আহত ব্যক্তিদের সরবরাহ করার জন্য রক্ত সংগ্রহ করেছে। ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন জরুরি ডাক্তারি সাহায্য নিয়ে গেছে আহতদের কাছে। হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকেরা রক্ত দিচ্ছেন। সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে ইবনে সিনা ও ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল। শোকাবহ ঘটনা জাতীয় ঐক্য গঠনের একটি আবহ তৈরি করেছে। প্রেসিডেন্টের শপথ নেয়া যদি অন্ততপক্ষে কয়েকটি দিন পিছিয়ে দেয়া হতো সেটি আরো ভালো হতো। অনেক ব্যক্তি ও কোম্পানি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানাতে দেখা যাচ্ছে। একজন নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক অবশ্যই আনন্দের। আনন্দের জন্য জাতীয় শোকের এদিনকে এড়ানো গেলে আরো ভালো হতো।
রানা প্লাজায় হতাহতেরা স্পেকট্রাম ও তাজরীনের ভাগ্য বরণ করুক এটা কেউ চায় না। জাতীয় শোক পালন করে হতাহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে সরকার দায়িত্ব শেষ করবে এমনটা যেন না হয়।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি গার্মেন্ট শিল্পে বাংলাদেশের শেষ ট্র্যাজেডি হোক। সেজন্য ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে দায়ী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতেও সরকার আন্তরিক হবেন। ডেকে এনে যারা মানুষ হত্যা করল, তারা যেন কোনো ফাঁকফোকর গলিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে সেই প্রত্যাশা সবার।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads