ইরাক যুদ্ধের সময় মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে কিছু সাংবাদিক যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহে যোগ দিয়েছিলেন। তারা সেনাবাহিনীর সাথে অবস্থান করতেন। এসব সাংবাদিককে সৈন্যদের সব নিয়মবিধি মেনে চলতে হতো। তাদের পাঠানো সব রিপোর্ট বা প্রতিবেদন এবং টেলিভিশনের জন্য ভিডিও সেনাবাহিনীর ইউনিট কমান্ডারের অনুমতিসাপেক্ষে প্রচার করা হতো। এসব সাংবাদিক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে স্বাধীনভাবে কোনো রিপোর্ট বা ভিডিও পাঠাতে পারতেন না। ইরাক যুদ্ধের এই সংবাদ পাঠানোর প্রক্রিয়া থেকে সাংবাদিকতার ইতিহাসে ইমবেডেড জার্নালিজম নামে নতুন একটি অভিনব পদ্ধতির উদ্ভাবন। সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড এ পদ্ধতির উদ্ভাবক; অর্থাৎ রাষ্ট্রের যুদ্ধ কৌশলের অংশ হিসেবে সৈন্যদের সাথে সাংবাদিকদের জুড়ে দেয়ার এই প্রচার যুদ্ধের কৌশল তার মাথা থেকে এসেছে। ডোনাল্ড রামসফেল্ড সাংবাদিকতার এই নতুন পন্থাকে একটি বিপ্লবাত্মক বা রেভ্যুলিউশনারি উদ্যোগ বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে লাইভ প্রোগ্রামের মাধ্যমে যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি মানুষের সামনে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে। আর খবর সংগ্রহে ইমবেডেড সাংবাদিকদের ইউনিট কমান্ডারের ঠিক করে দেয়া স্থান থেকে লাইভ সম্প্রচার করতে হয়েছে। আর রিপোর্টের ভাষা বা শব্দ প্রয়োগে সংযত থাকতে হয়েছে। এসব সাংবাদিককে স্বাধীনভাবে কোথাও গিয়ে ভিডিও ধারণ করার অনুমতি দেয়া হতো না। যুদ্ধক্ষেত্রে যতটুকু তাদের দেখা ও শোনার অনুমতি দেয়া হতো, ততটুকুই তারা দেখতে ও শুনতে পারতেন। সেনাবাহিনীর যানবাহন নিয়ে তাদের চলাচল করতে হয়েছে। ইমবেডেড জার্নালিজমের যুৎসই বাংলা শব্দ পাওয়া দুষ্কর। তবে অনেকে শয্যাশায়ী সাংবাদিকতা, পরাশ্রয়ের সাংবাদিকতা বা আশ্রয়দাতাদের মনোরঞ্জনের সাংবাদিকতা বলে এর ভাবানুবাদ করেছেন; অর্থাৎ এসব সাংবাদিক যাদের আশ্রয়ে আছেন তাদের ইচ্ছা বা মনোরঞ্জনে সংবাদ পরিবেশন করতে হয়েছে। এখানে স্বাধীন সাংবাদিকতা, বস্তুনিষ্ঠতা কিংবা সাংবাদিকদের মান-মর্যাদার প্রশ্ন অবান্তর।
২.
বাংলাদেশে এখন সঙ্ঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যদিও ইরাক যুদ্ধের সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতির কোনোভাবেই তুলনা চলে না। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, জাতি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। এক দিকে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ অপর দিকে ইসলাম ও ভূখণ্ডগত স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। যার নেতৃত্বে আছেন বাংলাদেশে নির্মূলের রাজনীতির প্রবক্তা কিছু বুদ্ধিজীবী ও ধর্মবিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদ প্রচারের সাথে জড়িত কিছু তরুণ। আর অপর অংশে রয়েছে একেবারে সমাজের সাধারণ মানুষ, আলেম সমাজ এবং সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আমরা এখন এক ধরনের মনোরঞ্জনের সাংবাদিকতার ধারা লক্ষ করছি। জাতিকে বিভাজনের কাজটিও ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারছে এসব গণমাধ্যম। বাংলাদেশে জনমত গঠন এমনকি রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে কিভাবে গণমাধ্যম এজেন্ডা ঠিক করে দেয়, শাহবাগের আন্দোলন তার একটি বড় উদাহরণ। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই রায়ের প্রতিবাদে আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি জানিয়ে ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টের ব্যানারে কয়েকজন তরুণ সমবেত হয় শাহবাগে। কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল এই সমাবেশের খবরটি শুধু গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেনি, প্রথম দিন থেকেই লাইভ সম্প্রচার করতে থাকে। একসাথে প্রায় ১০টি টেলিভিশন চ্যানেল এভাবে লাইভ সম্প্রচারে সাধারণ মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে শাহবাগ। ব্লগারদের সাথে প্রথমে যোগ দেয় বাম ছাত্র সংগঠনগুলো। ক্ষমতাসীন দলের হাই কমান্ডের নির্দেশে দ্রুত ছাত্রলীগ শাহবাগ মঞ্চের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ফলে শাহবাগে জনসমাবেশ বাড়তে থাকে। এ সময় একুশের বইমেলা চলায় প্রতিদিন বিকেলে উপস্থিতি বেড়ে যেতো। গান-বাজনা আর চলচ্চিত্র দেখানোয় শাহবাগ হয়ে ওঠে এক ধরনের বিনোদন কেন্দ্র। এই আন্দোলনে ক্ষমতাসীন দলের চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সদস্য ইমরান এইচ সরকার শাহবাগ মঞ্চের নেতা হিসেবে হাজির হন। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো শুধু ২০ দিন ধরে লাইভ সম্প্রচার করেনি, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের প্রতিদিনের প্রধান খবর হয়ে ওঠে শাহবাগ। এই প্রচারণায় শাহবাগে জনসমাগম শুধু বাড়ায়নি। এই সমাবেশকে দেশের মানুষের জনমতের প্রতিফলন বলে তুলে ধরা হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার রাজীবের হত্যার পর এই আন্দোলনের নেপথ্য ব্যক্তিদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। কিন্তু সরকার স্পষ্টত ব্লগারদের পক্ষ নেয়। প্রধানমন্ত্রী নিহত রাজীবের বাসায় যান। একজন আওয়ামী লীগ নেতা তাকে আখ্যা দেনÑ ‘মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় শহীদ’ হিসেবে। ভারত প্রকাশ্যে শাহবাগ আন্দোলনে সমর্থন জানায়। এর পরও সাধারণ মানুষ এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ঠিকই বুঝে নেয়। ধীরে ধীরে শাহবাগের হাওয়া বদলে যেতে থাকে।
জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর দেশজুড়ে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। এক দিনে মারা যায় ৬৬ জন। এর মধ্যে চিকিৎসা শেষে বিরোধীদলীয় নেতা ঢাকায় ফিরে সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক দেন। বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাগের আন্দোলনকারীদের নষ্ট তরুণ এবং এই মঞ্চ ভেঙে দেয়ার আহ্বান জানান। এর আগে হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামপন্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় শাহবাগের আন্দোলনের পেছনে নাস্তিক কিছু ব্লগার মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। তারা তাদের শাস্তি দাবি করেন। এরপর আমরা দেখলাম শাহবাগের জনস্্েরাত থেমে গেছে। উপস্থিতি কোনোভাবেই আর বাড়ানো যাচ্ছে না; প্রশ্ন হচ্ছে শাহবাগের এই জনসমাগম যদি প্রকৃত অর্থে ফাঁসি চাই আন্দোলনের প্রতিফলন হতো, তা হলে সাঈদীর রায়-পরবর্তী বিরোধীদলীয় নেতার এক বক্তব্যের পর জনসমাগম কেন কমতে থাকল? এখনো কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল শাহবাগের খবর গুরুত্বের সাথে প্রচার করছে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ও জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে অনশন চলছে। কিন্তু জনগণ কেন তাতে অংশ নিচ্ছে না? বিকল্প সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া ইমরান এইচ সরকার বিভিন্ন ধরনের নির্দেশ ও আহ্বান জানাচ্ছেন; কিন্তু তাতে কোনো সাড়া মিলছে না। কারণ মিডিয়ার বিভ্রান্তি মানুষের সামনে এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে। আন্দোলনের চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের বৈঠকেও বেশির ভাগ সদস্য শাহবাগের মঞ্চ ভেঙে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আসলে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশে ইসলামের পক্ষে একটি গণজাগরণ হয়েছে। যেখানে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অংশগ্রহণ করেছে। দেশের গণমাধ্যম এই জাগরণকে আড়াল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো শাহবাগের এই মঞ্চে শয্যাশায়ী হয়েছিল। পতিত বাম প্রভাবিত সরকারের মনোরঞ্জনের জন্যই তারা প্রচারযন্ত্রকে মাত্রাহীনভাবে ব্যবহার করেছে। গণমাধ্যমই এর আদুরে নাম দিয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। কিন্তু এই গণজাগরণ ছিল আশ্রিত জাগরণ, যা সৃষ্টি করেছিল মিডিয়া। শাহবাগের আন্দোলনের পরিণতি প্রমাণ করে শুধু গণমাধ্যমের প্রচারণার ওপর ভিত্তি করে জনসমাগমের মাধ্যমে গণজাগরণ হয় না। এমনকি সরকারের সমর্থনে ব্যবসায়ীদের চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে বিরিয়ানি-পোলাও খাইয়ে; পুলিশি নিরাপত্তায় কোনো গণজাগরণ সম্ভব নয়। এ জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি দরকার। শাহবাগের আন্দোলনকে যখনই দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল এবং দেশের সামাজিক শক্তির উৎস আলেম সমাজ চ্যালেঞ্জ করেছে, তখনই ফানুসের মতো উড়ে গেছে।
৩.
এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের গণমাধ্যম কি এই রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়? অবশ্যই ওয়াকিবহাল। সমস্যা হচ্ছে মনস্তত্ত্ব। ধরা যাক একজন প্রবীণ সম্পাদকের কথা। সংবাদপত্রটি যখন প্রকাশ হয়, তখন একটি বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছিল। অনেকগুলো কাঁচামরিচের মধ্যে একটি মাত্র পাকা মরিচ; অর্থাৎ সব সংবাদপত্র বা সম্পাদক কাঁচা হলেও এই পত্রিকার সম্পাদক ভীষণ রকম পাকা। কয়েক দিন আগে পত্রিকাটি ছবি ছাপার ক্ষেত্রে ভয়ানক এক কাঁচা কাজ করে ফেলেছে। বিরোধীদলীয় নেতার বগুড়ার সমাবেশের ছবি ছাপানোর ক্ষেত্রে পুরনো একটি ছবিকে বগুড়ার সমাবেশের ছবি বলে চালিয়ে দেয়া হয়। আর এই ভুল ধরে দিলেন এমন একটি সংবাদপত্র যারা সম্পাদককে তথাকথিত এই পাকা সম্পাদকেরা বিভিন্নভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার চেষ্টা করেন। পেশাদার সাংবাদিক নন বলে এক ধরনের নাক সিটকানো ভাবও আছে। কিন্তু এই সম্পাদক নয়া দিগন্তে দীর্ঘ সময় কলাম লিখেছেন। তখন এবং এখনো তার কলাম সমান জনপ্রিয়। পত্রিকাটির সার্কুলেশনও প্রতিদিনই বাড়ছে বলে জানি, যা হোক এখানে কাঁচা বা পাকা সম্পাদক নিয়ে আমরা আলোচনা করতে চাই না। বিরোধী দলের নেত্রীর পুরনো ছবি ছাপার এই যে মানসিকতা এর কারণ হচ্ছে অনেক সাংবাদিক এমন কথা প্রকাশ্যই বলেন, বিএনপি এমন কী রাজনৈতিক দল। বিরোধীদলীয় নেতাকেও তারা সেভাবেই বিবেচনা করেন। কিন্তু তিনি যে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং সর্বাধিক ভোটে বিজয়ী রাজনৈতিক নেত্রী এই কথাটি এই সাংবাদিক বা সম্পাদকেরা প্রায়ই ভুলে যান। এই সম্পাদকেরা ভুলেই গেছেন বিরোধীদলীয় নেতা ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত চারটি নির্বাচনে পাঁচটি আসনে বিজয়ী হয়েছেন। ২০০৮ সালে তিনটি আসনে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা ছিল এবং তিনি তিনটি আসনেই বিজয়ী হয়েছেন। এ ছাড়া তিনি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন সময় নির্বাচন করলেও কোনো আসনে পরাজয় বরণ করেননি। তিনি ফেনী, বগুড়া, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, খুলনায় বিভিন্ন নির্বাচনী আসনে প্রতিদ্বন্দিতা করে বিজয়ী হয়েছেন। এই দিক দিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবেও তাকে উল্লেখ করা যায়। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতার সংবাদ বা ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের নেতিবাচক ভূমিকা রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী নিয়ে সংবাদ পরিবেশনে গণমাধ্যমের এই ভূমিকা আরো বিস্ময়কর। বাংলাদেশে সবচেয়ে অল্প সময়ে খ্যাতিমান রিপোর্টার হওয়ার সহজ উপায় হচ্ছে জামায়াত-শিবির বা ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল নিয়ে রিপোর্ট করা। কারণ এসব দল নিয়ে কোনো খবর বা মতামত প্রকাশে যাচাই-বাছাই বা সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যের দরকার হয় না। শুধু প্রয়োজন খানিকটা কল্পনাশক্তি ও মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখার ক্ষমতা। কারণ জামায়াত-শিবির বা ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল নিয়ে কোনো স্টোরি করতে পারলে নির্ঘাত লিড বা সেকেন্ড লিড। ফলে রিপোর্টারের নাম চার দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। তার কদরও বাড়ে। আজ এই সংবাদপত্র বা টেলিভিশন তো ছয় মাসের মধ্যে অন্য সংবাদপত্র বা টেলিভিশনে চাকরি হচ্ছে। কদরের সাথে বেতনও বাড়ছে। এই সাংবাদিকেরা অন্তত এ কারণে জামায়াত-শিবিরের ওপর কৃতজ্ঞ থাকতে পারেন এই দল না থাকলে বেতন বাড়া কিংবা বেশি বেতনে চাকরি বদলের প্রক্রিয়াটি থেমে যাবে।
এখন আমরা এই সময়ে গণমাধ্যমের বহুল প্রচলিত তাণ্ডব শব্দটির দিকে নজর দেই। এখন প্রতিদিন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের খবর থাকছে। এই তাণ্ডবের উৎসটি হচ্ছে জামায়াত-শিবির মিছিল সমাবেশ করতে চাইলে পুলিশ বাধা দিচ্ছে এ নিয়ে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হচ্ছে। বিুব্ধ জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা কোথাও কোথাও গাড়ি ভাঙচুর করছে বা গাড়িতে আগুন দিচ্ছে।
জামায়াত-শিবিরের ইটপাটকেল কিংবা ককটেল নিক্ষেপে পুলিশ আহত হচ্ছে। আবার পুলিশের গুলিতে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা প্রাণ হারাচ্ছে বা আহত হচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের পুলিশের ওপর হামলা বা গাড়ি ভাঙচুর নিশ্চয়ই অপরাধ; কিন্তু এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না সভা-সমাবেশ-মিছিল করা সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে একজন ব্যক্তির অধিকার। কিন্তু পুলিশের সাথে জামায়াত-শিবিরের সব সংঘর্ষের খবর হয়ে যাচ্ছে তাণ্ডব। জামায়াত-শিবির যদি একপক্ষীয় তাণ্ডব চালায় তা হলে তাদের এত নেতাকর্মী আহত বা নিহত হচ্ছে কিভাবে? তা হলে তাণ্ডবের খবরের মধ্যে নিশ্চয়ই ফাঁক আছে। কোনো সংবাদকর্মী বা সম্পাদক কী খোঁজ নিয়েছেন রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বা সিরাজগঞ্জে যেখানে সহিংসতা হচ্ছে কেন সেখানে বারবার একই ঘটনা ঘটছে। এর প্রধান কারণ পুলিশের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন মামলায় হাজার হাজার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। এমন অনেক পরিবার আছে যে পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্য মাসের পর মাস বাড়িতে থাকতে পারছে না। এর ওপর ঘুষ বাণিজ্য তো আছে। ফলে নারী ও শিশুরা পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দেখিনি। এ পর্যন্ত যেসব লোক মারা গেলে সেসব পরিবারে কী বিপর্যয় নেমে এসেছে তা নিয়ে কোনো মানবিক রিপোর্টও আমরা দেখছি না। একটি দৈনিক পত্রিকায় সাতক্ষীরায় পুলিশের সাথে সংঘর্ষের সময় একজন আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যুর ওপর করুণ মানবিক রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু সাতক্ষীরায় পুলিশের গুলিতে ১৪ জন মানুষ মারা গেছে। তাদের পরিবারে কী কান্না নেই। সেসব পরিবারের মৃত্যুর বেদনার খবর কোথায়। আজকে জনগণের প্রতিরোধে গাছ কাটা নিয়ে হাহাকারের সীমা নেই। কিন্তু রংপুরের পীরগঞ্জে ধানক্ষেতে পুলিশ যে কৃষককে হত্যা করেছে সে পরিবারে হাহাকারের খবর কোথায়?
পুলিশের সাথে রাজনৈতিক কর্মীদের এ ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা বাংলাদেশে প্রথম ঘটছে তা নয়। শুধু ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের দিন দৈনিক সংবাদের খবর অনুযায়ী ১৫ ব্যক্তি মারা গেছে। জামায়াতের সাথে সে সময় আওয়ামী লীগ এই নির্বাচন ঠেকানোর জন্য আন্দোলন করেছিল। এ দিন আওয়ামী লীগের হামলায় একজন আনসার সদস্য নিহত হয়। ১৯৯৩-১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় একাধিক পুলিশ সদস্য মারা গেছে। বর্তমান কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ফার্মগেটে এক পুলিশ সদস্যের হাতের আঙুল কামড়ে নিয়েছিলেন। এ নিয়ে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশ হয়েছিল। আজকের বাস্তবতায় নিশ্চয়ই সেই ঘটনাও তাণ্ডব বা পুলিশের ওপর আক্রমণ ছিল। আবার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম যেদিন লাঠিমিছিল নিয়ে হাইকোর্টে হাজির হয়েছিলেন সেদিন ব্যাপক গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছিল; কিন্তু তা কি তাণ্ডব ছিল? কিংবা ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর প্রধান বিচারপতির এজলাস ভাঙচুর যারা করেছিল তারা কী প্রতিবাদ জানিয়েছিল না তাণ্ডব চালিয়েছিল? তখন কেন তাণ্ডব শব্দটি আবিষ্কার হয়নি। রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণেই কি শব্দটি হারিয়ে গিয়েছিল? আজকে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে বা টেলিভিশনে যে শব্দের ব্যবহার হচ্ছে তা মনোরঞ্জনের সাংবাদিকতার অংশ মাত্র। কারণ বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বড় অংশ শুধু আর্থিক কারণে নয় বিশ্বাস এবং নীতির দিক থেকে এখন সরকারের সাথে শয্যাশায়ী হয়েছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই গণমাধ্যমেই আবার পেশাদারিত্ব কিংবা বস্তুনিষ্ঠতার স্লেøাগান নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হচ্ছে। শাহবাগের আন্দোলনে গণধিকৃত পরিণতির মধ্য দিয়ে গণমাধ্যমের এই মুখোশ খুলে গেছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন