প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান মতে গত চার মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সহিংসতার প্রেক্ষাপটে ৩৮৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সূত্র মতে, গ্রেফতার করা হয়েছে- প্রায় ৩৩ হাজার লোককে। এসব মামলায় অজ্ঞাত আসামীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। এই তিন লাখের অধিক অজ্ঞাত আসামী ধরার আইনগত অধিকারকে একশ্রেণীর পুলিশ ভালভাবেই কাজে লাগাচ্ছে। আজকাল যাকে তাকেই নানান ছুতানাতায় আসামী করে থানায় মামলা দেয়া হচ্ছে। আর তাদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। পুলিশের এই গ্রেফতারী বাণিজ্যের প্রতিবাদও সংশ্লিষ্ট লোকেরা করতে পারছেন না। তাহলে এই বাণিজ্যখাতে আরও অধিক আর্থিক খেসারত দিতে হয়। বলা বাহুল্য, এই গ্রেফতারী বাণিজ্যের অধিক শিকার হচ্ছেন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় একশ্রেণীর নেতাকর্মী। বর্তমানে দেশে এমন এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে যে, তাতে রাজনৈতিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত লোকেরা নিজেদের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মস্তবড় এক সুযোগ পেয়েছে। এতে ভিন্নমতের বিরোধী রাজনৈতিক মতের কর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষও নিরাপদে ঘুমানোর বদলে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। কারণ রাজনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্ত এসব লোকের দাপটে অনেক সময় থানাও স্তব্ধ।
রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে দলীয়করণের রাজনীতি যে দেশে প্রশ্রয় পায়, সেখানে ভিন্ন মতের অধিকারী মানুষের আশ্রয় নেবার আর কোনো স্থান থাকে না। ন্যায়নীতি সেদেশে সদা আর্তনাদে থাকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই পরিস্থিতিতে কোনোদিন সংশ্লিষ্ট দেশে শান্তি আসতে পারে না। কারণ, মানুষ ন্যায়নীতি বঞ্চিত হয়ে, যেখানে এরূপ আশ্রয় পায় সেখানকারই শরণাপণœ হয়। ফলে পরস্পরবিরোধী এই দ্বি-মানসিকতার সংঘাত ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ সংঘাতময় অবস্থার রূপ নেয়। আমাদের দেশ বর্তমানে এমন একটি পরিস্থিতিরই শিকার হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা সৃষ্টির সূচনাপূর্বে দেশের জ্ঞানী বুদ্ধিজীবীমহল নানানভাবে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে এটা বুঝাতে চেষ্টা করে আসছে যে, দলীয়করণ নীতি পরিহারে সরকারি ও বিরোধীদলের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে সমঝোতায় আসা অপরিহার্য। অন্যথায় দেশের চলমান অবস্থা আরও অধিক অশান্তিময় হয়ে উঠবে। পরিতাপের বিষয়, সরকার মুখে গণতন্ত্রের কথা উচ্চারণ করলেও নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ ক্ষুণœ হবার আশঙ্কায় এ পথে চলার বদলে স্বেচ্ছাচারিতার পথে চলার নীতিই অবলম্বন করে চলেছে। একথা বার বার সকল মহল থেকেই বলা হচ্ছে যে, নির্দলীয় সরকারের অধীনেই আসন্ন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হবে এই কথা ক্ষমতাসীন সরকার ঘোষণার সাথে সাথেই হরতালসহ রাষ্ট্রের জন্যে আরও যত প্রকার সমস্যা এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে, তার সবই একটি সঠিক পথে এসে যাবে। বর্তমানে যারা দেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক, পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতারী বাণিজ্যসহ সকল প্রকার বাণিজ্যিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক এমনকি ধর্মীয় সমস্যা দেখা দিয়েছে তার সবগুলোই একটি গণতান্ত্রিক চরিত্র লাভ করবে। কিন্তু যে কারণেই হোক সরকার এদিকে না এসে অযৌক্তিক পথেই শুধু চলছে।
এছাড়া দেশে যত অন্যায় কাজ হচ্ছে, খাটুক না খাটুক, যৌক্তিক হোক অযৌক্তিক সব কিছুর জন্যেই প্রথমে জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করে বিবৃতি দেয়া হচ্ছে। প্রধান বিরোধীদল বিএনপিকে এখন শুধু সব সংঘটিত অপরাধের জন্যে দায়ী করা হচ্ছে না, দলটির নেতা-কর্মীদের ওপরও চলছে সকল অযৌক্তিক জুলুম-হয়রানি। কোনো যৌক্তিক দাবি সরকার স্বীকার না করে হঠকারিতার পন্থা অবলম্বন করলেই প্রতিবাদের প্রান্তিক ব্যবস্থাস্বরূপ হরতাল, প্রতিবাদ মিছিল ইত্যাদি করা হয়ে থাকে। কিন্তু ন্যায় দাবি না মেনে যদি উল্টো তাদের বিরুদ্ধে পায়ে পাড়া দিয়ে ‘ঝগড়া’র নীতি অবলম্বন করা হয়, তাহলে সেই ঝগড়া তীব্রতর হবার বদলে মিটমাট হবার কোনোই সম্ভাবনা থাকে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের প্রতিবাদের গণতান্ত্রিক পন্থাসমূহ রুদ্ধ করে দেয়ার কারণেই তো বিভিন্ন ক্ষেত্রে অশান্তির মাত্রা বেড়ে যায়, দেশবাসীর কল্যাণে এই সাধারণ কথাটি সরকার খোলামনে মেনে নিলেই সব সমস্যার সমাধান হতে পারে।
বাকি থাকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ। প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ৪০ বছর পর মিথ্যা সাক্ষী সৃষ্টি করে তার ভিত্তিতে কাউকে শাস্তি ও প্রাণদ- দান কি করে ন্যায়বিচারের অনুকূল হতে পারে, যে কারণে আন্তর্জাতিক মহলেও বাংলাদেশের এ বিচারের প্রশ্নে সমালোচনার অন্ত নেই। বলাবাহুল্য, জামায়াত-শিবির ও অন্যান্য ন্যায়বিচারপন্থী দলসমূহ একারণেই তার প্রতিবাদ করে আসছে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিরপেক্ষ ন্যায়বিচারের দাবি জানাচ্ছে। দাবির এই সত্য ও বাস্তবতা কিছুতেই অস্বীকারের উপায় নেই। এসব দলের ব্যাপারে আদৌ কোনো প্রতিহিংসা ছাড়া যদি সরকার তাদের ন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে অনুরূপ পন্থায় বিচারের ব্যবস্থা নেয়, তাতে সরকারের অসুবিধা কোথায়? অভিযুক্তরা এ পন্থায় শাস্তি থেকে মুক্তি পেয়ে যেতে পারেন এবং যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের মুক্তিদাতারাই উল্টো অপরাধে ফেঁসে যেতে পারেন- এটাই কি আশংকা? যদ্দরুণ এ পথে পা না বাড়িয়ে বক্র পথে পা দিয়েছেন এবং অভিযুক্তদের অস্তিত্বকে পৃথিবী থেকে বিলীন করে দিতে চাচ্ছেন। পরিশেষে আমাদের বক্তব্য, একটাই বিরোধীদল ও জামায়াত শিবিরসহ অন্যান্য যেসব সংগঠন বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলনে রত, সরকারের উচিত প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের বক্রপথে না গিয়ে এসব সমস্যার মীমাংসা করে ফেলা। অন্যথায় এসবকে কেন্দ্র করে আলোচ্য বিষয়সহ যেসব উদ্ভূত সমস্যা গোটা সমাজকে গ্রাস করার জন্যে দ্রুত এগিয়ে আসছে তা থেকে রক্ষার উপায় থাকবে কি না চিন্তার বিষয়। আমরা মনে করি, পরিস্থিতি এখনও হাতের বাইরে চলে যায়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করলে এখনও সব কিছু স্বাভাবিক পথে ফিরে আসার সময় আছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন