আহাজারি, ক্ষোভ, হতাশা আর লাশের গন্ধ এখন সাভারে। একের পর এক লাশ নামানো হচ্ছে সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে। মানুষের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে সাভারের বাতাস। অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে চলছে স্বজনের লাশ খুঁজে ফেরার করুণ দৃশ্য। সাভারের এই ভবনধস নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়, রীতিমতো হত্যাকাণ্ড। কারা এই শত শত মানুষের হত্যার সাথে জড়িত? ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণের সাথে জড়িত এই ভবনের মালিক যুবলীগ নেতা সোহেল রানা এবং ভবনে থাকা চারটি পোশাক কারখানার মালিক। ভবনটির ফাটল আগের দিনেই দেখা গিয়েছিল। এ খবর নয়া দিগন্তে আগের দিনে ছাপাও হয়েছিল। দুর্ঘটনার দিন শ্রমিকেরা কাজে যোগ দিতে রাজি ছিলেন না। তাদের পিটিয়ে জোর করে ভবনে ঢুকতে বাধ্য করা হয়েছিল। এমনও বলা হয়েছিল, ওই দিন যারা কাজে যোগ দেবে না, তারা বেতন পাবে না। বেতন পেতে হলে কাজে যোগ দিতে হবে। যুবলীগ নেতা সোহেল রানা নিজেও এ ভবনের মধ্যে ছিলেন। তিনি হরতালবিরোধী সমাবেশের জন্য অনেককে এই ভবনে জড়ো করেছিলেন। তারাও হতাহতের শিকার হয়েছেন।
ভবনধসের নামে এই হত্যাকাণ্ডের সাথে কারা কিভাবে জড়িত তা বোঝা কোনো কঠিন ব্যাপার না হলেও আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যথারীতি এই হত্যাকাণ্ডের সাথে বিরোধী দলের জড়িত থাকার বিষয়টি আবিষ্কার করতে সফল হয়েছেন। দেশের মানুষ যখন ভবনের ভেতরে আটকে পড়া মানুষের জন্য বেদনা অনুভব করছেন, তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মাথায় কাজ করছে কিভাবে এ ঘটনার সাথে বিরোধী দলকে জড়িয়ে তাদের ফাঁসানো যায়। তিনি বুধবার রাতে বিবিসি বাংলার সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দুর্ঘটনার আগে কিছু মৌলবাদী ও বিএনপির ভাড়াটে লোক সাভারের ভবনটির গেট ও বিভিন্ন স্তম্ভ ধরে ‘নাড়াচাড়া’ করেছিল। তার মতে, ভবনটি ধসে পড়ার পেছনে এটিকেও ‘একটি কারণ’ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
এ সময় তিনি বিরোধী দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদেরও এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দৃশ্যত যে নির্দেশনা অনুযায়ী ভবনটি নির্মাণ করা উচিত ছিল, সে নির্দেশনা অনুসরণ করে ভবনটি নির্মাণ করা হয়নি। ভবন ধসের জন্য স্থানীয় বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের দায়ী করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এখানকার (সাভারের) মৌলবাদী… বিএনপি… এদের (শ্রমিকদের) হরতালের জন্য আহ্বান জানাচ্ছিল। আমাকে বলা হয়েছে, হরতাল-সমর্থক কিছু ভাড়াটে লোক সেখানে গিয়ে ওই যে ভাঙা দালান ছিল বা ফাটল ধরা দালান ছিল, সেই দালানের বিভিন্ন স্তম্ভ নিয়ে নাড়াচাড়া করে এবং যে গেট বা দরজা ছিল, সেটা নিয়েও নাড়াচাড়া করে। এটাও এ ধরনের একটি দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।’
ভবন ধরে নাড়াচাড়া করার কারণেই ভবনটি ধসে পড়েছে কি না, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, ‘কিছু অংশ হতে পারে। ভবন সম্পর্কে মনে রাখা দরকার, যখন একটি ভবন ধসে পড়া শুরু হয়, তখন তার একটি অংশ বা খানিকটা অংশ ধসে পড়লে বাকি অংশের ওপরও এর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সে ধরনের প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হতে পারে।’
ভবনে ফাটল দেখা যাওয়ার পরও পরের দিন কিভাবে সেখানে শ্রমিকদের কাজে পাঠানো হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের মনে রাখতে হবে, এটা পুলিশি রাষ্ট্র নয়। আমরা সবকিছু পুলিশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমরা বলেছি, ভবনটি বিপজ্জনক। স্থানীয় কর্তৃপও বলেছে। তথাপি কিছু লোক সেখানে গেছেন। আমাকে বলা হয়েছে, এরা নিজের সম্পত্তি বা জিনিসপত্র উদ্ধার করতে গেছেন।’
ভবনের মালিক মতাসীন দলের সাথে যুক্ত আছেন বলে এ ঘটনার কোনো বিচার হবে নাÑ এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কাউকেই রেহাই দেয়া হবে না। অপরাধী অপরাধী হিসেবেই বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশ নামে এই রাষ্ট্রটি কী ধরনের লোক দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে, তার নমুনা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে পাওয়া যাচ্ছে। তিনি অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে দেখছেন, কিন্তু এই অপরাধী হতে হবে অবশ্যই বিরোধী দলের কোনো সদস্য। কারণ, এই মন্ত্রীর মাথায় কোনো দিনই ঢুকবে না ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা আওয়ামী লীগের কেউ কোনো অপরাধ করতে পারে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী কমলাপুরে ডেমু রেলের উদ্বোধনের সময় বলেছেন, আমরা আগেই ভবন ফাটলের খবর জানতে পেরেছিলাম। ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছিল। কিছু লোক মূল্যবান জিনিসপত্র আনতে গিয়ে আটকে পড়েছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে হয় তিনি অন্তত এ কথা বলেননি যে, পাকিস্তান থেকে আমদানি করা ককটেলের আঘাতে ভবনটি ধসে পড়েছে। সাভারের সোহেল রানাকে অচিরেই হয়তো আওয়ামী বীর হিসেবে সংবর্ধনা দেয়া হবে। সেই সংবর্ধনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে। যেমন বিরোধী দলের নেতাদের পেটানোর জন্য তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করেছেন। এই ভবন ধসের জন্য স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের আসামি করে মামলা দায়ের করা হবে। হেফাজতে ইসলামের যেসব নেতাকর্মী বা মাদরাসা ছাত্র রক্ত দিতে গিয়েছে তাদের তালিকা করে জঙ্গি হিসেবে এ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত করে আসামি করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অদ্ভুত এক উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন