নববর্ষে বৈশাখ নবজাগরণের বার্তা নিয়ে আসে। যাবতীয় অজাচার, অনাচার ও আবিলতা ধুয়ে মুছে নতুন এক সকালের ডাক দিয়ে যায় বৈশাখ। বৈশাখকে নিয়ে আমাদের আবেগ-উচ্ছ্বাসও কম নয়। বৈশাখে আমরা গ্রাম বাংলায় প্রকৃতির মতই স্বচ্ছ চিত্র লক্ষ্য করি। তবে শহরের চিত্র আবার অন্যরকম। বৈশাখে গ্রামবাংলায় যে মেলার আয়োজন করা হয় তাতে পেশাজীবী মানুষের পণ্যের সমাহার যেমন ঘটে, তেমনি ঘটে গ্রামবাংলার লোকজসংস্কৃতির আনন্দঘন সমাবেশও। গ্রামীণ মেলায় কামার-কুমার ও কৃষকের পণ্যের পসরা হয়, তাতে গ্রামীণ সমাজের মানুষের প্রয়োজন মেটে এবং অর্থনীতির বিকাশও ঘটে। বৈশাখের গ্রামীণ মেলা কোনো কৃত্রিম আয়োজন নয়। প্রাণের টানে, জীবনের প্রয়োজনে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয় এবং এতে বাংলার কৃষক সমাজ জীবনীশক্তি খুঁজে পায় এবং উপভোগ করে আনন্দ-বিনোদনও। বৈশাখে গ্রামবাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কৃতজ্ঞচিত্তে ¯্রষ্টাকে স্মরণ করে, ভাল কিছু খাওয়ার এবং ভাল থাকার চেষ্টাও করে। তাদের জীবনাচারে লক্ষ্য করা যায় সম্প্রীতি ও অল্পে তুষ্টির সংস্কৃতি- যা নগরজীবনে তেমন লক্ষ্য করা যায় না।
বৈশাখ উপলক্ষে নগরজীবনেও দেখা যায় নানা আয়োজন। তবে এখানে প্রকৃতির মত স্বচ্ছতা তেমন লক্ষ্য করা যায় না। নগর জীবনের বৈশাখে রাজনীতির প্রোপাগান্ডা যেমন লক্ষ্য করা যায়, তেমনি লক্ষ্য করা যায় আরোপিত সংস্কৃতির দৌরাত্ম্যও। একশ্রেণীর মিডিয়ার আনুকূল্যে ও প্রশ্রয়ে এ দৌরাত্ম্যের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। নগরজীবনের প্রাত্যহিকতায় বৈশাখ বা বাংলা সনের গণনা হয় না, কৃষক সমাজের স্বার্থরক্ষার চেতনাও এখানে অনুপস্থিত। দেশের ৮০ ভাগ গ্রামীণ মানুষের স্বার্থ ও সংস্কৃতি চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভোগবাদী গুটিকয় মানুষ কী করে দেশকে প্রগতির কাক্সিক্ষত পথে নিয়ে যাবে? এদের বৈশাখ উদযাপনেও গণবিচ্ছিন্ন চেতনার আলামত প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। বৈশাখ উপলক্ষে খুব ঘটা করে বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। বিশাল আয়োজনের এ শোভাযাত্রায় ময়ূর, পেঁচা, কুমিরসহ নানা পশু-পাখির প্রতিকৃতি ও মুখোশের সমাবেশ ঘটানো হয়। এই মঙ্গল মিছিলের যে রূপ ও আবহ তা গ্রামবাংলার ব্যাপক জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনার সঙ্গে মিলে না। কৃত্রিম এ শোভাযাত্রায় বিশেষ ঘরানার রাজনৈতিক চেতনাও লক্ষ্য করা যায়, যা সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনার সঙ্গে যায় না। আর যে বিষয়টি প্রকট হয়ে ধরা পড়ে তা হলো, এদেশের ৯০ ভাগ মুসলমানের মনে আল্লাহর একত্ববাদ বা তাওহিদের যে চেতনা, তার বিপরীত ধারায় পরিচালিত হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রায় পশু-পাখির যে প্রতিকৃতি বা মুখোশ তার সাথে টোটেম বিশ্বাসের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী পশু-পাখির প্রতিকৃতি বা মুখোশের মাঝে কোনো মঙ্গল বা কল্যাণ খুঁজে পায় না। সমাজবিজ্ঞানের ইতিহাসেও বলা হয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কহীন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ এক সময়ে বিভিন্ন পশু-পাখিকে পূজা করতো এবং তাদের কাছে মঙ্গল বা কল্যাণ ভিক্ষা করতো।
বাংলাদেশের মানুষ তো বহু আগেই চিন্তার সে স্তরটা পেরিয়ে এসেছে। তাহলে তাদের আবার মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে পেছনের দিকে ডাকা হচ্ছে কেন? পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, এদেশের ইসলামবিদ্বেষী কিছু মানুষ সরাসরি ইসলামের তাওহিদী চেতনার বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস না পেলেও, নববর্ষ উপলক্ষে বাঙালিয়ানার নাম করে পশু-পাখির প্রতিকৃতি নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার আড়ালে ভিন্ন সংস্কৃতির একটি মিশ্রণ ঘটাবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কৌশলে। তাই বিষয়টিকে তারা গণবিরোধী সংস্কৃতির আগ্রাসন হিসেবেই বিবেচনা করেন।
পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় মঙ্গল ও কল্যাণের অনেক কথাই বলা হয়। কিন্তু তার প্রভাব এই শোভাযাত্রার সমর্থকদের মধ্যে তেমন লক্ষ্য করা যায় না। পশু-পাখির অর্চনা বা টোটেম বিশ্বাসের অন্তসার শূন্যতার কারণে মঙ্গল শোভাযাত্রার নানা বুলি ইতোমধ্যেই কাগুজে বুলি হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। নয়তো বৈশাখের বর্ষবরণ উৎসবকে কেন্দ্র করে হামলা, শ্লীলতাহানি ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে কেমন করে? পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ছাত্রীকে চড়-থাপ্পড় ও শাড়ি টেনে শ্লীলতাহানি এবং সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের ছাত্রী হোস্টেলের হামলার মধ্য দিয়ে বাংলার নববর্ষ উদযাপন করলো ছাত্রলীগ কর্মীরা। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পহেলা বৈশাখে রাতভর পলাশী দিয়ে আগত মানুষের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেছে। এ ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে ৪ সাংবাদিককে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ছাত্রী হোস্টেলে হামলা, ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি, চাঁদাবাজি ও সাংবাদিক প্রহার তো পহেলা বৈশাখের আদর্শ হতে পারে না। বরং এই সব অনাচার ও আবিলতা ধুয়ে মুছে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র সমাজ বিনির্মাণের আবাহন জানায় বৈশাখ। কিন্তু নগরজীবনের গান-বাদ্য, পান্তা-ইলিশ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা তো বৈশাখের আবাহনকে সমুন্নত রাখতে সমর্থ হচ্ছে না। আসলে কৃত্রিমতা কিংবা উদ্দেশ্যপ্রবণ আরোপিত সংস্কৃতি দিয়ে বৈশাখের বার্তা সমুন্নত রাখা যায় না। বৈশাখের বার্তায় জীবনকে আলোকিত করতে হলে প্রয়োজন গ্রামবাংলার অকৃত্রিম সংস্কৃতিতে ফিরে যাওয়া, যেখানে কৃত্রিমতা কিংবা প্রহসনের কোনো স্থান নেই। গ্রামবাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন আমাদের মহান ¯্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ থেকে কর্ম-সংস্কৃতিতে নিষ্ঠাবান থাকার প্রেরণা দেয়। আসলে ধর্ম ও কর্মের সমন্বিত সংস্কৃতিই গ্রাম বাংলার সংস্কৃতি, পহেলা বৈশাখের বার্তাও তাই। বিষয়টি উপলব্ধি করলেই আমাদের মঙ্গল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন