বাস্তবতার নিরিখে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সুস্পষ্ট একটি রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছেন। তার এই রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে মতাসীন মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। মতাসীন দলের একেকজনের মুখ থেকে বারুদের মতো বক্তৃতা বের হচ্ছে। কেউ বলেছেন, খালেদা জিয়াকে পাকিস্তান চলে যেতে। কেউ বলেছেন, খালেদা জিয়া সন্ত্রাসীদের নেত্রী। আবার কেউ বলেছেন, খালেদা জিয়া গণতন্ত্র ধ্বংসের খেলায় মেতেছেন। আর অন্যরা যে যা বলেছেন, প্রয়োজনবোধে সেসব কথা বলা থেকে বিরত থাকলাম। কেননা মতাসীনদের মাথা এখন ঠিক নেই। চতুর্মুখী চাপে তারা এখন চোখে সরষে ফুল দেখছেন। তাদের সব দুরভিসন্ধি ভেস্তে যেতে বসেছে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি আদর্শে বিশ্বাসী মানুষ এক মঞ্চে সমবেত হচ্ছে, তারা ইস্পাত কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, যার জন্য শাসকগোষ্ঠী খালেদা জিয়াকেই এখন প্রধান বাধা মনে করছে, তার বিরুদ্ধে নোংরা ও চরিত্রহানিকর মন্তব্য করছে; হুকুমের আসামি করে তাকে গ্রেফতারের হুমকি দেয়া হচ্ছে, তার কার্যালয়ে সন্ত্রাসীদের দিয়ে গুলিবর্ষণের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। সরকার যে কতটা নার্ভাস ও অস্থিরÑ বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের গুলির ঘটনায় অনুমান করা যায়।
বস্তুত খালেদা জিয়া একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, একটি রাজনৈতিক বলয়ের নেত্রী। খালেদা জিয়া বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন। বাংলাদেশের প্রয়োজনে খালেদা জিয়া যেকোনো রাজনৈতিক অবস্থান নিতে পারেন। তাতে এত বিচলিত ও অস্থির হওয়ার কী আছে, সরকারের অস্থিরতা দেখে মনে হয়; খালেদা জিয়া সঠিক সময়ে সঠিক কাজটিই করেছেন। তিনি দেশ রায় রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। তার রাজনৈতিক অবস্থানে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি শক্তি আপন বলীয়ানে উজ্জীবিত এবং এক মহাশক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। এই শক্তি এখন ফ্যাসিবাদের বিষদাঁত ভেঙে দেবে। গণতন্ত্রের শত্রু ও তাদের দোসরদের মুখোশ উন্মোচন করবে।
খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে দেখলেন, মতাসীনদের অপরিণামদর্শী রাজনীতির কারণে দেশে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেশজুড়ে পুলিশের গুলিতে শুধু লাশ আর লাশ পড়ছে। সিভিল প্রশাসন একবারে ভেঙে পড়েছে। বাংলাদেশের অনেক উপজেলা জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পর্যটন শহর কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ ছয় দিন ধরে রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন। প্রায় ৪০টি জেলার জেলা প্রশাসকেরা তাদের এলাকা ও নিজেদের নিরাপত্তা চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। বিভিন্ন জেলায় সংসদ সদস্য ও সরকারি দলের নেতাকর্মীরা প্রশাসনের কাছে নিরাপত্তা চেয়েও নিরাপত্তা পাচ্ছেন না। যারা নিরাপত্তা দেবেন, তারা উল্টো সরকারের কাছে নিরাপত্তা চাচ্ছেন।
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে, জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে তাদের বাড়িঘর, ব্যবসায়প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয়। হামলা হচ্ছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। অকাতরে ধ্বংস হচ্ছে দেশের সম্পদ। জাতির বিভক্তি চরমপর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এমন অবস্থায় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং অনিশ্চয়তা দূর করতে খালেদা জিয়া যেকোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। দেশের যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে আহ্বান জানাতে পারেন দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে। এটা তার রাজনৈতিক কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। যারা খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নোংরা, অশালীন মন্তব্য করছেন বরং তারাই কর্তব্য পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। কোথাও তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না, পরিস্থিতির ওপর তারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে দেশে তাৎণিক স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে, তিনি রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। এর নামই হচ্ছে নেতৃত্ব, দেশের সঙ্কটময় মুহূর্তে নেতৃত্ব প্রকাশই দুরদর্শী নেতৃত্বের পরিচায়ক। মতাসীন মহলের ব্যাপক প্রতিক্রিয়াতেই খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অবস্থানের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়।
রাজনৈতিক বিভাজন প্রত্যেক দেশেই আছে, আছে আদর্শগত বিরোধও, তাই বলে কি একে অপরকে ধ্বংস করার খেলায় মেতে উঠতে হবে? শাসক দলের রাজনৈতিক অবস্থান প্রতিপকে একেবারে সমূলে বিনাশ করে দেয়া। দেশকে বিপন্ন করা। খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে অরাজনৈতিক ও কটূক্তিপূর্ণ বক্তৃতা দেয়া এবং তাকে গ্রেফতারের হুমকি দেয়া, অন্য দিকে বিএনপির শীর্ষনেতাদের জামিন বাতিল করে পাইকারি হারে জেলে নেয়া বিএনপিকে উত্তেজিত করে তোলা। বিএনপি উত্তেজিত হলে এর প্রভাবে গোটা রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাতেই প্রভাব পড়বে। কেননা বিএনপি একটি সামাজিক শক্তিও বটে। আর সামাজিক শক্তিকে ধ্বংস করার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠা মানে রাষ্ট্রকে বিপন্ন করে তোলা। একে অপরকে ধ্বংস করার এমন আত্মঘাতী প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনীতিকে তার স্বাভাবিক নিয়মে চলতে দিতে হবে। একটি শতভাগ রফতানিমুখী দেশে বিভেদ-বিভক্তি ও বিভাজন তৈরি করা অস্বাভাবিক রাজনৈতিক খেলা ছাড়া আর কিছু নয়। তাতে বাংলাদেশ লাভবান হবে না, লাভবান হবে বাংলাদেশের শত্রুরা; পত্রিকায় খবর বের হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত কয়েক মাসে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের রফতানি অর্ডার চলে গেছে পাশের একটি বৃহৎ দেশে।
বিভক্তি ও বিভাজন নিয়ে কোনো জাতি সামনে এগোতে পারে না। দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ বিভক্তি ছড়িয়ে পড়েছে। এই বিভক্তি থেকে জাতিকে বের করে আনার কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় মানুষ চোখে সরষে ফুল দেখছে। কোথাও কোনো আশার বাণী তারা শুনতে পাচ্ছেন না, কেউ তাদের আশ্বস্ত করছে না। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, তাদের জিম্মি করে রাজনীতি হতে পারে না; নির্বিচারে হত্যাও সমস্যা সমাধানের পথ নয়।
সুতরাং মতাসীন দলকে তার রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে, হামলা-মামলা-হত্যা-নির্যাতন বন্ধ করতে হবে, বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে এবং তাদের মুক্তি দিতে হবে। সরকারকে অনুধাবন করতে হবে, নিরীহ মানুষ হত্যা, বিরোধী নেতাদের পৈশাচিক কায়দায় ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে ও রিমান্ডে নিয়ে এবং দ্রুত বিচার আইনে মামলা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়েছেÑ এমন নজির ইতিহাসে নেই।
সরকারের সামনে এখন দু’টি পথ খোলা আছে। প্রথমটি হলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের রায় মেনে নেয়া। দ্বিতীয়টি হলো যেকোনো কলাকৌশলে মতা হস্তান্তর না করে নিজেরাই মতা আঁকড়ে ধরে রাখা। আশা করি, সরকার প্রথম পথটি অনুসরণ করবে এবং অন্ধকার দূর করে দেশকে আলোর পথে নিয়ে আসবে এবং চরম বিপর্যয় থেকে দেশকে, দেশের গণতন্ত্রকে রা করবে।
সুতরাং সবাইকেই দেশের স্বার্থে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রা করতে হবে। এই ল্েয গণমাধ্যমকে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে। গণমাধ্যমের গঠনমূলক ও দায়িত্বশীল ভূমিকাই চলমান সঙ্কট থেকে দেশকে বের করে আনতে পালন করতে পারে নিয়ামকের ভূমিকা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন