হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ ও বিশাল সমাবেশের মাধ্যমে সরকারের উদ্দেশে সুস্পষ্ট বার্তা পাঠানো হলেও ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই ক্ষমতাসীনরা আবারও নিজেদের পুরনো অবস্থানেই ফিরে আসতে শুরু করেছেন। বিএনপি ও জামায়াত বিরোধিতার আড়ালে আবারও শুরু হয়েছে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরোধিতা। আওয়ামী মহাজোট ও ১৪ দলের ব্যানারে গত দু’দিনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সমাবেশে ক্ষমতাসীনরা বলেছেন, বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতে ইসলাম সবই নাকি এক! সবার উদ্দেশ্যই নাকি কথিত যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়া ভ-ুল করা! হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফাকেও তারা মধ্যযুগের অন্ধকারে ফিরিয়ে নেয়ার কর্মসূচি হিসেবে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করেছেন। এই সুযোগে শাহবাগের ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিকরাও নতুন পর্যায়ে সোচ্চার হতে শুরু করেছে। তারা এমনকি হেফাজতে ইসলামকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার এবং আল্লামা শাহ আহমদ শফিসহ এর নেতাদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানোর ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। হেফাজতের ডাকা হরতাল প্রতিহত করার জন্যও নানা কর্মসূচি দিয়েছে তারা। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসবই সম্ভব হয়েছে ও হচ্ছে আসলে ক্ষমতাসীনদের চাতুরিপূর্ণ কৌশলের কারণে। বস্তুত ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিতও হয়েছে, মুখে মিষ্টি কথার ফুলঝুরি ছড়ালেও ইসলাম এবং মুসলমানদের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে ইসলামবিদ্বেষীদের পক্ষই নিয়েছিলেন। তাদের ইঙ্গিতে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামসহ নামসর্বস্ব কয়েকটি সংগঠনের পক্ষ থেকে ৫ এপ্রিল সন্ধ্যা ছয়টা থেকে লংমার্চের দিন ৬ এপ্রিল সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত অভিনব এক হরতালের ডাক দেয়া হয়েছিল। লাফিয়ে এসেছিল শাহবাগের নাস্তিক ব্লগাররাও। তারা দিয়েছিল অবরোধের ঘোষণা। সবার উদ্দেশ্য ছিল একটাই। দেশের কোনো অঞ্চল থেকে মানুষ যাতে লংমার্চে অংশ নিতে এবং ঢাকায় আসতে না পারেন। এ ব্যাপারে অন্যদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন মন্ত্রী ও এককালের শ্রমিক নেতা শাজাহান খান। তার অঘোষিত নির্দেশে বাস-ট্রাক তো বটেই, লঞ্চ ও স্টিমার চলাচলও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সরকার মাওয়া-কাওড়াকন্দি এবং আরিচা-দৌলতদিয়ার ফেরি চলাচলও বন্ধ করিয়েছিল। ফলে বরিশাল, পটুয়াখালি থেকে খুলনা, বাগেরহাট ও মাদারিপুর পর্যন্ত কোনো এলাকার মানুষই স্বচ্ছন্দে ঢাকা অভিমুখে আসতে পারেননি। একযোগে হুকুম চাপানো হয়েছিল পরিবহন মালিকদের ওপর। ফলে আগাম টাকা নেয়া সত্ত্বেও মালিকরা বাস বা ট্রাক ভাড়া দেননি। সবাই বলেছেন, নির্দেশ নাকি এসেছিল ‘ওপর’ থেকে। ট্রেন চলাচল বন্ধও করেছিল সরকার। ফলে আটকে পড়েছিলেন লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ, যারা হেফাজতে ইসলামের আহবানে লংমার্চে অংশ নেয়ার এবং ঢাকায় আসার জন্য এসে জড়ো হয়েছিলেন বিভিন্ন শহরে। এমন অবস্থা শুরু হয়েছিল লংমার্চের দু’দিন আগে থেকেই। সব মিলিয়ে পরিষ্কার হয়েছে, সরকার নিজেই আসলে লংমার্চকে ভ-ুল করে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিল। তাছাড়া দেশের প্রতিটি এলাকায় পুলিশকে দিয়ে সরকার লংমার্চকারীদের বাধা দিয়েছে, ভয়ভীতি দেখিয়েছে। রাজধানীতেও সরকারের নির্দেশে হোটেল-রেস্তোরাঁ আগেরদিনই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। লংমার্চকারীরা যাতে আশ্রয় নেয়ার সুযোগ না পান সে জন্য রাজধানীর সব মসজিদে তালা ঝোলানো হয়েছিল। সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে শাহবাগের নাস্তিক ও ইসলামবিদ্বেষী ব্লগারদের পাশাপাশি নির্মূল কমিটি ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মতো নামসর্বস্ব সংগঠনগুলোর বাড়াবাড়িও সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। রাজধানীর পাঁচটি প্রবেশমুখে তারা পুলিশের সহযোগিতায় অবরোধ করেছে, লংমার্চকারীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। প্রতিটি স্থানে আওয়ামী গুন্ডা-সন্ত্রাসীদেরও অংশ নিতে দেখা গেছে। এভাবে সব মিলিয়েই সরকার লংমার্চ ভ-ুল করে দেয়ার জন্য সর্বাত্মক তৎপরতা চালিয়েছে।
একই সরকারকে কিন্তু শাহবাগের ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগারদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ বিপরীত ভূমিকায় দেখা গেছে। দিনের পর দিন, দু’ মাসের বেশি সময় ধরে এই নাস্তিক ব্লগাররা শাহবাগের মতো অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে। স্বাভাবিক যানচলাচলই শুধু বন্ধ হয়ে যায়নি, অসুস্থ রোগীরাও চিকিৎসার জন্য বারডেম ও পিজি হাসপাতালে যেতে পারছেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকার শাহবাগীদের উল্টো জামাই আদরে রেখেছে। তাদের জন্য মাইক্রোবাসে করে বিরিয়ানি আর মোরগ পোলাও সরবরাহ করা হচ্ছে। পাঠানো হচ্ছে মিনারেল ওয়াটার। মোবাইল টয়লেটও স্থাপিত হয়েছে। এসবের পাশাপাশি বিজিবি, র্যাব ও পুলিশকে দিয়ে সরকার শাহবাগীদের জন্য তিন-চার স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করেছে। ছাত্রলীগের ‘সোনার ছেলেরা’ এবং আওয়ামী লীগের লোকজনও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। মঞ্চে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করেছেন ৭০ জন এমপি এবং বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। সংসদে দাঁড়িয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শাহবাগীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘ্ষোণা করেছেন। সব রীতি ও নিয়ম লংঘন করে শাহবাগী নাস্তিকদের সাক্ষাতের সুযোগ দিয়েছেন স্পিকার। তাদের কাছ থেকে স্মারকলিপি গ্রহণ করেছেন। জাতীয় সংসদও শাহবাগীদের দাবিতে রাতারাতি যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক আইন সংশোধন করেছে। অথচ শাহবাগের নাস্তিক ব্লগাররা জনগণের নির্বাচিত কোনো গ্রুপ বা গোষ্ঠী নয়। তাছাড়া তারা একদিকে দেশের আদালতকে চ্যালেঞ্জ করেছে, অন্যদিকে ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে নোংরা প্রচারণা চালাচ্ছে আল্লাহ এবং রাসূল (সা.) এবং ইসলামের বিরুদ্ধে। এমন এক অবস্থায় কর্তব্য যখন ছিল নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া, সরকার তখন উল্টো প্রশ্রয় ও সহযোগিতাই শুধু দেয়নি, একই সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের আইনসম্মত লংমার্চকেও ভ-ুল করে দেয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছে। আমরা সরকারের এসব অপকৌশল এবং কর্মকা-ের তীব্র নিন্দা জানাই। ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত হয়েছে, মুখে যতো কিছুই বলা হোক না কেন, বাস্তবে ক্ষমতাসীনদের বিশেষ কারো কারো ‘মন-প্রাণ’ এখনো শাহবাগেই পড়ে আছে। এজন্যই নিতান্ত লোক দেখানোর জন্য চার-পাঁচজন মাত্র নাস্তিক ব্লগারকে গ্রেফতার করা হলেও পুলিশকে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের ব্যাপারেই বেশি তৎপর দেখা যাচ্ছে। শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। সে একই পুলিশ আবার সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও নাস্তিক ব্লগারদের ছাড় দিচ্ছে সম্পূর্ণরূপে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সরকার আসলে নাস্তিকদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেয়ার পরিণতি সম্পর্কে ক্ষমতাসীনরা যতো তাড়াতাড়ি সতর্ক হবেন ততই তাদের জন্য মঙ্গল বলে আমরা মনে করি। সরকারের উচিত হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা পূরণ করা এবং শাহবাগের ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিকদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন