সোমবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৩

মতিঝিলের মহাগর্জন ও শাহবাগের সান্ত্বনা


গত ২৩ মার্চ রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে আলেমদের নামে একটি সমাবেশ হয়েছে। এর ঠিক দুই সপ্তাহের মাথায় ৬ এপ্রিল একই স্থানে হয়েছে আলেমদের আরেক সমাবেশ। প্রথমটি সরকারের সার্বিক সহযোগিতায়। পরেরটি সরকারের সর্বাত্মক বিরোধিতার পরও সাফল্যের সাথে সম্পন্ন হলো। ২৩ মার্চ প্রধান বক্তা ছিলেন শোলাকিয়া ঈদগাহের বিতর্কিত ইমাম, শাহবাগের মঞ্চে একাত্মতা ঘোষণাকারী মাওলানা ফরিদউদ্দীন মাসউদ। ৬ এপ্রিলের প্রধান ব্যক্তিত্ব হাটহাজারী মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আহমদ শফী। ২৩ মার্চের সমাবেশের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় ও প্রচারণা হয়েছিল, তা সত্ত্বেও মঞ্চ থেকে নিচের দিকে প্রায় ৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে তাকিয়ে বক্তৃতা দিতে হয়েছে। মাত্র শ’ তিনেক লোক থাকা এর কারণ। আর ৬ এপ্রিল মঞ্চের বক্তারা প্রায় ০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে সামনে সুদূরে তাকিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। সমাবেশ যে সেদিন বিশাল ছিল, এটা তারই সাক্ষ্য দেয়। দু’টি সমাবেশই দেখার সুযোগ পেয়েছি। ২৩ মার্চের ুদ্র সমাবেশে লোকসমাগম ছিল অনেক পথসভার চেয়েও কম। বিরাট ও উঁচু মঞ্চটি লাগছিল বড়ই বেখাপ্পা। মঞ্চ থেকে ‘লাখো’ মানুষের উপস্থিতির কথা শুনে নিশ্চয়ই উদ্যোক্তারাও মনে মনে হেসেছেন। আর ৬ এপ্রিলের মহাসমাবেশে কত লাখ মানুষ এসেছিলেন, যারা তা দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই পেরেছেন উপলব্ধি করতে।

বেলা ১১টায় অফিসে যাওয়ার পথে মৎস্য ভবনের অদূরে ব্যারিকেডের পাশে পুলিশ এবং সাথে কিছু লোকজন দেখলাম। বোঝা গেল, শাহবাগের ‘অবরোধ’ এটা। প্রেস কাবের সামনে রাস্তার এক পাশে শার্ট-প্যান্ট পরা এক তরুণীর নেতৃত্বে একটি মিছিল সে দিনের হরতালের সমর্থনে পশ্চিম দিকে যাচ্ছিল। রাস্তার আরেক পাশ দিয়ে আলেমরা দল বেঁধে যাচ্ছিলেন পূর্ব দিকে। এর আগে দেখলাম, তারা হাঙ্গামা এড়াতে মিছিলটি থেকে দূরে সরে গেলেন। পল্টন মোড়ে তখন কড়া ব্যারিকেড পুলিশের। সেখান থেকেই হেফাজতে ইসলামের স্বেচ্ছাসেবীরা তৎপর। অবাক হলাম শাপলা চত্বরের মঞ্চ থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে পল্টন মোড় পর্যন্ত ওই সমাবেশ বিস্তৃত হতে দেখে। তখন বেলা ১১টার মতো। পরে লোক সমাগম বাড়তে বাড়তে প্রেস কাব, জিরো পয়েন্ট, বিজয়নগর, আর মতিঝিলের অপর পাশে দিলকুশা, আরামবাগ, কমলাপুরসহ বিস্তীর্ণ এলাকা জনসমুদ্রের তরঙ্গে প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল। অতীতে কোনো কোনো বড় দলের মহাসমাবেশ হয়েছে শাপলা চত্বরে। তখন শুধু প্রধান সড়ক ধরে দৈনিক বাংলা পর্যন্ত মানুষে ভরে গেলে পত্রিকায় লেখা হতো ‘ঐতিহাসিক’ জনসভা। সে হিসেবে ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘জনমহাসমুদ্র’।
অথচ এটা ঠেকাতে দিবানিশি হরতাল এবং দেশজুড়ে অসংখ্য স্থানে অবরোধ করানো হলো। কারা তাদের দিয়ে এসব করালেন তা দেশবাসী দেখেছেন। শাসনক্ষমতার নিকৃষ্ট নজির, সেদিন দেশজুড়ে সব যানবাহন বন্ধ করা। সেলুকাসের এই বিচিত্র দেশে সরকারও হরতাল-অবরোধ করিয়েছে সম্প্রতি। তবে ডে অ্যান্ড নাইট ক্রিকেট ম্যাচের মতো ডে-নাইট বা নাইট অ্যান্ড ডে হরতাল যে থাকতে পারে, তা এবারই প্রথম বিশ্ববাসী দর্শন করেছে। আমরা শান্তি, ঐক্য ও সুশাসনের রেকর্ড গড়তে না পারলেও দিবস-রজনী হরতালের রেকর্ড তো গড়েছি। তাতে ফায়দা হয়নি এতটুকুও। অতএব আত্মসান্ত্বনা লাভের ব্যর্থ প্রয়াস। ‘হেফাজতে ইসলাম জামায়াত-বিএনপিকে দূরে রেখেছে’, ‘মহাসমাবেশের মাধ্যমে নাশকতার পরিকল্পনা ব্যর্থ’, ‘হেফাজত শুধু এক দিন হরতাল দেয়ায় বিএনপি নাখোশ’ ইত্যাকার উক্তি শুনে একটি প্রবাদবাক্য মনে পড়ে যায়। তা হলো, উড়ো খই গোবিন্দায় নমঃ। এক লোকের হাত থেকে বাতাস খই উড়িয়ে নেয়ায় আর সেগুলো খেতে না পেরে সে নিজেকে সান্ত্বনা দিলোÑ এগুলো দেবতাকে উৎসর্গ করে দিলাম।
৫-৬ এপ্রিলে আহূত দিবারাত্র হরতাল ডাকা হয় ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ নামে। কয়েক দিন আগে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের  উদ্দেশে বলেছিলেন দিনের বদলে রাতে হরতাল দিতে। তিনি মশকারি করে বলেছিলেন কি না জানি না, তবে নিশ্চয়ই তিনি জানতেন, বিরোধী দল রাতে হরতাল দেবে না। অথচ সেই অদ্ভুত ও উদ্ভট কর্মটি করেছে শাহবাগের মঞ্চটির উদ্যোক্তারা। আর নাহিদদের মতো আওয়ামী বামরা এই মঞ্চের ব্যাপারে বেশি উৎসাহী।
ডে অ্যান্ড নাইট ক্রিকেট খেলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাইওনিয়ার হতে পারেনি। সে কমতি মিটে গেছে ডে-নাইট হরতালে। অবশ্য দেশের মানুষ বলেছে, এটা সরকারি হরতাল। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে  সমাজতন্ত্র যখন ফিরে এসেছে, তার আওতায় হরতাল জাতীয়করণ বা সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনাই তো স্বাভাবিক। গত ডিসেম্বরে জামায়াতের বিরুদ্ধে বামদের ডাকা একটি হরতাল সফল করার জন্যও সরকার নিষ্ঠার সাথে সর্বাত্মক প্রয়াসী হয়েছিল। হরতালে শত শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়- ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রীরা অহরহ বলে থাকেন। তবে তাদের আয়োজিত বা মদদপুষ্ট হরতাল বোধহয় ‘মিষ্টি হরতাল’ যা সুস্বাদু; আর দেশের অবর্ণনীয় ক্ষতি হলেও তা তখন বুঝি দেশেরই স্বার্থে।
এ প্রসঙ্গে কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম লিখেছেন, ‘এমন অভিনব ও সরকারি, রাতের হরতাল কখনও দেখিনি। দিনে শুরু হয় পরদিন সকালে শেষ হতে দেখেছি, কিন্তু রাতে শুরু হতে দেখিনি। …… কোনো দেশে কেউ কখনও রাতে হরতাল করেছে কি না জানি না। ৬ তারিখের হরতালের উদ্দেশ্যটা তেমন ভালো ছিল না।’
মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের জনসমুদ্রে ঢেউ ছিল, জলোচ্ছ্বাস ছিল না। এই মানবসাগর ছিল উত্তাল, তবে ঝঞ্ঝাুব্ধ ও সঙ্ঘাতসঙ্কুল নয়। এর জনারণ্যে শৃঙ্খলা, নেতৃত্বের আনুগত্য, শান্তিপ্রিয়তা, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, সহমর্মিতা দেখে সেকুলার ও বাম মহল বিস্মিত ও ঈর্ষান্বিত হওয়ার কথা। মতিঝিলের মহাগর্জন ছিল সচেতন সংগ্রামী জনতার বজ্রনির্ঘোষ বার্তা। এটা ছিল না নির্মূল রাজনীতির হিংসাশ্রয়ী উচ্ছৃঙ্খল উম্মাদনা।
তবুও মহলবিশেষের আশীর্বাদপুষ্ট ও পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিরা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বাঁকা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেননি। একজন প্রবাসী কলামিস্ট জনৈক ব্রিটিশ ব্যক্তির মুখ দিয়ে বানিয়েছেন, ‘ঢাকায় এসে এই এপ্রিলেই দেখি তার হরাইজন সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। মতিঝিল চত্বরে শুধু মানুষ আর মানুষ। শাহবাগের চেয়েও বড়। ওরা সহিংস, শাহবাগ অহিংস। ভয় হয়েছে, মুখোমুখি হলে শাহবাগ কি পারবে?’
যারা নিজেদের বাংলাদেশ সরকারের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ভাবেন, তাদের তো ভয় করার কথা নয়। তবে কারণটা হলো, সেই ৬ এপ্রিল মতিঝিল শুধু বড়ই ছিল না, শাহবাগের চেয়ে কত গুণ বেশি মানুষ সেখানে সমবেত হয়েছেন, তা হিসাব করতে গেলে মাথা ঘুরে যাওয়ার কথা। আর উল্লিখিত উদ্ধৃতিতে সহিংস ও অহিংস হওয়ার বয়ান প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছেও আজগুবি ও অবাস্তব ঠেকবে। সেদিন বিকেলে শাহবাগের কর্মীদের হামলায় শ্বেতশুভ্র শ্মশ্রুশোভিত বৃদ্ধের রক্তাক্ত মুখমণ্ডলের ছবি মিডিয়ায় সবাই দেখেছেন। এটা নিঃসন্দেহে অহিংসাপন্থী কারুকাজ হতে পারে না।
মহাসমাবেশ ‘সহিংস’ ছিল বলে যারা আবিষ্কার করেছেন, তাদের জন্য প্রণিধানযোগ্য হলো বিশিষ্ট কলামিস্ট ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর একটি লেখা। কোরেশী অবিভক্ত ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন যখন আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা মরহুম আবদুর রাজ্জাক ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। কোরেশী দৈনিক যুগান্তরে ১১ এপ্রিল তার কলামে লিখেছেন, ‘লংমার্চের সংগঠকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম যেন ইসলামের হেফাজতের পাশাপাশি বাংলাদেশের হেফাজতের বিষয়টি মনে রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে তাদের সাধুবাদ জানাতেই হয়। এত বাধাবিপত্তি ও উসকানির মুখেও তারা অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। তাদের শৃঙ্খলাবোধ, নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতা ছিল প্রশংসনীয়। দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম জনসমাবেশটির পরিচালনায় কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা দেখা যায়নি। কাঁটায় কাঁটায় নির্ধারিত সময় সকাল ১০টায় শুরু, নির্ধারিত সময় বিকেল ৫টায় সমাপ্তি। আমাদের বহু পুরানো ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতার দাবিদার রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ।’
শাহবাগের শুরুতে দাবি ছিল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি। অচিরেই তা সব ‘যুদ্ধাপরাধী’র ফাঁসিতে পরিণত হয়। কোনো বিচার নয়, সরাসরি রায়। তা-ও সর্বোচ্চ দণ্ড। দিনরাত ‘ঁফাসি ফাঁসি’ শুনে এবং এর ছবি দেখে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে একটি শিশু এবং রাজধানীর কাছে টঙ্গীতে আরেকটি শিশু ‘ফাঁসি খেলা’য় জীবন দিয়েছে। এই দু’টি মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য কারা দায়ী, তা বলার দরকার পড়ে না। শাহবাগে শুরুতে ছিল শুধু জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করার দাবি। পরে তা বিস্তৃত হয় ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে। শাহবাগ মঞ্চের মূল উদ্যোক্তা বামপন্থী এবং ক্ষমতাসীনদের ভেতরের উগ্র সেকুলারদের দাবি, সব ধর্মীয় দল নিষিদ্ধ করা। কিন্তু এই দাবির সাথে স্বঘোষিত নাস্তিক ব্লগারদের গোমর ফাঁসের ঘটনা মিলে শাহবাগের আন্দোলনে ধস নামিয়েছে। এখন তাদের অনেক পৃষ্ঠপোষকও এই সত্য স্বীকার করছেন অকপটে।
শাহবাগে মঞ্চ বানানোর এক সপ্তাহের মাথায় বিএনপি অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিল, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্দলীয় সরকারব্যবস্থার দাবিতে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধেও কথা বলুন।’ ইমরান সরকাররা তা নাকচ করে জানিয়ে দেন, বাংলা পরীক্ষা দিতে এসে অন্য কোনো বিষয়ের কথা আমরা ভাবছি না।’ শুধু এক বিষয়ের পরীক্ষাই যারা দিনের পর দিন দিতে থাকেন, তারা আদৌ সব বিষয়ে পরীক্ষা দিতে চান কি না, সে প্রশ্ন উঠবেই। কেবল একটি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে রেকর্ড মার্ক পেলেও কি সনদ জোটে? বাস্তবতা হলো, তখন থেকেই মানুষের মনে সন্দেহ জাগে, দেশের এত বড় বড় সমস্যাকে আড়াল করে বিশেষ লক্ষ্য হাসিলের চেষ্টা চলছে বোধহয়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সাধারণত আর্থসামাজিক বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করে থাকে। রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে তাদের ইত:পূর্বে প্রত্যক্ষভাবে কার্যক্রম পরিচালনা কিংবা মতামত প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। ৮ এপ্রিল ডেইলি স্টারে সিপিডির গবেষক মেহেরুন নেসার নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যার শিরোনাম The exit point of shahbag movement (শাহবাগ আন্দোলনের বহির্গমন পথ)। সাধারণত কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত কেউ কোথাও কোনো বক্তব্য দিলে কিংবা লেখা প্রকাশ করলে সাথে সাথে বলে দেয়া হয় যে, এতে প্রদত্ত অভিমত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজস্ব এবং এটা উক্ত সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের মতামত নয়। এমন কোনো কথা উপরিউক্ত নিবন্ধের সাথে নেই বিধায় ধরে নেয়া যায়, এতে সিপিডির দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত।
এই লেখায় জোনাথন ক্রিস্টিয়ানসেনের বক্তব্যের সূত্রে জানানো হয়েছে, সামাজিক আন্দোলনের চারটি পর্যায় থাকে। যেমন, আবির্ভাব (emergence), MYmg_©b (mass popularity), আনুষ্ঠানিকীকরণ (formalisation) এবং পতন বা অবনয়ন (decline)। শাহবাগের তরুণদের একটানা অবস্থান ও প্রতিবাদ জ্ঞাপনকে ‘সামাজিক আন্দোলন’ অভিহিত করে বলা হয়েছে, শাহবাগ আন্দোলনের লক্ষণ দেখে মনে হয়, এটি চতুর্থ বা শেষ পর্যায়ে উপনীত হচ্ছে। সরকারের দু’মুখো নীতি (ডাবল স্ট্যান্ডার্ড) এর কারণ বলে নিবন্ধটিতে উল্লেখ করা হয়। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, পয়লা এপ্রিল আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শাহবাগের মঞ্চ গুটিয়ে নেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। পরদিনের পত্রপত্রিকায় এ খবর এসেছে। অথচ ওই দিনই ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের টকশোতে খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বললেন, শাহবাগের আন্দোলন অব্যাহত রাখার প্রতি কৌশলগত সমর্থন দিয়ে যেতে সরকার ইচ্ছুক। এমনকি মন্ত্রী বললেন, আওয়ামী লীগের পূর্বোক্ত বৈঠকে শাহবাগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে কোনো কথাই বলা হয়নি।’ যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে কেন প্রেস নোট দিয়ে প্রকৃত ব্যাপার তুলে ধরা হলো না, এ প্রশ্নও তুলেছেন সিপিডি গবেষক। বাস্তবতা হলো, ডাবল স্ট্যান্ডার্ড প্রচলিত ক্ষমতার রাজনীতিতে বড় দলগুলোর একটি বড় বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে এটা স্পষ্ট যে, মতিঝিলের গর্জন থেমে যাওয়ার পর সরকার স্বরূপে ফিরে গেছে। পয়লা এপ্রিল শাহবাগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতৃত্ব অবস্থান নেয়ার খবর এখন মানুষের কাছে ‘এপ্রিল ফুল’-এর মতো মনে হচ্ছে। কারণ, শাহবাগের মঞ্চ বহালতবিয়তেই শুধু নেই, সে আন্দোলন যথাসাধ্য চেষ্টা করে কিছুটা চাঙ্গা করা যায় কি না সে কোশেশ শুরু হয়ে গেছে। বলাই বাহুল্য, এর পেছনে ক্ষমতাসীন দলের অন্তত বড় একটা অংশের সর্বাত্মক সমর্থন থাকবেই।
হেফাজতে ইসলামের দাবি পূরণের আলামত দৃষ্টিগোচর নয়। বরং হরতাল, হামলা, সংঘর্ষ ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে, হেফাজত নেতাকর্মীদের আগামী দিনগুলোতে নিজেদের হেফাজত করা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, মতিঝিলের গর্জনে অর্জন কতটুকু? নিশ্চয়ই এর স্থায়ী সাফল্য এবং সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য অনেক। কিন্তু আপাতত অর্জন হয়েছে কি? হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে সরকারের নানা কায়দার খেলা দেখে দেশবাসী টের পাচ্ছে, এ দেশের রাজনীতিতে চাণক্যের চাতুর্য আর কৌটিল্যের কুটিলতা কতখানি আসন গেড়েছে।
মতিঝিলের মহাসমাবেশের পরপরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর শান্তভাবে ও গম্ভীর মুখে বললেন, ‘সরকার হেফাজতের দাবিগুলো গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখবে।’ কথাটার মধ্যে ইতিবাচক ভাবটাই বেশি বলে প্রতীয়মান ছিল বিধায় কঠোর মন্ত্রীর কোমল কথায় অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। এরপর বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানালেন, হেফাজতের দাবিদাওয়ার যেগুলো গ্রহণযোগ্য, সেগুলো মেনে নেয়া হবে। আর যেসব দাবি গ্রহণ করা সম্ভব নয়, সেগুলো মানা হবে না।’ এভাবে সরকারের মনোভাব ক্রমশ উন্মোচিত হয়েছে, যার চূড়ান্ত প্রকাশ আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের সাফ জবাব। তিনি সোজা বলে দিলেনÑ হেফাজতের ১৩ দফা দাবির একটাও মানা যায় না।’ অতএব ‘মোকদ্দমা যে ডিসমিস’ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বলা দরকার, আইনমন্ত্রীরা বর্তমান সরকারের সে মহলটির মানুষ, শাহবাগের ব্যাপারে যাদের উৎসাহ ও সমর্থন খুব বেশি।
অপর দিকে সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্ক দমনে নেমে সরকার ধর্মবিদ্বেষী ‘নূরানি চাপা’র সাথে প্রতিপক্ষের ‘বাঁশের কেল্লা’ও বন্ধ করে দিয়েছে। আর শাহবাগের আন্দোলনের সূচনাতেই তাদের দাবিমাফিক সোনার বাংলাদেশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ, ‘আমার দেশ’ সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট মাহমুদুর রহমানকে শুধু গ্রেফতারই নয়, সাথে সাথে নেয়া হলো ১৩ দিনের রিমান্ডে। বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের প্রতি এমন আচরণের নজির থাকার কথা জানা যায়নি। মাহমুদুর রহমান এর আগে প্রায় ৪ মাস নিজ অফিসে স্বেচ্ছাবন্দী ছিলেন বাধ্য হয়ে। কারণ, সরকারের মামলা। যা হোক, শাহবাগ যখন হতাশ, তখন তাদের একটা বড় দাবি পূরণ করা হলো এই সাংবাদিককে জেলে পাঠিয়ে।
দেখা যাচ্ছে, সরকারের মতিগতি দৃশ্যত বোঝা মুশকিল। অবশ্য তারা পরিকল্পিতভাবে বিশেষ লক্ষ্যে সুকৌশলে এগিয়ে যেতে চান বলেই পর্যবেক্ষকদের অভিমত। ক্ষমতাসীন সরকার ও দলের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলদের কারো কারো স্ববিরোধী কিংবা কখনো নরম, কখনো গরম বক্তব্য দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি সে কৌশলের অংশ বলে ধরে নিতে হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে এর মধ্য দিয়ে প্রতিপক্ষকে উসকিয়ে দেয়া হচ্ছে যার পরিণতি দাঁড়াতে পারে পরিস্থিতির ক্রমাবনতি।
হেফাজতে ইসলামের লংমার্চকে শর্ট প্ল্যান দিয়ে ঠেকানো যায়নি। বরং সাজানো হরতাল-অবরোধের বালির বাঁধ মহাসমাবেশমুখী জনপ্লাবনের তোড়ে ভেসে গেছে। এ অবস্থায় ইজ্জত বাঁচাতে সরকার সুর নরম করেছিল। তবে দু’দিন না যেতে ক্ষমতাসীন মহল তাদের অরিজিনাল কালার অ্যান্ড ক্যারেক্টারে প্রত্যাবর্তন করেছে। তাই আগে যারা শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশ শেষ করে ফিরে যাওয়ায় হেফাজতে ইসলামকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, এখন তারাই বলছেন, ‘ওরা লেজ গুটিয়ে ফিরে গেছে’। হেফাজতও পাল্টা হুমকি ছেড়েছে, ‘মে মাসের শুরুতে অবরোধ কর্মসূচিতে দেখা যাবে, কারা লেজ গুটিয়ে পালায়।’ এসব শুনে সাধারণ মানুষ সম্ভাব্য সহিংসতার আতঙ্কে আরো গুটিয়ে যাচ্ছে।
শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন এ দেশের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সাড়া জাগানো ঘটনা। প্রধানত তরুণদের উদ্যোগে সূচিত এবং তাদের উপস্থিতিতে অব্যাহত এই অবস্থান কর্মসূচি শুধু একটানা আড়াই মাসের দীর্ঘ মেয়াদের কারণে নয়, তার রাজিৈনতক বৈশিষ্ট্য এবং সর্বোপরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। শাহবাগের মঞ্চের নাম ‘গণজাগরণ মঞ্চ’। এই মঞ্চকেন্দ্রিক আন্দোলন ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীকে জাগাতে গিয়ে অবাঞ্ছিত কিছু কর্মকাণ্ডে ধর্মীয় মহলের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করে দিয়েছে। নিজেদের ভুল ও বাড়াবাড়ির মাশুল হিসেবে সৃষ্ট এই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে শাহবাগ তার পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রাণশক্তি হারিয়ে এখন যে অনেকটাই বিবর্ণ ও স্থবির, তা তাদের মুরব্বিরাই হতাশার সাথে স্বীকার করছেন। শাহবাগের তারুণ্য জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করলে স্মরণীয় হয়ে থাকত। বাস্তবে তা জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত ও পরস্পরের মুখোমুখি করে দেশের মিত্রদের উদ্বিগ্ন আর শত্রুদের উৎফুল্ল করেছে।
যেকোনো দেশ ও জাতির কল্যাণ এবং অগ্রগতির জন্য তরুণ ও প্রবীণের সম্প্রীতি, আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের সম্মিলন, ধর্ম ও বিজ্ঞানের সমন্বয় এবং আবেগ ও মেধার সমাহার অপরিহার্য। আমরা যদি মানবিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য না দিই, তা হলে স্বাধীনতা কিংবা ধর্ম, কোনোটার বিষয়েই আমরা নিষ্ঠার পরিচয় দিতে পারব না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads