পৃথিবীটা এখন ভাল নেই, ভাল নেই মানুষও। সবাই এখন সমস্যাগ্রস্ত, আতঙ্কিতও বটে। অবশ্য প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বে সমস্যা ও আতঙ্কের কারণ সবক্ষেত্রে এক রকম নয়। এমন পার্থক্য ও রকমফেরের কথা আমলে নিয়েও বলা যায়, আমাদের প্রিয় এই পৃথিবীর মানুষ ভালো নেই। সমাজবদ্ধ ও রাষ্ট্রবদ্ধ হওয়ার কারণগুলোও এখন নানাভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন। মহান ¯্রষ্টা তো নানা নেয়ামতে সমৃদ্ধ করে এ পৃথিবীকে মানববান্ধব করে সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু আমরা মানুষরাই এখন পৃথিবীর বান্ধব নই, নই মানবেরও বান্ধব। বর্তমান পৃথিবী তথা সভ্যতার এমন পরিণতির জন্য নিজ নিজ ক্ষেত্রে মানুষরাই দায়ী, তবে বিশেষভাবে দায়ী ক্ষমতাবান মানুষ ও শাসকরা। তৃতীয় বিশ্বের একজন নাগরিক হিসেবে এটা আমার কোনো ক্ষেদোক্তি নয়, পৃথিবী নিয়ে সমাজ নিয়ে যারা ভাবেন তারাও এখন বিমর্ষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো এখন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রের নাগরিকরাও এক ধরনের অহংকার নিয়েই পৃথিবীতে চলাফেরা করেন। কিন্তু সে যুক্তরাষ্ট্রেরও পতনের আভাস পাচ্ছেন পর্যবেক্ষকরা। অথচ বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র রাষ্ট্রের শাসকরা, রাজনীতিবিদরা দেশের মূল সমস্যাগুলোকে পাশ কাটিয়ে কী নির্বিকারভাবেই না হিংসা-বিদ্বেষের নেতিবাচক রাজনীতি ও ব্লেমগেমে মত্ত রয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গেলে শুধু বিস্মিত নয়, আহাম্মকও বনে যেতে হয়।
আমাদের প্রিয় এই পৃথিবী টিকে আছে ¯্রষ্টা নির্ধারিত কিছু নিয়মনীতি ও ভারসাম্যের উপর। এই পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রকেও প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে হলে নিয়ম-নীতি তথা ন্যায় ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থাকেই সমুন্নত রাখতে হয়। জুলুম, শোষণ, প্রতারণা, শঠতা ও চাতুর্যের মাধ্যমে প্রকৃত প্রগতি অর্জন সম্ভব নয়। বর্তমান সময়ের প্রধান পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেলায়ও ঐ সব কথা সত্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন পতনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় অতিক্রম করে চূড়ান্ত পতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন দিক থেকে এখন ক্ষয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিদিনই দেশটির দুর্দশার খবর আসছে। বিভিন্নভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক অবক্ষয়ের চিত্র ফুটে উঠছে। মার্কিন নাগরিকদের এবং বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের এক বিশাল অংশই আত্মঅহংকার, স্বার্থান্ধতা, অর্থ-লোলুপতা, অকৃতজ্ঞতা, প্রতারণা ও ভোগবাদের দোষে দুষ্ট হয়ে উঠেছেন। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্র পতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। কিন্তু বেশির ভাগ মার্কিন নাগরিকই ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকায় সামনের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারছেন না। তারা যেন এমন এক ‘মিথ’-এ বিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন যে, কেবল মার্কিনী বলেই সমৃদ্ধির অশেষ ধারা তাদের জন্য চিরকাল অব্যাহত থাকবে। কিন্তু এমন ভাবনা যে বাস্তবসম্মত নয় তা দেশটির অর্থনৈতিক ধসের চিত্র তুলে ধরলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। আর বস্তুবাদী ও ভোগবাদী মানুষের কাছে সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক অবক্ষয়ের চাইতে অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের চিত্রটাই বেশি বোধগম্য হবে। বিশ্লেষকরা ইতোমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতনের ৩৪টি কারণ উল্লেখ করেছেন। সবগুলি কারণ এই পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। তবে উপলব্ধির জন্য ২/১টি কারণ উল্লেখ করাই যথেষ্ট। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০১ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে মার্কিন জিডিপি বা গড় অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের অবদান ছিল শতকরা ৩১ দশমিক ৮ ভাগ। আর ২০১১ সালে এই হার নেমে এসেছে ২১ দশমিক ৬ ভাগে। ২০০৭ সালে ২০-২৯ বছর বয়সী মার্কিনীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল প্রায় ৬ দশমিক ৫। বর্তমানে এ শ্রেণীর মার্কিনীদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ১৩ শতাংশ। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে দিক থেকে একটানা ৪ বছর ধরে মার্কিন অবস্থান নীচে নামছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এ র্যাংকিং নির্ধারণ করে আসছে। মার্কিন অর্থনীতি যত বেশি শোচনীয় হচ্ছে মার্কিনীরা ততই হতাশা প্রতিরোধক ওষুধসহ চিকিৎসকদের নির্দেশিত বিভিন্ন ধরনের ওষুধ সেবন করছে। এই খাতে মার্কিনীরা ২০০৫ সালে যতটা অর্থ ব্যয় করতো, তার চেয়ে ৬০০০ কোটি ডলার বেশি খরচ করেছে ২০১০ সালে। মার্কিন জনগণের এমন দুর্দশায়ও মার্কিন ধনকুবের বা পুঁজিপতিদের স্বার্থই রক্ষিত হচ্ছে সেদেশে। দেশটির মাত্র ১ শতাংশ পুঁজিপতির হাতে আমেরিকার সিংহভাগ সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়ে রয়েছে।
বিশ্লেষকরা যখন এ অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির পতনের আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন, তখন আমাদের শাসক ও রাজনীতিবিদরা বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় টিকে থাকার বাস্তব কর্মকা- বাদ দিয়ে পরস্পর ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত রয়েছেন কোন সুখে? পতনের আশঙ্কা ব্যক্ত করা হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গর্ব করার মতো অনেক বিষয় এখনো বিরাজমান রয়েছে। দেশটিতে আইনের শাসন, বিচার ব্যবস্থা, নিয়মশৃঙ্খলা, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির যে বাতাবরণ বহাল রয়েছে, তার ধারে কাছেও আমরা নেই। তারপরেও আমাদের শাসক রাজনীতিবিদরা ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির দ্বন্দ্ব সংঘাতে দেশকে নাগরিকদের বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে। দমন-অবদমন ও রাজপথের সহিংস ঘটনার এমন অস্বাভাবিক পরিবেশে জনগণ আশাবাদী ও কর্মচঞ্চল হবে কেমন করে? এমন অবস্থায় শাসকরা আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আশাপ্রদ উদাহরণ সৃষ্টি করলে দেশ পতনের আশঙ্কা থেকে রক্ষা পেতে পারে। তেমন শুভবুদ্ধির উদয় হয় কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন