মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্মকে পেছনে ছুড়ে ফেলে কেউ যুদ্ধে নামেনি। রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা জামাতে নামাজ আদায় করেছে। এমন বহু ঘটনার কথা আমরা জানি। মুক্তিযুদ্ধের মূল সনদ ও বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার কপি আমরা দেখেছি। সেখানে ধর্মহীন রাজনীতির একটি শব্দও লেখা নেই। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেটা ছিল দুই অঞ্চলের (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) ব্যাপক অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বৈষম্য থেকে পূর্ব অঞ্চলের মানুষকে রক্ষা করা, এমনকি পাকিস্তান ভেঙে যাক, এটাও বঙ্গবন্ধু চাননি। পাকিস্তানি শাসকদের গোঁয়ার্তুমির কারণে পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হয়। ওই সময় দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায় লিড নিউজ হয়ে প্রকাশ পায় এসব কথা। মূল কথা হলোÑ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মর্মবাণীটি ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। ৪২ বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে জাতিকে মুক্তি দেয়া ছয় দফার এই শিল্পীত বিজ্ঞানের কথা ভুলে গিয়ে উল্টো ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করেছি। এর ফলে বাংলাদেশ ৪২ বছরেও মালয়েশিয়ার ধারেকাছে আসতে পারেনি, যা মালয়েশিয়া পেরেছে মাত্র ২০ বছরে। ১৯৬৮-৭০ সালে এমনকি স্বাধীনতার পরেও মালয়েশিয়ার স্কোর মার্ক বাংলাদেশের নিচে ছিল।
শাহবাগে নতুন প্রজন্মের রাজাকারের ফাঁসি চাইÑ এর সাথে যে জাগরণ শব্দ আমরা শুনতে পেয়েছিলাম, সেটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সম্পৃক্ত নয়। নতুন প্রজন্মের গড়া প্রজন্ম চত্বর মূলত ভুল পথে ধাবিত হয়েছিল। কারণ এদের জন্ম ’৭১-এর বহু পরে। এরা এখন যা বলছে, তা সম্পূর্ণ বিশেষ কোনো দলের শিখানো বুলি। আমরা মনে করি, নতুন প্রজন্ম যখন মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, এর লক্ষ্য উদ্দেশ্য কী ছিল, তা তাদের না জানাই স্বাভাবিক। দেশের পত্রপত্রিকা এবং বই-পুস্তকও বিভ্রান্তিতে ভরা। সব কিছুই দলকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। দেশকেন্দ্রিক যদি হতো, তাহলে বাংলাদেশ দণি এশিয়ার এক নম্বর রাষ্ট্রে পরিণত হতো। অর্থনৈতিক মুক্তিই ছিল প্রকৃত অর্থে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’। এই চেতনার কথা কেউই বলে না। যদি বলত তাহলে আজকের এই বিভাজন দেশে থাকত না। সবাই দেশকে গড়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করত। প্রতিটি দলের মধ্যেই এই চেতনা আমরা দেখতে পেতাম। গোটা বিশ্বে এখন চলছে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জনের যুদ্ধ। কে কার আগে যেতে পারেÑ এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। জাপানকে টপকে চীন এখন এশিয়ার এক নম্বর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ভারত প্রতিযোগিতা করছে কিভাবে চীনকে টপকানো যায়। অন্য দিকে আমরা অতীতমুখী বিভ্রান্তি কিছু শব্দ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করছি। এসব করে আমরা শুধু পিছিয়ে যাচ্ছি। একটি সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রের মৃত্যুর জন্য দায়ী এসব বিভ্রান্তিমূলক কর্মকাণ্ড। বিষয়টি অতি লজ্জাকর। এ লজ্জা ঢাকি কিভাবে। ভোগবাদী ক্ষমতালোভী জ্ঞানপাপীদের কারণে এসব ঘটছে।
নতুন প্রজন্মের দোষ দেবো না। কারণ তাদের নেপথ্যে যারা কাজ করছেন, তারা দলীয় স্বার্থে ও ক্ষমতার স্বার্থে নতুন প্রজন্মের তারুণ্যের উচ্ছ্বাসকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার প্রয়াস চালাচ্ছেন। তরুণ প্রজন্মেরা নিজের বিবেক দিয়ে পরিচালিত হতে পারেননি। যদি পারতেন তাহলে মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার স্বপ্নটা নিয়ে ময়দানে নামলে সবারই সহযোগিতা তাদের পক্ষে থাকত।
নতুন প্রজন্মের প্রতি আকুল আবেদন, বাংলাদেশ সম্পদশালী একটি রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও কেন আজ দেশটি পিছিয়ে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের এই মূলমন্ত্রকে আঁকড়ে ধরে শাসকগোষ্ঠী যারা ৪২ বছর ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল, তারা কেন বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। নতুন প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এই ব্যর্থতার বিচার চাওয়া উচিত ছিল এ শাহবাগের জাগরণ মঞ্চ থেকে। তাহলেই তারা দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছেই গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে সমর্থ হতো।
স্বাধীনতার পরে ক্ষমতাসীনেরা প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্রের মূলনীতিকে সংবিধানে ভারতীয় সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে রচিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে এরা সফল হয়। এরা ভারতীয় রাষ্ট্রের মূল নীতিমালা বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশ করে। পরবর্তী সময় একেই ঢালাওভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে প্রচার চালাতে থাকেন, তাদের আজ্ঞাবহ এ দেশীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে (শাহবাগ) অবিকল ভারতীয় আজ্ঞাবহ দলটির নীতি আদর্শ যেটা ভারতীয় সংবিধানের আলোকে তৈরি করা হয়েছিল, তারই প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। সুতার নাটাই অন্যের হাতে। তাদের শব্দমালা, সংস্কৃতির আচরণ এবং স্লোগান এসব কিছু হুবহু মিলে যায় একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের মূল এজেন্ডার সাথে। এ কারণে অন্য আরেকটি বড় দল তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে দেখা যায়। ১৬ কোটি মানুষের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি শাহবাগের তারুণ্যের কাছে ধরা পড়েনি। মূলত তরুণ প্রজন্মর অনেকটাই ওই বিশেষ দলের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক ধ্যানধারণা না থাকার কারণে। অর্থও এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
মুক্তিযুদ্ধে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ছিল না মোটেই। বর্তমান বহু ইসলামি দলের মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। এমনকি জামায়াতে ইসলামেও মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা শুধু একটি বিশেষ দলের মধ্যেই ছিল আর অন্য কোনো দলে ছিল না এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। মুক্তিযুদ্ধকে সীমাবদ্ধ একটি দলের মধ্যে নিয়ে আসাও একটি অন্যায় কাজ। বিগত দুই দশকের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি রমরমা ব্যবসায় শুরু হয়েছে। যখন যে সরকার আসে এই মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাটাও জ্যামিতিক পদ্ধতিতে বাড়িয়ে কমিয়ে দেখানো হয়। আমরা মনে করি, মুক্তিযুদ্ধ একটি সার্বজনীন বিষয়। এটাকে নিয়ে কোনো দলের রাজনীতি শোভনীয় নয়। মনে হয় যেন পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। একমাত্র বাংলাদেশেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। উত্তর সুদান, পূর্ব তিমুর, ফিলিস্তিন, ইথিওপিয়াÑ এসব দেশও মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এরা কলহে লিপ্ত হয়নি পরবর্তী কোনো সময়ে। অতীতে যারা ক্ষমতায় ছিলেন এবং বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছেন, সবাই সেই পুরনো ইতিহাস নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে একটি দ্বন্দ্বযুদ্ধ বাধিয়ে পুরো পাঁচটি বছর সময়ক্ষেপণ করেন। মূলত পুরনো ইতিহাস নিয়ে দুই পক্ষ বা দলের মধ্যে বিবাদ জিইয়ে রেখে দেশটাকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। পঞ্চ ইন্দ্রিয় সক্রিয় থাকলে কোনো মানুষ এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে পারে না। ভারতের দিকে তাকান, সেখানে এত দীর্ঘ সময় ধরে এ ধরনের কোনো মঞ্চ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ এরা জানে, এতে শুধুই জাতির মধ্যে বিভাজন তৈরি হবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না। প্রজন্ম চত্বর জাতির মধ্যে শুধু বিভাজন নয়, নাগরিক সমস্যাও বাড়িয়েছে। ছাত্রদের লেখাপড়া থেকে শুরু করে এর জের ধরে দেশে যে হরতাল, ধর্মঘট, বাগ্যুদ্ধ হচ্ছে তাতেও দেশের প্রতিদিন শত শত কোটি টাকা গচ্ছা যাচ্ছেÑ এ চিন্তা বড় দুটো রাজনৈতিক দলের মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। দেশে যা ঘটছে, বড় দুটো দল এর দায় থেকে কোনোভাবেই রেহাই পাবে না। গৃহযুদ্ধ বাধলে লাভবান হবে ওই রাষ্ট্রটি, যারা প্রজন্ম চত্বরের গণজাগরণকে বাহবা দিয়ে উসকে দিয়েছে। তাদের গণমাধ্যমও সরব ভূমিকা পালন করেছে, যার কারণে বর্তমানে ওই প্রজন্ম চত্বরকে কেন্দ্র করে দেশে মারমার কাটকাট একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে মূলত লাভবান হয়েছে বেনিয়া গোষ্ঠীরা আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা।
লেজুড়বৃত্তি করা তরুণদের কাজ নয়। প্রকৃত মানুষ হওয়া তাদের কাজ। তাদের ব্যবহার করে কেউ কেউ ফায়দা লুটবে আর দেশ যাবে অতলে ডুবেÑ এটা কোনো দেশপ্রেমিক মানুষ চাইতে পারে না। যারা আমাদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়, তাদের দেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন জাতীয় ইস্যুতে তারা এক টেবিলে বসে আলাপচারিতা করতে দেখা যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর ওপর সহিংস তাণ্ডব নিয়ে শাসক দল (কংগ্রেস) বিরোধী দলের (বিজেপি) সাথে লোকসভায় বসে আলোচনা করেছেন এবং বাংলাদেশের সরকারের কাছে তদন্তপূর্বক এ ব্যাপারে ত্বরিত অ্যাকশন নেয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। আমরা কিন্তু সীমান্তে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশীদের ভারতীয় বিএসএফের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে একসাথে আজ পর্যন্ত আলোচনা করতে পারিনি। জাতীয় ইস্যুতে ওরা এক হতে পেরেছে, আমরা পারিনি। দুই দলের লজ্জা পাওয়া উচিত।
দশম সংসদ নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে (সময় বাকি আছে মাত্র ছয় মাস) আজো দুই দল একসাথে বসে সিদ্ধান্ত নিতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এসব ব্যাপারে বিদেশী কূটনীতিকদের শরণাপন্ন হচ্ছে। ভারত কিন্তু কোনো সময় তা করেনি। নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেরা করতে না পারলে তার ব্যর্থতার নমুনা কী ধরনের হয় (ওয়ান ইলেভেন) তা নিকট অতীতেও দেখা গেছে। সামনে এর চেয়ে ভয়ঙ্কর বিপদ অপেক্ষা করছে। প্রজন্ম চত্বরের লোক দিয়ে এই ভয়ঙ্কর বিপদ রোখা যাবে না। বরং তা আরো দাবানলের রূপ ধারণ করবে। বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি পথই খোলা আর তা হলোÑ মুক্ত পরিবেশে মুক্ত চিন্তা নিয়ে মূল সমস্যার স্থায়ী সমাধানের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করা। কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, এটা সরকারকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে হবে এবং সেই পদ্ধতিটি সব রাজনৈতিক দলের মনঃপূত হতে হবে। তাহলেই বর্তমান জটিল সমস্যা থেকে গোটা জাতি ও দেশ মুক্তি পাবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন