ভারতীয় এজেন্ডার অনুসরণেই কিছুদিন ধরে জামায়াতের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতন চালাচ্ছে সরকার। এই নির্যাতন অরাজনৈতিক ইসলামপন্থী আলেম-ওলামার উপরও শুরু হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের লংমার্চে বাধাদান তারই একটা দৃষ্টান্ত। এই নির্যাতনের তালিকায় স্বাভাবিক কারণেই এসেছে বিএনপি। এর পাশাপাশি শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় আনা সংক্রান্ত ‘আউটলুক’-এর খবর সত্য হলে এমন মনে করাটাই সঙ্গত যে, আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তিকে নির্মূল করে দেয়ার ‘কৌশল’ হিসেবে শেখ হাসিনার সরকারকে সামনে রেখে ফ্যাসিস্ট কর্মকা- আসলে ভারতই চালাচ্ছে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা সম্ভবত ভেবেছেন, এভাবেই তারা শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় আনতে পারবেন। বলা হচ্ছে, একই উদ্দেশ্যের ভিত্তিতেই সবশেষে দৃশ্যপটে এসেছে আনন্দবাজারীরা। ভারতের মদদে মঞ্চায়িত শাহবাগ নাটক ব্যর্থ হয়েছে ও ধরা পড়ে গেছে বলেই নাস্তিক ব্লগারদের জন্য ‘লাইফ সাপোর্ট’ নিয়ে হাজির হয়েছে তারা। তাদের এ চেষ্টার মধ্যেও বাংলাদেশের জন্য নতুন পর্যায়ে উদ্বেগের উপাদান রয়েছে। এখন দেখার বিষয়, ভারতের একার ইচ্ছা অনুসারেই সবকিছু ঘটে কি না এবং হত্যা ও নির্যাতনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে ইচ্ছাধীন করে ফেলা সম্ভব হয় কি না।
ছোটবেলায় অংক শিখেছিলাম খুব কষ্ট করে। না শিখে উপায়ও ছিল না। কারণ, একদিকে আব্বা ছিলেন একটি হাই স্কুলের হেড মাস্টার। সুতরাং তার মানসম্মান রাখার প্রশ্ন ছিল। অন্যদিকে আম্মার হাতপাখার ডাটির বাড়ি তো ছিলই, সেই সাথে ছিল পাশের বাড়ির গায়েত্রী দি’র কানমলাও। সব মিলিয়েই অংক শিখতে হয়েছিল। সে কারণে যোগ-বিয়োগ-পূরণ-ভাগের মতো বিষয়গুলোতে এখনো সাধারণত ভুল হয় না। তা সত্ত্বেও মাঝে-মধ্যে ধন্দে পড়ে যেতে হয়। যেমন পড়তে হয়েছিল গত ৪ এপ্রিল। সেদিন শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চওয়ালারা প্রধানমন্ত্রীর তেজগাঁও অফিসে যাচ্ছিল স্মারকলিপি দেয়ার জন্য। মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা গুণতে গিয়ে রীতিমতো ধন্দে পড়ে গিয়েছিলাম। মনে পড়েছিল সেই পুরনো প্রবাদের কথাÑ ‘লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার...’। আসলেও ‘শুমার’ করে ওঠা সম্ভব হয়নি। কারণ, শাহবাগীদের চাইতে সামনে পাহারা দিয়ে এগিয়ে চলা পুলিশের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। খুব বেশি হলে দেড়, দুই বা আড়াইশর মতো ছিল শাহবাগীরা। সবাইকে নয়, জনা পাঁচেককে যেতে দেয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর অফিস পর্যন্ত। সেখানেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের সাক্ষাৎ দেননি। তার পক্ষে একজন পরিচালক স্মারকলিপিটি গ্রহণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী কেন সাক্ষাৎ দেননি তার একটি কারণ হিসেবে ‘স্পর্ধা’ কথাটা আলোচিত হয়েছে। ক’দিন আগেই শাহবাগীদের নেতা ইমরান সরকার বলেছিল, তাদের দাবি অনুযায়ী ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী নাকি ‘স্পর্ধা’ দেখিয়েছেন!
এটা অবশ্য সরকার এবং শাহবাগীদের নিজেদের ব্যাপার। তারা নিজেরা নিজেরা কখন কি করবেন, কখন কোন কৌশলে জনগণকে বিভ্রান্ত করবেন এসব বিষয়ে এক অনুমান করা ছাড়া আমাদের করার কিছু নেই। কিন্তু নতুন পর্যায়ে কথা উঠেছে অন্য একটি বিশেষ কারণে। কারণটি শাহবাগীদের নিয়ে ভারতীয়দের শোরগোল। আবারও শাহবাগীদের বন্দনায় নেমে পড়েছে তারা। সেটাও এমন এক সময়ে, শাহবাগে মঞ্চায়িত নাটকের সেবাদাস কুশীলবরা যখন মরি-মরি অবস্থায় পৌঁছে গেছে। যখন বলা হচ্ছে, তারা আসলে হাসপাতালের আইসিইউতে রয়েছেÑ যে কারণে আজকাল তাদের মিছিলে দেড়, দুই বা আড়াইশর বেশি লোক হয় না। এমন এক অবস্থার মধ্যেও কলকাতার প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজারের সহযোগী সাপ্তাহিক দেশ নাস্তিক ব্লগারদের বন্দনার উদ্দেশ্যে ‘জয় বাংলা : শাহবাগে গণজাগরণ’ শিরোনামে এক কভার স্টোরি ফেঁদে বসেছে। ১৭ মার্চ সংখ্যার ওই নিবন্ধে তারা লিখেছে, শাহবাগে নাকি এখনও ‘জনজোয়ার বাড়ছে’! শাহবাগ স্কয়ার শুধু নয়, জনজোয়ারে নাকি সমগ্র বাংলাদেশই ভাসছে! শাহবাগীরা নাকি মৌলবাদের ‘রক্তচক্ষু’ উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছে! জামায়াতের তো বটেই, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোরও তুমুল নিন্দা ও সমালোচনা করেছে দেশ। বলেছে, দলগুলো নাকি ‘গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি’ তৈরি করতে চাচ্ছে! কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থান নাকি ‘দুঃখজনক’ এবং ‘দুর্ভাগ্যবশত’ তিনি নাকি জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন! ‘অসংখ্য’ তরুণ নাকি শাহবাগ বিরোধীদের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে! সব মিলিয়ে এই মুহূর্তের বাংলাদেশ নাকি ‘অগ্নিতপ্ত, অশান্ত’! এভাবে শাহবাগের নাস্তিক ব্লগারদের বন্দনায় কা-জ্ঞান পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে সাপ্তাহিকটি। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সফর নিয়ে সাপ্তাহিক দেশ লিখেছে, ‘শ্বশুর বাড়ি’র দেশে গিয়ে তিনি নাকি ‘উষ্ণ অভ্যর্থনা’ পেয়েছেন!
অন্যদিকে শাহবাগীরা আসলে যে মরি মরি অবস্থায় পৌঁছে গেছে তার সর্বশেষ প্রমাণ তো ৪ এপ্রিলও পাওয়া গেলো। কথাটা ভারতীয়দেরও না জানার কথা নয়। জানেও তারা সুনির্দিষ্টভাবেই। তা সত্ত্বেও এই সময়ে ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠার কারণ, শাহবাগী নাস্তিক ব্লগারদের তারা ‘লাইফ সাপোর্ট’ দিয়ে কোনোভাবে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে চায়। কারণ, শাহবাগ যে তাদেরই সৃষ্টি! কথাটা খোদ ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়াও সম্প্রতি এক রিপোর্টে স্বীকার করেছে। জানিয়েছে, শাহবাগের কর্মকা- চলছে ভারতের মদতে। দেশ-এর এ কভার স্টোরিতেও সে উদ্দেশ্যেরই প্রকাশ ঘটেছে। এজন্যই কল্পিত ‘জনজোয়ার’ থেকে প্রণব মুখার্জির ‘উষ্ণ অভ্যর্থনা’ পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে কেবল গালগল্পই ফেঁদেছে দেশ। দেশ-এর আড়ালে গালগল্প ফেঁদেছে আসলে ভারতীয়রা।
কলকাতার চরম বাংলাদেশবিরোধী আনন্দবাজারী গোষ্ঠীর পত্রিকা সাপ্তাহিক দেশ-এর রিপোর্টকে নিয়ে শুরু করার কারণ হলো, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় রদবদল ঘটানোর ব্যাপারে ভারত শুধু ‘শকুনি’র মতো নজরই রাখে না, নাকও গলায়। উদাহরণ দেয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘সঙ্গে’ নিয়ে লগি-বৈঠার হত্যা-তা-ব ও ১/১১ ঘটানো থেকে তথাকথিত ‘রোডম্যাপ’ অনুযায়ী ‘ডিজিটাল’ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া পর্যন্ত অনেক তথ্য ও ঘটনারই উল্লেখ করা যায়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্যও ভারত যথেষ্টই ভূমিকা পালন করে চলেছে। শেখ হাসিনার সরকারও ঋণ ও দায় পরিশোধের চেষ্টায় কোনো ত্রুটি করছে না। তিস্তা চুক্তির মতো কোনো কোনো বিষয়ে শেখ হাসিনা মাঝে-মধ্যে ঘাড় বাঁকাতে চাইলেও তার ‘মান ভাঙানোর’ উদ্যোগ নিতে ভারত দেরি করে না। ঢাকা-দিল্ল¬ীর সম্পর্কে ‘নতুন গতি’ আনার জন্য ভারতের ‘হেভিওয়েট’ মন্ত্রীরা পদধূলি দিতে ঢাকায় এসে হাজির হনÑ যেমনটি সম্প্রতি এসেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর এবং মাত্র ক’দিন আগে ‘বাঙালি’ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সফরের কথাও স্মরণ করা দরকার। প্রতিটি উপলক্ষেই দেখা গেছে, নানা কথাবার্তার মধ্য দিয়ে ভারতের এই নেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইমেজ বা ভাবমর্যাদা বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। বুঝিয়ে গেছেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় কোন দল কিভাবে আসবে এবং কতদিন থাকবে এ ব্যাপারে ভারতের ইচ্ছা ও পরিকল্পনার বাইরে যাওয়াটা এখন আর সহজে সম্ভব নয়।
এবার অন্য একটি পত্রিকার কথা। পাঠকদের নিশ্চয়ই ভারতের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ‘আউটলুক’Ñএর কথা মনে পড়বে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপর, ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সেনা অফিসারদের হত্যাকা-ের সময় এ ম্যাগাজিনটি অনেক গোপন খবর ফাঁস করেছিল। ভারত যে বাংলাদেশকে তার ‘রাডার’-এর বাইরে যেতে দেবে না সে খবরও আমরা ‘আউটলুক’-এর বদৌলতেই জানতে পেরেছিলাম। পরবর্তীকালেও উইকিলিক্স-এর ফাঁস করা গোপন খবরসহ অনেক তথ্যই প্রকাশ করেছে ‘আউটলুক’। একই ‘আউটলুক’-এর সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ভারত বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই আবারও ক্ষমতায় আনতে চায় এবং সে উদ্দেশ্যে দেশটি তার কার্যক্রম শুরু করেছে। এ কার্যক্রমকে ম্যাগাজিনটি বলেছে ‘কৌশল’। কৌশলও ভারত নাকি চূড়ান্ত করে ফেলেছে। ‘আউটলুক’-এর রিপোর্টে এমন কিছু তথ্য রয়েছে, যেগুলো ‘আকেলমন্দদের’ জন্য ‘কাফি’ বা যথেষ্ট। যেমন রিপোর্টের এক অংশে বলা হয়েছে, ভারত যেখানে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনার চেষ্টা চালাচ্ছে সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে এগোতে চাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিকল্পনায় জামায়াতে ইসলামীরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ বা অবস্থান রয়েছে। রিপোর্টে জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ৮০টি আসনে জয়ের জন্য জামায়াতের ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জামায়াত বিএনপির ঘনিষ্ঠ মিত্র, আওয়ামী লীগের নয়। সে কারণে জামায়াতের ব্যাপারে ভারতের মনোভাব নেতিবাচক। ভারত চায়, যুক্তরাষ্ট্রও ‘মৌলবাদী’ দল জামায়াতকে শত্রু শিবিরে ঠেলে দিক এবং ভারতের পরামর্শ অনুযায়ী বাংলাদেশের সেক্যুলার দলগুলোর পক্ষে দাঁড়াক। অন্যদিকে জামায়াতের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও মনোভাব কিন্তু ভারতের মতো নয়। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন জানাচ্ছে না। ওয়াশিংটন বরং জানিয়ে দিয়েছে, বিচারে কোনোরকম অনিয়ম এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হলে যুক্তরাষ্ট্র তা সহ্য করবে না। যুক্তরাষ্ট্রের এই বক্তব্য ও মনোভাব শেষ পর্যন্ত জামায়াতের পক্ষে যাচ্ছে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ‘আউটলুক’ একই সঙ্গে তিনটি তথ্য জানিয়েছে। এক. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই ভারত আবারও ক্ষমতায় আনতে চায় এবং এ ব্যাপারে দেশটি তার কৌশলই শুধু চূড়ান্ত করেনি, কার্যক্রমও শুরু করেছে। দুই. ভারত শেখ হাসিনাকে নিয়ে এগোলেও যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে অন্য পরিকল্পনা। সে পরিকল্পনায় বেগম খালেদা জিয়ার পাশাপাশি জামায়াতের অবস্থানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, জাতীয় সংসদের অন্তত ৮০টি আসনে জামায়াত প্রধান নির্ধারক শক্তি; এবং তিন. ‘মৌলবাদী’ দল এবং ‘দানব’ হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা চালানো হলেও জামায়াতের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই প্রমাণ করা যায়নি। কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন জানাচ্ছে না। বড়কথা, শেখ হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ভারত তাই বলে পিছিয়ে যায়নি। দেশটি বরং এমন কৌশল নিয়েই এগোচ্ছে যাতে আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার সামনে কোনো কিছুই প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে না পারে।
১/১১ ঘটানো থেকে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে ঘনিষ্ঠভাবে ভারতের ‘সঙ্গে’ থাকলেও বর্তমান পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন আলাদা কোনো পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে এবং সে পরিকল্পনায় বিএনপির পাশাপাশি কেন জামায়াতে ইসলামীকেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দিয়েছে সে প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি হলেও বর্তমান নিবন্ধকে শুধু ভারত প্রসঙ্গে সীমাবদ্ধ রাখা হবে। ‘আউটলুক’ যেহেতু শেখ হাসিনাকেই ক্ষমতায় আনার খবর জানিয়েছে সেহেতু ভারতীয়দের বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতাকেন্দ্রিক নীতি-মনোভাবকে সামনে আনাটা বেশি দরকার। কারণ, পর্যালোচনায় দেখা যাবে, বিশেষ করে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতীয়দের রাষ্ট্রক্ষমতাকেন্দ্রিক তৎপরতা অনেক বেড়ে গেছে। এ ব্যাপারে প্রথম প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল পিলখানা হত্যাকা-ের সময়। এ প্রসঙ্গে ‘উইকিলিকস’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে ভারতেরই দুটি প্রভাবশালী দৈনিকে প্রকাশিত খবরের কথা স্মরণ করা যায়। ২০১১ সালের ২৭ মার্চ দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’ এবং ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’ জানিয়েছিল, পিলখানায় কথিত বিডিআর বিদ্রোহের পর ‘সাহায্য চেয়ে’ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকে টেলিফোন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রণব মুখার্জি ‘ইতিবাচক সাড়া’ দিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রয়োজন অনুযায়ী’ সাহায়তা করা হবে। এটুকুই সব নয়, সাহায্যের জন্য ‘সুনির্দিষ্ট অনুরোধ’ যাওয়ার পর রাতারাতি ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্যারাস্যুট রেজিমেন্টকে আগ্রা থেকে পশ্চিম বঙ্গের কালাইকুন্ডে নিয়ে আসা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে এই রেজিমেন্টের সেনাদেরই বিমানযোগে বাংলাদেশে নামানো হয়েছিল, বাংলাদেশ যাদের ‘নখদর্পণে’ ছিল। ওদিকে কলকাতা ও আসামে ‘প্রস্তুত’ ছিল ভারতীয় বিমান বাহিনীর বোমারু বিমান। এসব খবর সে সময় ভারতের সংবাদ মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছিল। অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকারকে ‘সাহায্য’ করার জন্য ভারত রীতিমতো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল আর এসব কর্মকা-ের নেতৃত্বে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। এখানে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে অন্য একটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তথ্যেরও উল্লে¬খ করা দরকার। তথ্যটি হলো, পিলখানা হত্যাকা-ের ঠিক প্রাক্কালে, ২০০৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ১০ ঘণ্টার এক ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসেছিলেন প্রণব মুখার্জি। ওই সফরকালে বিরোধী দলের নেত্রী এবং তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করলেও তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ’র সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেছিলেন। এই বৈঠক নিয়ে সে সময় জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হয়েছিল। বলা হয়েছে, এর ক’দিনের মধ্যে সংঘটিত পিলখানা হত্যাকা-কে বিবেচনায় নেয়া হলে নাকি প্রণব মুখার্জির ওই সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে!
উল্লেখযোগ্য অন্য একটি তথ্য হলো, ভারতের মিডিয়া তখন থেকেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভয়ংকর তথ্যযুদ্ধ শুরু করেছিল। ভারতীয় প-িতরা সে সময় নিজেদের মহাআবিষ্কারের তথ্য জানিয়েছিলেন। নিজেদের মনের মতো করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও হাজির করেছিলেন তারা। বলেছিলেন, বিডিআরের কথিত বিদ্রোহ সফল হলে নাকি ‘ডানপন্থী’ বিএনপি ও ‘ইসলামপন্থী’ জামায়াতে ইসলামীর জোট ক্ষমতায় ফিরে আসতো! বিডিআর বিদ্রোহের ‘ষড়যন্ত্র’ নাকি সে উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়েছিল এবং ষড়যন্ত্রের নাকি দীর্ঘমেয়াদী ‘গেম প্ল¬¬¬্যান’ও ছিল! পরবর্তীকালেও বিভিন্ন সময়ে ভারতের সে প-িতদের দৃশ্যপটে দেখা গেছে। যেমন ২০১২ সালের জানুয়ারিতে কথিত ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পরপর উল্লে¬খযোগ্যদের মধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষস্থানীয় গবেষক ও নীতিনির্ধারক ভাস্কর রায় এবং প্রবীণ সাংবাদিক ও কূটনীতিক কুলদিপ নায়ার বলেছিলেন, সেবারও নাকি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতা দখল করার লক্ষ্য নিয়েই অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছে। ভাস্কর রায়ের অভিমত ছিল, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মাদরাসা ছাত্রদের ব্যাপকভাবে সেনাবাহিনীতে ঢোকানো হয়েছিল এবং তারাই অভ্যুত্থান চেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়েছে! কুলদিপ নায়ার বলেছিলেন, শেখ হাসিনার সরকার ইসলামী মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে বলেই সেনাবাহিনীর ভেতরে ধর্মান্ধ ইসলামিস্টরা অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। মিস্টার নায়ারের মতে ব্যর্থ ওই অভ্যুত্থান দিল্লী¬র জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে এসেছে এবং দিল্লীর উচিত বাংলাদেশের জনগণকে জানিয়ে দেয়া, শেখ হাসিনাকে রক্ষার জন্য দিল্লী¬ ‘যে কোনো সীমা পর্যন্ত’ পদক্ষেপ নেবে। অর্থাৎ প্রয়োজনে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে হলেও শেখ হাসিনাকে রক্ষা করবে। ওদিকে কলকাতার প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার লিখেছিল, ব্যর্থ অভ্যুত্থানের তথা বিএনপি ও জামায়াতের আসল লক্ষ্য নাকি ছিল নয়াদিল্লী!
প-িত নামধারীরা শুধু নন, ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময়ে যথেষ্টই দেখানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর কিছু বক্তব্য উল্লেখ করা দরকার। ২০১১ সালের ২৯ জুন ভারতীয় সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনার সরকারের ভুয়সী প্রশংসা করে ড. মনমোহন সিং বলেছিলেন, এই সরকার ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দমনের ব্যাপারে ভারতকে ‘ব্যাপক সহযোগিতা’ দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বর্তমানে খুবই ভালো এবং সাম্প্র্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ‘বিশেষ পর্যায়ে’ পৌঁছেছে। মনমোহন সিং একই সঙ্গে আরো বলেছিলেন, বাংলাদেশের অন্তত ২৫ শতাংশ মানুষ জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক এবং তারা তীব্র ভারতবিরোধী। জামায়াত বাংলাদেশে ‘যে কোনো সময়’ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটাতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর এই বক্তব্য গুরুতর হিসেবে শুধু নয়, বাংলাদেশের জন্য ভীতিকর হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছিল। সে সময় প্রশ্ন উঠেছিল, ভারতের প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের ‘ব্যাপক’ সহযোগিতা থাকার পরও বাংলাদেশে কিভাবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা দেখেছিলেন মনমোহন সিং? এখানেই হিসাব মেলাতে গিয়ে গোল বেঁধেছিল। কারণ, একথা এতদিনে সাধারণ মানুষও জেনে গেছে যে, ডিজিটাল নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো এবং শেখ হাসিনার সরকারকে দিয়ে একের পর এক নিজের ইচ্ছা পূরণ করিয়ে নেয়া পর্যন্ত সবকিছুর পেছনে ভারতই প্রধান ভূমিকা পালন করে এসেছে। এ অনুমানও সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ভারতের ইচ্ছা ও পছন্দের বাইরে অন্য কোনো দল বা নেতার পক্ষে বাংলাদেশের ক্ষমতায় যাওয়া সহজে সম্ভব নয়। অর্থাৎ কোনো কারণে পটপরিবর্তন যদি ঘটেও যায় তাহলে তার পেছনেও ভারতেরই ‘হাত’ বা ভূমিকা থাকবে। এজন্যই পর্যবেক্ষকরা সন্দেহ করেছিলেন, ২০১০ সালের জানুয়ারিতে স্বাক্ষরিত সমঝোতাচুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়াসহ কিছু কিছু কারণে শেখ হাসিনা ঘাড় বাঁকাতে শুরু করেছিলেন বলেই বাংলাদেশ সফরে আসার প্রাক্কালে মনমোহন সিং তাকে প্রকারান্তরে ধমক দিয়েছিলেন। এমন অনুমানের কারণ, ‘২৫ শতাংশ’ বলতে প্রায় চার কোটি বাংলাদেশীকে বোঝায়। জামায়াতের পেছনে এত বিপুল মানুষের সমর্থন থাকলে আর যা-ই হোক, আওয়ামী লীগ অন্তত ক্ষমতায় আসতে পারতো না। কথাটা ভারতের প্রধানমন্ত্রীরও অবশ্যই জানা ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি বলেছিলেন বলেই ধরে নেয়া হয়েছিল, এর মধ্য দিয়ে মনমোহন সিং একদিকে শেখ হাসিনাকে মধুর একটি ‘ধমক’ দিয়েছিলেন, অন্যদিকে উস্কানি দিয়ে বলেছিলেন, জামায়াত যেহেতু ‘যে কোনো সময়’ পটপরিবর্তন করতে তথা সরকারের পতন ঘটাতে পারে সেহেতু শেখ হাাসিনার উচিত জামায়াতকে ‘শায়েস্তা’ করা।
বলা হচ্ছে, মূলত ভারতের হুকুম তামিল করার জন্যই কিছুদিন ধরে জামায়াতের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতন চালাচ্ছে সরকার। তালিকায় স্বাভাবিক কারণেই এসেছে বিএনপি। এর পাশাপাশি শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় আনা সংক্রান্ত ‘আউটলুক’-এর খবর সত্য হলে এমন মনে করাটাই সঙ্গত যে, আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তিকে নির্মূল করে দেয়ার ‘কৌশল’ হিসেবে শেখ হাসিনার সরকারকে সামনে রেখে ফ্যাসিস্ট কর্মকা- আসলে ভারতই চালাচ্ছে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা সম্ভবত ভেবেছেন, এভাবেই তারা শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় আনতে পারবেন। বলা হচ্ছে, একই উদ্দেশ্যের ভিত্তিতেই সবশেষে দৃশ্যপটে এসেছে আনন্দবাজারীরা। ভারতের মদতে মঞ্চায়িত শাহবাগ নাটক ব্যর্থ হয়েছে ও ধরা পড়ে গেছে বলেই নাস্তিক ব্লগারদের জন্য ‘লাইফ সাপোর্ট’ নিয়ে হাজির হয়েছে তারা। তাদের এ চেষ্টার মধ্যেও বাংলাদেশের জন্য নতুন পর্যায়ে উদ্বেগের উপাদান রয়েছে। এখন দেখার বিষয়, ভারতের একার ইচ্ছা অনুসারেই সবকিছু ঘটে কি না এবং হত্যা ও নির্যাতনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে ইচ্ছাধীন করে ফেলা সম্ভব হয় কি না। মাঝখানে বিএনপি ও জামায়াতসহ জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও যে রয়েছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও যে রয়েছে পৃথক পরিকল্পনাÑ সেসব কথাও বিবেচনায় রাখা দরকার।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন