ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী :
আমরা তো ভেবেছিলাম কোনো না কোনো কাঠামোর ভেতরে সরকার গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। কারণ গণতন্ত্র ছাড়া সরকারও এক গহীন গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। যখন ক্ষমতা থাকে, হাতে পুলিশ বাহিনী থাকে, অর্থ-বিত্ত দিয়ে সন্ত্রাসী লালন করা যায়, তখন স্বৈরশাসনপ্রবণ সরকারগুলো ক্ষমতার মদমত্ততায় একেবারে অন্ধ হয়ে ওঠে। দিগি¦দিক ও হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের ভেতরে এই প্রবণতা ও সংক্রমণ অনেক বেশি। শেখ হাসিনার সরকার অন্ধ, সুতরাং সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখছে তারা। গণতন্ত্রের কফিনে, বলতে গেলে, শেষ পেরেকটি ঠুকে ফেলেছে শেখ হাসিনা সরকার।
তার কাছে বিরোধী দল এক অসহ্য ব্যাপার। তিনি যা উচ্চারণ করবেন, গোটা দেশ একযোগে তাকে তথাস্তু তথাস্তু বলে স্বাগত জানাবে। কিন্তু গণতন্ত্রে কি তাই হয়? সেখানে সবসময় ভিন্নমত থাকে। আজ শেখ হাসিনার কচিকাঁচা সরকারে ভিন্ন মতের কোনো অবকাশ নেই। যেই ভিন্নমত প্রকাশ করবে, সেই সরকারের শত্রু। অতএব মারি অরি পারি যে কৌশলে। সে পথেই অগ্রসর হয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি এখনও সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেননি। আমাদেরকে জানান দেননি যে, আর সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। কিন্তু সেই আত্মহনন পথে তিনি পা বাড়িয়েছেন।
শেখ মুজিবের এক দলীয় বাকশাল সফল হয়নি। তাতে কি। শেখ হাসিনা একই পথে হেঁটে তাকে সফল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বিরোধী জামায়াত চাই না। বিএনপি চাই না। শেখ হাসিনার দীর্ঘকালের সহযোগী এরশাদ তো বান্দরের খেলা খেলেই যাচ্ছেন। আজ শেখ হাসিনাকে বলেন, সরকারের বিপদের দিনে তিনি কখনও তাদের ছেড়ে যাবেন না। কাল হেফাজতের আন্দোলনে অকুণ্ঠ সমর্থন ঘোষণা করেন। পানি আর খাবার নিয়ে তাদের পাশে থাকেন। এর আগে বিদেশ থেকে ফিরে তিনি বিমান বন্দর থেকে সরাসরি শাহবাগি চত্বরে সংহতি জানাতে হাজির হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রবীণ রাজনীতিবিদ তার দলের অন্যতম সিনিয়র নেতা কাজী জাফর আহমদের পরামর্শে শেষ পর্যন্ত নিবৃত্ত হয়েছিলেন। আর যেহেতু তিনি শাহবাগে যাননি, ফলে তিনি আশা করেছেন যে, শাপলা চত্বরের মিছিলে তাকে দু’হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানানো হবে।
এরশাদ ভেবেছেন তিনি দারুণ খেলোয়াড়। ভালই খেলেছেন। হেফাজতের কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন। আর শাহবাগিরাও নিশ্চয়ই তাকে ভুল বুঝবে না। কারণ তারাও সরকারের হাতের ক্রীড়নক। আর তিনি নিজেও তাই। কিন্তু এইসব ফেল্। চূড়ান্ত বিচারে এসব যে কোনোই কাজে দেবে না, এরশাদ নিজেও তা জানেন। তারপরেও শেখ হাসিনা সরকারের খেলারাম হিসেবে তিনি খেলে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার অতি আপনজন হু মু এরশাদ কোনো বিরোধী দল নয়। এখনও সরকারের এক অংশীদার। তার দলের এক নেতা সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য এখনও আছেন। ফলে তার যতসব চালবাজি, তার কোনোটাই শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকবে বলে মনে হয় না।
অতএব শেখ হাসিনার সামনে জামায়াত, বিএনপি ছাড়া আর কোনো শত্রু নেই। জামায়াত ধ্বংসের প্রক্রিয়া তিনি শুরু করেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নামক এক প্রহসনের মাধ্যমে। এমন আজব প্রহসন পৃথিবীর ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রহসনে এখন যাদের আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে তারা সবাই জামায়াত ও বিএনপির সদস্য। এর বাইরে একজনকেও কাঠগড়ায় হাজির করা হয়নি। তার অর্থ হলো এই যে, জামায়াত-বিএনপিই যুদ্ধাপরাধী। আওয়ামী লীগ যারা করে তাদের কেউ যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত নেই। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে রাজাকার আলবদর ছিলেন। আওয়ামী লীগের সংজ্ঞা অনুযায়ী তাদেরও যুদ্ধাপরাধী হওয়ার কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগ এমন এক নিকৃষ্ট বৈপরীত্যের সরকার যে, তারা ঐসব আওয়ামী যুদ্ধাপরাধীর নামে মনুমেন্ট গড়ে তুলেছে, সড়ক নির্মাণ করেছে। এমন দৃশ্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কমই ঘটেছে।
প্রাথমিকভাবে সরকার স্থির করেছিল যে, জামায়াতকে ধ্বংস করতে হবে। কারণ জামায়াত সুসংগঠিত ক্যাডারভিত্তিক রাজনৈতিক দল। ফলে জামায়াতের অর্ধ ডজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছে। আর যা করেছে তা হলো, এই অভিযোগের প্রতিবাদকারী কিংবা সম্ভাব্য প্রতিবাদকারী জামায়াত নেতাদের গ্রেফতার করে কারাগারে পুরেছে। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেইনি এমন হাজার হাজার শিবির কর্মীকে রাজাকার বলে গ্রেফতার করে জেলে ঢুকিয়েছে। এখনও প্রতিদিন পুলিশ আর ছাত্রলীগের সশস্ত্র গু-ারা তথাকথিত ‘শিবিরের মেসে’ হানা দিয়ে ডজন ডজন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করছে। আর ধরে নিচ্ছে জামায়াতও শেষ। শিবিরও শেষ। এবার বিএনপির শেষ হবার পালা। সেটা চূড়ান্ত করার জন্য আওয়ামী নেতারা কোরাসের মতো বলছে যে, জামায়াতকে ছেড়ে আসুন, তা হলে আলোচনা হবে। অর্থাৎ তাহলে জামায়াতকে শেষ করে দেয়া সহজ হবে। এর পর শুরু হবে বিএনপির পালা।
সে পথে সরকার অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে। জামায়াত নেতাদের গ্রেফতার ছিল পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ। দেখি, শালা বিএনপি কা করে? বিএনপির নিচের দিকের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে সরকার গ্রেফতার করেছে। তাদের খবর কেউ রেখেছে বলে মনে হয় না। তারপর আস্তে আস্তে বিএনপির মিছিল করার ক্ষমতা পর্যন্ত কমে এসেছে। এ এক দারুণ খেলা! এরপর সরকার বিএনপির মাঝারি স্তরের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পুরেছে। লক্ষ্য করার চেষ্টা করেছে যে, বিএনপির কী প্রতিক্রিয়া হয়? প্রতিক্রিয়া তেমন কোনো জোরদার ছিল না। এরপর বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দিকে হাত বাড়ায়। বিএনপির একশ’ ৪৮ জন শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীকে যখন গ্রেফতার করা হয়, তখনও আইন মান্যকারী দল হিসেবে বিএনপি টুকটাক বক্তব্য দিয়ে যেতে থাকে। এখন বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া বিএনপির সকল শীর্ষস্থানীয় নেতা কারাগারে। কোথায়ও কুটোটিও নড়েনি।
বিএনপি হয়তো ভেবেছে তারা বিশ্বের কাছে প্রমাণ করে দিল যে, সরকারের এত নির্যাতন সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই তারা প্রতিবাদ করতে চেয়েছে। তার অংশ হিসেবেই তারা জ্বালাও পোড়াও-এর নীতি গ্রহণ করেনি। বরং তাদের সকল নেতাকর্মী কারাবরণ করেছে। তাহলে আন্দোলন কে করবে? দেশে এই যে হিটলারী স্বৈরাচার জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে, তাকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করবে কে? এখন বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কেউ গ্রেফতার হতে বাকি নেই। জোর গুজব আছে যে, বেগম খালেদা জিয়ার গ্রেফতার এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ, প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, সরকার যত অত্যাচার নির্যাতনই করুক না কেন বিএনপির তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই। অতএব শেখ হাসিনা নিঃরাজনীতিকরণ ও নিঃবিরোধিতার উদ্যোগ সফল হতে যাচ্ছে।
এই সরল হিসাব কষে সরকার তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। ইসলাম যে এ দেশের রাজনীতিতে একটা বড় ফ্যাক্টর সেটা অস্বীকার করতে চাইছে সরকার। সে অস্বীকৃতি তাদের জন্য আখেরে যে কোনো সুফল বয়ে আনবে না, সেটাও উপলব্ধি করার ক্ষমতা সরকারের নেই। সে শিক্ষাও সরকারের ভেতরে কারও নেই। যখন সহজ স্বাভাবিক পথে প্রতিবাদের সকল রাস্তা রুদ্ধ হয়ে যায়, তখন প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মেই মানুষ প্রতিবাদের পথ খুঁজে নেয়, যেভাবে জলধারা ঠিক ঠিক বের করে ফেলে আপন গতিপথ। তাকে কেউ আটকাতে পারে না।
প্রকাশ্য রাজনীতির পথ যখন বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন রাজনীতি আরও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। এখন যেমন দেখে দেখে জামায়াত-বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে জেলে পুরে নির্যাতন করা সম্ভব হচ্ছে, তখন আর তা সম্ভব হয় না। বোঝা যায় না, কে কোন মতলব নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। একে দমনও করা যায় না। দমন করতে হলে গোটা দেশের জনগণকে একেবারে কচুকাটা করে কবরের শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো স্বৈরশাসক যে তেমন চেষ্টা করেনি, এমন নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারাই নিঃশেষ হয়ে গেছে। গোটা জনপদের মানুষকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হয়নি।
রাজনৈতিক দল এই সরকারের শত্রু। জনগণ এই সরকারের শত্রু। এর সর্বশেষ শত্রু তাদের ইসলাম। একথা আমরা বারবার বলেছি যে, এদেশের মানুষ মুসলমান বলেই বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুদ্ধ করেছে। অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। তাদের সে পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টা কখনও সফল হবে না। সরকার এখন সে পরিচয় মুছে ফেলার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। কিন্তু নিভৃতে ইসলাম চর্চাকারী লাখ লাখ মানুষ গত ৬ এপ্রিল ঢাকায় সমবেত হয়ে জানান দিয়ে গেছে যে, এদেশে ইসলাম আছে, ইসলাম থাকবে। কিন্তু সে মহাসমাবেশ থেকে সরকার কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেননি। বরং হেফাজতে ইসলামের হরতাল কর্মসূচি বানচাল করার জন্য অস্ত্র দিয়ে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের মাঠে নামিয়ে দিয়েছে : যারা ইসলামের কথা বলে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দাও। চট্টগ্রামে গত সোমবার আমরা তার মহড়া দেখলাম। আওয়ামী ঘাতকেরা ঈমান আকিদা রক্ষার আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সরকারের এ যুদ্ধ এখন এদেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে সে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে, এ যুদ্ধে নিশ্চয়ই জনগণেরই বিজয় হবে, ইনশাআল্লাহ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন