সঙ্কট উত্তরণের প্রধান উপায় হলো সঙ্কটের অস্তিত্ব স্বীকার করা। বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে একটা ভয়াবহ সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে; এটি উপলব্ধি করে সম্মানিত ব্যক্তিরা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যার যার দায়িত্ববোধ থেকে সঙ্কট সমাধানে সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সরকার এই হাত বাড়িয়ে দেয়াকে কোনো মূল্য তো দিচ্ছেই না উপরন্তু সবাইকে ধমকের সুরে অপমান-অপদস্থ করছে। সরকার জানে সুশাসন উপহার দিতে এবং জনজীবনের বিরাজমান সমস্যা সমাধানে তারা শুধু ব্যর্থই হয়নি, অত্যন্ত চরমভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। তাই নির্দলীয় সরকারে অধীনে নির্বাচনে আবার মতায় যাওয়ার সম্ভাবনা নেই জেনে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে নানা ফন্দি-ফিকির করছে।
কিন্তু বর্তমানে সর্বগ্রাসী সঙ্কটের মধ্যে একতরফা কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে জয় লাভ করে আবার মতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এই নির্মোহ সত্যটি শাসক দলকে অনুধাবন করতে হবে এবং এই বিপজ্জনক পথ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
মতার মোহে অন্ধ হয়ে রাজনীতি নিয়ে বিপজ্জনক খেলা শুরু হয়েছে। এই খেলার শেষ কোথায় তা কেউ জানে না, কোথাও কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। অনিবার্য ধ্বংস ছাড়া এই বিপজ্জনক খেলার পরিসমাপ্তি ঘটবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। কেননা এই খেলা যারা খেলছেন, নিশ্চয় তাদের একটা সুস্পষ্ট ল্য-উদ্দেশ্য আছে; উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তারা এখন মরিয়া হয়ে সঙ্কট সৃষ্টি করে চলেছেন।
বর্তমানে দেশে যে সঙ্কট চলছে, তা গত তিন বছর আগেও বাংলাদেশে ছিল না। সমস্যাগুলো সুকৌশলে সৃষ্টি করা হয়েছে; আর তা করেছে বর্তমান সরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের মধ্য দিয়ে মূলত সঙ্কটের আবির্ভাব। সরকার একতরফা আদালতের ওপর দায় চাপিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে। উচ্চ আদালত বাংলাদেশে বর্তমানে যে অবস্থা তাতে আরো দু’টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মত দিয়েছেন। কিন্তু সরকার আদালতের মতকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি; আর তাতেই সঙ্কটের সূত্রপাত, এই সঙ্কট এখন প্রান্তসীমায় এসে পৌঁছেছে। তাতে দেশ এক অস্থির, অশান্ত ও বেদনাবহ সময় অতিক্রম করছে। সুযোগ সন্ধানী মানুষগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে তাদের স্বার্থ আদায়ে। এদের জন্য বর্তমান সয়ম খুবই সহায়ক।
নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাই সমাধানের েেত্র কারো বুদ্ধিবৃত্তিকতার ছাপ পরিলতি হচ্ছে না। প্রত্যেকটি ঘটনাতেই অযাচিতভাবে শক্তি প্রয়োগ করার প্রবণতা ল করা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনগণকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করানো হচ্ছে; যা কোনোভাবেই কাক্সিত ও কাম্য নয়। এমন একটা অবস্থায় গিয়ে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে, সাধারণ মানুষের মিছিল দেখলেই পুলিশ সরাসরি গুলি চালাচ্ছে। যেমন গুলি চালায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি পুলিশ। গত কয়েক মাসে পুলিশের গুলিতে প্রায় ২০০ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে হাজার হাজার, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, রাষ্ট্রের ভিত্তিও জনগণ; এই জনগণকে নির্বিচারে পাখির মতো হত্যা করে রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। এই প্রবণতার ফলে রাষ্ট্র ভেতরে ভেতর য় হয়ে যাচ্ছে, একটা ঘটনা থেকে আরেকটা ঘটনার সূত্রপাত হচ্ছে। ধর্ম নিয়ে কটূক্তি ও অশালীন ভাষায় গালমন্দ করা হচ্ছে। তাতে ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার, তাদের বাড়িঘর, ব্যবসায়প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে, যা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ঘটেনি।
অন্য দিকে অত্যন্ত সুকৌশলে ইসলাম ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। এর মাধ্যমে জাতিকে করা হয়েছে সুস্পষ্টভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। এই বিভক্তি ধীরে ধীরে চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে, সূত্রপাত হচ্ছে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের; ঘরে ঘরে ভাইয়ে ভাইয়ে সৃষ্টি হচ্ছে বিরোধ, একে অপরের বাড়িঘর ও ব্যবসায়প্রতিষ্ঠান আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। ধ্বংস করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। দিন যত যাচ্ছে এটা বেড়েই চলেছে এবং ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে যাচ্ছে। এটার লাগাম কোথায়, কেউ জানে না। সব সামাজিক শক্তি এখন মুখোমুখি। একে অপরকে ধ্বংস করতে ভেতরে ভেতরে সবাই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে হয়। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া এই খেলা বন্ধ করার কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না।
খেলতে খেলতে সঙ্কটকে এমন এক জায়গায় নিয়ে দাঁড় করানো হচ্ছে, যাতে বাইরের হস্তপে অনিবার্য হয়ে ওঠে; একবার যদি বাইরের হস্তপে হয়, তা হলে এ থেকে বেরিয়ে আসা বাংলাদেশের জন্য কঠিন হয়ে যাবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। কাজেই রাজনীতিবিদদের বোধোদয় হতে হবে। রাজনীতি নিয়ে বিপজ্জনক খেলা বন্ধ করতে হবে। শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দিতে হবে। হামলা-মামলা ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ পরিষ্কার করতে হবে। একতরফা নির্বাচনের ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফলতে হবে। চলমান সর্বগ্রাসী সঙ্কট থেকে দেশকে বেড় করে আনতে মতাসীনদের আরো দায়িত্বশীল ও উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি সঙ্কট দূর করে দেশকে নির্বাচনমুখী করতে হবে। দেশ নির্বাচনমুখী হলেই সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে। মানুষ আশ্বস্ত হবে, মানুষের মাঝে স্বস্তি ও শান্তি ফিরে আসবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন