শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৩

উন্মাদ আর কাকে বলে


ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

সাভারের রানা প্লাজার গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে যে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে, সে ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে কমই ঘটেছে। আওয়ামী যুবলীগ নেতার মালিকানাধীন এই নয়তলা ভবনটি সম্পূর্ণ ধসে পড়ায় সহস্র গার্মেন্টশ্রমিকের জীবন সংশয়াপন্ন হয়ে যাচ্ছে। এই নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত সেখান থেকে প্রায় তিন বিশ শ্রমিকের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে আরো প্রায় হাজার দুয়েক লোক। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২৪ এপ্রিল ধসে পড়া ওই ভবনটিতে এখনো আরো কয়েক শ’  মানুষ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। এখনো ভবনের ভেতর থেকে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে মানুষের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। কেউ কেউ এমন আকুতিও জানাচ্ছে যে, একটা কিছু দেন, আমার হাতটা, পাটা কেটে ফেলে বেরিয়ে আসি। কেউ কেউ বলছেন, হাত-পা কেটে হলেও আমাকে জীবন্ত উদ্ধার করুন। কেউ কেউ কিছুই বলছেন না। আর্তচিৎকার কিংবা ফোঁপানো কান্নায় এলাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। উদ্ধারকারীদের চোখে বইছে অশ্রু। এই উদ্ধারকাজে এলাকার হাজার হাজার মানুষ অংশ নিচ্ছে। স্যান্ডউইচের মতো চুপসে যাওয়া ভবনের ছাদ কেটে বিপন্ন মানুষকে বের করে এনেছে। তারপর দ্রুত তাদের হাসপাতালে স্থানান্তর করছে। এভাবেই হাজার হাজার বছর ধরে এ দেশের মানুষ পরস্পর বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু বর্তমান সরকার এক আজব সরকার। এটা কী ধরনের সরকার তা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। সরকারের কর্ণধারেরা সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গেছেন কি না তা এখন সবার ভাবার বিষয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যাকে ‘রাজাকার কমান্ডার’ হিসেবে অভিহিত করে বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বিপদে পড়েছেন, সেই মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাভারের গার্মেন্ট দুর্ঘটনা নিয়ে এক চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন সাংবাদিকদের সামনে। ২৪ এপ্রিল বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে এই অতি উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোকটি কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে জানান দিয়েছেন, হরতালকারীরা এসে এই ভবনে ধাক্কাধাক্কি করেছিল বলেই ভবনটি ধসে পড়েছে। একটি নয়তলা ভবন, তার মধ্যে ইট-কাঠ-রড থাকার কথা। কতগুলো লোক এসে ধাক্কা দিলো, আর ভবনটি ঝুরঝুর করে ধসে পড়ে গেল। এ-ও কি সম্ভব! সম্ভব কি অসম্ভব, তা বিবেচনা করার মতো বোধবুদ্ধি এই ‘বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর ভাষায় রাজাকার কমান্ডারের’ নেই। মানুষে ধাক্কা দিলে কোনো বিল্ডিং পড়ে ধূলিসাৎ হয়ে যায়, তা এই প্রথম শোনা গেল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এ কথা বলতে কোনো কুণ্ঠা বোধ করেননি। মূর্খতা ও অজ্ঞানতারও তো বোধ করি একটা সীমা আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কী বলে যে বিশেষায়িত করব, বুঝতে পারছি না।
মন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর সারা দেশে ছি ছি রব উঠেছে। রাস্তাঘাটে, বাসে, ট্রেনে, হাটবাজারে, চায়ের দোকানে একটিই আলোচনার বিষয়Ñ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী বলে গেলেন? এ কথা বলতে পারলেন? এ কথা বলতে গিয়ে প্রখ্যাত স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেছেন, কোনো উন্মাদই কেবল এ রকম কথা বলতে পারেন। মানসিকভাবে সুস্থ কোনো মানুষের পক্ষে এ কথা বলা সম্ভব নয়। আরেকজন খ্যাতিমান সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বলেছেন, আমি বরং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে চাই, তিনি গিয়ে কোনো নয়তলা ভবনের পিলার ধরে ধাক্কাধাক্কি করে দেখুন ভবনটি ফেলতে পারেন কি না। এ দিকে আবার সেনাবাহিনীর প্রকৌশল ব্যাটালিয়নের প্রধান লে. কর্নেল মোহাম্মদ মইনউদ্দিন বলেছেন, আগের দিনে ভবনটির কংক্রিটের পিলার দুর্বল ছিল। তার ওপর এতে লোকজন ওঠে এবং জেনারেটর চলায় কম্পনের সৃষ্টি হয়। এতে ভবনটি ধসে পড়ে। দমকল বাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান বলেন, জনগণ এর গেট ধরে ধাক্কাধাক্কি করলেই কোনো ভবন ধসে পড়তে পারে না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিয়ে শুরু করলাম বটে, কিন্তু শুরু করা উচিত ছিল প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বিরাট জনদরদি লোক। জনগণের দুঃখ-কষ্টে তার হৃদয় বড় বেশি ভারাক্রান্ত হয়। তিনি এসব সহ্য করতে পারেন না। তাই যারা টিভি টকশোতে এই ভবনমালিক ও গার্মেন্টমালিকদের সমালোচনা করছিলেন, তিনি তাদের ওপর একেবারে খড়গহস্ত হয়ে উঠলেন। ভবন মালিক আওয়ামী যুবলীগ নেতা। নয়তলা ভবন করেছেন পুকুরের ওপরে রাজউকের কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই। আর আজব ব্যাপার এই যে, এসব স্থানে ভবন নির্মাণের জন্য রাজউকের অনুমোদনের দরকার হয় না। পৌরসভা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদও অনুমোদন দিতে পারে। আর যদি প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকে, তাহলে এসব অনুমোদনেরও কোনো প্রয়োজন হয় না। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে সিমেন্ট-বালুর তোয়াক্কা না করে ইট গেঁথে উঠে গেলেই হয়।
প্রধানমন্ত্রী টকশোর আলোচকদের ওপর বিরক্ত হয়ে বলেছেন, একে ধরো তাকে মারো এসব কথা না বলে আলোচকেরা ঘটনাস্থলে গিয়ে যদি একজন মানুষকেও উদ্ধার করেন, তাতে লোকজন উপকৃত হবেন। যেন সরকারের দায়দায়িত্ব এখানে খুবই সীমিত। কিন্তু আমরা দেখেছি, এ উদ্ধারকাজে সরকারের লোক যতটা না অংশ নিয়েছেন তার  চেয়ে বেশি ছিলেন বেসরকারি লোক ও এলাকাবাসী। আহতদের চিকিৎসার দায়ও নেয় সাভার ও ঢাকার কমলাপুরের দু’টি বেসরকারি হাসপাতাল। আহতদের জন্য রক্ত দিতে হাজির হন হাজার হাজার মানুষ। সরঞ্জামের অভাবে শেষ পর্যন্ত রক্ত আর গ্রহণ করা যায়নি। বহু লোক ফিরে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একেবারে একই সুরে গীত গেয়ে গিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সকালবেলা হরতালকারীরা এসে বিল্ডিংয়ের পিলার ধরে ধাক্কাধাক্কি করে। সেই কারণে ভবনটি ধসে পড়েছে। আর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিল্ডিংয়ে ফাটল ধরার কারণে সরকার সব লোককে ভবন থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সকালবেলা এই ভবন থেকে মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী নেয়ার জন্য কিছু কর্মচারী এসে হাজির হন এবং তারা ভবনের ভেতরে ঢোকেন। সে কারণে তারা এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।
সব কর্মচারীর জন্য এটা কর্মক্ষেত্র। সেখানে এরা স্বর্ণালঙ্কার, টাকা-পয়সা বা অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ লুকিয়ে রাখার জন্য কোনো আয়োজন করেন না। তাদের সম্পদ যদি কিছু থাকে তবে সেটা তারা বাসায়ই গচ্ছিত রাখেন, অথবা অন্য কোনো আপনজনের কাছে রাখেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য মানলে বিশ্বাস করতে হয়, এই যে প্রায় সাড়ে তিন হাজার লোক, যারা রানা প্লাজায় ঢুকলেন, তারা সবাই কারখানার মূল্যবান সামগ্রী চুরি করতে ঢুকেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর বোধ হয় কোনো ধারণাই নেই যে, গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে শ্রমিকেরা কিভাবে ঢোকেন এবং কিভাবে বের হন। এদের দেহ তল্লাশি করে ঢোকানো হয় এবং দেহতল্লাশি করে বের করা হয়, যাতে তারা কোনো গার্মেন্টসামগ্রী নিয়ে বের হতে না পারেন। সেখানে এরা মূল্যবান সামগ্রী আনার জন্য ফ্যাক্টরিতে ঢুকলেন এবং সব দুয়ার খোলা থাকল, আর তিন শতাধিক লাশ উদ্ধার হলো, প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর জবাব কী? প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য যে সারবত্তাহীন সেটির আরো প্রমাণ পাওয়া গেল হাসপাতালে চিকিৎসাহীন আহত কর্মীদের কাছ থেকে। তারা জানান, আগের দিন ভবনটিতে ফাটল দেখা দেয়ায় সে দিন কর্মীরা কাজে যোগ দিতে চাননি। কিন্তু কারখানার কর্মকর্তারা তাদের বাসা থেকে ফোন করে ডেকে আনেন এবং জানান যে, এরা ইঞ্জিনিয়ার এনে পরীক্ষা করে দেখেছেন, ভয়ের কোনো কারণ নেই। আর কর্মকর্তারাও তাদের কাজে লাগিয়ে দিয়ে চলে যাবেন না। তাদের সাথেই থাকবেন। তারা তা ছিলেনও। তাদের অনেকেই এই দুর্ঘটনায় হতাহত হয়েছেন। এ থেকেও প্রমাণিত হয়, প্রধানমন্ত্রীর দাবি অসার অনুমানপ্রসূত ও অসত্য।
কিন্তু বাস্তবতা হলো রানার এই ভবন প্রাঙ্গণ সরকার সমর্থক ও বিরোধী দলের কর্মসূচি প্রতিহত করার একটি কেন্দ্র ছিল। সাভারে হরতালবিরোধী যেসব মিছিল-সমাবেশ আওয়ামী লীগ করে, তারা প্রথমে এসে সমবেত হয় এই রানা প্লাজার সামনে। তারপর বিরোধী দলের কর্মসূচির বিরুদ্ধে এরা শোডাউন শুরু করে। সে দিনও হরতালের দিন ছিল এবং সোহেল রানা যথারীতি সকালবেলা এসে সেখানে কর্মী বাহিনীকে সমবেত করতে থাকেন। বিল্ডিং ধসের সময় তিনি নিজেও ভবনের নিচতলায় তার অফিসকক্ষে অবস্থান করছিলেন। এতে তিনি সামান্য আহতও হন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমপি মুরাদ জংয়ের সহায়তায় তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এখনো তার সন্ধান মেলেনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইতোমধ্যে নিজেকে বদ্ধ উন্মাদে প্রমাণিত করেছেন। এর আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সম্পর্কে নানা ধরনের বাজে কথা চালু হয়েছে। এখন দেখছি সেই তালিকায় আরেকজন যুক্ত হলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীর যখন বললেন, ১৮ দলীয় জোটের কর্মীরা তার অন্তরের অন্তস্তলের রানা প্লাজার কলাপসিবল গেট ও পিলার ধরে নাড়াচাড়া করছেন, তখন সংবাদপত্রের রিপোর্ট ছিল ভিন্ন। সরকার সমর্থক পত্রিকা দৈনিক প্রথম আলো সে দিনই রিপোর্ট করে, ভবনের মালিক সোহেল রানা পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদ প্রাঙ্গণে বললেন, রানা যুবলীগের কেউ নয়। কিন্তু সে কথাও শেষ পর্যন্ত অসত্য বলে প্রমাণিত হলো। সাভারের অলিগলিতে স্থানীয় এমপি মুরাদ জং ও সোহেল রানার ছবি সংবলিত পোস্টারে ভরা। তাতে নানা আহ্বানÑ শোক দিবস পালন করুন। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলুন। মুরাদ জংয়ের এমন সব পোস্টারের নিচে লেখা আছে ‘সৌজন্যে মোহাম্মদ সোহেল রানা, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক, সাভার পৌর যুবলীগ’।
কিন্তু কেন এ  ধরনের এক ঘাতককে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এতটা মরিয়া হয়ে উঠলেন? তার কারণ সম্ভবত এই যে, তিনি পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। এর আগেও আমরা দেখেছি, এই সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় উচ্চ আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া খুনিদেরও কারাগার থেকে মুক্ত করে দিয়েছে। একই বিবেচনায় হাজার হাজার খুনি-ডাকাত, ধর্ষক, লুটেরাকে দায়মুক্তি দিয়েছে। সুতরাং সোহেল রানাই বা বাদ যাবেন কেন? আর তাই প্রথম থেকে সরকারের শীর্ষস্থানীয় লোকেরা তার পক্ষ নিয়েছেন। কিন্তু এই পক্ষপাত যে শেষ পর্যন্ত জনপ্রতিরোধের মুখে ধুলায় মিশে যায়; ইতোমধ্যে দেশের প্রান্তে প্রান্তে সে রকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। সুতরাং এ দিয়ে সরকারের শেষ রক্ষা হবে বলে মনে হয় না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads