সিরাজুর রহমান
ঊনবিংশ শতকের ষাটের দশকে আবার ক্রীতদাস ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে দক্ষিণের কনফেডারেট রাজ্যগুলোর সাথে উত্তরের ইউনিয়নিস্ট রাজ্যগুলোর গৃহযুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধের শেষে সেনাবাহিনী থেকে ছাড় পাওয়া উত্তর ও দক্ষিণের লাখ লাখ সৈন্য দেশ জুড়ে ঘুরে বেড়ায়, যে যেভাবে পারে বিত্ত-সম্পদ অর্জনের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে। ওয়াইল্ড ওয়েস্ট নামে পরিচিত এই লাখ লাখ বর্গমাইল এলাকার অজস্র কাহিনী নিয়ে বহু ‘ওয়েস্টার্ন ফিল্ম’ তৈরি হয়েছে। জন ওয়েন অভিনীত রিও লোবো নামের ছায়াছবিটি অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বলতে হবে।
ছবির কাহিনীতে ইউনিয়নিস্ট বাহিনীর এক সার্জেন্ট তার অধীন কয়েকজন সাবেক সৈনিককে নিয়ে রিও লোবোতে আস্তানা গেড়ে বসে। এই লোকদের দিয়ে সে বাজারে নিয়ে যাওয়ার পথের গরু কিংবা ঘোড়ার পাল ছিনিয়ে নিত। চার পাশের খামার মালিকদের ওপর জোরজুলুম করে নিজেদের জোত-জমা ওই সাবেক সার্জেন্টের নামে লিখে দিতে বাধ্য করা হতো। এলাকার মূল শহরে সে নিজের লোকদের শেরিফ (পুলিশ প্রধান), ডেপুটি ও জজ নিয়োগ করেছিল। কেউ সার্জেন্ট এবং তার দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে গেলে উল্টো তাকেই মারধর করা কিংবা গুলি করে খুন করা হতো।
আজকের বাংলাদেশের সাথে রিও লোবোর মিল চোখে না পড়েই পারে না। এ দেশের বিশাল পুলিশ বাহিনী রিও লোবোর শেরিফ ও ডেপুটিদের মতো। চোর চুরি করলে দোষ নেই, কিন্তু চুরির খবর যদি কেউ প্রকাশ করে পুলিশের চোট উল্টো তার ওপরই গিয়ে পড়ে। বাংলাদেশের বিচারপদ্ধতি দলীয়কৃত বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। সুতরাং সুবিচার পাওয়ার আশা নেই বলে মনে করা হয়। শাসকের ওপরও এখন হাতির ঘাড়ের ছারপোকার মতো উৎপাত সৃষ্টি করেছে শাহবাগীরা। সরকার নিজেদের অন্যায় কাজের প্রতি মেকি সমর্থন হিসেবে দেখানোর জন্য এদের খোরপোষ আর অর্থ দিয়ে শাহবাগে বসিয়ে দিয়েছিল। এরা এবং এদের ‘পালের গোদা’ ডা: ইমরান সরকার এখন সে সরকারের ওপরই তম্বি করে, সরকারকে লাল চোখ দেখায়।
সরকার মূলত শাহবাগীদের ওখানে বসিয়েছিল কাদের মোল্লা ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত অবশিষ্টদের সবাইকে ফাঁসির দণ্ড দিতে তথাকথিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। কিন্তু রাজার ওপরের রাজার মতো শাহবাগীরা একের পর এক হুকুমের তালিকা বাড়িয়েই চলেছে। ‘কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই’ দাবির পরে জিগির উঠলÑ শিবির ধরো জবাই করো। তার পর জামায়াতকে বেআইনি করো। আরো পরে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করো। এসবের জের ধরে আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, দিনকাল ও সংগ্রাম পত্রিকা নিষিদ্ধ করার এবং আমার দেশ সম্পাদককে গ্রেফতারের দাবি উঠল। স্বাধীন সংবাদপত্রের টুঁটি টিপে মারা এ সরকারের ঘনিষ্ঠ মহলের পুরনো প্রকল্প। সুতরাং শাহবাগীদের দাবি তাদের মনঃপূতই হয়েছিল।
অপরাধী নয়, এজাহারকারীই শাস্তি পাবেন?
আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এখন গ্রেফতার হয়েছেন। সুতরাং ইমরান সরকার এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা বগল বাজাতেই পারে। তারা এখন বলছে, ‘আগেই বলেছিলাম মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করো। তাকে তখনই গ্রেফতার করা হলে এত গোলমাল আর অশান্তি হতো না।’ মাহমুদুর রহমানের ওপর বিশেষ আক্রোশ আছে শাহবাগীদের। তিনি এবং তার পত্রিকা ফাঁস করেছিল যে, শাহবাগীদের প্রধান হোতাদের কয়েকজন নাস্তিক ও ধর্মদ্রোহী এবং তারা আল্লাহ, রাসূল সা: ও ইসলামকে নিয়ে ইন্টারনেট ব্লগে পর্নোগ্রাফি প্রচার করছিল। এর জের ধরেই বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, রাষ্ট্রীয় গণহত্যায় প্রায় ১৮০টি প্রাণ নষ্ট হয়েছে এবং হেফাজতে ইসলাম নামে একটা স্বতঃস্ফূর্ত মহা-আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এ আন্দোলন এখন সরকারের জন্য উটের পিঠের বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে সরকারের অভিযোগের সংখ্যা এখন বোধ করি ৬৩টি। বিভিন্ন ব্লগে এবং আমেরিকা থেকে পাওয়া নানা সূত্রে প্রচারিত হয়েছিল যে, একটা মার্কিন তেল কোম্পানিকে বিনা টেন্ডারে তেল সন্ধানের একটা ব্লক ইজারা দেয়া বাবদ প্রধানমন্ত্রীর জনৈক আত্মীয় পাঁচ মিলিয়ন (৫০ লাখ) ডলার পেয়েছেন। আমার দেশ সে খবরটা ছেপেছিল। সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর তখন থেকেই সরকারের আক্রোশ। আদালত তাকে মানহানির দায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন, কিন্তু মাহমুদুর রহমানকে জেলে রাখা হয় ১০ মাস। কিছু দিন রিমান্ডেও রাখা হয় তাকে। বর্তমান সরকারের আমলে রিমান্ড সরকারের আক্রোশ ঝাড়ার উপায় বলেই সর্বসাধারণের বিশ্বাস। রিমান্ডে তারেক রহমানের কোমর ভেঙে দেয়ার কথা বাংলাদেশের মানুষ ভুলে যায়নি, আশা করি।
সরকারের গাত্রদাহের বড় কারণটি ঘটে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে। লন্ডনের বিশ্ববিখ্যাত সাময়িকী ইকোনমিস্ট বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অবস্থানকারী জনৈক আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সাথে ‘আন্তর্জাতিক’ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি নিজামুল হকের সুদীর্ঘ স্কাইপ আলোচনার বিবরণ প্রকাশ করেছিল। বিষয়টি অবশ্যই বাংলাদেশের গণস্বার্থে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সে বিবেচনায় আমার দেশ ইকোনমিস্টে প্রকাশিত বিবরণটি প্রকাশ করে। সংবাদের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সবাই সেটাকে জনসেবার পরাকাষ্ঠা হিসেবে দেখেছেন।
বিভিন্ন সময়ে কয়েক ঘণ্টার এই স্কাইপ কথোপকথনে কী ছিল? বিচারপতি নিজামুল হক জিয়াউদ্দিনের কাছ থেকে বিচার পরিচালনা পদ্ধতি, সে কাজে কার কার পরামর্শ কিংবা সাহায্য নেয়া যেতে পারে, রায় লেখার ঠিকা কাকে দেয়া যেতে পারে ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ চেয়েছিলেন। আলোচনায় বিচার সম্বন্ধে সরকারের পূর্বনির্ধারিত মনোভাবেরও আভাস ছিল। সরকার আশা করছিল, তাদের রাজনৈতিক ঘোষণা অনুযায়ী আদালত অভিযুক্তদের সবাইকে ফাঁসি দেবেন। বিচারপতি নিজামুল হক আহমেদ জিয়াউদ্দিনকে এ আভাসও দিয়েছিলেন যে, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রায় দিলে তিনি পুরস্কৃত হতে অর্থাৎ পদোন্নতি পেতে পারেন।
সরকারের আক্রোশ অযথা ও অন্যায্য
আইন সম্বন্ধে সামান্যতম ধারণাও যাদের আছে তারা অবশ্যই জানেন, রায় দেয়ার আগ পর্যন্ত বিচারপতি মামলা সম্বন্ধে তার চিন্তাভাবনার কথা অন্য কাউকে বলতে পারেন না এবং অন্য কেউ তার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা গুরুতর অপরাধ। বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করে প্রমাণ করেন, তার সেই স্কাইপ সংলাপগুলো অনুচিত ছিল বলে তিনিও মনে করেন। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের গঠন এবং এর গোটা বিচারপদ্ধতি নিয়ে আগে থেকেই বাংলাদেশী এবং বিদেশী আইনবিশেষজ্ঞরা সমালোচনা করেছেন। ইকোনমিস্ট সেসব সংলাপের অনুলিপি প্রকাশ করায় গোটা দুনিয়ার মানুষ বিষয়টি জানতে পারে। এমনকি ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাংলাদেশেরও বহু মানুষ সেটা জেনে গিয়েছিলেন। এ অবস্থায় আমার দেশের বিরুদ্ধে সরকারের ক্রুদ্ধ হওয়ার কিংবা মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করার কোনো সঙ্গত যুক্তি থাকতে পারে না।
উইকিলিকস ব্লগের দৃষ্টান্ত এ ব্যাপারে খুবই প্রাসঙ্গিক হবে। অস্ট্রেলীয় নাগরিক জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ কয়েক বছর ধরে মার্কিন দূতাবাসগুলোর হাজার হাজার তারবার্তা ফাঁস করে দেন। মার্কিন সরকারের প্রতিশোধের ভয়ে অ্যাসাঞ্জ এখন লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু গার্ডিয়ানসহ ব্রিটেনেরও কয়েকটি পত্রিকা তার ফাঁস করা বহু দলিল প্রকাশ করেছে। এসব প্রকাশনীর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ বা মার্কিন সরকার কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়নি। মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করে, কমান্ডো অভিযানের মতো তাকে গ্রেফতার করে এবং আমার দেশের ছাপাখানা তালাবদ্ধ করে দিয়ে বাংলাদেশ সরকার কি অতিমাত্রিক স্পর্শকাতরতার পরিচয় দেয়নি? যদ্দূর জানি, সরকার আমার দেশ পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করার কোনো ঘোষণা দেয়নি। পত্রিকার ছাপাখানায় তালা লাগানো এবং সংগ্রাম পত্রিকার ছাপাখানায়ও আমার দেশের মুদ্রণ বন্ধ করে দেয়া সরকারের আক্রোশের বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়েছে।
মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে আরেকটা মামলা শাহবাগের কয়েকজন শীর্ষ সংগঠকের ইসলামবিরোধী ব্লগগুলোর বিবরণ ফাঁস করা সম্বন্ধে। বিশ্বে মুসলমানের সংখ্যা ১০২ কোটি। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের ৯০ শতাংশই মুসলিম। এত মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে পর্নোগ্রাফি প্রচার যে কত বড় গুরুতর অপরাধ তা ভাষায় ব্যক্ত করা সহজ নয়। আমরা এবং আরো বহু সুচিন্তক ব্যক্তি অজস্রবার বলেছি, ধর্মনিরপেক্ষতা আর ধর্মবিরোধিতা নিয়ে বর্তমান সরকার তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। যে সরকার ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে দম্ভ করে, তাদের উচিত ছিল কোনো ধর্মবিশ্বাসীদের অনুভূতিতে আঘাত দানের বিরুদ্ধে বিশেষভাবে সতর্ক থাকা।
বর্তমান সরকার সংশ্লিষ্ট ব্লগগুলোর ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ ব্যাপারে প্রধান অপরাধী, ব্লগার রাজীব দুষ্কৃতকারীদের হাতে নিহত হলে প্রথমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পরে প্রধানমন্ত্রী নিজে তার বাড়িতে গিয়েছিলেন সমবেদনা জানাতে। প্রধানমন্ত্রীর এই কাজটা সব ধর্মপ্রাণ মানুষকে ব্যথিত করেছে। এ অবস্থায় এই ব্লগগুলোর বিবরণ ফাঁস করে দিয়ে আমার দেশ মুসলিম উম্মাহর একটা উৎকৃষ্ট সেবাই করেছে। সেটা যে সরকারের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেছে, সে জন্য এ পত্রিকা কিংবা তার সম্পাদক দায়ী হতে পারেন না; দায়ী হচ্ছে সরকারের অবিবেচনা, অযোগ্যতা ও অপদার্থতা। মাহমুদুর রহমান ও তার পত্রিকাকে শাস্তি দিয়ে সরকারের ইমেজের কালিমা দূর করা যাবে না।
মুজিবের শাসন স্বর্ণযুগ ছিল না
আমার দেশের ছাপাখানায় তালা দেয়া এবং সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার করে সরকার যে হিংস্রতার পরিচয় দিয়েছে, তার কারণ সম্ভবত অন্য একটি বিষয়। যেদিন এই ঘটনাগুলো ঘটে সেদিনের সংস্করণে আমার দেশ ঘোষণা দিয়েছিল, উইকিলিকস ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সম্বন্ধে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে পাঠানো মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের যেসব টেলিগ্রামের বিবরণ ফাঁস করেছিল, আমার দেশ ধারাবাহিকভাবে সেগুলো প্রকাশ করবে। সরকারের যে তাতে আতঙ্কের কারণ ঘটেছিল সেটা স্পষ্ট। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান সরকার কখনোই গোপন করার চেষ্টা করেননি যে, এরা শেখ মুজিবুর রহমানের অনুকরণে একটা একদলীয় বাকশালী পদ্ধতি চালু করতে চান এবং সেজন্যই যেকোনো ভাবে গদি আঁকড়ে থাকাই তাদের পরিকল্পনা।
বর্তমান সরকার নতুন প্রজন্মের দেশবাসীকে বিশ্বাস করাতে চায়, শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল একটা স্বর্ণযুগ এবং তখনকার বাংলাদেশ প্রকৃতই সোনার দেশ ছিল। কিন্তু প্রকৃত পরিস্থিতি তার ধারেকাছেও যাবে না। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিব চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। কিছু চাটুকার সুপরিকল্পিতভাবে ফুলের মালা আর স্তবস্তুতি দিয়ে তাকে ব্যস্ত রেখেছে এবং সে সুযোগে নিজেরা দুর্নীতি ও কুশাসন দিয়ে দেশের সর্বনাশ করেছে। শীর্ষ নেতাদের পরিবারও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল বলে তখন ব্যাপক বলা-কওয়া হচ্ছিল। সর্বব্যাপী দুর্নীতির কারণে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন হয়নি, অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন লিখেছেন, বাংলাদেশে যথেষ্ট খাদ্য মজুদ থাকা সত্ত্বেও কুশাসনের কারণে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। সে দুর্ভিক্ষে ৭০ হাজার বাংলাদেশী অনাহারে ও অপুষ্টিতে মারা গেছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এক দিকে বিদেশীদের সমর্থন লাভ, অন্য দিকে দেশের মানুষের আশাবাদ ধরে রাখার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবীরা শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে একটা জাদুর মায়াজাল সৃষ্টি করেছিলেন। আমি নিজেও এতে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। সে কারণে স্বাধীনতার পরবর্তী বছর দুয়েক লেখক-সাংবাদিকেরা মুজিবের ব্যক্তিজীবন নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তাদের যখন চোখ খুলল, সর্বনাশ তখন বহু দূর এগিয়ে গেছে। ব্যক্তিপূজা ছেড়ে তারা তখন সমালোচনা শুরু করেন। স্তবস্তুতির ঘুমঘোর থেকে জেগে ওঠা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সেটা সহ্য করা সহজ ছিল না। বিশেষ ক্ষমতা আইন পাস করে তিনি সমালোচকদের ধরে ধরে জেলে পাঠান। অসংখ্য বুদ্ধিজীবী তখন কারাবরণ করেছিলেন।
তার ওপর শেখ মুজিব চারটি সরকারি মালিকানাধীন পত্রিকা (ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ টাইমস ও বাংলাদেশ অবজারভার) ছাড়া অন্য সব পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দেন। লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারে তিনি আমাকে বলেছিলেন, নিউজপ্রিন্টের ব্ল্যাকমার্কেট বন্ধ করার জন্যই তিনি এ ব্যবস্থা নিয়েছেন।
ঐতিহাসিক ভুলের অন্ধ অনুকরণ
বর্তমান সরকারও প্রথম দিন থেকে তেমনি ভ্রান্ত পথ ধরেই চলেছে। সর্বব্যাপী দুর্নীতি দিয়ে দেশের সম্পদ আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীদের পকেটস্থ করা হয়েছে। নানা নামে, নানা অছিলায় প্রায় এক লাখ বিরোধী ও সমালোচককে কারাবন্দী করা হয়েছে। হয়তো দুর্নীতির কিছু বখরা দিয়েই মিডিয়ার দালাল অংশের আনুগত্য ধরে রাখা হয়েছে। অন্য দিকে যারা মাথা বন্ধক দিতে রাজি হয়নি তাদের বিরুদ্ধে অহরহ নির্যাতন চলছে। টেলিভিশন সাংবাদিক দম্পতি সাগর আর রুনি কুইক রেন্টাল কেলেঙ্কারির বিবরণ সংগ্রহ করেছিলেন। অত্যন্ত নৃশংসভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছে। দেশ জুড়ে সকলেরই হত্যাকারীদের সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা আছে। কিন্তু রিও লোভোর শেরিফ আর ডেপুটিদের মতো বাংলাদেশের দলীয়কৃত পুলিশ হত্যাকারীদের ধরেনি।
সরকারের, আওয়ামী লীগের, এমনকি ছাত্রলীগেরও সামান্যতম সমালোচনার কারণে এই সরকারের আমলে অন্তত ১৭ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন, আহত হয়েছেন শত শত। বহু সাংবাদিককে দিবারাত্রি ভয়ে ভয়ে কাটাতে হচ্ছে। কিন্তু সরকারের হিংস্রতা এবং প্রতিশোধলিপ্সার জ্বলন্ত প্রমাণের কারণে মাহমুদুর রহমান এবং আমার দেশ পত্রিকার বিরুদ্ধে নির্যাতন এখন বড় হয়ে উঠেছে। বাক ও সংবাদের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিক নির্যাতনের ব্যাপারে বর্তমান সরকার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু তাতে তাদের কোনো লাভ হচ্ছে কি?
নিজেদের কৃতকাজের পরিণতি তাদের জন্য কেমন মারাত্মক হচ্ছে, সেটা বোঝার মতো বিজ্ঞতাও নেই এই সরকারের। এ সরকার সম্বন্ধে প্রায়ই একটা উপমা আমার মনে আসেÑ এরা বাঘের লেজে চিমটি কেটে নিজেদের সঙ্কট ডেকে আনে। সরকার ও মন্ত্রীরা এখন সবচেয়ে ভীত হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে। কিন্তু দেশের সব মানুষের ক্রোধের উদ্রেক কি সরকার নিজে করেনি? কী প্রয়োজন ছিল সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহ ও আল্লাহর ওপর আস্থা বাদ দেয়ার? কী কারণে এই সরকার চাকরিবাকরি ইত্যাদি সব ব্যাপারে সংখ্যাগুরুর বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করার প্রয়াস পেল?
আইনশৃঙ্খলা সাধারণ মানুষ হাতে তুলে নিচ্ছে
যে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগে ওমরাহ করে হিজাব পরে বিমান থেকে নামেন, কী কারণে তিনি ফসল ভালো হওয়ার জন্য ‘মা-দুর্গা’কে ধন্যবাদ দিলেন? ব্লগারদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষপাতিত্বের এবং প্রতিবাদীদের হত্যার কী প্রয়োজন ছিল? অথচ মূল সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার বিধান নিয়ে তো বাংলাদেশের মুসলমান সন্তুষ্ট ছিল, তারা কোনো আপত্তি করেনি। এখন আবার প্রধানমন্ত্রী ‘মদিনা সনদ’ অনুযায়ী দেশ শাসনের কথা বলছেন। আমি যদ্দূর জানি, মদিনা সনদে চূড়ান্ত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর ওপর ন্যস্ত বলে উল্লেখ ছিল। প্রধানমন্ত্রী কি সেটা মেনে চলছেন? ইসলাম-ইসলাম করে হানিফের মুখে খই ফুটছে। এসব কি সরকারের ভীতি আর আতঙ্কের পরিচয় দেয় না? লক্ষ করার বিষয়, তার আগের রাতেই হানিফের বাড়িতে নাকি ‘ডামি বোমা’ ছোড়া হয়েছিল। আমার মনে হয়, বোমাবাজেরা অযথা সময় ও সামর্থ্য নষ্ট করছে। শুনেছি হানিফের পরিবার দু-তিন মাস আগেই কানাডার টরেন্টোয় চলে গেছে। মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ পরিবার-পরিজনদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে লোকজন বলাবলি করছে।
বাংলাদেশে এখন আইনশৃঙ্খলা নেই, প্রশাসন নেই। কিছু লোক মন্ত্রিত্বের গদিতে বসে থাকলেও প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশে কার্যকর সরকারও নেই। দেশের মানুষ এখন পুলিশ ও আদালতের ওপরও আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তারা এখন আওয়ামী লীগের ক্যাডার, ছাত্রলীগ, যুবলীগ আর পুলিশকে একই দলভুক্ত অত্যাচারী আর নির্যাতক মনে করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে, সিরাজগঞ্জে, খুলনায়, যশোরে আমরা দেখেছিÑ কেউ তাদের ওপর অত্যাচার করতে আসছে মনে হলে স্থানীয় জনসাধারণ পুলিশের ওপরও ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কে পুলিশ আর কে আওয়ামী লীগ বাছবিচার করছে না। ফটিকছড়ির ঘটনা সম্বন্ধে শাসক দল এবং তাদের দোসররা বহু অপপ্রচার চালাচ্ছে। আসলে এখানেও স্থানীয় জনসাধারণ ক্যাডারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল।
মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার আর আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দেয়াকেও দেশের মানুষ সরকারের নির্যাতনের আরেকটা দৃষ্টান্ত হিসেবেই দেখছে। দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। সাংবাদিকেরা গত সোমবার প্রতীকী অনশন ধর্মঘট করেছেন। প্রতিবাদ করছে রাজনীতি-নিরপেক্ষ মানুষ, বিএনপি-জামায়াতসহ ১৮ দলের সমর্থকেরা এবং হেফাজতে ইসলাম আন্দোলনের সব সমর্থক। অবশিষ্ট থাকছে সরকারের ভোটব্যাঙ্কÑ যারা জনসংখ্যার দশ ভাগের এক ভাগ মাত্র। এদের সমর্থনের জোরেই কি গদি আঁকড়ে থাকতে চায় সরকার?
ছায়াছবি রিও লোবোর সমাপ্তি শুভ হয়েছিল। নায়ক জন ওয়েন অভিনয় করেছিলেন ইউনিয়নিস্ট বাহিনীর একজন সাবেক কর্নেলের ভূমিকায়। তিনি এবং আরো দু’জন সাবেক সৈনিক দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং তাদের সমুচিত শাস্তি দিয়ে অপহৃত সম্পত্তি প্রকৃত মালিকদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। প্রমাণ হলো, কিছু মানুষ দৃঢ়সঙ্কল্প নিয়ে রুখে দাঁড়ালে অত্যাচারীর পতন হবেই।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন