বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৩

হঠাৎ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার নেপথ্যে


এক

হঠাৎ কেন উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে? এর মধ্যে এমন কিছু অঞ্চলও রয়েছে যেখানে শত শত বছর ধরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা যায়নি। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ক্ষেত্রভূমি হিসেবে এক সময় পরিচিত ছিল ভারত। কয়েক বছর পরপর দেশটিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যেত। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের প্রাক্কালে এবং এর আগে ব্রিটিশ-ভারত আমলেও কয়েকটি বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন এবং এর পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের নেতৃত্বে ন্যাটোর তালেবানবিরোধী সন্ত্রাস দমন যুদ্ধের পর পাকিস্তানে সম্প্রদায়গত সহিংসতা বেশ বেড়ে যায়। বাংলাদেশে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর কক্সবাজারে বৌদ্ধবিহার ও বসতিতে সাম্প্রদায়িক হামলা ও ভাঙ্চুরের ঘটনা ঘটে। হাজার বছর ধরে শান্তিপূর্ণ এই জনপদে হঠাৎ উত্তেজনা বেশ রহস্যজনকই থেকে যায়। এর আগে ও পরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে মিয়ানমারের আরাকান (রাখাইন) রাজ্যে। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এই রাজ্যটিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও মুসলিম নিধনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে বারবার। এ ধরনের ধারাবাহিক দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় আরাকান রাজ্যের এক সময়কার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রোহিঙ্গারা এখন সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করায় রোহিঙ্গারা এখন পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত নাগরিকত্বহীন এক জনগোষ্ঠীতে। সর্বশেষ মিয়ানমারের মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে দেশটির বৃহত্তম নগরী ইয়াঙ্গুন রাজধানী নেপাইথোসহ ব্যাপক অঞ্চলে। মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, ব্যবসায় বাণিজ্য কেন্দ্র, জনবসতি সর্বত্র হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। একটি মাদরাসায় আগুন দিয়ে ১৩ কিশোর ছাত্রকে পুড়িয়ে মারা হয়।
এবার মিয়ানমারের ম্যানডাল অঞ্চলের মেইকটিলা শহরে মুসলিম নিধন সবার মধ্যে নতুন করে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। মেইকটিলা শহরে ২০ মার্চ শুরু হওয়া সহিংসতায় এ পর্যন্ত অন্তত ২০০ মুসলিম নিহত হয়েছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই সহিংসতায় কেবল বৌদ্ধ ভিুরাই নয়, সামরিক বাহিনী, পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জড়িত থাকার প্রমাণ থাকার কথা বলেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস, গালফ নিউজের মতো পত্রিকা। মিয়ানমারের মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসঙ্ঘের বিশেষ প্রতিনিধি টমাস ওজেয়া কুইটানা বলেছেন, ‘চলমান সহিংসতায় রাষ্ট্রীয় সম্পৃক্ততা রয়েছে। সুসংগঠিত উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ দাঙ্গাবাজেরা যখন নৃশংসতা চালাচ্ছিল, তখন সামরিক বাহিনী, পুলিশ এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে। তাদের চোখের সামনে নিধনযজ্ঞ চললেও তারা তা বন্ধ করার কোনো চেষ্টা চালায়নি।’ মিয়ানমারের দাঙ্গায় নেপথ্য থেকে ইন্ধন দিচ্ছে একশ্রেণীর ভিুও। এসব ভিুর পরিচিতি যতটা না ধর্মীয় তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক।
দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত অঞ্চলগুলোতে এই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা কি স্বাভাবিক কোনো ঘটনা পরম্পরা নাকি এর পেছনে গভীর কোনো রহস্য লুকিয়ে আছেÑ এ প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান করতে গিয়ে নানা কিছু বেরিয়ে আসছে। এশিয়ার উদীয়মান শক্তি চীনের প্রভাব খর্ব করতে বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতৃত্বকে ব্যবহার করার প্রবণতা বেশ পুরনো। চীন থেকে বিচ্ছিন্ন করে তিব্বতকে স্বাধীন ভূখণ্ড করার আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা দালাই লামা। তিব্বতের এই স্বাধিকার আন্দোলন চীনের কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সাথে বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতৃত্বের একটি দ্বন্দ্বমুখর সম্পর্ক তৈরি করে গোড়া থেকেই। এটি নিকটবর্তী বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারেও বিস্তৃত হয়। দেশটির বৌদ্ধ ভিুদের একটি অংশ নেপথ্যে জড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে। ওই আন্দোলনের একজন নেতা হলেন উইরাথো। ২০০৩ সালে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় ঘৃণা ছড়ানোর জন্য গ্রেফতার হয়েছিলেন এই বৌদ্ধভিু। তখন তাকে ২৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। পরে মুক্তি পান এই বৌদ্ধভিু। তিনি ২০১২ সালের মার্চে অং সান সু কির গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে রাজবন্দীদের মুক্তির এক বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন। ২০০৭ সালে কথিত ‘কমলা বিপ্লবের’ সময়ও অং সান সু কির সমর্থনে বিক্ষোভে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। সর্বশেষ আরাকানে মুসলিমবিরোধী রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়ও অং সান সু কির অনুগত এসব ভিুর অংশগ্রহণ দেখা যায়। অং সান সু কির অতীতের আন্দোলনে মুসলিমদের সমর্থন থাকলেও রোহিঙ্গা বিতাড়নে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার ব্যাপারে সু কি রহস্যজনকভাবে নীরব থাকেন। এবার সু কির অনুগত ভিুদের দাঙ্গায় প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। এ ব্যাপারেও সু কি কোনো সোচ্চার ভূমিকা পালন করেননি। গত সেপ্টেম্বরে সু কির অনুগত বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের বিক্ষোভ ও আন্দোলনের মুখে মিয়ানমারের কাচিন স্টেটে চীনের আর্থিক সহায়তায় নির্মাণাধীন বিশ্বের ১৫ শ’ বৃহত্তম মিটসন ড্যামের নির্মাণকাজ স্থগিত করা হয়।
মিয়ানমারে বর্তমানে মুক্ত বিশ্বের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করার জন্য যে রাজনৈতিক সংস্কার চলছে তার পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সৃষ্টি খুব স্বাভাবিক বিষয় নয়। কিন্তু তারপরও আরাকান থেকে শুরু করে ইয়াঙ্গুন নেপাইথো পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা ঘটে চলেছে। বিশেষত এ দাঙ্গায় মাদরাসা-মসজিদে আগুন দিয়ে নির্মম গণহত্যা চালানোর তৎপরতার সাথে সু কি অনুগত ভিুদের সম্পৃক্ততা বেশ উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এর সাথে দু’টি বিষয়ের তাৎপর্যপূর্ণ সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। প্রথমত, মিয়ানমারের বৃহৎ প্রকল্পগুলোতে চীনের একতরফা বিনিয়োগে পশ্চিমাদের অংশগ্রহণের যে প্রচেষ্টা চলছে তাকে সুসংহত করতে চীনবিরোধী শক্তিকে সংগঠিত করা। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বকে একই সমান্তরালে আনতে সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাত সৃষ্টির চেষ্টা হতে পারে। মিয়ানমারের জ্বালানিসম্পদ সমৃদ্ধ আরাকান উপকূল বরাবর রোহিঙ্গা মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা প্রথমে শুরু হয়। বর্তমানে এ দাঙ্গা যেসব অঞ্চলে বিস্তৃত হচ্ছে সেসব এলাকায় বৌদ্ধ মুসলিম উত্তেজনা সেভাবে ছিল না। রাজনৈতিক রূপান্তরের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণে দু’টি প্রতিক্রিয়া একসাথে হবে। এতে এক দিকে সংস্কারের ফলে মিয়ানমারে বিনিয়োগের যে সুযোগ সৃষ্টি হবে তাতে কেবল পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরা অংশগ্রহণ করতে পারবে। মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার কারণে এখানে বিনিয়োগ নিরাপদ মনে করবে না মুসলিম দেশগুলো।
দ্বিতীয় একটি কৌশলগত দিক বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেটি ইসরাইলি স্বার্থের সাথে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট। মিয়ানমারে চীনা প্রভাব কমানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমের পাশাপাশি ইসরাইলেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রায় দেড় দশক ধরে মিয়ানমারের সাথে ইসরাইলের সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক চলে আসছে। দেশটি এক সময় এককভাবে চীনা প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ওপর নির্ভরশীল হলেও ইসরাইল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমারে বিভিন্ন ধরনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রি শুরু করেছে। ইসরাইলের সামরিক বেসামরিক বিনিয়োগের ক্ষেত্র বিস্তারের জন্য মুসলিম বিশ্বের সাথে দেশটির দূরত্ব সৃষ্টির বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। এর বাইরে ইসরাইলের একটি কৌশলগত দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ এই অঞ্চলে থাকতে পারে। সেটি এই অঞ্চলে একটি ুদ্র ইহুদি রাষ্ট্র সৃষ্টির পরিকল্পনার সাথে সংশ্লিষ্ট। বেশ কিছুকাল ধরে এই এলাকায় ইহুদিদের এক বড় জনগোষ্ঠী আবিষ্কার প্রচেষ্টা সক্রিয় রয়েছে। ১৯৯৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর খ্যাতনামা মার্কিন সাময়িকী টাইম এ ‘লস্ট ট্রাইব অব ইসরাইল’ নামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এই প্রতিবেদনে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের অধিবাসী মিজোদের ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত হারিয়ে যাওয়া ইহুদি গোত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। টাইমের প্রতিবেদনে মিজোরামের রাজধানীতে পাওয়া ইহুদি সিনাগগ, সেখানকার অধিবাসীদের জুদাবাদে বিশ্বাসের বিভিন্ন বিষয় তুলে আনা হয়। বলা হয়, তিন হাজার বছর আগে ওল্ড টেস্টামেন্টে হারিয়ে যাওয়া ইহুদিদের যে পরিচয় দেয়া হয়েছে, তার সাথে মিজোদের অপূর্ব মিল রয়েছে। আত্মপরিচয় ফিরে পেয়ে অনেক মিজোর ইহুদি ধর্মে ফিরে আসা এবং ইসরাইলের নাগরিকত্ব নেয়ার কথাও বলা হয় প্রতিবেদনে। এতে মিজোরামে খ্রিষ্টান মিশনারিদের হাতে ধর্মান্তরিত হওয়ার পর আবার ইহুদি ধর্মে ফিরে আসা নিয়ে দুই পরে টানাপড়েনের কথাও বলা হয়েছে।
টাইমের প্রতিবেদনে বলা হয়, শিংল্যাং-ইসরাইল পিপলস কনভেনশনের প্রতিষ্ঠাতা লালচানহিমা সাইলো নামে ৪৪ বছর বয়সী এক যাজক মিজোদের নতুন পরিচয় উদঘাটনের ব্যাপারে বিশেষ সঙ্কল্প নিয়েছেন। এই ব্যক্তি মিজোদের নাম পাল্টে যেন শিংল্যাং-ইসরাইল রাখার জন্য বিভিন্নভাবে প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। তিনি একই সাথে বৃহত্তর শিংল্যাং-ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যও ডাক দিয়েছেনÑ যার মধ্যে ভারতের মিজোরাম-মিয়ানমারের শিন ও বাংলাদেশের মিজোরা থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। টাইমে প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরও এই ধারায় আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রচার প্রচারণা অব্যাহত থাকে। জর্জ টি হ্যাওকিপ ‘কুকি-শিন-মিজো : দ্য লস্ট ট্রাইব অব ইসরাইল’ শিরোনামে এক দীর্ঘ প্রবন্ধে হারিয়ে যাওয়া ইহুদিদের সম্পর্কে আরো বিস্তৃত সব ‘পরিসংখ্যান’ হাজির করেছেন। ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশে বসবাসকারী কুকি-শিন ও মিজোদের তিনি হারিয়ে যাওয়া ইহুদি গোত্র বলে উল্লেখ করেছেন। তার বক্তব্য অনুসারে মনিপুরে পাঁচ লাখ, মিজোরামে আট লাখ, আসামের কাচার ও উত্তর কাচারে দুই লাখ, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই লাখ এবং মিয়ানমারের শিন পাহাড়, মাতু, খুমি, মিরা ও আরাকানে হারিয়ে যাওয়া সম্প্রদায়ের ৩০ লাখ ইহুদি রয়েছে।
জর্জ টি হ্যাওকিপ তার লেখায় উল্লেখ করেন, উল্লিখিত এক লাখ ২৪ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় প্রায় ৫০ লাখ মানুষ একই গোষ্ঠী থেকে এসেছে। তাদের সংস্কৃতির উৎস, ভাষা, রীতি ও ঐতিহ্য প্রায় অভিন্ন। কুকি-শিন-মিজোদের সাথে ইসরাইলের যুগসূত্র আবিষ্কার ও তা প্রতিষ্ঠিত করার তৎপরতা বাংলাদেশে দেখা না গেলেও মিজোরামে এ উদ্যোগ বেশ সক্রিয়। ১৯৯৪ সালের ৭ জুলাই এ ব্যাপারে একটি কনভেনশন ডাকা হয়। শিংল্যাং ইসরাইল পিপলস কনভেনশনে কুকি-শিন-মিজোদের ইসরাইলি মেনাসে ও এফবেইম গোত্রের উত্তরাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করে একটি ঘোষণা অনুমোদন করা হয়। এটি ১৯৯৪ সালের ২৮ অক্টোবর জাতিসঙ্ঘে উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, মিয়ানমারের শিন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সন্নিহিত সমতল, মিজোরাম ও পাশের মনিপুর আসাম ত্রিপুরার কুকি-শিন-মিজোরা একজন ভিন্ন মতাবলম্বী ইহুদি যাজকের অনুসারী ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের লুসাই ও বোমদের এই হারিয়ে যাওয়া ইহুদি গোত্র হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। যদিও তাদের উল্লিখিত সংখ্যার সাথে বাস্তবের মিল নেই।
১৯৪৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রবিন্দু ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়ও সেখানকার ইতিহাসের নানা দিকের সাথে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে নানা গবেষণা ও লেখালেখি হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইঙ্গ-মার্কিন সমর্থনে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ব্যালফোর ঘোষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইসরাইল রাষ্ট্র। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের যে অঞ্চলটিতে হারিয়ে যাওয়া ইসরাইলিদের বসবাসের কথা দাবি করা হচ্ছে, সেখানে এখন নানা ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। মিজোরাম ও মনিপুরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন মাঝে মধ্যেই চাঙ্গা হয়ে ওঠে। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই প্রধান পাহাড়ি জনগোষ্ঠী চাকমা ও মারমাদের হারিয়ে যাওয়া ইহুদিদের সংশ্লিষ্টতার দাবি করা না হলেও মাঝে মধ্যেই অনেক বিপত্তির সৃষ্টি হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমল্যান্ড প্রতিষ্ঠার দাবিতে এক সময় সশস্ত্র লড়াই চলেছিল। শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সে লড়াইয়ের আপাতত অবসান ঘটে। কিন্তু এখন পাহাড়ে নতুন করে সশস্ত্র সঙ্ঘাতের আওয়াজ তোলা হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সমর্থনে তাদের নানামুখী বিচ্ছিন্নতামূলক তৎপরতা ল করা যাচ্ছে। রামু ও উখিয়ার যে অঞ্চলে বৌদ্ধ মন্দির ও বসতিতে হামলা ভাঙচুর করা হয়েছে সেটি এই অঞ্চলের কাছাকাছি আর পার্বত্য এলাকার অধিকাংশ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মের হওয়ায় এ ঘটনাকে বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের একটি দূরত্ব তৈরির ব্যাপারে ব্যবহারে প্রচেষ্টাও লক্ষ করা গেছে। এসব পর্যবেক্ষণ করে মিয়ানমারে এখন যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখা যাচ্ছে, তার নেপথ্যে বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার অঞ্চলে ইসরাইলের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য তৎপরতা সক্রিয় থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনা প্রভাবকে খর্ব করতে একশ্রেণীর বৌদ্ধভিুর ব্যবহারের পশ্চিমা প্রচেষ্টা শুধু মিয়ানমারে সীমিত নয়। এ চেষ্টা শ্রীলঙ্কায়ও সক্রিয় রয়েছে। বাংলাদেশের রামু ও উখিয়ার হাজার বছরের শান্তিপূর্ণ সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা কোনো বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ নয় বলে অনেকে মনে করেন। এ ঘটনার সাথে বিভিন্ন পক্ষকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা হলেও এর গভীর অনুসন্ধানে এমন কিছু বিষয় উঠে আসে, যা সাধারণভাবে কোনো আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা গোষ্ঠী সম্পৃক্ত থাকলে পাওয়া যায়। আরাকানে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার পরে রামুর এ ঘটনা মিয়ানমারের গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। মিয়ানমারে চলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির জন্য এটাকেও ব্যবহার করা হয়েছে।

দুই
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ মামলাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে শাহবাগে প্রজন্ম চত্বর স্থাপন আর সেখান থেকে বাংলাদেশের ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়ার দাবি জানানোর মাধ্যমে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পুরো বিচার কার্যক্রমে দেশের মানুষ বিশেষভাবে নজরে রেখেছে। মামলার উপস্থাপিত দলিল-প্রমাণাদি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য, সর্বশেষ স্কাইপের মাধ্যমে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের এ মামলার ব্যাপারে মন্তব্য ও পর্যবেক্ষণে দেশের মানুষের মধ্যে এ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, মাওলানা সাঈদীকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ফাঁসানো হয়েছে। তার মৃত্যুদণ্ডে মানুষ কতটা বিুব্ধ হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় সপ্তাহকাল ধরে দেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার মধ্যে। শাহবাগে কিছু ব্লগারের উদ্যোগে স্থাপিত (ভারতীয় পত্রিকার বক্তব্য অনুযায়ী নয়াদিল্লির মদদে স্থাপিত) প্রজন্ম চত্বর থেকে অবিরাম ফাঁসির দাবি জানানোর পর মাওলানা সাঈদীকে দেয়া ফাঁসির দণ্ডাদেশ আরো বেশি প্রশ্নের মুখে পড়ে। এটি আরো উত্তেজনার সৃষ্টি করে যখন শাহবাগ মঞ্চের আয়োজক ব্লগারদের মধ্যে আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর প্রতি কুৎসা রটনা করে লেখাগুলো প্রকাশ হয়ে পড়ে। মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া এবং শাহবাগের ব্লগারদের রাসূল সা:-এর প্রতি কুৎসামূলক লেখা প্রকাশের পর সারা দেশে যে সহিংস আন্দোলন গড়ে ওঠে সেটিকে অন্য দিকে প্রবাহিত করতে সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন মন্দির বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। সরকার এ ঘটনার জন্য সাথে সাথেই বিরোধী দলের আন্দোলনকে দায়ী করলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে এই অপকর্মে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা ধরা পড়ার পর নতুন রহস্যের সৃষ্টি হয়। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট সাংবাদিক কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদের বক্তব্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের ইসলামি উগ্রবাদীরা হিন্দু-বৌদ্ধদের প্রতি আক্রমণাত্মক নয়, তারা বাম ও প্রগতিশীল মুসলমানদেরই তাদের প্রধান শত্রু মনে করে। আক্রমণটা তাদের ওপরই চলছে অনেক দিন ধরে। রামুর ঘটনায় দেখা গেছে, ধর্মান্ধ মুসলমানদের ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রভৃতি দলের লোকেরা নারকীয়তায় উৎসাহ দিয়েছে। বর্তমানে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে যে হামলা হয়েছে এবং হচ্ছে, তাতে কারা জড়িত তা তদন্তে সরকারের আগ্রহ দেখা যায়নি। অনেক জায়গায় সরকারি দলের লোক জড়িত, সে তথ্য কোনো কোনো মাধ্যমে আসছে।’ তিনি মনে করেন, ‘ভারতের সাম্প্রদায়িক শক্তি যদি হিন্দুদের স্বার্থ রার প্রশ্নে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তাতে বাংলাদেশের দেড় কোটি হিন্দুর কোনো উপকার হবে না, একটি দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির সৃষ্টি হবে। তাতে তি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের, সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের। দুনিয়ার কোথাও সংখ্যালঘুরা অশান্তিতে থাকলে সংখ্যাগুরুরা শান্তিতে থাকতে পারে না।’
এ প্রসঙ্গে রহস্যের ব্যাপার হলো হঠাৎ করেই বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ২০ বছর পরে বাংলাদেশে কোনো হিন্দু থাকবে না। সৈয়দ আবুল মকসুদের মতে, বাঙালি জাতির ইতিহাসে এর চেয়ে নির্মম উক্তি আর কোনো দিন উচ্চারিত হয়নি। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘দেড় কোটি হিন্দু যাবে কোথায়? কেন যাবে হাজার বছরের পূর্বপুরুষদের বাড়িঘর ফেলে? নষ্ট রাজনীতির কারণে এক দিন গেছে, আজ কেন যাবে। তার কথাটি অনেকে উপভোগ করবেন, কারণ এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা একটি প্রধান উপাদান। মুসলমানদের কেউ বগল বাজাবেন, হিন্দুদের জমি কিনতে পারবেন। কিন্তু ওই ঘোষণা শোনার পর আমার লোম খাড়া হয়ে যায়, কোটি কোটি সাধারণ হিন্দুর মতো আমারও বুক কাঁপে।’
রামু ও উখিয়ায় সংঘটিত ঘটনার মতোই সাম্প্রতিক হিন্দু মন্দিরে ভাঙচুরের বিষয়টিও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। ঠিক এ সময়টাতে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের ভবিষ্যতে বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ বাংলাদেশের ধর্মীয় সহনশীলতার যে ভাবমর্যাদা রয়েছে তাকে ুণœ করবে মারাত্মকভাবে। কিন্তু তিনি কেন এ ধরনের মন্তব্য করতে গেলেন? এর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে নিয়েও তিনি এমন কথা বলেছেন, যা নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। যার সাথে বর্তমান সরকারের অনুসৃত নীতিও মেলে না।
উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে এই ইস্যুর গভীরতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। শ্রীলঙ্কায় মুসলিমদের সাথে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের শত শত বছর ধরেও সহনশীল ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তামিল বিদ্রোহ দমনে সাফল্য লাভের পর সেখানেও বিক্ষিপ্তভাবে বৌদ্ধ-মুসলিম উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। পাকিস্তানে এই উত্তেজনার বিষয় বানানো হয়েছে শিয়া-সুন্নি মুসলিমের মধ্যে। আগামী বছর ভারতে সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচন এ বছরও এগিয়ে আসতে পারে। ভারতে নির্বাচনের আগে কাকতালীয়ভাবে প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দেয়। এবারো দিচ্ছে। উপমহাদেশের চারটি দেশেই সরকারের পরিবর্তন হবে ২০১৩, ২০১৪ বা ২০১৫ সালে। এ পরিবর্তন বিশ্ব রাজনীতির জন্যও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে আগামী ১১ মে পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের আগামী অক্টোবরে নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময় হলেও রাজনৈতিক পরিবর্তন আসন্ন বলে ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে চার দিকে। মিয়ানমারে ২০১৫ সালে সাধারণ নির্বাচনের সূচি রয়েছে। এসব পরিবর্তনের সাথে চলমান অস্থিরতার একটি সম্পর্ক থাকতে পারে। আর এর সাথে দক্ষিণ এশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ ও বিনিয়োগ বাজার দখলের একটি সম্পর্কও থাকতে পারে। বিকাশমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে এশিয়ার এই অঞ্চল জ্বালানি ুধার এলাকা হিসেবে পরিচিত। আর বঙ্গোপসাগরে রয়েছে জ্বালানি সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার। এই ভাণ্ডারে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে। বাংলাদেশ সেই প্রতিযোগিতার শিকারে পরিণত হওয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে দেশের সর্বশ্রেণীর মানুষকে হতে হবে সতর্ক, তা না হলে আজ যে সঙ্ঘাতের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তা দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধে পরিণত হতে পারে। আফ্রিকার সঙ্ঘাতময় অনাকাক্সিক্ষত দেশের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বাংলাদেশেও। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ হয়ে পড়ে অনিবার্য। অন্তরাল থেকে কেউ এ ধরনের হস্তক্ষেপের কারণ তৈরি করতে কাজ করছে কি না তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads