ফরহাদ মজহার
বোঝাবুঝির েেত্র চারটে বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে শেখ হাসিনা নিশ্চিত করেছেন ব্লাসফেমি আইন তিনি করছেন না। দুই. হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি সম্পর্কে তাঁর অবস্থান হচ্ছে তিনি খতিয়ে দেখবেন, ‘যুক্তিযুক্ত’ মনে হলে গ্রহণ করবেন, না হলে করবেন না। তিন. তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করছেন না। যদিও এই ধরণের একটি কথা শোনা গিয়েছিল। চার. তিনি বিরোধী দলের দাবি মানছেন না, তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে না। তার দাবি হচ্ছে নির্বাচন অনুষ্ঠান সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, সংসদে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তিনি সংবিধানে কোন ‘পরিবর্তন’ আনবেন না। এর পরেও যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে তারা আসন হারাবে।
প্রথম আলো শেখ হাসিনার সাাৎকার ঘটা করে প্রথম পাতায় ছেপেছে। আন্তর্জাতিক মহলকে এটা জানানোর দরকার ছিল যে শেখ হাসিনা ব্লাসফেমি আইন করছেন না। তা ছাড়া হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশের পর তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিশাবে দেখানো দরকার তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে সম। সেই দিক থেকে এই সাাৎকার পাঠ করা যেতে পারে।
হেফাজতে ইসলাম আদৌ ব্লাসফেমির আইন দাবি করছে কি না সেটা তর্কসাপে। তারা দাবি করে নি ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের সমালোচনা করা যাবে না। তারা সুনির্দিষ্ট ভাবে বলছে, “আল্লাহ্, রাসূল (সা:) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস করতে হবে।”
এখানে মূল ধারণা হচ্ছে, ‘অবমাননা’। আর অবমাননা বলতে তারা কতিপয় ব্লগারের কুৎসিত ও কদর্য ভাষায় রাসূল (সা:) সম্পর্কে লেখালিখি বুঝিয়েছেন। তাঁদের ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার বাইরে আল্লাহ, রাসূল (সা:) বা ইসলাম সম্পর্কে কোন আলোচনা করা যাবে না, এ কথা তারা বলছেন না। কিন্তু দাবির এই মর্মার্থ না বুঝে হেফাজতে ইসলাম ‘ব্লাসফেমি’ আইন দাবি করছে বলে দেশে-বিদেশে প্রচার করা হয়েছে। বিবিসিও সেই ভাবেই প্রশ্ন করেছে। মানবাধিকারের দিক থেকে মৃত্যুদণ্ড চাওয়া বিতর্কের ব্যাপার হতে পারে। তবে সেটা ভিন্ন বিতর্ক।
ধর্মীয় সংগঠন হিশাবে হেফাজতে ইসলামের পে এই ধরনের দাবি তোলা মোটেও অযৌক্তিক নয়। এটাও আমাদের মনে রাখা দরকার অবাধ বাক ও ভাব প্রকাশের অধিকার বলে বিমূর্ত কোন ধারণা নাই। সে কারণে বাস্তবে এই অধিকার পৃথিবীর সব দেশেই সুনির্দিষ্ট কিছু বাধানিষেধসাপেে জারি থাকে।
মানুষ সামাজিক জীব, সমাজেই তাকে বাস করতে হবে। সমাজের কোন অংশের সদস্যকে আঘাত দিয়ে ব্যক্তির পে সমাজে টিকে থাকা কঠিন। আধুনিক রাষ্ট্র বলা বাহুল্য ধর্মরাষ্ট্র নয়। তবুও এই ধরণের বাক ও ভাব প্রকাশের সংকট সামাল দেবার জন্য রাষ্ট্র তার সেকুলার জায়গা থেকেই বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের ওপর ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ’ আরোপ করে থাকে। এতে ধর্ম রাষ্ট্রের শরিয়া যে কারণে ব্লাসফেমি ধরণের আইন করে তার তুল্য আইন আধুনিক রাষ্ট্রেও থাকা সম্ভব। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই ধরণের আইন প্রণয়নের সুযোগ পুরো মাত্রায় রয়েছে। অতএব দাবি অবশ্যই হেফাজতে ইসলাম করতে পারে। শুধু তা-ই নয়, নাগরিক হিশাবে এই দাবি তোলা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। সেই অধিকার তাদের আছে। হেফাজতে ইসলাম তাদের দাবি সরল ভাবে তুলেছে, কৌশলের সঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা মাথায় রেখে তুললে তাদের সমালোচনার মুখে পড়তে হোত না।
কী যুক্তিতে রাষ্ট্র তা বাক ও ভাব প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ জারি করে বা করতে বাধ্য? বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ১. রাষ্ট্রের নিরাপত্তা একটি বড় যুক্তি। বাংলাদেশের রাষ্ট্র আজ সংকটে পড়েছে কি না সেটা শেখ হাসিনাকে বিবেচনা করে দেখতে হবে। ২. বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। রাসূলে করিমের এই অমর্যাদার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে বহু দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সেই পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশকে রা করা শেখ হাসিনার দায়িত্ব। ৩. জনশৃংখলা আরেকটি বড় কারণ। বাংলাদেশে কিছু ব্লগারের কারণে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং ইতোমধ্যে বহু মানুষ শহীদ হয়েছে এবং শহীদ হবার জন্য প্রস্তুত রয়েছে সে কারণেও শেখ হাসিনাকে সংবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বাধ্য। ৪. আদালত অবমাননা। গত বছর ব্লগে বা সোস্যাল নেটওয়ার্কে এই ধরণের লেখালিখি বন্ধ করবার জন্য কতিপয় ব্লগ ও ব্লগারকে সুনির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং অন্যদেরও খুঁজে বের করবার জন্য নির্দেশও জারি করতে হয়েছিল উচ্চ আদালতকে। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও সরকার কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করে নি। শেখ হাসিনার সরকার আদালত অবমাননার জন্যও এই েেত্র দায়ী। এরপর রয়েছে ৫. মানহানি বা হেট স্পিচ। বাকস্বাধীনতা আর ঘৃণা ছড়ানো এক জিনিস নয়। বাকস্বাধীনতার নামে সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো, তাদের নিচু করে দেখানো, তাদের প্রিয় নবীর বিরুদ্ধে কুৎসামূলক রচনা রাষ্ট্র চলতে দিতে পারে না। কারণ নবী করিমের অপমান বাংলাদেশের মানুষের বুকে শেলের মতো বিঁধেছে। শেষ যুক্তি হচ্ছে ৬. অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা। অর্থাৎ রাষ্ট্র কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এই ধরণের কুৎসাকারীদের ওপর হামলা হতে পারে। এই ধরণের লেখালিখি অপরাধে প্ররোচনা ঘটাতে পারে। সেই কারণেও বাক ও ভাব প্রকাশের ওপর “যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ আরোপের” প্রয়োজনীয়তা আছে। হয়তো ব্লগার রাজীব এই ধরণের আইনে আগেই যদি গ্রেফতার হোত তাহলে আজ তাকে নিহত হতে হোত না। তার লেখালিখি অপরাধ সংঘটনে কাউকে না কাউকে প্ররোচিত করেছে। সে হিশাবে এই হত্যার জন্য আসলে দায়ী তো সরকারই। এই বিচারে মৃত্যুদণ্ড ধরণের কঠিন আইন আছে কি নাই সেটা মুখ্য নয়। সরকার যদি রাষ্ট্র পরিচালনার েেত্র মনে মগজে ধর্ম বা ইসলামবিদ্বেষী হয়, তবে আইন থাকলেও সে এর কোন অ্যাকশন বা প্রয়োগ করবে না এটাই দেখা যাচ্ছে।
এটা পরিষ্কার যে ‘ব্লাসফেমি’ নিয়ে যে তর্ক চলছে তা কূটতর্ক মাত্র। এই অনুমানও কাজ করে বাংলাদেশের মাওলানা-মাশায়েখরা প্রাগৈতিহাসিক জীব। তাঁরা কিছু জানেন না। এই অনুমান ঠিক নয়। হেফাজতে ইসলাম বারবারই দাবি করছে আমরা রাজনৈতিক দল নই, ধর্মীয় ও অরাজনৈতিক সংগঠন। সেটা তাঁরা তাদের ৬ তারিখের সমাবেশে প্রমাণ করেছেন। জামায়াত, বিএনপি বা জাতীয় পার্টি কাউকেই তারা তাদের সমাবেশ থেকে ফায়দা তুলতে দেন নি। প্রশাসনকে কথা দিয়েছেন ৫টায় তাদের সমাবেশ শেষ হবে, ওয়াদামাফিক সমাবেশ শেষ করে তারা চলে গিয়েছেন।
অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন হিশাবে ইসলাম হেফাজতের কর্তব্য থেকেই হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব মনে করেছেন এই রাষ্ট্রের অধীনে রাসূলে করিমের ইজ্জত ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে কটূক্তি ও কদর্য ভাষায় দীর্ঘ দিন ধরে লেখালিখি হতে থাকলেও রাষ্ট্র বা সরকার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি। অথচ শেখ হাসিনা বিবিসির কাছে দাবি করেছেন প্রচলিত আইনে ধর্মীয় অনুভূতি রা করা যায়। প্রথম আলো শিরোনাম করেছে, “আমরা সব সময় ধর্মীয় অনুভূতিকে রার চেষ্টা করি”। এটা ডাহা মিথ্যা কথা, তিনি তার কিছুই করেন নি। তিনি ফৌজদারি দণ্ডবিধি, বিশেষ মতা আইন এবং সম্প্রতি পাস হওয়া তথ্যপ্রযুক্তি আইনের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারের কোন উল্লেখ করেন নি। ব্লগে কুৎসিত লেখালিখি চলতে থাকলেও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি। আগেই বলেছি গত বছর এই ধরণের লেখালিখি বন্ধ করবার জন্য কতিপয় ব্লগ ও ব্লগারকে সুনির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত এবং অন্যদেরও খুঁজে বের করবার জন্য নির্দেশ উচ্চ আদালত দেবার পরেও সরকার কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করে নি।
অথচ ২০১২ সালের ৩১ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে সমালোচনার জন্য ঝিনাইদহের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শিমুল কুমার বিশ্বাস হরিণাকুণ্ড সরকারি লালন শাহ কলেজের ছাত্র আবু নাইম জুবায়েরকে কারাগারে পাঠিয়েছেন। জামিন দিতে অস্বীকার করেছেন। আদালত বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে ফেসবুকে সমালোচনা করা হয়েছে তার প্রমাণ আদালতের কাছে আছে।
ফলে প্রশ্ন উঠেছে সরকার যদি বঙ্গবন্ধু বা প্রধানমন্ত্রীর অবমাননার জন্য কাউকে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি দিতে পারে তাহলে রাসূল (সা:)-এর অবমাননাকারীদের শাস্তি দিতে এত গড়িমসি কেন? বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের প থেকে প্রশ্নটি তুলবার ধরণ গুরুত্বপূর্ণ। ধরে নেয়া হয়েছে, রাসূল (সা:)-এর ইজ্জত ও মর্যাদা রা রাষ্ট্র ও সরকারের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর েেত্র পড়ে। আখেরি নবীর ইজ্জতের চেয়েও শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রীর ইজ্জতের মূল্য বেশি! হেফাজতে ইসলাম প্রশ্নটি তুলেছে বিদ্যমান রাষ্ট্রের চরিত্র এবং জালিম শাসকদের রাজনীতির পরিপ্রেেিত।
হেফাজতে ইসলাম যখন বলে সরকারকে “ব্লাসফেমি” আইন করতে বাধ্য করা হবে তখন মধ্যবিত্ত শ্রেণি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অথচ ধর্মীয় সংগঠন ধর্মের ভাষাতেই কথা বলবে। এতে আতঙ্কিত হবার কিছুই নাই। সমাজে যে-কেউই তার নিজের জায়গা থেকে দাবি তুলতেই পারে। আমাদের বিচার করে দেখতে হবে গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার দিক থেকে এই দাবিগুলো রাষ্ট্র কতটুকু বা কিভাবে গ্রহণ করতে সম। নিঃসন্দেহে অনেক েেত্র রাষ্ট্রের পে সব দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান ধরে আমরা যে আলোচনা করেছি তাতে রাসূলের ইজ্জত রার জন্য সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আইন প্রণয়ন মোটেও বেমানান নয়। গণতন্ত্রের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ কোন পদপেও নয়। নিজের দেশের জনগণের মর্মবেদনা ও অনুভূতির চেয়েও শেখ হাসিনা বিদেশিদের সন্তুষ্ট করবার দিকেই মনোযোগ দিয়েছেন।
আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী এই জন্যই সম্ভবত হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, “সরকার দেশের কোটি কোটি মুসলমানের মনের ভাষা বুঝতে না পারলে চরম মূল্য দিতে হবে”। যদি তিনি ধর্মের ভাষায় কথা না বলে গণতন্ত্রের ভাষায় বলতেন তাহলে এই হুঁশিয়ারির খুব একটা হেরফের হোত না। তিনি বলতেন কোটি কোটি নাগরিকের মনের ভাষা বুঝতে শেখ হাসিনা ভুল করছেন। এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে।
না। আমরা কোন মূল্য দিতে রাজি নই। আমরা চাই সবাই হুঁশে থাকুক। আলাপ-আলোচনা কথাবার্তার পথ যেন সমাজে রুদ্ধ না হয়। হয়তো এর মধ্য দিয়েই আমাদের গঠনমূলক পথ সন্ধান করে নিতে হবে।
যেসব নাগরিককে আমরা নাগরিকতার বাইরে রেখে দিতে চাই, যদি তাঁদের সমষ্টির অন্তর্ভুক্ত করে আমরা ভাবতে না শিখি এবং তাঁদের দাবির মর্ম যদি গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার জায়গা থেকে বুঝতে আমরা ভুল করি তাহলে বাংলাদেশকে রক্তাক্ত পথেই আমরা ঠেলে দেবো। কেউ আমাদের রা করতে পারবে না।
এই সমাজ ও রাষ্ট্র তাদেরও। এই সত্য যেন আমরা না ভুলি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন