বুধবার ২৪ এপ্রিল। নয়া দিগন্তের ১৫ পৃষ্ঠায় দ্বিতীয় কলামে একেবারে নিচে, ছোট টাইপের হেডিং দেয়া একটি খবর। ‘সাভারে রানা প্লাজার ফাটল আতঙ্ক : গার্মেন্ট কারখানা ও ব্যাংক ছুটি ঘোষণা।’ সাভার সংবাদদাতার এই ছোট রিপোর্টটা পড়ে অনেকে হয়তো ভেবেছিলেন, এমন আতঙ্কের ঘটনা নতুন নয়। আসলে ব্যাপার এত মারাত্মক কিছু নয়। বিশেষ করে একজন দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা যখন সার্টিফিকেট দিলেন দুর্ঘটনার কোনো আশঙ্কা নেই, তখন তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলাই স্বাভাবিক।
শুধু সাভার কেন, মাঝে মধ্যে অন্যান্য স্থানেও ভবনে ফাটল ধরার খবর ও ছবি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়ে থাকে। বুধবারের সে খবরটি নি¤œরূপ : সাভারে গতকাল বাজার বাসস্ট্যান্ডের রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় দেয়ালের প্লাস্টারে ফাটল দেখা দেয়। এ সময় ভবনটিতে থাকা একাধিক গার্মেন্ট কারখানায় কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এতে ভবনের তৃতীয় তলা থেকে অষ্টমতলা পর্যন্ত নিউ ওয়েভ বাটনস লি., গার্মেন্ট টিওসি লি. ও নিউ ওয়েভ স্টাইল লি. নামে তিনটি গার্মেন্ট কারখানায় কর্মরত প্রায় দুই হাজার শ্রমিককে ছুটি ঘোষণা করে গার্মেন্ট কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া দ্বিতীয় তলায় থাকা ব্র্যাংক ব্যাংক সাভার শাখার সব কর্মকাণ্ড বন্ধ ঘোষণা করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় মার্কেটের সব দোকান খোলা ছিল। সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেন সরদার, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও সাভার থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।
ুদ্র রিপোর্টটির পরবর্তী অংশটুকুই এখন অনেক বৃহৎ গুরুত্ব নিয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করছে। তা হলোÑ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেন সরদার জানান, ‘ফাটলের অবস্থা অস্বাভাবিক কিছু নয়। দেয়ালের প্লাস্টার ধসে গেছে ও একটি পিলারে সামান্য ফাটল দেখা গেছে। এ ঘটনায় কোনো ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা নেই।’
ইউএনওর মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বললেন কিভাবে? কোনো প্রকৌশলী তাৎক্ষণিকভাবে ভবনটি পরীক্ষা করলে তা রিপোর্টে জানা যেত। তাহলে ইউএনও কেন এমন কথা মুখ থেকে বের করলেন, যার পরিণতি পরদিনের ভয়াবহ ট্র্যাজেডি। এতগুলো মানুষের মৃত্যু, পঙ্গুত্ব ও জখম, আর্থিক ক্ষতি এসব কিছুর দায়ের একাংশও কি তিনি নিতে রাজি হবেন? যদি না হন, তাহলে বিশেষজ্ঞের ভঙ্গিতে দুর্ঘটনা না ঘটার নিশ্চয়তা দিয়ে ‘বিশেষ অজ্ঞে’র ভূমিকায় নেমেছিলেন কী কারণে? বিস্ময়ের ব্যাপার, তাকেই তদন্ত কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে রানা প্লাজা ধসের ব্যাপারে। মিডিয়ার সমালোচনায় পরে নাকি তার নাম বাদ দিতে বলা হয় ঊর্ধ্বতন মহল থেকে।
জাতি ট্র্যাজিক সেঞ্চুরি চায় না
সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের রানা প্লাজার ভিত ছিল ছয়তলার। অসৎ মালিক আরও তিনতলা তুলেছে এর ওপর। বিরাট এই ভবনে কয়েকটি পোশাক কারখানার পাশাপাশি ব্র্যাক ব্যাংক শাখা এবং বহু দোকানপাট। ২৪ এপ্রিল সকালে রানা প্লাজা ধসে পড়ে দেশের ইতিহাসের বেনজির ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়েছে। এই লেখা তৈরি করা পর্যন্ত প্রায় চার শ’ লাশ বের করে আনা সম্ভব হয়েছে। নিখোঁজ আট শ’রও বেশি। জীবিত উদ্ধার হয়েছেন আড়াই হাজার। অনেককে উদ্ধারের সময় হাত বা পা কেটে ফেলতে হলো। শত শত আহত গার্মেন্টকর্মী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। স্বজনের আহাজারিতে আকাশ-বাতাসও যেন কাঁদছে।
বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট ম্যাচে আমাদের সাকিব, মুশফিক, তামিম সেঞ্চুরি করলেন কি না, গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার সে দিকে দেশবাসীর তেমন আগ্রহ ছিল না। কারণ সাভারে মানবসৃষ্ট মহাবিপর্যয়ে তখন ট্র্যাজিক সেঞ্চুরি তৈরি হচ্ছিল। রানা প্লাজা ধসের প্রলয়ে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণকারীর সংখ্যা প্রায় চার শ’ হয়ে গেছে। মাত্র কয়েক মাস আগে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ড সারা দুনিয়ায় তোলপাড় তুলেছিল। তখন নিহতের সংখ্যা এক সেঞ্চুরি পার হয়েছিল। এর আগে এই সাভারের স্পেকট্রাম গার্মেন্ট ধসে মৃতের সংখ্যার দিক দিয়ে আমাদের ট্র্যাজেডি পৌনে এক সেঞ্চুরি অতিক্রম করে দাঁড়িয়েছিল ৭৬-এ। দেখা যাচ্ছে, দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাতের শিল্পে একের পর এক প্রলয়ঙ্করী বিপর্যয় ঘটছে। এসব নারকীয় ঘটনার কোনোটার প্রতিকার এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের কোনো শাস্তিই হয়নি। ফলে আগের ঘটনার চেয়ে পরেরটাতে মারা গেছে আরও বেশি মানুষ। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে আরও ব্যাপক। এখন বাংলাদেশ সরকার এবং সেই সাথে বিজিএমইএকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা এসব মর্মান্তিক সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়ব, নাকি গার্মেন্টকর্মীদের অন্য সবার মতো মানুষ মনে করে তাদের জন্য মৃত্যুকূপ বানানো বন্ধ করব?
সোনার ছেলে ও কানামাছি ভোঁ ভোঁ
ভবন ধসের পরপরই মিডিয়ার খবরে জানা যায়, ধসে পড়া ৯ তলা ভবনটির মালিক সোহেল রানা। এই যুবক যুবলীগের স্থানীয় নেতা। সে যুবলীগের পরিচয়ে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছে। এমনকি হিন্দুর সম্পত্তি দখল করেছে বলেও পত্রিকা খবর দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার সংসদে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, সাভারে ধসে পড়া রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা যুবলীগের কেউ নয়। তার হাতের তালিকায় রানার নাম নেই। প্রধানমন্ত্রী এর পরই বলেছেন, ‘অন্যায়কারী আমার দলের হলেও শাস্তি পেতে হবে। যদি দলের দোহাই দিয়ে পার পেতে চায়, পার পাবে না।’ তার এই বক্তব্য প্রশংসনীয়। তবে এ কথা থেকে এটাও ধরে নিতে হয় যে, যুবলীগের কমিটির তালিকায় সোহেল রানার নাম থাকুক না থাকুক, সে যে বিরোধী দল নয়, বরং আওয়ামী লীগের লোক, তা দলের নেতাদেরও জানা। কোনো কোনো পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পাশে একটি পোস্টারের ছবি, যা সাভারের বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়। শোক দিবসের পোস্টারে বঙ্গবন্ধু এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট ছবির পাশে বড় ছবি সাভারের এমপি তৌহিদ জং মুরাদের। নিচে সবচেয়ে বড় ছবিটি সোহেল রানার। সাথে তার দলীয় পরিচয় লেখা ‘সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক, সাভার পৌর যুবলীগ’।
এই পরিচয় যদি মিথ্যা হয়, তাকে কি বহিষ্কার করা হয়েছে? কিংবা দল এর কোনো প্রতিবাদ জানিয়েছে কি? এমন কোনো খবর পত্রিকায় আসেনি। এ অবস্থায় মানুষ ধারণা করছে, গার্মেন্টে আগুন কিংবা ভবন ধসের আগের ঘটনাগুলোর মতো এটারও হোতাদের হয়তো শাস্তি হবে না। বড় ভাইরা দলের ‘দুষ্টু ছেলেদের’ বাঁচিয়ে দেয়াকে এক ধরনের দায়িত্ব মনে করেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে।
সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের হম্বিতম্বি এবং প্রশাসনের তোড়জোড়ের মাঝে শোনা গেল, ‘রানা প্লাজার মালিক এবং যুবলীগের দখলবাজ ‘সোনার ছেলে’ সোহেল রানার খোঁজ মিলছে না।’ আমরা প্রায় সময়ই পত্রপত্রিকায় দেখি, অমুক তমুক সন্ত্রাসী পুলিশের খাতায় ‘পলাতক’ হলেও তাদের নাকের ডগা ও চোখের পাতার সামনে দিয়ে অবাধে ঘোরাফেরা করছে। কার্টুনে দেখা যায়, চোখে কাপড় বাঁধা পুলিশ ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ’ খেলছে আর কুখ্যাত অপরাধী আশপাশে ঘুরছে হাসিমুখে। সরকারি দল করে বলে তার ক্ষমতা পুলিশের চেয়ে বেশি। অতএব, তাকে ছোঁয়ার সাধ্য কারো নেই। সাভারের রানা প্লাজার অসৎ ও লোভী মালিক সোহেল রানার হদিস পেতে মাসুদ রানার মতো গোয়েন্দার দরকার হয় না। জনগণ মনে করেছে, সে লুকিয়ে বা পালিয়ে থাকলে ক্ষমতাসীন মহলের আশ্রয়েই থাকবে। সে তার অন্যায়-অপকর্ম ও দৌরাত্ম্য চালাতে পেরেছে একই মহলের প্রশ্রয়ে। গত বুধবার রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর কে সোহেল রানাকে গণরোষ থেকে দ্রুত উদ্ধার করে নিয়ে গেছেন? পত্রিকার খবর, আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি (তার বাবাও অতীতে আওয়ামী এমপি ছিলেন) তাকে সরিয়ে নিয়ে যান ছুটে এসে। পত্রপত্রিকা লিখেছে, সে ওই এমপির ঘনিষ্ঠজন। এই ঘনিষ্ঠতা কত গভীর, তা তো তাকে উদ্ধার করা থেকেই প্রমাণিত। অথচ এমপির বড় দায়িত্ব ছিল, সর্বাগ্রে ভবন ধসে আটকা পড়া মানুষ এবং হতাহতদের উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়া। যা হোক, শেষ পর্যন্ত সোহেল রানা বেনাপোলে ধরা পড়েছে। সে পালাচ্ছিল ভারতে।
সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ল বুধবার সকালে। ভবনটির মালিক আর সেখানকার গার্মেন্ট মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা হলো দুই দিন পরে। শুক্রবার সন্ধ্যায় জানা গেল, বিজিএমইএ ওইসব গার্মেন্ট মালিককে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছে। একই সময়ে মিডিয়া প্রচার করেছে, প্রধানমন্ত্রী ভবনমালিককে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন। রানাা প্লাজা ট্র্যাজেডি ঘটার পর তৃতীয় দিনে এর মালিক যুবলীগ নেতা রানাকে গ্রেফতারের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ এসেছে। কেন এত বিলম্বে, এ প্রশ্ন জেগেছে সাথে সাথেই। আওয়ামী এমপি তাকে গণরোষ থেকে বাঁচাতে তড়িঘড়ি সরিয়ে এনেছেন। একইভাবে খুব ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী মহল তাকে আশ্রয়, এমনকি দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া অসম্ভব ছিল না।
সরকারের পিলার ও সাভারের পিলার
সরকারকে একটা ভবনের সাথে তুলনা করলে এর একটি প্রধান পিলার বা স্তম্ভ বা খাম্বা হচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশের মতো অঞ্চলে এ পদের গুরুত্ব কত বেশি, তা বলার দরকার পড়ে না। বর্তমান সরকারের একটি বড় ‘পিলার’ যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিনি সাভারের ভবন ধসের ঘটনা প্রসঙ্গে ‘পিলারতত্ত্ব’ দিয়েছেন। সারা দেশে এ নিয়ে ক্ষোভ ও কৌতুকÑ দুটোই সৃষ্টি হয়েছে বলে পত্রপত্রিকা জানিয়েছে। বিবিসির মতো আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শোনা গেছে, মন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন, ‘এই দুর্ঘটনার আগে কিছু মৌলবাদী এবং বিএনপির ভাড়াটে লোক ভবনটির গেট এবং বিভিন্ন পিলার ধরে নাড়াচাড়া করেছিল। ভবন ধসের এটাও কারণ হতে পারে।’ স্বরাষ্ট্্রমন্ত্রী ডক্টরেটধারী যে বিষয়ে, তাকে অনেকে এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ মনে করতে পারেন। কিন্তু তিনি তো প্রকৌশলী বা নির্মাণ বিশেষজ্ঞ নন মোটেও। আসলে গরুর ওপর রচনা না লিখে গরুকে নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে নদীর ওপর রচনা লেখার ব্যর্থ প্রয়াস এটা। সরকার মৌলবাদ আর বিএনপি আতঙ্কে যে কত বেশি ভুগছে, এসব উদ্ভট উক্তি তার প্রমাণ। মন্ত্রী দেখাতে চেয়েছেন, সাভারের এই ট্র্যাজেডির পেছনেও বিরোধী দলÑ বিশেষ করে জামায়াত-শিবির জড়িত। বাস্তবে এই মর্মান্তিক বিপর্যয় ঘটল মন্ত্রীর দলেরই এক যুবনেতার চরম লোভ ও অসততার কারণে।
আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বচনামৃত এতই বিস্বাদ যে, তা আওয়ামী লীগের ফ্রি স্টাইল কটুভাষী নেতাদেরও গলাধঃকরণ করা সম্ভব হয়নি। মাহবুব-উল আলম হানিফ এ ধরনের ‘উল্টাপাল্টা’ কথা বলা বন্ধ করতে বলেছেন। আর ক্ষমতাসীন জোটের দ্বিতীয় বড় শরিক দলের প্রধান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। আগের দিন বৃহস্পতিবার একই দাবি জানালেন নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে এর আহ্বায়ক ফরহাদ মজহার। এমন পরিস্থিতিতে শুক্রবার মিডিয়াম্যানদের এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী দাবি করেন, মিডিয়া তার বক্তব্যে বিকৃতি ঘটিয়েছে। মন্ত্রী বলেন, আমি বলেছি ‘হরতালকারীরা ওই ভবনের ফাটা পিলারে ধাক্কাধাক্কি না করলেও পরতেন। সেই ধাক্কাধাক্কি ভবনটা ভেঙে পড়ার কারণ এমন কথা বলিনি।’
বিজিএমইএ : আইন কি কাজীর গরু?
বৃহস্পতিবার রাতে টিভি চ্যানেল কোনোটা খবর দিয়েছে, বিজিএমইএ সাভারের রানা প্লাজার পাঁচটি গার্মেন্টের মালিকের সদস্যপদ ‘বাতিল’ করেছে; কোনো চ্যানেল বলেছে, ‘স্থগিত’ করেছে। আসলে ব্যাপারটা কী? বাংলাদেশে ‘স্থগিত’ মানে, বাস্তবে পুনর্বহালের সুযোগ। আর ‘বাতিল’ করার আদেশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাতিল হয়ে যায় আপিলের সুবাদে কিংবা ‘বিশেষ’ বিবেচনায়। বিজিএমইএ ভবিষ্যতে কী করবে, জানি না। অতীতে তারা যে ভূমিকা রেখেছে তাকে দায়িত্বে অবহেলা কিংবা উদাসীনতা বা ব্যর্থতা বললে অনেক কম বলা হয়।
বিজিএমইএর সবচেয়ে বড় দায়িত্বগুলোর মধ্যে একটি হলো Compliance, অর্থাৎ গার্মেন্ট শিল্পের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অনুসরণীয় ও বাধ্যতামূলক সব আইনকানুন, বিধিবিধান, শর্ত ও নির্দেশ যথাযথভাবে কার্যকর করা হচ্ছে কি না। Compliance ছাড়া নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, শ্রমিকের অধিকার রক্ষা, সর্বোপরি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ এবং অবস্থান বজায় রাখাÑ কোনোটাই সম্ভব নয়। শেষোক্ত কারণটি না থাকলে গার্মেন্ট মালিকেরা Compliance-কে কতটা গুরুত্ব দিতেন, তা নিয়ে অনেক সন্দেহ। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসম্মত বা নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং পেশাগত সুরক্ষার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের দেশে আজো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরিহার্য বিবেচিত হয় না; বরং এটা অবহেলা ও অবমূল্যায়নের বিষয়। মালিকদের আইডিয়া হলো, ‘শ্রমিকের জানের চেয়ে আমার মুনাফার গুরুত্ব বেশি।’
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাত, তৈরী পোশাক শিল্প। এর Compliance বিষয় নিশ্চিত করার জন্য বিজিএমইএর কেন্দ্রীয়ভাবে দায়িত্বশীল তো বটেই, এ বিষয়ে সাব-কমিটিও থাকে নিয়মিত তত্ত্বাবধানের জন্য। সাভারের রানা প্লাজার পাঁচটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি বিজিএমইর আপত্তি সত্ত্বেও কারখানা চালু রেখেছিল বলে এখন দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের কারখানাগুলোর ব্যাপারে নিয়মিত কেন মনিটরিং করে যথাসময়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয় না? Compliance প্রতিপালনে ব্যর্থতার দরুন এ যাবৎ ক’টি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ বাতিল বা স্থগিত হয়েছে, কিংবা অন্যবিধ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা বিজিএমইএর প্রকাশ করা উচিত। আইন, বিধি, নিয়ম-নির্দেশ অমান্যকারী সদস্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কী কী পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে এবং সেগুলো পর্যাপ্ত কি না, তা জানার অধিকার আছে জনগণের।
শুক্রবার নয়া দিগন্তের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি শিরোনাম, ‘রানা প্লাজার মতো অসংখ্য মৃত্যুকূপ ঢাকার আশপাশে।’ এ রিপোর্টে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। এতে জানানো হয়েছে, সাড়ে চার হাজার পোশাক কারখানার বেশির ভাগ ভবনের নির্মাণ ত্রুটিযুক্ত। ফলে প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকদের কাজ করতে হয়। কথা হলো, বিজিএমইএ কি এসব খবর রাখে না? তাদের যদি দায়িত্ববোধ থাকে, এ ক্ষেত্রে গার্মেন্ট মালিকেরা আদালতের বিধিনিষেধ ও নির্দেশনা কী করে উপেক্ষা করে যাচ্ছেন? চোর পালালে বুদ্ধি যদি বাড়েও, তবুও যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যায়। আর বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে ‘বারবার চুরি করে চোর পালাচ্ছে’, তবুও মালিকদের সংগঠন এবং সরকারের বুদ্ধি গজায় না। এভাবে আর কত দিন জাতি শত শত প্রাণ হারিয়ে খেসারত দেবে?
বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্ট পণ্য সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে জিএসপি সুবিধা অব্যাহত না থাকলে আমাদের খুব অসুবিধায় পড়তে হবে। Generalized System of Preference বা GSP সুবিধা যাতে বাংলাদেশ ভবিষ্যতেও পায়, সে জন্য আলোচনা করতে একটি প্রতিনিধিদল আমেরিকা গেছে। কয়েক মাস আগে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনে পুড়ে ৭৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় বাংলাদেশ এমনিতেই বেকায়দায় রয়েছে। তার ওপর এখন সাভারে চার শ’ গার্মেন্টকর্মীর মৃত্যু জিএসপি ভাগ্য অনিশ্চিত করে দিতে পারে। খোদ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বৃহস্পতিবার ঢাকায় বলেছেন, এ ঘটনা জিএসপি সংক্রান্ত শুনানিতে প্রভাব ফেলবে।
সুন্দর দেশ, হতভাগ্য জাতি
আমাদের দেশটি শস্য শ্যামল। এ দেশ সবুজ নিসর্গের অনুপম সৌন্দর্যের অধিকারী। পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ ভূমির এই পললপ্রান্তরে উর্বরতা এত বেশি যে, বীজ থেকে আপনাআপনি বৃক্ষ গজায়। এটা দেখে বিদেশীরা বিস্মিত হন। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে ভূগর্ভস্থ সম্পদভাণ্ডারও কম নয় আমাদের। গোটা দেশের মানুষের ভাষা ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য প্রায় এক। অন্তত ৮৫ ভাগ মানুষ একই ধর্মের। এমন সমস্বত্ব বা Homogeneous রাষ্ট্র বিশ্বে খুব কম। ১৬ কোটি মানুষ বোঝা নয় আদপে। তারা উদ্যমী ও কর্মঠ অপরিমেয় জনসম্পদ।
এমন সম্ভাবনাময় দেশটির মানুষেরা সুখে-শান্তিতে থাকার কথা। কিন্তু আমাদের ফাটা কপাল। প্রধানত মানবসৃষ্ট কারণে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব এই দুরবস্থার জন্ম দিয়েছিল। এমন এক প্রেক্ষাপটে গার্মেন্ট শিল্প বিরাট সুযোগ বয়ে এনেছে আমাদের দুর্ভাগা জাতির ফাটা কপাল জোড়া লাগানোর। কিন্তু অসৎ, অপরিণামদর্শী কিছু লোকের অপকর্মে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ আগুনে পুড়ছে। ভবন ধসের অঘটন এই শিল্পে ধস ডেকে আনছে। গার্মেন্ট শিল্পের পতন ঘটলে লাখ লাখ বস্ত্রবালিকাসহ সংশ্লিষ্ট অসংখ্য মানুষের জীবিকা রুদ্ধ হবে। জাতীয় অর্থনীতি পড়বে মুখ থুবড়ে। দেশে বেকারত্ব হবে প্রকট; সামাজিক অশান্তি দেখা দেবে। বৈদেশিক মুদ্রার কোষাগার অনেকটা ফাঁকা হয়ে যাবে। বারবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড আর ভবন ধসে যে বৈরী বার্তা বিশ্বাঙ্গনে পৌঁছে যাচ্ছে, এতে দেশের শিল্প মালিক ও উদ্যোক্তারা হারাবেন বিদেশের আস্থা। ফলে আমাদের গার্মেন্ট পণ্য হারাবে আন্তর্জাতিক বিপণন। ওঁৎ পেতে থাকা কয়েকটি বড় দেশ এ সুযোগে দখলে নেবে সে বিরাট বাজার। সুযোগ একবার হারালে পুনরুদ্ধার সহজ নয়। তখন গার্মেন্টের কোয়ানটিটি ও কোয়ালিটি আমরা যতই বাড়াই, ফায়দা হবে না। এই বিবেচনায় বলা যায়, সাভারে ছয়তলার ভিত্তির ওপর বানানো নয়তলা রানা প্লাজার ফাটল আসলে আমাদের জাতির ভাগ্যের বা কপালেরই ফাটল। এই ভবন ধসে পড়ে লাখো লাখো মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ ধরনের ঘটনাগুলোর জের ধরে অর্থনীতির ধস নেমে যাতে দেশের কোটি কোটি মানুষকে বিপন্ন না করতে পারে, সে লক্ষ্যে কাজ শুরু করতে হবে এখনই।
‘চিরদিন সমান নাহি যায়’। এটি জাতীয় কবি নজরুলের একটি বিখ্যাত গান। এতে প্রথমেই উল্লেখ আছে সাভারের প্রাচীনকালের রাজা, দাতা হরিশ্চন্দ্রের ভাগ্যবিপর্যয়ের। আমরা এখন দেখছি সেই সাভারে অসংখ্য অসহায় গার্মেন্টকর্মী ও তাদের আপনজন, সেই সাথে গোটা জাতির ভাগ্যবিপর্যয়। দরিদ্র শ্রমিকদের ঘাম ঝরিয়ে, শ্রমশোষণের মাধ্যমে বিত্তের পাহাড় গড়েছে শোষক লুটেরা মালিক ও পুঁজিপতিরা।
এমন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা চাই, যেখানে অজস্র মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে কোনো অসৎ অর্থগৃধ্নু নিজের ভাগ্য গড়তে পারবে না। যারা সাভারের ঘটনার মতো বিপর্যয়ের কারণ সৃষ্টি করে, তাদের এবং ওদের আশ্রয়দাতাদেরও ‘চিরদিন সমান নাহি যায়’Ñ এমন পরিস্থিতি কি অবিলম্বে সৃষ্টি করা উচিত নয়?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন