কদিন আগে শুরু হয়েছে ১৪২০ বাংলা সাল। বাংলা সালের প্রথম দিন আশা জাগিয়ে গেল সমাজের নানা স্তরের মানুষের মধ্যে। মোঘল বাদশাহ আকবরের আমলে আমীর ফতেহ উল্ল¬াহ সিরাজী যে বাংলা সালের প্রবর্তন করেন, সেটা সবাই নতুন করে মনে করলেন। অনুভব করলেন বাঙালি সংস্কৃতি ও সালের মূল শেকড়কে। আরবি হিজরি সনের কাঠামোয় বাংলা সনের প্রবর্তন শুধু বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গই নয়, তাবৎ উপমহাদেশের জন্যেই এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
বাংলা সনের মধ্যে লুকিয়ে আছে আশাবাদ। ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর ডাক। এর আরেক নাম ফসলি সন। আছে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির কথা। মানুষ যে রাজনীতি বা সংস্কৃতিই ধারণ করুক না কেন, মূলগত দিক থেকে সে শান্তি, কল্যাণ আর মৈত্রীর পিয়াসী। বাংলা সাল সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা সে কথা কতটুকু মনে রাখতে পারি? ঈদ, পদবী, ক্ষমতার কাছে জিম্মি হলে শান্তি, কল্যাণ আর মৈত্রী ইত্যাদি সুবাসিত কথা অনেকেরই মনে থাকে না। আমরা যা নেই, সেটার জন্য দুঃখ করতে পারি। চেষ্টা করতে পারি, যা আছে তাকে এগিয়ে নিতে। আমাদের ধর্ম, গণতন্ত্র, সংস্কৃতি, ভাষা, মূল্যবোধ ইত্যাদি এখনও অটুট আছে। আমরা পরাভব মানি না অসত্যের কাছে। এই শক্তি আমাদের চিরন্তন প্রেরণা। এই প্রেরণাতেই জাতি পথ চলে।
আশা জাগানিয়া বাংলা নববর্ষে শুভবোধ ও কল্যাণের পথে এগুনোর শপথই প্রধান। এই শপথ কোনও ক্ষুদ্র স্বার্থের গ-িতে; জাতিবিরোধী শক্তির কাছে বিলীন যাতে না হয়, সেটাই বলে গেছে বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষে শোনা যায় নিজস্ব সংস্কৃতি বিকাশের আহ্বান। ডাক দেয়া হয় বিদেশী সংস্কৃতি, আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধেও। এর প্রয়োজন আছে। তথ্য-প্রযুক্তির যুগে বিজাতীয় সংস্কৃতি এসে আমাদেরকে প্রবলভাবে গ্রাস করছে। আমাদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ধর্ম, পোশাক, জীবন-যাপন, খাদ্যাভ্যাসকে বিনষ্ট করছে। আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে কলুষিত করছে। এমন অবস্থা মেনে নেয়ার উপায় নেই। এ কারণেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বমহল থেকে প্রতিবাদ উচ্চারিত হচ্ছে।
বাংলা নববর্ষ এদেশের মানুষকে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে বলে। নিজস্বতার অনুসরণ করতে বলে। নিজের যা আছে, সেটা ত্যাগ করে অপরের অন্ধ অনুকরণে নিষেধ দেয়। জ্ঞান ও ইতিহাসচেতনার অভাবহেতু সমাজে অনেককেই গড্ডলিকা প্রবাহে মিশে অন্ধ অনুকরণ করতে দেখা যায়। বিশেষ করে তরুণ-তরুণী প্রজন্ম এক্ষেত্রে কিছুটা বিভ্রান্ত ও বেলেল্লাপনার পথে চলে যায়। এর ফলে সামাজিক সংস্কৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। এটা হতে দেয়া উচিত নয়। কারণ এতে জাতীয় সত্ত্বার মূল ¯্রােতে আধিপত্যবাদের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা তৈরি হয়।
মানুষ যেখানে আছে, সমাজ যেখানে আছে, সেখানে সংস্কৃতি থাকবেই। তবে সে সংস্কৃতি হতে হয় মানুষ আর সমাজের উপযোগী। আমেরিকার কৃষক আবহাওয়া ও নিজস্ব সংস্কৃতির কারণে প্যান্ট পরে ট্রাকে চেপে চাষ করে। শীতের কারণে এবং আবহাওয়ার প্রয়োজনেই সে সেটা করে। বাংলাদেশের কৃষক গরম আবহাওয়ার কারণে এবং নিজস্ব সংস্কৃতির প্রয়োজনে গামছা ও লুঙ্গি ব্যবহার করে। এখন যদি বাংলাদেশের কৃষককে প্যান্ট আর আমেরিকার কৃষককে লুঙ্গি পরানো হয়, তবে সেটা আধুনিক সংস্কৃতি হবে না। হবে বিকৃতি। ইউরোপের মেয়েরা সারা বছর শীতে জবুথবু হয়ে বসন্তে বিকিনি পরে প্রায়-উলঙ্গ হয়ে যায়। বাংলাদেশের গরম আবহাওয়ায় মেয়েরা সেটা করতে গেলে পরিবেশ ও সমাজ মানবে না। ধর্ম ও নৈতিকতাও সহ্য করবে না। অতএব সংস্কৃতি পালন করতে গেলে লক্ষ্য রাখতে হয়, যেন নিজস্বতা কোনওভাবেই খর্ব না হয়।
নববর্ষ নিজস্বতার ডাক দেয়। আধুনিকতার নামে সমাজ-বহির্ভূত কিছু করতে বলে না। সব কিছুই করা যাবে ধর্ম, ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং নিজস্ব সভ্যতার আলোকে। যেখানে শ্রদ্ধা থাকবে, সম্মান থাকবে, ¯েœহ থাকবে, ভালোবাসা থাকবে। মুক্ত বিহঙ্গের মতো উদ্দাম উড়ে বেড়ালেই সংস্কৃতি হবে, তা কিন্তু নয়। কিছু না বুঝে পোশাক আর অঙ্গসজ্জা পরিবর্তন করলেও সেটা সংস্কৃতি হবে না। হয়ে যাবে বিকৃতি। এই বিকৃতি রোধ করা দরকার। সমাজে শুভতার সঙ্গে বিকৃতিও থাকে। আমরা শুভকে গ্রহণ করবো আর বিকৃতিকে বর্জন করবো। তবেই সকলের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ সংস্কৃতির বিকাশ সাধিত হবে। বাংলাদেশ আর্থ-রাজনৈতিক দিক থেকে যেভাবে বিকৃতি ও আগ্রাসনের শিকার, তাতে এখানে ভারসাম্যপূর্ণ সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জরুরি দায়িত্ব রয়েছে। এ দায়িত্ব সমাজের সকলকে গ্রহণ করতে হবে। নইলে আমাদের নিজস্বতা আগ্রাসন ও বিকৃতির কবলে ধ্বংস হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে হাজার বছরের ইতিহাস পাড়ি দিয়ে আজকের জায়গায় এসে পৌঁছেছে। হঠাৎ কোনও হটকারিতার মাধ্যমে ইতিহাসের গতিপথকে নষ্ট করা যাবে না; করা ঠিকও হবে না। আশেপাশে অনেকেই লুকিয়ে আছে, যারা বাংলাদেশের ধর্ম, সংস্কৃতি, বিশ্বাসকে নিয়ে লুকোচুরি খেলছে। ধর্মনিষ্ঠ মানুষের দেশে নাস্তিক্যবাদ, সেক্যুলারিজম, উদার ও অবাধ মেলামেশা ইত্যাদির মাধ্যমে নীতি-নৈতিকতার অবসান ঘটাতে চায়। মানুষের ধর্ম, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির বারোটা বাজাতে চায়। এরা পশ্চিমা সংস্কৃতির দাস। এরাই পৌত্তলিকতাবাদের অনুচর। এরা কখনওই এদেশের প্রধান শক্তি নয়। কিন্তু এরাই যখন তাদের লঘু বিষয়কে জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়, প্রধান সেজে বসে, তখন আশঙ্কার কারণ ঘটে বটেই। এ আশঙ্কা দূর করার কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। বুদ্ধিজীবী, ধর্মচিন্তক, সমাজপতিদেরকে একাট্টা হয়ে সাংস্কৃতিক আপদের নামে ক্রমঅগ্রসরমান নাস্তিক্যবাদ ও পৌত্তলিকতাবাদকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হবে। মানুষের কাছে মানুষের বিশ্বাস ও মূল্যবোধনির্ভর মৌলসংস্কৃতিকে পৌঁছে দিতে হবে। মানুষ কখনওই নিজের মৌলিক জায়গাটিকে ছেড়ে দিতে পারে না। যে মানুষ ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষার জন্য যুদ্ধ করে জীবন দেয়, সেদেশে আগ্রাসনের মাধ্যমে কিছু চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হবে না। মিডিয়া বা অন্য কোনও উপায়ে ভিন্নধর্মী কিছু করার চেষ্টা করা হলে, সেটা মানুষ গ্রহণ করবে না। চমক বা চটক দেখিয়ে অল্প দিনের জন্য অল্প কিছু মানুষকে বিপথগামী করা গেলেও জাতির মূল¯্রােতধারাকে কদাচ বিভ্রান্ত করা যায় না। উপনিবেশিক ব্রিটিশ খ্রিস্টবাদীরা অতীতে যা পারে নি, আজকের নাস্তিক্যবাদীরাও সেটা পারবে না। বাংলা নববর্ষ, ঈদ, রমজান ইত্যাদি সর্বকল্যাণময় বিশ্বাসী সাংস্কৃতিক জীবনাচারের বাংলাদেশে নাস্তিক্যবাদ ও পৌত্তলিকতাবাদের মূর্তি, প্রতীক, আগুন, আলপনা ও নৃত্য আগ্রাসন চালাতে পারবে না। বিশ্বাসী মানুষ নিজের একত্ত্ববাদী সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক বিশ্বাসের সবুজ-শীতল ছায়াতেই খুঁজে পাবে স্থায়ী আশ্রয়। বিকৃতি ও ষড়যন্ত্রের কতিপয় ক্ষুদ্রতার মধ্যেও বাংলা নববর্ষ বিশ্বাসীদের মধ্যে এই আশাই জাগিয়ে গেল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন