‘রানা প্লাজা বিপর্যয়’ বাংলাদেশের ইতিহাসে মানুষের সৃষ্ট সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়। এ দেশে অনেক বড় বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু এত বিশাল ভবন ধসের ধ্বংসস্তূÍপ থেকে উদ্ধার কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জীবন। ‘একজন মানুষ প্রাণ হারানো মানে পুরো মানবতার মৃত্যু ঘটা’। অদক্ষতা ও অযোগ্যতার কারণে যদি একজন মানুষের প্রাণ যায়, তাহলেও মানবতার অবমাননা ঘটল। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার যে অবস্থান নিয়েছে তা কখনো সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। সরকার কয়েকটি উন্নত দেশের সাহায্যের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। ‘ভাবমর্যাদা নষ্ট হওয়া’র যে কারণ দেখিয়ে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হলো, ভবনে আটকে পড়া শ্রমিকদের আত্মীয়স্বজনের আহাজারির প্রতি এর মাধ্যমে নিদারুণ অবজ্ঞার প্রতিফলন ঘটল।
রোববার ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফ খবর দিয়েছে, উদ্ধার অভিযানে সাহায্য করতে ব্রিটেনসহ কয়েকটি উন্নত দেশের প্রস্তাব সরকার প্রত্যাখ্যান করেছে। দুর্ঘটনার পরপরই জাতিসঙ্ঘ কর্মকর্তারা যখন বুঝতে পারলেন, বিপুলসংখ্যক লোক ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চাপা পড়ে আছেন, তখন বাংলাদেশ নিজের সামর্থ্যে উদ্ধারকাজ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে পশ্চিমা কূটনীতিকদের সাথে পরামর্শ করা হয়। তারা একমত হন, বাংলাদেশ এই কাজ করতে পারবে না। তারা তখন ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশকে বিষয়টি অবগত করেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বিদেশী সাহায্য না নিয়ে সাভারের উদ্ধার কার্যক্রমে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর নির্ভর করা হয়। তাদের সুরক্ষাদায়ক পোশাক ছিল না, এমনকি অনেকে প্লাস্টিকের স্যান্ডেল পরেও কাজে নেমেছিলেন। হাজার হাজার মানুষকে উদ্ধারে সরকারের প্রস্তুতির অভাব এর মাধ্যমে প্রকাশ হয়ে পড়ে।
পত্রিকাটি শনিবার প্রকাশিত অন্য এক প্রতিবেদনে লিখেছে, চিকিৎসকেরা স্বেচ্ছাসেবককে এক নারী গার্মেন্ট শ্রমিকের এক হাত কেটে উদ্ধারের নির্দেশনা দিচ্ছেন। অন্য দিকে একজন অভিজ্ঞ উদ্ধারকারী হলে হয়তো সে মেয়েটির হাতও রক্ষা পেত। চাপা পড়া অনেক শ্রমিক দিনের বেলার ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় বেঁচে ছিলেন নিজের প্রস্র্রাব পান করে। দক্ষ ও অভিজ্ঞ উদ্ধারকারীরা মৃত্যুপথযাত্রীদের কাছে পৌঁছাতে পারতেন। সে ক্ষেত্রে মৃতের সংখ্যা অবশ্যই কমে আসত। আরো সহজে উদ্ধারকাজ চালানো যেত। সরকার মানুষের জীবন রক্ষার চেয়ে ভাবমর্যাদাকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছে। সাহায্যকারী দেশগুলোর পক্ষ থেকে এমন প্রস্তাবও দেয়া হয় যে, সাহায্যের বিষয়টি প্রকাশ করার দরকার নেই। তারপরও সরকারের এক কথা, নিজেদের মানমর্যাদা বেশি।
রানা প্লাজা ধসে প্রমাণ হয়েছে, বাংলাদেশে বিরাট বিরাট ইমারত তৈরি হচ্ছে। সেগুলো নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকার কঠোর হাতে মান নিয়ন্ত্রণ করছে না। এমনকি এত বড় ভবন ধসে গেলে তখন উদ্ধার অভিযান কেমন হতে পারে সে ধারণা নেই সরকারের। মানুষকে যদি না বাঁচানো যায়, তাহলে ভাবমর্যাদা দিয়ে কী হবে? এই ভাবমর্যাদা কি সরকারের একা? গরিব মেহনতি মানুষ ও শ্রমিকদের কোনো ভাবমর্যাদা নেই? এ প্রশ্নের জবাব দেবে কে। ক্ষমতাসীনদের বলতে হবে, সবাইকে একই পাল্লায় মাপুন। মানুষের মর্যাদার ক্ষেত্রে এ ধরনের বিভাজন করবেন না। রাষ্ট্র প্রধান থেকে শুরু করে একজন সাধারণ শ্রমিকের জীবনের সমান মূল্য রাষ্ট্র দেবেÑ গণতান্ত্রিক সমাজে এটাই সবার প্রত্যাশা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন