শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৩

দুর্নীতির এই কলঙ্ক মুছতে হবে বাংলাদেশকে


পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘এসএনসি-লাভালিন’ এবং এর শতাধিক সহযোগী প্রতিষ্ঠানসহ ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে বিশ্বব্যাংক। এটি হলো বিশ্বব্যাংকের এ যাবৎকালের সরবোচ্চ নিষেধাজ্ঞা। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ নিয়ে ব্যাংকের সাথে আলোচনায় সমঝোতার ফলে এই নিষেধাজ্ঞা এসএনসি-লাভালিন মেনে নিয়েছে। কানাডার আদালতে বিচারাধীন মামলায় অভিযুক্ত এসএনসি-লাভালিনের ভারতীয় বংশোদ্ভূত কর্মকর্তা রমেশ শাহর ডায়েরি থেকে পাওয়া ২৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শুনানি শেষ হওয়ার আগেই এসএনসি-লাভালিনকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলো বিশ্বব্যাংক। রমেশের এই ডায়েরিতেই উল্লেখ ছিল পরামর্শককাজ পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের একজন উপদেষ্টা, একজন মন্ত্রী, একজন সাবেক মন্ত্রী, সাবেক সচিব এবং একজন রাজনীতিবিদকে ১০ শতাংশ ঘুষ দিতে হবে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ছিল ৩৮ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের এই নিষেধাজ্ঞার ফলে কানাডার সর্ববৃহৎ নির্মাণকারী এই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত বিশ্বের কোনো জায়গায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে হওয়া কোনো কাজে অংশ নিতে পারবে না। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতিবিরোধী বিভাগ ইন্টিগ্রিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট লিওনার্ড ম্যাকার্থির বক্তব্য অনুসারে এ ঘটনাকে বৈশ্বিক দুর্নীতি প্রতিরোধে একটি সমন্বিত প্রচেষ্টারই অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ক্রয়নীতি লঙ্ঘন করে এসএনসি-লাভালিন পদ্মা সেতুর কাজ পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে ঘুষ দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল। এর আগে বিশ্বব্যাংক ঘুষ প্রদানের ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়ায় বাংলাদেশ সরকারকে বিষয়টি তদন্ত করে দেখার অনুরোধ করে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম দিকে পুরো বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার কথা থাকলেও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে দীর্ঘ টানাপড়েনের পর গত জানুয়ারির শেষে বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ নেবে না বলে জানায়। এর আগে গত বছরের জুন মাসে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করে দেয়া হয়। পরে সরকারই অনুনয়-বিনয় করে বিশ্বব্যাংককে প্রকল্পে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালায়। পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ পেতে বাংলাদেশী কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়ার অভিযোগে এসএনসি-লাভালিনের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল ও আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহের বিচার চলছে কানাডায়।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থা শুধু তাদের প্রদেয় ঋণই বাতিল করেনি, একই সাথে এটি বাংলাদেশের ভাবমর্যাদার জন্যও একটি কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই অভিযোগ ওঠার পর বিষয়টি যেভাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ডিল করা হয়েছে, তাতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে সন্দেহ ঘনীভূত হয়। বাংলাদেশে বর্তমান শাসনামলে এর সব রহস্য উদঘাটন হবে, এমনটা কেউ আশা করেন না। কিন্তু কানাডার আদালতে এখন এ সংক্রান্ত মামলার যে শুনানি চলছে, তাতে হয়তো দুর্নীতির অনেক রহস্য বেরিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন ব্যুরো এসএনসি-লাভালিনকে নিষিদ্ধ করার বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে পানি ঘোলা হওয়ার আগে দুদককে তদন্ত করার অনুরোধ জানানো হলেও তা নিয়ে গড়িমসি করে প্রতিষ্ঠানটি। এতে ঋণটি শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক বাতিল ঘোষণা করে। তা না হলে এই দুর্নীতি নিয়ে বাংলাদেশের ইমেজ আজকের এ পর্যায়ে যে পৌঁছত না, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বাংলাদেশের আদালত বা দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারেরর একধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও বিষয়টি নিয়ে কানাডার আদালতে যে মামলা চলছে, তার ওপর সরকারের কোনো প্রভাব হয়তো থাকবে না। এ মামলায় এ দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আরো কী কী তথ্য বেরিয়ে আসে তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। সেখানকার মামলায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সাবেক মন্ত্রী সচিব বা এ পর্যায়ের কর্মকর্তার ঘুষ নেয়া বা নেয়ার আয়োজনের বিষয়টি প্রমাণিত হলে বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যের কোনো সীমা থাকবে না।
আমরা আশায় থাকব যে, পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বা সাবেক মন্ত্রী ঘুষ নেননি বা নিতে চাননিÑ এটাই প্রমাণ হয়েছে। এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটে থাকলে বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের মাথা হেঁট হয়ে যাবে। পদ্মা সেতু নিয়ে সর্বনাশের যা হওয়ার ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। এখন দুর্নীতিগ্রস্ততার যে কলঙ্ক জাতির কপালে অঙ্কিত হয়ে গেছে, তা মুছে ফেলার জন্য অন্তত আর কোনো প্রকল্পে যেন ঘুষ দুর্নীতির অভিযোগ না ওঠে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তা না করা হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে বারবার যেমন বাধার মুখে পড়তে হবে। তেমনিভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের প্রতীকে পরিণত হবে আমাদের প্রিয় স্বদেশ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads