ব্যক্তিগতভাবে অদৃষ্টবাদী কিংবা নিয়তিবাদী নই। তবে ভাগ্যের ভালো-মন্দের ওপর বিধাতার নিয়ন্ত্রণ ষোলআনা কবুল মানি। আজাব-গজব বিশ্বাস না করার কোনো কারণ নেই। তবে এটা মানুষের পদস্খলিত জীবনের অর্জন। দুর্বিনীত শাসক যেমন আপদ, তেমনি নির্লিপ্ত জনগণও বিপদ। জালেম অধ্যুষিত জনপদে অসহায় মজলুম নিপীড়িত হবে, শোষিত হবে, অত্যাচারিত হবে, জুলুমের শিকার হবেÑ এটা মেনে নিয়ে অগ্রসর হওয়াই ভালো। তবে অদৃষ্টবাদী সেজে মুখ বুজে বসে থাকা কোনো বিশ্বাসী মানুষের কাজ নয়। চোখ কান খোলা রেখে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে পথ চলাই সময়ের দাবি। তাছাড়া অজ্ঞতাই অভিশাপ। এ অভিশাপের আগুনে নিজে পুড়ে মরলে কোনো কথা ছিল না। লাখো মানুষকে যখন পুড়ে মারে কিংবা বিভ্রান্তির ঘোরে ফেলে দেয়, তখন সমূহ ক্ষতি হয়ে যায়। এ ক্ষতি থেকে বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে। এ বিদ্বেষ মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো ধ্বংস করে দেয়। তখনই চার দিকে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে ওঠে, যা আজ সর্বত্র প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।
তার পরও আমাদের সমাজে সবজান্তা ভাব দেখানোর লোকই বেশি। আবার অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করীদের দৌরাত্ম্যও সর্বত্র। কুরআন-কিতাবকে সেকেলে ভাবেন এমন জ্ঞানপাপীরাও আজকাল প্রায় দেখা যায়, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য দু’ছত্র কুরআনের অনুবাদ পড়ে শোনাচ্ছেন। কুরআন যেন চড়–ইভাতির খেলার উপাত্ত। পূর্বাপর সঙ্গতি নেই, বলে দিলো সুবিধামতো একটা দুইটা লাইন। ওরা নিজেদের ছাড়া সবাইকে ভাবে বোকার হদ্দ। এমন জ্ঞানপাপীরাই প্রজ্ঞাবান আলেমদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে।
একজন জাঁদরেল ও হাইব্রিড নেতা হেফাজতে ইসলামকে নিন্দাবাদ দেয়ার আর কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে বলে দিলেন, ১৩ দফা মধ্যযুগীয় বিষয়। নিশ্চিত করে বলতে পারি, ভদ্রলোক রাজনীতিবিদ বটে তবে ইতিহাসজ্ঞানে গণ্ডমূর্খ। যুগের ভাগ-বিভাজনই তিনি জানেন না। ইসলামের মধ্যযুগ সোনালী যুগ। ইউরোপের মধ্যযুগ অন্ধকারময়। যদিও রোমানরা তখনও একটা সভ্যতা ধরে রাখার চেষ্টা করছিল। গ্রিস পুরনো সভ্যতা ধরে রাখতে পারছিল না। আফ্রিকাও অন্ধকারে ডুবেছিল। চীন মধ্যযুগেও অপাঙক্তেয় ছিল না। বিশ্বাসের ভ্রান্তি বাদ দিলে পারস্যও ছিল সমৃদ্ধ। মধ্যযুগের যে সংজ্ঞায়ন, এটাও ইউরোপীয় ইতিহাসবিদদের। শিল্প বিপ্লব ও রেনেসাঁর পথ ধরে পনেরো শতকের পর আধুনিকতার পথে এগিয়েছে। ইতিহাসের প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক ও উত্তর আধুনিক যুগের ধারণা ভারতীয়, আরবীয়, চৈনিক ও গ্রিক-রোমান ধারণায় একেবারে অনুপস্থিত। কারণ ইউরোপীয় সংজ্ঞা মতো মধ্যযুগ ধরা হয় পাঁচশত বছর থেকে পনেরো শ’ শতক পর্যন্ত। এটা ঠিক পোপ-পাদ্রি ও যাজকেরা ইউরোপের মধ্যযুগে বিজ্ঞানচর্চায় অসহিষ্ণুতা দেখিয়েছে। বৃদ্ধাকে ডাইনি সাজিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে। ধর্মের নামে অনাচার করেছে। অপর দিকে অন্ধকার যুগ বা আইয়ামে জাহিলিয়াতের ওপর হেরার জ্যোতি ছড়িয়ে ইসলাম বিশ্বকে নতুন সভ্যতা উপহার দিয়েছে। ইসলামের যা বুৎপত্তি, অর্জন কথিত মধ্যযুগেই হয়েছে। কারণ মহানবী সা:, সাহাবা, চার খলিফা, ওমাইয়া, আব্বাসীয় শাসনের কোনো জুড়ি নেই। এ সময় অর্ধজাহানজুড়ে মুসলিম সভ্যতা পৃথিবীকে সবক দিয়েছে। সভ্যতা বিলিয়েছে। এ সময় বাংলাদেশে ইসলাম এসেছে। স্পেনে গেছে। ভারতজুড়ে তো বটেই, বলকান-ককেসাস অঞ্চলেও ইসলামি সভ্যতার হাতছানি পড়েছে। মক্কা-মদিনার আলোছটা বাগদাদ-দামেস্ক-স্পেন-কর্ডোভাকে রাঙিয়ে তুলেছে। ইউরোপ যখন অন্ধকারে, আস্তাবলে ঘোড়াÑমানুষ যখন একসাথে বাস করছিল, তখন মক্কা-মদিনা নগর রাষ্ট্র, আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন প্রক্রিয়াও তারা রপ্ত করে নিয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখায় তখন মুসলিম বিজ্ঞানী, জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ, অঙ্কবিশারদ, চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দোর্দণ্ড প্রতাপ। সমুদ্র বিজ্ঞান থেকে শুরু করে মহাকাশ পর্ব তখন মুসলিম বিজ্ঞানীদের নখদর্পণে। যে জ্ঞান বিজ্ঞান মুসলিমদের হারানো সম্পদ, তা ছিল মধ্যযুগের অর্জন।
ভারতীয়রা কেমন ছিল তা জানার জন্য আল বিরুনীর ‘ভারত তত্ত্ব’ পড়ে নেয়াই যথেষ্ট। হিন্দুরা মুসলমানদের মতোই ইউরোপীয় ধারণায় ইতিহাস ব্যাখ্যা করে না। তারা সত্য, ত্রেতা, দাপর, কলি ও ঘোরকলিÑ এভাবেই বৈদিক যুগ থেকে যুগ ভাগ করে বুঝে আসছে। তাছাড়া ইসলামের বাস্তবতা মেনেই ইতিহাসচর্চা করেছেন ইশ্বরী প্রসাদ, রমেশচন্দ্র মজুমদার, নেহরু প্রমুখ। পিকে হিট্টি, উইলিয়াম মুইরকেও এ ইস্যুতে সাক্ষী মানা যায়।
আজ প্রধানমন্ত্রীর সারিন্দা মধ্যযুগের নিন্দাবাদ গাইছেন। অপর দিকে খোদ প্রধানমন্ত্রী মদিনা সনদের মাহাত্ম্য প্রচার করছেন। অনেকেই আজ হোদায়বিয়ার সন্ধি, মদিনা সনদ, মক্কা ডিকলারেশন ও বিদায় হজের বাণীর কথা বলেন। তারা এসব বলেন, নিজেদের ধর্মপ্রীতি থেকে নয়, ধর্মভীতি ও বিদ্বেষ থেকে। তারপরও সাধুবাদ যে অজ্ঞতা অভিশাপ হলেও মাঝে মধ্যে অজ্ঞতা থেকে অকপট সত্য বেরিয়ে আসে। শয়তানও বিধাতার ইচ্ছায় কিছু ভালো কাজের জোগান দিতে পারে। ইসলামকে ইউরোপের মধ্যযুগীয় বর্বরতার সাথে তুলনা না করলে নতুন প্রজন্মের সামনে সঠিক তথ্য তুলে ধরা সম্ভব হতো না। এ ব্যাপারে তাদেরও অনুসন্ধিৎসু মন সত্য জানার জন্য প্রস্তুত হতো না। প্রধানমন্ত্রী আবেগের আতিশয্যে মদিনা সনদের প্রশ্ন না তুললে এ যুগে মদিনা সনদ এতটা পঠিত হতো না। যদিও বিশ্বের কোনো সন্ধি, চুক্তি, দলিল, যুদ্ধনীতি, শ্রমনীতি-সংবিধান রচনায় মদিনা-সনদ, হোদায়বিয়ার সন্ধি, মক্কা ডিকলারেশন ও বিদায় হজের বাণীকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয়, মানবাধিকার, আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার, মানুষের মানবিক মর্যাদা ও নৈতিক ভিত্তি রচনার ক্ষেত্রেও। তাছাড়া সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখার জন্য এবং আন্তঃধর্ম সম্পর্ক রক্ষা করার তাগিদেও ইসলামের শিক্ষার বাইরে পাওয়া সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীরা ভালোভাবেই জানেন, কুরআনকে এড়িয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা হবে খণ্ডিত। পাক-পবিত্র হওয়া, হালাল-হারাম বিবেচনা ও নৈতিক শিক্ষার উৎস সন্ধানে ইসলামকে বাহ্যিকভাবে এড়ানো সম্ভব, অস্বীকার করা সম্ভব নয়। আধুনিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের উৎস ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। বাড়াবাড়ি করে ইসলামকে টার্গেট বানিয়ে এতটা প্রচার প্রপাগান্ডা না হলেও জিজ্ঞাসু মনেরই জন্ম হতো না। নাইন-ইলেভেনের পর শুধু টুইন-টাওয়ার নিশ্চিহ্ন হয়নি। ইসলাম নিশ্চিহ্ন করার ইস্যু সৃষ্টি করা হয়েছে। ইসলাম-মুসলমান আক্রান্ত হয়েছে ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে। টুইন টাওয়ার ধ্বংস হলেও লাদেন চরিত্র আলোচিত হয়েছে। বহু লোককে আলোড়িত করেছে। সেই সাথে সবার অজান্তে কুরআন চর্চার হিড়িক পড়েছে পাশ্চাত্যে। ইসলাম গ্রহণের মাত্রা হাজার গুণ বেড়েছে। বিশেষত তারুণ্য ও মহিলারা সত্যের সন্ধানে উৎসুক হতে গিয়ে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছে। একটি নেতিবাচক ঘটনা-দুর্ঘটনার আড়ালে অনেক শিক্ষা লুকিয়ে থাকে। যারা জ্ঞানী, ধীমান ও অগ্রসর চিন্তার মানুষ তারা এভাবেই সঠিক পথ পেয়ে যায়।
একটা অকপট সত্যের স্বীকৃতি জরুরি। শাহবাগে কিংবা অন্যত্র ইসলামের প্রতি এতটা বিদ্বেষ না ছড়ালে হেফাজতে ইসলামীর উপস্থিতি তাৎপর্যহীন হতো। একটি প্রতিক্রিয়ার অনিবার্যতায় নতুন প্রজন্ম ইসলামকে গভীর অনুসন্ধিৎসা নিয়ে খতিয়ে দেখার দায় বোধ করল কিংবা উৎসাহিত হলো। আগেও উল্লেখ করেছি, আল্লাহ চাইলে শয়তানকে দিয়েও কাজ আদায় করে নিতে পারেন। নেতিবাচক কাজের মাধ্যমেও মিথ্যার বেসাতির বিপরীতে সত্যকে আড়াল থেকে তুলে এনে প্রতিষ্ঠিত করে দিতে পারেন। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের সবক’টি ঘটনাই যেন ঘটছে গায়েবী ইশারায়। আর গায়েবের সাহায্য চেয়েছেন আল্লামা শফী। মানুষ যা ভাবে বিধাতা ভাবেন ভিন্ন কিছু। জাতীয় কবি বলেছেনÑ আধমরাদের ঘা মেরে জাগিয়ে দিতে। মনের অজান্তেই আজ আধমরাদের জাগিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম ও সমাজনীতি বিশ্লেষণে সবাই যখন অক্ষম হয়ে পড়েছেন, তখন ব্যাখ্যাতীত কিংবা স্বব্যাখ্যাত ঘটনা-দুর্ঘটনাগুলোই ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিচ্ছে। এর নাম গায়েবি সাহায্য কি না জানি না, তবে অনেক ঘটনাই ঘটছে যা প্রচলিত নিয়মে ব্যাখ্যা করা কঠিন। এর সাথে লৌকিক নয়, অনেক অলৌকিক ধারণাই যুক্ত হচ্ছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন