সোমবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৩

আমাদের সংস্কৃতি ধ্বংসে ভারতীয় আগ্রাসন



একটি দেশকে পদানত করতে হলে সে দেশের সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে চুরমার করার রেওয়াজ অতি প্রাচীন। সংস্কৃতিতে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের লোলুপ থাবা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। ভারত সরকারের চাপে এদেশের সরকার, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অসহায়। শিল্প, সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশ বিষয়ক অধিকাংশ প্রকল্প সরকার নিচ্ছে ভারতীয়দের চাপে। বাংলাদেশ হয়ে উঠছে ভারতীয় সংস্কৃতি চর্চার ‘উর্বর ক্ষেত্র’ হিসেবে। দু’দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি থাকলেও এসব চলছে চুক্তির তোয়াক্কা না করে। এ দেশের বিদ্যমান। আইন না মেনে তারা চালাচ্ছেন তাদের দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা। এতে সংস্কৃতি ধ্বংসের পাশাপাশি ভারতে চলে যাচ্ছে দেশের কোটি কোটি টাকা। এখন সরকারি-বেসরকারি অনেক অনুষ্ঠান শুরু হয় ভারতীয়দের অনুকরণে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে, ঢোল বাদ্য বাজিয়ে। মন্ত্রী, সচিব, সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, আওয়ামীপন্থী, বাম সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এটা করছেন। ভারতীয় শিল্পীদের দিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে।  (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ১১ এপ্রিল ২০১১)
দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পকে যুগোপযোগী না করে সরকার ভারতীয় ছবি প্রদর্শনে তৎপর কেন? আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পে এখন নাজুক অবস্থা যাচ্ছে। সে মূহুর্তে ভারতীয় ছবি প্রদর্শন মানে শেষ পেরেকটুকু ঠুকে দেয়া। ভারতীয় চলচ্চিত্র মুক্তি দেয়া নিয়ে চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিচালক ও শিল্পীরা এর বিরোধিতা করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে ছবি মুক্তি দেয়ার স্বপক্ষে নেমেছেন সিনেমা হল মালিকরা। স্বাধীন দেশে কেন বিদেশী ছবি দিয়ে দেশের সিনেমা হল বাঁচাব এমন প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে।
যারা ভারতীয় ছবি আনছেন, তারা আসলে কারা? এরা কাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করছেন? স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে যদি নিজেদের তৈরি সিনেমা দিয়ে মানুষকে সিনেমা হলে নিয়ে আসা যায়, তাহলে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর কেন আজ ভারতীয় ছবি আনা হচ্ছে? ভারতীয় ছবি নয়, উপমহাদেশের ছবি আমদানি করার কথা ছিল। কিন্তু ভারতীয় ছবিই প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে। তাছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে এ চলচ্চিত্র এ দেশের বাজারে আনা হয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সাধারণ অর্থে কোনো আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে বাধা থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে মুক্তবাজার অর্থনীতি সব দেশই তাদের দেশীয় শিল্প এবং কৃষির স্বার্থে নানান শুল্ক ও অশুল্ক বাধা জারি রাখে। একইভাবে চলচ্চিত্র শিল্পের যদি উন্নতি করতে হয় তাহলে তাকে মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে আর্থিক কারিগরি, নন্দনতাত্ত্বিক সবদিক থেকেই দুর্বল রাখার সব ম্যাকানিজম চালু রাখলে চলচ্চিত্রকে আরো প্রতিযোগিতামূলক হতে হবে না।
দেশীয় শিল্প সংস্কৃতির অস্তিত্ব বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনের মুখে কোনঠাসা। আকাশ সংস্কৃতির উন্মুক্ত পথে ভিনদেশী ঐতিহ্য, আচার ব্যবহার, পোশাক এবং ধর্মীয় প্রভাব বাংলাদেশী কিশোর-কিশোরী ও শিশুদের মনোজগতে যে প্রভাব ফেলছে তাতে দেশপ্রেম ও স্বাজাত্যবোধ গড়ে ওঠার পথে বিরাট বাধার সৃষ্টি করেছে। ফলে এদেশের শিশু-কিশোররা তার অতীতে সংগ্রামী বীর পুরুষদের কথা ভুলে জাতীয় বীর হিসেবে ভিনদেশী চরিত্রকে স্নাত স্মরণীয় মনে করছে। এভাবে এদেশীয় শিশু-কিশোরদের মনে হীনমন্যতা ধীরে ধীরে শিকড় বিস্তার করছে। ফলে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক দখলদারিত্বের পথ নির্মাণে ভারতীয়দের তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না। এতে দেশটির সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের থাবায় বিপন্ন এদেশের সার্বভৌমত্ব।
ভারত প্রাচীন সংস্কৃতির দেশ হলেও আমরা দেশটির পর্ণো সংস্কৃতির আগ্রাসনের শিকার। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, মিডিয়া ব্যবসায়ীরা ওই পর্ণো সংস্কৃতি উপভোগ করছে। এতে এ দেশের সংস্কৃতি বিকশিত হতে পারছে না। সংস্কৃতি চর্চার নামে এদেশের যারা আইন না মেনে ভারতীয় শিল্পীদের আনছেন তাদের জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। ফলে তারা একের পর এক শিল্পীকে আনছেন।
রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক দখলদারিত্বের পর বাংলাদেশে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ষোলকলা পূর্ণ হতে চলেছে। পাহাড়প্রমাণ বাণিজ্য ঘাটতির পাশাপাশি সংস্কৃতি জগতে আগ্রাসনের লোলুপ থাবা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে দিন দিন। বাংলাদেশ এখন ভারতীয় শিল্পীদের রমরমা বাজার। এ প্রক্রিয়া হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে চলে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ভারতীয় নামি-দামি শিল্পীদের এনে প্রোগ্রাম করে ‘জাতে ওঠার’ এক ধরনের হীনমন্যতার ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় ঘটছেÑবিপরীতে দেশের প্রতিভাবান শিল্পীরা অবজ্ঞা, উপেক্ষার ন্যক্কারজনক শিকার।
বাংলাদেশকে বলা হয় বাউলের দেশ। এ মাটিতে বহু বাউলশিল্পী জন্ম নিয়েছেন। গান গেয়ে বাংলার সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত করেছেন বাংলাদেশের বাউলসমাজ। বাংলাদেশের বাউলকূলকে ধ্বংস করা হচ্ছে। তথাকথিত কিছু সংগঠনের নামে ভারত থেকে বাউলশিল্পী এনে ঢাকায় কনসার্ট করানো হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ থেকে একজন বাউল শিল্পী সেদেশে গিয়ে কনসার্ট করতে পেরেছেন বলে জানা যায়নি।
পারিশ্রমিক হিসেবে বিপুল পরিমাণ টাকা হুন্ডি করে ভারতে পাঠানো হচ্ছে। কোনো প্রকার ট্যাক্স দেয়ার বালাই নেই। এক একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে একেকজন শিল্পী কমপক্ষে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক নিচ্ছেন। বাংলাদেশে আসার আগেই মোটা অঙ্কের টাকা আগাম সম্মানী দিয়ে তাদের বুকিং করতে হয়।
যথাযথ অনুমতি ছাড়াই ভারত থেকে শিল্পীরা বাংলাদেশে আসছেন। যেসব শিল্পী আনা হয়েছে এরা হলেনÑমান্না দে, হৈমন্তি শুক্লা, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, জগজিৎ সিং, পঙ্কজ উদাস, কুমার শানু, অলকা ইয়াগনিক, কবীর সুমন, নচিকেতা, সনু নিগম, শান, অনুরাধা ঘোষ, ইন্ডিয়ান আইডল ইমন, কৈলাস খের, সারেগামাপার সঞ্চিতা ও মনীষা, ফেইম গুরুকুলের রূপরেখা, চন্দ্রিমা, আইটেম গার্ল শেফালি ও শিরিন, পূর্ণদাস বাউল, স্বপন বসু, দিব্যেন্দু দাস বাউল প্রমুখ।
ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে হুন্ডি করে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন তারা। যেসব মন্ত্রণালয় বা দফতরের অনুমতি প্রয়োজন সেখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ‘ম্যানেজ’ করে ভারতীয় শিল্পীদের ঢাকায় আনা হয়। ম্যানেজ করা হয় অনুষ্ঠানের টিকিট বা অন্য উপঢৌকন দিয়ে। ওইসব ব্যক্তি সপরিবারে জামাই আদরে অনুষ্ঠানের প্রথম সারিতে বসে উপভোগ করার আমন্ত্রণ পান।
আওয়ামী মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরই সরকারের এক বছর পূর্তির দুই মাস পূর্ব পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ভারতীয় শিল্পী এদেশে কনসার্ট করেছেন। দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি বিদ্যমান থাকলেও এসব চুক্তির কোনো তোয়াক্কা না করেই শিল্পীদের আনাগোনা অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অনেক ক্ষেত্রেই এ সংক্রান্ত ব্যাপারে অবগত নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জেনেও তারা উদাসীন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে, ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, চিটাগাং ক্লাব, সোনারগাঁও, শেরাটন, রেডিসন, ওয়েস্টিন, ঢাকা রিজেন্সির মতো বিলাসবহুল ভেন্যুতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভারতীয় শিল্পীদের দিয়ে অবাধে অনুষ্ঠান করছে। পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ ও বিজেএমইএ নিয়ে এসেছে একদল ভারতীয় শিল্পী। ৫ নভেম্বর ২০০৯  থেকে চীন মৈত্রী ও সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত হয় তাদের কনসার্ট।
পারফরমেন্সের নামে ঢাকায় দলে দলে আসছেন ভারতীয় শিল্পী। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে কোনো শিল্পী ভারতে যেতে পারছে না। বড় ধরনের কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে না। বাংলাদেশের দুই জীবন্ত কিংবদন্তী রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমিনের কোনো কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়নি আজ পর্যন্ত ভারতে। অথচ সে দেশের নামি-দামী, অখ্যাত শিল্পীরা বাংলাদেশে এসেছেন-কামিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। ভারতীয় বিভিন্ন শিল্পী বাংলাদেশকে তাদের গানবাজনা ও চ্যানেলের বাণিজ্যিক ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক বৈষম্য যেমন রয়েছে, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বিরাট বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। সুস্থ সাংস্কৃতিক বিনিময়ের নামে এ ধরনের একতরফা সাংস্কৃতিক বাণিজ্য কিছুতেই মেনে নেয়া যায়না। এদের রুখতে হবে। এদের রুখতে না পারলে দেশের সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাবে।
অনেক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে অভিজাত ক্লাবগুলো যেসব ভারতীয় শিল্পীকে বাংলাদেশে আনছে তাদের গোপনীয়তার কারণে সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব নয়। ভারত থেকে নামি-দামি শিল্পীরা বাংলাদেশে এলে মিডিয়া তাদের সংবাদ ফলাও করে ছাপে ও প্রকাশ করে। কিন্তু অভিজাত ক্লাবগুলোতে যেসব শিল্পী আনা হয়, সেখানকার খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয় না। বেশিরভাগই লুকোচুরি করে ভারতীয় শিল্পীদের ঢাকায় আনা হয়। ট্যাক্স ফাঁকি দিতে আয়োজকরা এই লুকোচুরি করেন। অভিজাত ক্লাবগুলো ভারতীয় আইটেম গার্ল ও ডিজিটাল জকিদের নিয়ে অনুষ্ঠান করেন অনুমতি ছাড়াই। যার কারণে ওইসব শিল্পীর আসার খবর পাওয়া যায় না। ক্লাব চড়া দামে টিকিট বিক্রি করে।
২০০৯ সালের আগস্ট মাসে স্থানীয় একটি হোটেলে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় আইটেম গার্ল শেফালীকে দিয়ে একটি ডিজে নাইট শোর আয়োজন করা হয়। কাঁটালাগা খ্যাত আইটেম গার্ল শেফালী সেখানে পারফরমেন্স করেন। ওই অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ওই অনুষ্ঠানে শেফালী অশ্লীল নৃত্য পরিবেশন করেন। বিত্তবান শ্রেণির ছেলেমেয়েরা ওই অনুষ্ঠান বিপুল পরিমাণে টাকা খরচ করে উপভোগ করে। সর্বনিম্ন টিকিট ছিল ১০ হাজার টাকা।
২৫ জানুয়ারি ২০০৯ চট্টগ্রামে আসেন ভারতের জনপ্রিয় শিল্পী কুমার শানু। সঙ্গে ছিলেন অপর ভারতীয় শিল্পী অনুরাধা ঘোষ। গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইর আয়োজনে ‘গার্মেন্ট মেলা বাটেক্সপো ২০০৯’ উপলক্ষে তারা এসেছিলেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন ভারতীয় শিল্পী মান্না দে। তিনি তিনটি কনসার্টে অংশ নেন। এর মধ্যে দু’টি ছিল ঢাকায়, অন্যটি কক্সবাজারে।
এমব্রেজার ফিল্মস এবং প্রিয়ন্তী অ্যান্ড ইফেক্টস যৌথভাবে এই কনসার্টের আয়োজন করে। মান্না দে’র প্রথম কনসার্টটি হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শেরাটন হোটেলের উইন্টার গার্ডেনে। দ্বিতীয়টি অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেইমে। এ দুটি কনসার্ট উপভোগ করতে দর্শক শ্রোতাদের ৫০০০, ৩৫০০ এবং ২৫০০ টাকা করে টিকিট কাটতে হয়। তৃতীয় কনসাটটি অনুষ্ঠিত হয় কক্সবাজারের হোটেল সি প্যালেসে। মান্না দের সঙ্গে এসেছিলেন আরেক ভারতীয় শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা। তিনিও মান্না দের সঙ্গে এসব কনসার্টে অংশ নেন। তিনটি কনসার্টে অংশ নিয়ে এই দুই শিল্পী প্রায় এক কোটি টাকা পারিশ্রমিক নিয়েছেন।
৬ মে ২০০৯ ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের জনপ্রিয় সুফি ব্যান্ড দলের কৈলাস খের। তার পরের দিন তিনি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেইম মিলনায়তনে সম্পূর্ণ একটি বাণিজ্যিক কনসার্টে অংশ নেন। কনসার্টটি এতই বাণিজ্যিক ছিল যে সাংবাদিকদের পর্যন্ত অনুষ্ঠান কাভারেজ করতে ডাকা হয়নি। কনসার্টটির আয়োজন করে ইউনিট্রেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান মোমেনটাম। কৈলাস খের প্রায় ২০টির মতো গান গেয়ে পারিশ্রমিক নেন ৫০ লাখ টাকা। কৈলাশ খের বাংলাদেশে গান গাইবেন তবে কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে হবে বলে বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেন আয়োজকদের। এর মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিল গণমাধ্যমে সাক্ষাতকার দিতে হলে তাকে সেজন্য পারিশ্রমিক দিতে হবে এবং একই সঙ্গে কনসার্ট টিভিতে প্রচার করা যাবে না। প্রচার করতে হলে আলাদা রয়েলিটি দিতে হবে তাকে। কনসার্টটি উপভোগ করার জন্য দর্শক শ্রোতাকে ৪০০০, ৩৫০০ ও ২৫০০ টাকা দিয়ে টিকিট কিনতে হয়েছে।
বলিউডের প্লেবেক সিঙ্গার হচ্ছেন শান। বাণিজ্যিক কনসার্টে অংশ নিতে ১৯ জুন ২০০৯ ঢাকায় আসেন তিনি। ২০ জুন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেইম মিলনায়তনে শো করেন এই শিল্পী। এই কনসার্টের আয়োজক ছিল অন্তর শোবিজ। একই কনসার্টে অংশ নেন ভারতীয় চ্যানেল জিটিভির গানের প্রতিভা অন্বেষণমূলক প্রতিযোগিতা সারেগামাপা’র সেরা ৫ম স্থান অধিকারী মনীষা। শান এই কনসার্ট থেকে ৬০ লাখ টাকা পারিশ্রমিক নেন।
২৫ জুন ১৯৯৯ ঢাকায় আসেন ভারতীয় শিল্পী নচিকেতা। তিনি দু’টি কনসার্টে অংশ নেন। কনসার্ট দুটি অনুষ্ঠিত হয় ওয়াটার গার্ডেন রেডিসন হোটেল ও উত্তরা ক্লাবে। নচিকেতার গানের পাশাপাশি ডিজে শোতে অংশ নেন ভারতীয় আইটেম গার্ল ডিজে শিরিন। আয়োজক ছিলেন বিমস কমিউনিকেশন।
ভারতের প্লেব্যাক গায়িকা অলকা ইয়াগন্বিক ঢাকায় এসেছিলেন ১৫ জুলাই ১৯৯৯। রেড এন্টারপ্রাইজের আয়োজনে ১৬ জুলাই বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেইম মিলনায়তনে শো করেন তিনি। তার  এই কনসার্টটি উপভোগ করার জন্য হল ভর্তি দর্শক-শ্রোতা উপস্থিত ছিল। টিকিটের দাম ছিল ৪৫০০, ৩৫০০ ও ১৫০০ টাকা। অলকা ইয়াগন্বিক সাধারণত বাণিজ্যিক শোতে ১ কোটি টাকার নিচে পারিশ্রমিক নেন না। তিনি এই কনসার্টে ১ কোটি টাকা পারিশ্রমিক নিয়েছেন।
১২ আগস্ট ১৯৯৯ ঢাকায় পারফর্মেন্স করেন ভারতীয় শিল্প ফেইম গুরুকুলের রূপরেখা, সারেগামাপা লিটল চ্যাম্পের সঞ্চিতা, ইন্ডিয়ান আইডল ইমন এবং কাঁটালাগা খ্যাত আইটেম গার্ল শেফালী।
১৬ অক্টোবর ১৯৯৯ চিরকুটের আয়োজনে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে কনসার্টে অংশ নেন কবীর সুমন (সুমন চট্টোপাধ্যায়)। ৩০ অক্টোবর উত্তরা ক্লাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাউলশিল্পীদের নিয়ে আয়োজন করা হয় বাউল গানের আসর ‘সংন্স অব দ্যা বাউল’। বাউলশিল্পীরা ছিলেন-পূর্ণদাস বাউল, স্বপন বসু ও দিব্যেন্দু বাউল। ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ভারতীয় শিল্পীদের দুটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিত্তবানদের ক্লাব ঢাকা ক্লাবে একক বাঁশি সন্ধ্যায় বাঁশি বাজান ভারতীয় বংশীবাদক হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। একই দিন ফায়ারফক্সের আয়োজনে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে কনসার্ট করেন সনু নিগম। ৪ নভেম্বর বিকেএমইএ’র আমন্ত্রণে ভারতীয় জনপ্রিয় গণশিল্পী জগজিৎ সিং কনসার্ট করেন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেইমে।
২০১০ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে আয়োজিত বলিউড কিং শাহরুখ খানের কিং খান লাইভ শো ইন ঢাকা’য় অংশ নিয়ে শাহরুখ খান কোটি কোটি টাকা নিয়ে যান। তিনি কোনো ট্যাক্স দেননি। ওই অনুষ্ঠানে বলিউড তারকা অর্জুন রামপাল, রানি মুখার্জি অংশ নেন। তারাও ট্যাক্স দেননি।
২০১১ সালের মার্চ মাসে এ দেশের স্বাধীনতা লাভের চল্লিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে ছিল ভারতীয়দের জয়জয়কার। অনুষ্ঠান শুরুর আগে ভারতীয় জাতীয় সংগীত বাজানোও আজকাল আর বিচিত্র কিছু নয়।
১ এপ্রিল ২০১১ ঢাকায় আয়োজিত রোটারি ক্লাব বাংলাদেশ শাখার সম্মেলনে নীতিমালা অমান্য করে বাজানো হয় ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীত। শিল্পীর পাশাপাশি হিন্দিভাষী উপস্থাপিকাও আনা হচ্ছে। সরকারি, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, সংগঠনের উদ্যোগে এসব অনুষ্ঠান আয়োজিত হচ্ছে। এক গবেষণা মতে, সরকারি সহায়তার পাশাপাশি গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, সঙ্গীত শিক্ষালয়, নাট্যবিদ্যালয়, নাট্যশালা, আর্ট স্কুল, ফ্যাশন শো, সঙ্গীত, অভিনয়, সুন্দরী প্রতিযোগিতা, পাঠ্যপুস্তক, সাহিত্য, সেমিনার, এনজিও, হাসপাতাল, রূপচর্চা কেন্দ্র, শিক্ষাবৃত্তি, ক্লাব-সমিতি, সাংস্কৃতিক সফর, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতি এদেশে ঢুকছে।
বলা হয়ে থাকে, একাত্তরের স্বাধীনতা লাভের পর এ জাতির সাংস্কৃতিক জাগরণের উজ্জ্বলতম উদাহরণ একুশের বইমেলা। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে আয়োজিত বাংলা একাডেমির বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন নোবেলজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. অমর্ত্য সেন। মেলা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস নোবেলজয়ী একমাত্র বাংলাদেশী। তাকে ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এ দেশের একমাত্র নোবেলজয়ীকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে একজন ভারতীয়কে বিশেষ অতিথি করায় নানা প্রশ্নের জন্ম হয়, সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে বলা হয়, দুদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বাড়াতে, এদেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রমাণের জন্য ড. অমর্ত্য সেনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ড. অমর্ত্য নিজেই সাম্প্রদায়িক চেতনার। তার ‘আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ বইয়ে ইসলাম ধর্ম বাদ দিয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন। এ বইমেলার এক মাসের আলোচনা অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যা আগে কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে এভাবে হয়নি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ফসল বাংলা একাডেমীর বইমেলার পুরো মাসের আলোচনা অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথকে বিষয় করায় নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। কেননা, ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোনো সম্পর্ক নেই। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আলোচনা করতে আমন্ত্রণ জানানো হয় কলকাতার অনেককে। একই বিষয়ে এদেশে বিশেষজ্ঞ থাকলেও তাদের মধ্যে অনেকে আমন্ত্রণ পাননি। একাডেমীর দাবি, রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এ বিষয় নির্ধারিত হয়। মেলার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানাতে ২ ডিসেম্বর ২০১১ একাডেমী আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এর পরিচালক শামসুজ্জামান খানের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুলকে নিয়ে একইভাবে পুরো মাসের আলোচনা অনুষ্ঠান করবেন কিনা?’ প্রশ্নটার উত্তর দেননি তিনি। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে চলছে রবীন্দ্রবন্দনা।  রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চায়ন, তাকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র বানাতে আর্থিক সহায়তা দিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নতুন প্রকল্প নিয়েছে। শিল্পকল্পা একাডেমী এ রকম পরিচালনা করছে। অথচ জাতীয় কবি নজরুলকে নিয়ে এরকম প্রকল্প সরকারের নেই। নজরুল এখন চরম উপেক্ষিত। অভিযোগ আছে ভারত সরকারের চাপে সরকার এ প্রকল্প নেয়।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাত্র সাতদিন পর আর মর্মান্তিক বিডিআর বিদ্রোহের দ্বিতীয় বার্ষিকীর আগ মুহূর্তে ঢাকায় ‘ডেসটিনি গ্রুপ ট্রাইনেশন বিগশো’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত হয় ভারতীয় শিল্পীদের উদ্দেশ্যমূলক কনসার্ট। অনুষ্ঠানটি করা হয় বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সঙ্গে মানুষকে সম্পৃক্ত করার জন্য। শো’র টিকিট এর দাম রাখা হয় দুই হাজার থেকে দুই লাখ টাকা। দেশের সংস্কৃতি সেবীরা বলেন, ‘অনুষ্ঠানটির সঙ্গে বিশ্বকাপের সম্পর্ক নেই। খেলোয়াড়রা মাঠে ভালো খেললে দর্শকরা ক্রিকেট উল্লাসে মেতে ওঠে। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষা চর্চার পরিবর্তে বলিউডের শিল্পীদের এনে হিন্দিগান পরিবেশন গর্হিত কাজ।’
অন্যদিকে একাত্তর সালে স্বাধীনতা লাভের চল্লিশ বছর পূর্ণ উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে মার্চ মাস জুড়ে। এর মধ্যে অনেকের অনুষ্ঠানের তালিকায় ছিলেন ভারতীয় শিল্পীরা, আর তাতে উপেক্ষিত ছিল এদেশের শিল্পীরা এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠান শিল্পকলা একাডেমী ও ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার’ মিলেও ভারতীয় শিল্পীদের দিয়ে অনুষ্ঠান করে। এ দু’প্রতিষ্ঠানের যৌথ আয়োজনে ৪ মার্চ  ২০১১ শিল্পকলা একাডেমীতে ছিল ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী বিদ্যা শাহ, ১৮ মার্চ পন্ডিত যশরাজের সঙ্গীত সন্ধ্যা। তারা ঢাকার বাইরে অনুষ্ঠান করেন। এই আয়োজনে এ দেশের কোনো সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালিক কামাল লোহানী বলেন, ‘ভারতীয় কো শিল্পীর সঙ্গে এদেশীয় কাউকে মঞ্চে উঠিয়ে দেয়ার মানে হয় না। তাই এদেশের কাউকে রাখা হয়নি। তাছাড়া ভারতীয় দূতাবাসও এদেশের কোনো শিল্পীকে অনুষ্ঠানে চাননি।’
আওয়ামীপন্থী সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর গণসঙ্গীত উৎসবে ২৮ মার্চ ২০১১ শিল্পকলা একাডেমীতে, ৩১ মার্চ বিয়াম মিলনায়তনে ছিল ভারতীয় শিল্পী মৌসুমি ভৌমিকের অনুষ্ঠান। গণসঙ্গীত না হলেও সরকারকে খুশি রাখা, ভারতীয় সংস্কৃতি চর্চার পথ আরও বিকশিত করতে তাকে আনা হয়। স্বাধীনতার চার দশক পূর্তি উপলক্ষে ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ভারতীয় শিল্পী ওস্তাদ জাকির হোসেনের তবলা বাদন আয়োজন করে সরকার সমর্থক একটি জাতীয় দৈনিক। ১৯ মার্চ ২০১১ থেকে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের শিল্পীদের সংগঠন ‘কিরাত’এর উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারি ২ এ আয়োজিত হয় চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক মৈত্রীর সেতু স্থাপন ও প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য বলে আয়োজকরা জানান। তবে সেখানে এদেশের কোনো শিল্পীর চিত্রকর্ম ছিল না। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ৭ নভেম্বর ২০০৯)
ভারতে বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল দেখা না গেলেও বাংলাদেশে তাদের চ্যানেলের আধিপত্য বেড়েছে। স্টার প্লাস, জিটিভি, সনি টিভিতে প্রতিদিনই ৭ থেকে ৮টি সিরিয়াল প্রচার হয়। ফলে বাংলাদেশে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভয়াল থাবা পড়েছে মারাত্মকভাবে। এসব হিন্দি সিরিয়াল মহিলাদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। তবে উচ্চবিত্ত গৃহিণীদের কাছে এসব সিরিয়াল বেশি জনপ্রিয়। গৃহিণীদের সময় কাটে এসব সিরিয়াল দেখে। অনেকের ঘুম আসে না এসব সিরিয়াল না দেখলে। বর্তমানে এসব সিরিয়ালের খারাপ দিক এতটাই মারাত্মকভাবে দেখা গেছে, হিন্দি সিরিয়াল দেখার জন্য ঘরে ঘরে ঝগড়া পর্যন্ত হচ্ছে। হিন্দি সিরিয়ালগুলোর কাহিনী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরকীয়ার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী মহিলা এসব সিরিয়াল দেখে থাকেন। অবৈধ প্রেম আর সম্পত্তি দখল নিয়ে নানা উদ্ভট বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে এসব সিরিয়ালে।
স্যাটেলাইট চ্যানেল সম্প্রচারে ভারতীয় ডিশ বক্স অবাধে আসছে দেশের সীমান্ত এলাকা দিয়ে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী অবৈধ এসব বক্স ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই। সরকারের অবহেলা, উদাসীনতা আর অদক্ষতায় ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরের বাজার ছেয়ে গেছে এসব বক্সে। দিনে দিনে এর বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে এদেশে। বাজার দখল করতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এদেশে গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। দেশীয় এ সিন্ডিকেট সরকারকে ম্যানেজ করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘ডাইরেক্ট টু হোম’ (ডিটিএইচ) নামের এসব ডিশ বক্সে কেবল ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেল সম্প্রচার হচ্ছে। ওই সার্ভিসে এদেশের কোনো চ্যানেল নেই। ফলে এদেশে ভারতীয় চ্যানেলের আধিপত্য বাড়ছে। এতে দেশীয় সংস্কৃতি পড়েছে ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনের কবলে। চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভারতীয় পণ্যের বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে এদেশে। এসব বক্স দিয়ে অনেক ক্যাবল ব্যবসায়ী ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেল সম্প্রচার করছেন। আর তারা দেশের সরকারকে কর না দিয়ে ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে টাকা দিচ্ছেন। এতে সরকার বছরে প্রায় দু’হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। বক্সের মধ্যে পর্ণো সিনেমা প্রচারের চ্যানেলও আছে। এসব চ্যানেল দেখে নষ্ট হচ্ছে দেশের তরুণ প্রজন্ম।
ঢাকাসহ সারাদেশের বাজার সয়লাব আজ ভারতীয় ডিশ বক্সে। ঢাকা থেকে এসব বক্স যাচ্ছে সারাদেশে। বক্সগুলো প্রশাসনের কর্মকর্তাদের চোখের সামনে অবাধে বিক্রি হচ্ছে বাজারে। ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সুপার মার্কেটে গেলে এমন চিত্রই দেখা যায়। সেখানকার ইলেকট্রো, টোকিও, আলিশা, ও নবরূপা ইলেকট্রনিক্সসহ প্রায় সব দোকানের সামনে বড় বড় অক্ষরে ঝুলছে এসব বক্স বিক্রির বিজ্ঞাপন। টাটা স্কাই, ডিশ টিভি, সান ডাইরেক্ট, বিগ টিভি, এয়ারটেল ডিজিটাল টিভি, ডিডি ডাইরেক্ট গ্লাসসহ ভারতীয় প্রায় পনেরটি কোম্পানির উৎপাদিত ডিশ বক্স সেখানে বিক্রি হচ্ছে।
এসব বক্স মূলত ডিশ এন্টেনার আধুনিক সংস্করণ। সস্তা, সহজলভ্যতা ও ঝামেলাহীন হওয়ায় বাজারে দিন দিনই এর চাহিদা বাড়ছে। প্রতি বক্সে বিশ থেকে ৩০টি ভারতীয় চ্যানেল দেখা যায়। একেকটি বক্সের দাম ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা। ভারত থেকে আনতে দাম পড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা। অভিজাত এলাকার বাসিন্দা ও ক্যাবল অপারেটররাও চ্যানেল সম্প্রচার করছেন বক্সগুলোর মাধ্যমে।
সীমান্ত এলাকা থেকে ভারতীয় দালালদের মাধ্যমে তারা এসব বক্স আনেন। ভারতীয় ডিটিএইচ সার্ভিস ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দেশের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এতে এদেশের সরকারই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ডিটিএইচ বক্সে কোম্পানির দেয়া নির্দিষ্ট নম্বরের ফ্রিকোয়েন্সির সাহায্যে ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেল প্রচার করা হয়। এজন্য ভারতীয় কোম্পানিগুলো হন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা এদেশে খরচ করছে। এ সংযোগের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা প্রথমে সাড়ে চার হাজার টাকা নিচ্ছেন। মাসিক সাবসক্রাইবার ফি হিসেবে নেন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। ই-ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ডিটিএইচ চার্জ পরিশোধ হচ্ছে। মোবাইলের প্রি-পেইড কার্ডের মতো বিভিন্ন মেয়াদের ডিটিএইচ কার্ডও বাজারে আছে। এসব বক্স ব্যবসার বেশিরভাগ টাকা চলে যাচ্ছে ভারতে।
‘ক্যাবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন-২০০৬’ অনুযায়ী কোনো নাগরিক ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক স্বার্থে ডিশ এন্টেনা ব্যবহার করতে পারবে না। আইন অনুযায়ী ওই ব্যবসা অবৈধ। তবে তা ঠেকাতে সরকারের কোনো কার্যক্রম নেই। তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ও এক্ষেত্রে নীরব।
সীমান্ত দিয়ে এসব বক্স আসা ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো তৎপরতা নেই। ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ে জাতীয় রাজস্ববোর্ডের কোনো তৎপরতা নেই।
প্রয়াত অভিনেতা সোহেল চৌধুরী  নব্বইয়ের দশকে দেশে প্রথম এ ব্যবসা শুরু করেন। ঢাকার গুলশান-১ এলাকায় ‘ফ্রেন্ডস ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক’ নামে তিনি অবৈধভাবে তা শুরু করেন। তিনি ও তার সহযোগীরা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশী চ্যানেলের পেমেন্ট পাঠাতেন। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে ঢাকা শহরে ব্যবসাটি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ছড়ায় সারাদেশে। এই ক্যাবল ব্যবসার বর্তমান সংস্করণ হচ্ছে ‘ডিটিইচ সার্ভিস’। প্রথম থেকেই ক্যাবল ব্যবসাখাতে রাজস্ব হারায় সরকার।
সোহেল চৌধুরী আওয়ামী লীগের গত শাসনামলে ঢাকার এক ক্লাবে সন্ত্রাসীদের গুলীতে নিহত হন। তার মৃত্যুর পর এ ব্যবসা থেমে থাকেনি। ক্ষমতায় যারা আসেন, তাদের সহায়তায় চলে এ ব্যবসা। সরকারের উদাসীনতায় দিনে দিনে এর বিস্তার ঘটে জোরালোভাবে। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ১৪ আগষ্ট ২০১১)
এক রাষ্ট্রের আইন না মানাটা ওই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননা। অবমাননার বিষয়টা যেভাবে চলে আসছে তাতে সার্বভৌমত্ব বিপন্ন। ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন দিন দিন বিস্তৃত হয়ে উঠছে।
দেশি সিনেমা ও শিল্প ধ্বংসের কালো ও কলঙ্কিত অধ্যায় শুরু হয় ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০১১ থেকে। সফল হয় দেশি শিল্প ধ্বংসের শেষ ঘণ্টাধ্বনি। স্বাধীনতার পর  এ দিন থেকে প্রথমবারের মতো দেশের সিনেমা হলগুলোয় চলেছে ভারতীয় ছবি। দেশের চলচ্চিত্র শিল্পী, প্রযোজক, নির্মাতা, কলাকুশলীদের শত আপত্তি, আন্দোলন, দাবি ও সমালোচনা উপেক্ষা করে এসব সিনেমা প্রদর্শন হয়। কোনোভাবেই তা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হলো না। স্বাধীনতার পর কোনো সরকার ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শনের অনুমোদন না দিলেও মহাজোট সরকারই দিচ্ছে। কোনো নীতিমালা ছাড়াই চলছে এসব সিনেমা। এক্ষেত্রে চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির রিলিজ কমিটি থেকে অনুমতি নেয়ার প্রচলিত নিয়মটিও মানা হয় না।
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১১ মুক্তি পায় ভারতের কলকাতার স্বপন সাহা পরিচালিত ‘জিৎ’, কোয়েল মল্লিক ও দীপঙ্কর দে অভিনিত ‘জোর’। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের ১২টি হলে মুক্তি পায় ছবিটি। প্রথমে ঢাকায় মধুমিতা, অভিসার, আজাদ, পূর্ণিমা, আগমন, গ্যারিসন ও গ্রিড হলে ‘জোর’ দেখানো হয়। আদালতের নির্দেশের কারণে ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনও হয়নি কোথাও। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা শেষ পর্যন্ত ভারতীয় ছবি প্রতিরোধের সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। তবে তারা বলছেন, ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শন দেশী চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ। আমদানি ঠেকাতে তারা বিভিন্ন সময় সরকারের উঁচু মহলে জোর দাবি ও অনুরোধ জানালেও সরকার ছিল আমদানির পক্ষে।
প্রখ্যাত নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভারতীয় সিনেমা এদেশে আমদানি ও প্রদর্শন মানে আমাদের চলচ্চিত্র ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা। দেশি সংস্কৃতি এখন আগ্রাসনের কবলে। ভারতীয় সিমেনা অবাধে প্রদর্শন হলে আগ্রাসনের কবলে পড়ে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি উচ্ছন্নে যাবে। সমাজ ও রাজনীতিতে যেসব মানুষ দেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে, ভারতীয় ছবি প্রদর্শনীর সঙ্গে তারা জড়িত।’ তার প্রশ্ন ‘দেশি ছবির পৃষ্ঠপোষকতা না করে বিদেশী ছবি প্রদর্শন হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গেল কোথায়? দেশপ্রেম কোথায় থাকল?’
নির্মাতা কাজী হায়াত বলেন, ‘কোন নীতিমালার ভিত্তিতে, কাদের সঙ্গে আলোচনা করে ভারতীয় ছবি প্রদর্শন হচ্ছে আমি জানি না। বিদেশি ছবি প্রদর্শনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দেশে নেই।
২০১০ সালে ভারতীয় ছবি আমদানি, প্রদর্শনের অনুমতি চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে গোপনে আবেদন করে ঢাকার সিনেমা হল মালিকদের সংগঠন ‘মেট্রোপলিটন এক্সিবিউটর এসোসিয়েশন’। সরকারের সমর্থন পেতে ভারতীয় এক মন্ত্রীকে দিয়ে তদবির করানো হয় বলে তখন অভিযোগ ওঠে। সরকার বাধ্য হয়ে আমদানি নীতিমালা পরিবর্তন করে তখন। নতুন নীতিমালার চলচ্চিত্র আমদানি করার এসআরও জারি হয়। এর বিরুদ্ধে এদশের শিল্পী, কলাকুশলীরা আবেদন করেন। এক পর্যায়ে সরকার এসআরও পরিবর্তন করে আমদানির বিধান বাতিল করে। এসআরও জারি, এটি বাতিল করায় মধ্যবর্তী সময়ে সিনেমা হলের কয়েক মালিক এলসি করে ভারতীয় বারটি সিনেমা আনার প্রক্রিয়া শুরু করেন। এর মধ্যে তিনটি সিনেমা (সংগ্রাম, বদলা, জোর) তারা এদেশে আনেন। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সেন্সর বোর্ড থেকে অনাপত্তি না পাওয়ায় এই তিনটি সিনেমা দেশে ঢোকানোর অনুমতি দেয়নি। বিষয়টি উচ্চ আদালতে গড়ায়। আদালত এসআরও বাতিলের আগে আনা সিনেমা তিনটিকে অনাপত্তি দিতে নির্দেশ দেয়। এর বিরুদ্ধে আদালতে আপিল করেনি তথ্য মন্ত্রণালয় বা চলচ্চিত্র সমিতির কেউ। পরে তথ্য মন্ত্রণালয় ও চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শনের  অনুমোদন অনাপত্তিপত্র দেয়।
চলচ্চিত্র একতা পরিষদ আদালতের নির্দেশনার কারণে ভারতীয় ছবি প্রতিরোধে আন্দোলনের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে। পরিষদের আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করার কথা ছিল ১৯ ডিসেম্বর ২০১০। চলচ্চিত্র ঐক্য পরিষদ ২৩ ডিসেম্বর থেকে আন্দোলনের ডাক দেয়। ভারতীয় ছবি মুক্তির দিন থেকে তারা এফডিসিতে সব ধরনের শুটিং, ডাবিং বন্ধ, যেসব সিনেমা হলে ‘জোর’ প্রদর্শন হবে, সেসব হলে পরবর্তী সময়ে দেশী ছবি সরবরাহ না করার হুমকি দেয়। এর প্রেক্ষিতে প্রদর্শকরা উচ্চ আদালতে রিট করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১১ আদালত ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আন্দোলন না করতে নির্দেশ দেয়। আদালত তথ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইজিপি, পুলিশ কমিশনার ও এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের উদ্দেশ্যে এ বিষয়ে নোটিশ জারি করে। এতে বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মনীতি মেনেই আমদানিকারকরা ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ আইনসম্মত নয়। একতা পরিষদের আহ্বায়ক মাসুদ পারভেজ জানান, ‘আদালতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করেছি।’
এদেশে এক সময় ভারতীয় ছবি প্রদর্শিত হতো। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় থেকে এর আমদানি, প্রদর্শন বন্ধ হয়। ১৯৭২ সালে আমদানির আবার দাবি উঠলেও সেই সময়ের সরকার তা করেনি। এরপর বিভিন্ন সরকারের সময় দাবি উঠলেও কোনো সরকারই আমদানির পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়নি। কোনোভাবেই যেন ভারতীয় ছবি এদেশের হলে প্রদর্শন না হয়, সেদিকে অতীতের সব সরকার সচেষ্ট ছিলÑযা মহাজোট সরকারের নেই। অভিনেতা, পরিচালক নায়ক রাজ রাজ্জাক বলেন, ‘দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সরকার চলচ্চিত্রকে উন্নত করার বদলে শিল্পটিকে ধ্বংস করার কর্মকা-ে সহযোগিতা করছে।’ (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১১)
বাংলাদেশের জাজ মাল্টিমিডিয়া ইতোমধ্যে দেশের ৫০টি সিনেমা হলকে ডিজিটাল করেছে বলে দাবি করেছে। ঘোষণাও দিয়েছে ২০০ সিনেমা হলকে ডিজিটাল করার। কিন্তু এরই মধ্যে কলকাতার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যানার ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের নাম জাজের সাথে জড়িয়েছে। ভেঙ্কটেশের সাথে মিলে জাজ মিডিয়া বাংলাদেশকে ভারতীয় ছবির বাজার বানাতে চায় কিনা এমন প্রশ্নও উঠেছে।
১৮ মার্চ ২০১৩ দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত বিজ্ঞাপন ও চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর ‘মাননীয় তথ্যমন্ত্রী, যদি সত্যিই দিন বদল চান’ শিরোনামে একটি লেখায় প্রকাশ, ‘বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর মধ্যস্থতায় এ দেশের একজন ব্যবসায়ী ও ভারতের শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের মধ্যে বাংলাদেশে ২০০ ডিজিটাল প্রজেকশনওয়ালা সিনেমা হল নির্মাণের চুক্তি হয়েছে।’
ওই লেখাতে ফারুকী অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের পরিষ্কারভাবে জানতে হবে, এ ২০০ সিনেমা হল নির্মাণের সরকারের ভূমিকা কী? সরকার কি তাদের জায়গা লিজ দেবে? কোনো রকম অর্থনৈতিক সুবিধা দেবে? ছবি প্রদর্শনের ব্যাপারে কোনো শর্ত থাকবে? থাকলে কী কী শর্ত? এগুলো খোলাসা হওয়া দরকার। একটা কথা পরিষ্কার করে বলতে চাই, এসব হল নির্মাণে সরকার কোনো সুবিধা দিক বা না দিক, সরকারকে একটা বিষয় নিশ্চিত করতে হবে, যেন ইন্ডাস্ট্রিতে কোনো ধরনের মনোপলির জন্ম না হয়।’ তিনি বলেন, ‘২০০ সিনেমা হলে কোন এক ভারতীয় ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে থাকলে এর সাংস্কৃতিক পরিণাম খুবই ভয়াবহ হতে পারে।’
ফারুকী তার লেখায় আরো বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের বহু সিনেমা হল যে দু’তিন জন ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে, শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস তাঁর অন্যতম। ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের অনেক ভালো অবদান আছে। আবার ইন্ডাস্ট্রির ওপর এই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে তারা কিছু খারাপ ভূমিকাও রাখছে। এসব ব্যবসায়ীর প্রভাব ও নির্দেশনায় কলকাতার বেশিরভাগ ছবিই এখন তামিল ছবির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কপি।’
জাজ মাল্টিমিডিয়ার সিইও শীষ মনোয়ারের বক্তব্য হচ্ছে, ‘এখানে ব্যবসায় তো সবার জন্য উন্মুক্ত’। আমি করলে যদি সেটি মনোপলি হওয়ার সুযোগ থাকে, তাহলে অন্যরা এসে করুক। তা হলে তো আমার এক হাতে ব্যবসায় থাকবে না।’ ফারুকীর লেখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সব কিছু না জেনে কথা বলা ঠিক নয়। কী চুক্তি হয়েছে, তার কী শর্ত রয়েছে সেসব ফারুকীর জানতে হবে। যারা এসবের বিরোধিতা করছেন, তাদেরও চুক্তির বিস্তারিত জানা উচিত।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা প্রেক্ষাগৃহ ডিজিটালের কাজটি একাই করছি। শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের সাথে যৌথভাবে চলচ্চিত্র বানানোর একটা প্রাথমিক চুক্তি করেছি।’ (সূত্রঃ দৈনিক নয়া দিগন্ত ২১ মার্চ ২০১৩)
প্রথম থেকেই আন্দোলন যাতে জোরালো না হয় সে জন্য টেস্ট কেস হিসেবে ভারতীয় ছবিগুলো প্রদর্শন করা হয়। সম্প্রতি সিনেমা হল মালিকরা আবার ভারতীয় ছবি প্রদর্শনে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছেন। বিশেষ করে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু কলকাতা ঘুরে এসে দুই বাংলার চলচ্চিত্র প্রদর্শনে সিনেমার অবাধ বাণিজ্যের কথা বললে সিনেমা হল মালিকরা নড়েচড়ে বসেন।
অভিনেতা রাজ্জাক বলেছেন, সিনেমা হল বাঁচানোর কথা বলে একদল লোক ভারতীয় ছবি নিয়ে আসছে। নিজেরা দেশের শিল্পকে দাঁড় করিয়েছি। অথচ আজকে ভারতীয় ছবি নিয়ে এসে আমাদের শিল্পটাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। আমাদের ছবি দিয়েই দেশে এক হাজার ২০০ সিনেমা হল হয়েছিল। অথচ আমাদের এখন দুর্দিন দেখে অন্য দেশের ছবি এনে তাদের সিনেমা হল বাঁচানোর কথা বলা হচ্ছে। এরপর একদল লোক নব্বইয়ের দশকে হংকং থেকে নীল ছবি এনে দেশে প্রদর্শনের সুযোগ করে দিল। আমাদের রুচিটা নষ্ট করে দিল। নারী দর্শকদের সিনেমা হল থেকে বের করে দেয়া হলো। এখন অশ্লীলতা বন্ধ হয়েছে। এখন তারা সুর তুলেছেন ভারতীয় ছবি আনতে হবে। যে কোনো রুগ্ন শিল্পকে সরকার সহযোগিতা করে। আমাদের শিল্পে অনেক সমস্যা কিন্তু সরকার কোনো প্রোটেকশন দিচ্ছে না।
অভিনেত্রী ববিতা বলেন, চলচ্চিত্র একটি দেশের সবদিক তুলে ধরে। রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি-রাষ্ট্রনীতি-সংস্কৃতিসহ সমাজের নানা অংশ দর্পনের মতো তুলে ধরাই এর কাজ। আজ আমাদের সেই দর্পনে ভাঙনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাগৃহে ভারতের ছবি প্রদর্শিত হবে এটা একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী কেন, সাধারণ মানুষ হিসেবেও মেনে নেয়া যায় না। চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নের জন্য চাই রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ, আর্থিক দায়িত্ব নেয়া, চলচ্চিত্র শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা করা। আর এসব কাজ বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে চলবে না। কারণ এ বাজার  অর্থনীতি এবং তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সংস্কৃতির কারণেই কিন্তু আজকে দেশীয় চলচ্চিত্রের এ অবস্থা। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। (সূত্রঃ দৈনিক দিনকাল ৮ এপ্রিল ২০১৩)
আগে আমাদের চ্যানেলগুলো ভারতে প্রচারিত হোক, আমাদের শিল্পীদের ওরা চিনুক, জানুক তারপর সমান সংখ্যক ছবি বিনিময়ের মাধ্যমে ভারতীয় ছবি প্রদর্শিত হবে। কেউ কি একবার খোঁজ করে দেখেছেন যে, কলকাতার রুগ্ন চলচ্চিত্রশিল্পে কীভাবে আবার ভালো জায়গায় চলে গেল? যখনই মুম্বাইয়ের ছবি মানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গেলেন তারা, মুম্বাইয়ের প্রযোজকেরাও কলকাতায় ছবি বানালেন। ওদের সিনেমা হলগুলোর পরিবেশও ভালো হয়ে গেল। এখন বাংলা ছবি সেখানে মুম্বাইয়ের ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে।
এ দেশে ভারতীয় ছবি প্রদর্শিত হলে আমাদের ছবির মানও ভালো হবে। এখানে প্রতিযোগিতা হবে এবং তখন থেকে উন্নত মানের বাংলা ছবি উপহার পাব আমরা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads