শাহবাগ সমাবেশে ‘শাহবাক’ (শাহী কথা বা রাজার কথা) এর হলুস্তুলে যে সংবাদটি চাপা পড়ে গেছে তা হলো সরকার অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সীদের ‘শিশু’ সংজ্ঞায়িত করার আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। সরকার এটি আইনে পরিণত করলে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে অনূর্ধ্ব ১৮ নারী ও পুরুষ আইনের চোখে শিশুই থেকে যাবে!
ইতঃপূর্বে লিখেছিলাম এ ‘সরকার চলছে ‘গণ্ডগোলে হরিবোল’এর মতো করে’। এখন দেখা যাচ্ছে, এই সরকারের পরামর্শক পর্যায়ে কিছু বালখিল্য জেঁকে বসেছে এবং তাদের শলাতে সরকার এই বালখিল্য (শিশুজনোচিত) সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।
বিজ্ঞ পাঠক-পাঠিকা জানেন বালখিল্য কাদের বোঝায়। তবুও আমার জ্ঞান ঝালাই করে নেয়ার জন্য লিখছি : ভারতের বৈদিক যুগে যখন মহা মহা ঋষিরা দেশে ‘অলিগার্কি’ (Oligarchy) বা ‘সর্বময় মতার অধিকারী গোষ্ঠীশাসন’ চালাচ্ছিল, তখন প্রথম এক প্রতিবাদী মুনির আবির্ভাব হয় যার নাম চার্বাক। চার্বাক মুনি তার অনেক প্রতিবাদের মধ্যে শীর্ষে আসীন ঋষিদের একচ্ছত্র মতার গোষ্ঠীশাসনের প্রতিবাদে প্রতীকী ঘোষণা দিলেন : ‘মস্তকÑ যেটা মানবদেহের শীর্ষে অবস্থান করেÑ সেটাই শ্রেষ্ঠ অঙ্গ নয়, এই মস্তককে ঊর্ধ্বে ধারণ করে রাখে যে পদযুগল, সেটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ অঙ্গ।’ এবং এই শ্রেষ্ঠ অঙ্গকে সম্মান ও স্বীকৃতি দানের জন্য তিনি বিশ্রামের সময় তার পদযুগলকে ঊর্ধ্বমুখী করে মস্তক মাটিতে স্থাপন করে গাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে ঘুমাতেন। তিনি পরিষ্কার ব্যাখ্যা না করলেও বিদ্বজ্জনরা বুঝে নিলেন যে, তিনি পদযুগলকে অর্থ করেছেন জনগণরূপে এবং মস্তক হচ্ছে শাসক; কিন্তু এই শাসকের ঊর্ধ্বে অবস্থান নির্ভর করে পদযুগল তথা জনগণের তাকে সমর্থন করা তথা ধারণ করার ওপর। এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রথম মন্ত্র, যা প্রকাশ পেল চার্বাক মুনির এই বাক্য ও প্রতীকী কর্মকাণ্ডে।
চার্বাক মুনির এই বাক্য ও কর্মকাণ্ডে সর্বময় মতার অধিকারী মহাঋষি শাসকগোষ্ঠী প্রমাদ গুণলেন। তারা শাসনের হাতিয়াররূপে যে ৬০ হাজার বালখিল্য (আকারে মানুষের আঙুলের সমান ঋষি) পোষণ করতেন তাদের এক ঝাঁক পাঠিয়ে দিলেন চার্বাক মুনিকে শায়েস্তা করার জন্য। বালখিল্যরা হেই হেই করে চার্বাক মুনির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, অসংখ্য ইঁদুরের মতো তঁর গা বেয়ে উঠে তার জটাজুটের মধ্যে ঢুকে পড়ে চুলের গোড়া ধরে টানাটানি করতে লাগল। চার্বাক মুনি সুস্থ সবল মানুষ; তিনি দু’হাতের মুঠির ভেতরে বালখিল্যদের ধরে ধরে কচলায়ে ছুড়ে ফেলতে লাগলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে আহত ও আতঙ্কিত বালখিল্যরা পলায়ন করল। (‘পরশুরাম’ ওরফে রাজশেখর বসুর লেখায় এর সুরসাল বর্ণনা আছে।)
এখন একবিংশ শতাব্দীর কিছু বালখিল্য বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের চুলের ভেতর ঢুকে পড়েছে এবং তাকে বালখিল্য কর্মকাণ্ড করার মন্ত্রণা দিচ্ছে বলে প্রতিভাত হয়। তারই একটি হচ্ছে অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের বাঙালিকে ‘শিশু’রূপে সংজ্ঞায়িত করার আইন প্রণয়নের পদপে।
যে রাজনৈতিক দলটির নামেই বাংলা ভাষার কোনো নামগন্ধ নেই বরং নামের গলায় তাদের পরম শত্র“ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর শব্দের (আওয়ামি) ফাঁস পরা রয়েছে, সেই রাজনৈতিক দলটি মতায় বসে বাংলা ভাষাকে সুরা এবং সমৃদ্ধ করবে এমন আশা করা যে বাতুলতা তা শেখ হাসিনা সরকার দেখাল। বাংলা ভাষায় ‘শিশু’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ‘অল্পবয়স্ক বালক বা বালিকা’; বাল্য ও যৌবনের মাঝামাঝি অর্থাৎ ‘১১ থেকে ১৫ বছর বয়স্ক এদের বলা হয় কিশোর ও কিশোরী’। এদের থেকে বড় কিন্তু ১৮ বছরের অনূর্ধ্বদের বলা হয় ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’, ইংরেজিতে ‘টিনেজার’ (Teenager) অথবা ‘আনএডাল্ট’ (Unadult)।
পাশ্চাত্যের কোনো দেশে এবং এমনকি বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর যন্তর-মন্তরদাতা ভারতে অনূর্ধ্ব ১৮-দের ‘শিশু’ সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এসব দেশে ১১ থেকে ১৬ বছর বয়স্কদের বলা হয় ‘টিনেজার’ (Teenager) এবং ১৮ বছরের অনূর্ধ্বদের বলা হয় ‘আন্ডার এইজ’, অথবা ‘আনএডাল্ট’ (Unadult)। এ শব্দগুলো শেখা অথবা এসব দেশ থেকে উদাহরণ নেয়ার কথাও মাথায় আসেনি বালখিল্যদের, এতই তাদের অজ্ঞতা!
এই সরকারের কর্ত্রী-কর্তাদের বাংলা ভাষা সম্পর্কে হিমালয়সম অজ্ঞতা হরহামেশাই প্রকাশ পায়। কিন্তু তাদের যে বাংলা ভাষার ‘কিশোর’, ‘কিশোরী’ শব্দগুলোই জানা নেই, এমন মূর্খতা আমাদের কল্পনাতীত ছিল। কিন্তু সরকার অনূর্ধ্ব ১৮-দের ‘শিশু’ সংজ্ঞায়িত করার জন্য আইন প্রণয়নের পদপে নিয়ে সে মূর্খতাই প্রমাণ করল।
অনূর্ধ্ব ১৮-দের ‘শিশু’ সংজ্ঞায়িত করলে বাংলাদেশে যত বিদ্যালয়ে ‘বয়েজ’ এবং ‘গার্লস’ শব্দ আছে সেগুলো পরিবর্তন করে লিখতে হবে ‘শিশু বিদ্যালয়’ অথবা ‘চিলড্রেন্স্ স্কুল’। সরকারের বালখিল্যরা হয়তো বলবে, ‘এতে অসুবিধা কী? নামে কী আসে যায়?’ ঠিকই তো। নামে কী আসে যায়? যেমন মতাসীন দল তাদের দলের নামে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা উর্দুর ‘আওয়ামি’ শব্দটির পতাকা উড়িয়ে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপিকে পাকিস্তানের এজেন্ট বলে গলাবাজি করছে।
অনূর্ধ্ব ১৮-দের ‘শিশু’ সংজ্ঞায়িত করতে শাসকগোষ্ঠী এত আগ্রহী হয়ে উঠল কেন? শাসকগোষ্ঠীর বেশির ভাগ সদস্যের দাদী-নানী মা হয়েছিলেন অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সে, বাংলাদেশে প্রণিতব্য নতুন আইনে যাদের সংজ্ঞা হবে ‘শিশু মা’। তাহলে সরকারের এরা কি নিজেদের ‘শিশু মা’দের নাতি-নাতনী রূপে পরিচিত হতে লালায়িত হয়েছেন?
ভাগ্যিস ভারতের মহামান্য প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি এবং তার স্ত্রী সবার প্রিয় শুভ্রা বৌদি বাংলাদেশে অনূর্ধ্ব ১৮-দের ‘শিশু’ সংজ্ঞায়িত করে আইন পাস করার আগেই বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। যদ্দুর জানা যায়, শুভ্রা বৌদি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালে এবং ১৯৫৭ সালে ১৪ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার যে ‘শিশু’ আইন পাস করতে যাচ্ছে তা যদি ইতোমধ্যেই পাস হয়ে যেত শুভ্রা বৌদি বাংলাদেশের আইনের চোখে একজন ‘শিশুবধূ’ হয়ে গিয়ে এই সফরে সবার শ্রদ্ধা অর্জনের পরিবর্তে হয়তো ব্যাপক কৌতুকের ‘বস্তু’ হয়ে যেতেন। কী বাঁচনটাই না বেঁচে গেলেন শুভ্রা বৌদি!
কবিগুরু প্রথম কবিতা লিখেছিলেন আট বছর বয়সে; তার অমর কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ লিখেছিলেন ১৪ বছর বয়সে এবং ১৭ বছর বয়সে তার প্রথম কবিতা সঙ্কলন বই প্রকাশিত হয়েছিল। বিশ্বের বৃহত্তম সংখ্যক বাংলা ভাষাভাষীর দেশ বাংলাদেশে সরকার অনূর্ধ্ব ১৮-দের ‘শিশু’ সংজ্ঞায়িত করে কবিগুরুর এই অমর কবিতাকে ‘শিশুর লেখা কবিতা’ বলে আখ্যায়িত করে কবিগুরুর মান ুণœ করার সুযোগ করে দিতে চায় কি শেখ হাসিনা সরকারের এই বালখিল্যরা? পাশাপাশি বাংলাদেশের আবহমান কালচার বা সমাজ-সংস্কৃতিতে বাঙালির গড়ে উঠাতে ঐতিহ্যগতভাবে চিহ্নিত যে ‘শিশু পর্যায়’, ‘কৈশোর পর্যায়’, ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক পর্যায়’ এবং ‘যুবা বয়স পর্যায়’গুলো রয়েছে এবং যার ওপর বাঙালির সাহিত্য, সঙ্গীত ও সংস্কৃতির এক বিরাট অংশ গড়ে উঠেছে তাকেই ধূলিসাৎ করতেই কি এই আইন পাস করতে যাচ্ছে সরকার?
শেষ প্রশ্ন : আওয়ামী লীগের মাথাওয়ালাদের জিজ্ঞেস করি, আপনাদের যুবলীগকে, যার বেশির ভাগ সদস্যের বয়স হচ্ছে অনূর্ধ্ব ১৮, তাদের ‘শিশু’ বলে ডেকে দেখুন আপনাদের কয়জনের ঘাড়ের ওপর মাথা থাকে?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন