ষষ্ঠ হিজরিতে মক্কার কাফের কুরাইশদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্পাদিত হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্তানুসারে মদিনার মুসলমানেরা পরের বছর উমরা করার জন্য মক্কা শরিফে যান। যাওয়ার সময় রাসূল সা: তাদের বলেন, মক্কায় কুরাইশরা তোমাদের দেখলে মদিনায় অভাবে ুধায় মুসলমানেরা দুর্বল ক্ষীণকায় হয়ে গেছে বলে টিটকারি দেবে। কাজেই আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ করার সময় প্রথম তিন চক্কর হেলেদুলে বীরের বেশে দৌড়ের গতিতে ঘুরবে। এহরামের গায়ের কাপড় তখন ডান কাঁধ খোলা রেখে বগলের নিচ দিয়ে বাম কাঁধের ওপর ছেড়ে দেবে। ইবাদতের মধ্য দিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের সৌন্দর্য ও শৌর্যবীর্য প্রদর্শনীর এই সুন্নতের নাম ‘রামাল’ এবং মক্কায় পৌঁছে প্রথম তাওয়াফে প্রত্যেক হাজীকে এখনো এই ‘রামাল’ করতে হয়। হজরত সা:-এর নির্দেশ, সাহাবায়ে কেরামের এই আমলও শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে আসা এই সুন্নত থেকে আমরা আধুনিক পরিভাষায় মিছিল, শোভাযাত্রা ও লংমার্চের শরয়ি সমর্থন পেতে পারি। বিশেষত, বর্তমান প্রচারমাধ্যমের আধিপত্যের যুগে ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত মুসলমানদের দৃপ্ত পদযাত্রা নিঃসন্দেহে আল্লাহর পথে জিহাদ হিসেবে গণ্য। শত্রু বাহিনীর সাথে সম্মুখ লড়াইয়ের সংবাদ ও ফলাফল একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে এবং দুশমনেরা একে সন্ত্রাস বা অন্য নামেও আখ্যায়িত করতে পারে; কিন্তু মিছিল ও বিক্ষোভের খবর ও প্রভাব মিডিয়ার কল্যাণে মুহূর্তে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং জনমত গঠনে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
ইসলামে এই শোভাযাত্রা বা লংমার্চের পক্ষে আরো প্রামাণ্য দলিল আছে। তন্মধ্যে ঈদগাহে ঈদের জামাত অন্যতম। মক্কা শরিফের হেরেমে বা মসজিদে নববীতে এক রাকাত নামাজের সওয়াব এক লাখ বা পঞ্চাশ হাজার রাকাত নামাজের সমান। অথচ নবী করীম সা: জীবনভর মসজিদে নববী ছেড়ে বাইরে ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়েছেন। আরো বলেছেন, তোমরা তকবির ধ্বনি দিতে দিতে এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যাবে আর ভিন্ন রাস্তা দিয়ে ঈদগাহ হতে ফিরে আসবে। সম্মিলিত পদচারণায় তকবির ধ্বনি নিয়ে এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহের নির্দিষ্ট স্থানে জমায়েত হওয়া আবার একই নিয়মে ভিন্ন রাস্তা দিয়ে ফিরে আসাকে আমরা আধুনিক পরিভাষায় নিশ্চয়ই মিছিল, লংমার্চ বলতে পারি। রাসূলে পাক সা: জীবনে শুধু একবার মসজিদে নববীর ভেতরে ঈদের নামাজ পড়েছিলেন, তাও অতি বৃষ্টির কারণে। এর সাথে আমাদের বর্তমান ঈদ জামাত পড়ার আনুষ্ঠানিকতার কতখানি মিল খুঁজে পাওয়া যাবে, তা এক ভিন্ন বিষয়।
এতটুকুন আলোচনায় পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মিছিল, শোভাযাত্রা বা লংমার্চ যদি তকবিরসহকারে হয়, তা সুন্নাতের অন্তর্ভুক্তি এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের শামিল। আর যখন কোনো বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এর গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। বাংলাদেশে রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র শাহবাগকে কেন্দ্র করে গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কিছু ধর্মবিদ্বেষী ব্লগার জঘন্য ইসলামবিরোধী তৎপরতা শুরু করে। এরা ইন্টারনেটে ব্লগে রাসূল সা: ও ইসলামের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সবার নিকৃষ্ট ও কুৎসিত ভাষায় কুরুচিপূর্ণ লেখালেখি করে আসছিল। একপর্যায়ে আদালতের একটি রায়কে উপলক্ষ করে শাহবাগে এসে বেসামাল উন্মাদনা শুরু করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিবেকবান মানুষ যখন হতবাক ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় তখনই বলিষ্ঠ প্রতিবাদের ঝাণ্ডা উত্তোলন করে চট্টগ্রাম থেকে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সরকার ধর্মবিদ্বেষী ব্লগারদের পক্ষ নিয়ে প্রতিবাদী মুসল্লিদের পাখির মতো গুলি করে ইতোমধ্যে দেড় শতাধিক লোকের রক্তপাত ঘটায়। এমতাবস্থায় ধর্মদ্রোহী মুরতাদ শাস্তির দাবি আর রাসূল সা: ও ইসলামের অবমাননার প্রতিবাদে আগামী ৬ এপ্রিল ঢাকামুখী লংমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী। সারা দেশের সর্বস্তরের আলেম ও তৌহিদি জনতা এই লংমার্চের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তাতে বলা যায় যে, রাসূল সা:-এর অবমাননাকারী ধর্মবিদ্বেষী ও ধর্মদ্রোহী ব্লগারদের শাস্তির দাবিতে বাংলাদেশের মুসলিম জনগণের মাঝে ইজমা (সার্বজনীন ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার শরয়ি গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের বিবেচনায় এই লংমার্চে অংশ নেয়া প্রতিটি মুসলমানের অলংঘনীয় কর্তব্য। কারণ, এই লংমার্চ নিছক কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়। আল্লাহর পেয়ারা হাবিবের সম্মানহানি যারা করেছে, যারা ওদের সমর্থন দিয়েছে এটি তাদের মুখে প্রচণ্ড মুষ্টি আঘাত, জিহাদ। রাসূলে পাকের সা: প্রতি যাদের অন্তরে সামান্যতম ভালোবাসা আছে, তারা এই মিছিল থেকে পিছপা থাকতে পারেন না। রাসূলে পাক সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি (রাসূল) তার কাছে তার পিতামাতা, সন্তান-সন্ততি ও সব মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় না হবো।’
এই ভালোবাসা বা রাসূল প্রেমের দাবি কী? কোনো অভিজাত লোক মারা গেছে, তার ছেলেরা বাপের অট্টালিকা ও সম্পদ উত্তরাধিকার পেয়ে সুখে জীবন কাটাচ্ছে। এক দিন মরহুম পিতার বিপক্ষ এক লোক এসে বাইরে দাঁড়িয়ে চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে গালিগালাজ শুরু করল, এখন ছেলেদের করণীয় কী? যদি বলে, আমরা অভিজাত পিতার ভদ্রঘরের সন্তান। বাবাকে বাইরে কে কী বলল, তাতে কিছু আসে যায় না, তখন বিবেকের ফায়সালা কী হবে? এরা কি কুপুত্র বা জারজ সন্তান হিসেবে চিহ্নিত হবে না? কাজেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে কর্তব্য হলো ভদ্রতা বুজুর্গির অহমিকা ছেড়ে বাইরে এসে গালমন্দকারীর টুঁটি চেপে ধরা। আশা করি মসজিদে, খানকায়, স্কুল-মাদরাসায় যারা ইবাদতে সাধনায় জ্ঞানচর্চায় মশগুল তারা পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবেন, ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। আল্লাহপাক নির্দেশিত ‘আমর বিল মারুফ’ ও ‘নাহি আনিল মুনকার’-এর দাবিও এটিই। হাদিস শরিফের ভাষ্য অনুযায়ী তোমাদের মধ্যে কেউ যখন কোনো অন্যায় হতে দেখবে, তখন হাত দ্বারা তা পরিবর্তন করবে, যদি সম্ভব না হয় মুখে তার পরিবর্তন ঘটাবে। যদি তাও সম্ভব না হয় অন্তরে তার পরিবর্তন কামনা করবে- অবশ্য এটি ঈমানের দুর্বলতম স্তর (এর পরে ঈমানের অস্তিত্ব আর নাই)।
সমগ্র দুনিয়া যাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে, যিনি আল্লাহর পেয়ারা হাবিব, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের প্রাণের প্রাণ নবীজী বাংলার জমিনে কয়েকজন পথভ্রষ্ট তার সম্পর্কে অকথ্য ভাষায় ব্লগে লিখবে আর তাদের রক্ষায় বাম-রাম মহল ও সরকার নিপীড়ন চালাবে, এর প্রতিবাদ অবশ্যই হতে হবে। তবে উল্লিখিত হাদিসের ব্যাখ্যায় হাত দ্বারা পরিবর্তন মানে শক্তি প্রয়োগ করে। অর্থাৎ প্রশাসনিক ক্ষমতা যে মুসলমানের হাতে আছে, তিনি এ পর্যায়ের আমর বিল মারুফ করবেন। যার হাতে নির্বাহী ক্ষমতা নেই, তার দায়িত্ব চলে আসে দ্বিতীয় স্তরে অর্থাৎ মুখের দ্বারা পরিবর্তন সাধন। তার মূল দায়িত্বও শরিয়তের আলেমদের ওপর। কারণ শরয়ি যেকোনো বিষয়ের মেরিট তারাই নির্ণয় করতে পারেন। সাধারণ মানুষের কর্তব্য, এ বিষয়ে আলেমদের জ্ঞানী লোকদের সমর্থন জোগানো, বর্তমানেও সে ধরনের পরিস্থিতি আমাদের সামনে এসেছে।
যাদের হাতে প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই বা মুখে ও লিখনীতে ইসলামের সঠিক বার্তা তুলে ধরার শক্তি নেই, তাদের দায়িত্ব মনে মনে অন্যায়ের পরিবর্তন কামনা করা। কিন্তু নীরব বসে থাকার সুযোগ কারো নাই। ৬ এপ্রিল লংমার্চ আসবে চট্টগ্রাম থেকে। কিন্তু ঢাকায় যারা আছেন তাদের কর্তব্য শাপলা চত্বর অভিমুখে শান্তিপূর্ণভাবে তসবিহ হাতে জিকিরসহ এগিয়ে যাওয়া। একান্ত সম্ভব না হলে বাড়িঘর থেকে বের হওয়া, অফিস আদালত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে নেমে আসা এবং রাস্তায় যতক্ষণ পারা যায় দাঁড়িয়ে থাকা, আর আল্লাহর রাসূলের সা: মহব্বতের দাবিতে জিহাদের চেতনায় নিজের চিন্তা ও বিবেককে আল্লাহ ও রাসূলের সা: সাথে একাকার করা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন