মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০১৩

সরকারের ‘রাবিশ’ অর্থমন্ত্রী


ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : 
বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে তিনি নিজে ছাড়া পৃথিবীর তাবৎ লোক ‘বোগাস’ আর ‘রাবিশ’। আবুল মাল সাহেব বিশ্বব্যাংকের অফিসার ছিলেন। তিনি ইংরেজি-টিংরেজি ভালোই জানেন বলে মনে করি। কিন্তু তিনি কীভাবে ধরে নিলেন যে, তিনি ছাড়া দুনিয়ার সকল লোক বোগাস আর রাবিশ, সেটি আমাদের পক্ষে অনুধাবন করা দুঃসাধ্য বিষয়। আশা করি আবুল মাল সাহেব অবগত আছেন যে, এই দু’টি ইংরেজি শব্দের কী মানে। ইংরেজি বোগাস শব্দটির অর্থ হচ্ছে, ‘জাল’, ‘মেকী’ ও ‘বাজে’। আর রাবিশ অর্থ ‘আবর্জনা’, ‘জঞ্জাল’, ‘ময়লা’; কখনও বা ‘নিরর্থক বাক্য’। আবুল মাল ছাড়া পুথিবির আর সব মানুষ হলো গিয়ে জাল, , মেকী, বাজে, আবর্জনা ও ময়লা। আর তিনি একেবারে সাফফান সাফফা। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, এ পর্যন্ত বহু লোককে তিনি ওরকম ভাষায় কটূক্তি করেছেন। কিন্তু কেউই বুঝতে পারছেন না, এ ধরনের কটূক্তি করার জন্য তার কী আকাশচুম্বি যোগ্যতা আছে। বরং জনসাধারণ তো প্রশ্ন করতে পারে, অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার যোগ্যতা একেবারেই শূন্যের কোঠায়। তাকে রাবিশ বলার সময় হয়ে গেছে। 
তার দৃষ্টিতে, দেশের পত্রপত্রিকাগুলো রাবিশ, দেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়া রাবিশ, বিভিন্ন জাতীয় গুর”ত্বপূর্ণ বিষয়ে আর সিদ্ধান্তের সঙ্গে যারা একমত নন, তারা সব রাবিশ। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পদলেহী এই আবুল মাল সমাজের কেবল ক্রিমই খেয়ে এসেছেন। এরশাদ আর আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যকার সখ্যতা কোনো রাখঢাক ব্যাপার নয়। এমন কি এই সাম্প্রতিক কাল পর্যন্তও নয়। এরশাদ নানা সময় নানা কথা বলে থাকেন। আজ যদি এক কথা বলেন, তা হলে ধরে নেয়া যায় যে, আগামীকাল তিনি ভিন্ন কথা বলবেন। কিন্তু শেখ হাসিনার সঙ্গে তার সখ্যতা খুবই দৃঢ়। তিনি বাইরে বাইরে অনেক সময় বলেন যে, যে কোনো সময় তিনি এই সরকারের মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাবেন। এটি সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু গত সপ্তাহে মিরপুর-বিমানবন্দর ফ্লাইওভার উদ্বোধনের সময় এরশাদ গদগদ হয়ে শেখ হাসিনাকে জানিয়ে দেন যে, সরকারের বিপদের সময় তিনি শেখ হাসিনাকে ছেড়ে যাবেন না। আসলে এরশাদের ফটর ফটরের মানে সাধারণ মানুষের এখন আর জানতে বাকি নেই। যদি বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচনে যায় সরকার, তাহলে এরশাদ হবেন বিরোধী দলের নেতা। এভাবেই ১৯৯৬ সালে এরশাদের পাতানো নির্বাচনে গিয়ে শেখ হাসিনা তাকে আরও কিছুটা সময়ের জন্য আয়ু দিয়েছিলেন।
সে পথেই আবুল মাল শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি ও বর্তমানে সরকারের ‘রাবিশ’ অর্থমন্ত্রী। বাংলাদেশে অর্থনীতিতে যে দুর্বৃত্তায়ন, লুট, চালিয়াতি-জালিয়াতির যে মহোৎসব চলছে, এখন তার থাইলতদারে পরিণত হয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল। আমরা সব সময় লক্ষ্য করেছি যে, দেশে কোনো একটি দুর্নীতির ঘটনা ঘটলে অমনি অর্থমন্ত্রী ফাল দিয়ে তার পক্ষাবলম্বন করেছেন। তবে কখনও কখনও তার আচরণে মনে হয়েছে, তিনি বোধকরি অপ্রকৃতিস্থ। কখনও কখনও তিনি আবার নিজেই বলেছেন যে, তিনি বুড়ো মানুষ, কখন কী বলেছেন, ঠিক নেই।
সরকার যখন জিয়া পরিবারের সকলের বির”দ্ধে কাল্পনিক দুর্নীতির মামলা একের পর এক সাজিয়ে যাচ্ছে, তাদের বির”দ্ধে সরকারের যখন লুটপাটের অভিযোগ একেবারে প্রাতঃস্মরণীয়, তখন শেখ হাসিনা সরকারের লোকেরা দৃশ্যত মাত্র ১৭ হাজার কোটি টাকা শুধুমাত্র সরকারি ব্যাংক থেকেই হাতিয়ে নিয়েছে। জিয়া পরিবারের বির”দ্ধে শেখ হাসিনা আঁচল-বিছিয়ে-ডেকে-আনা মইনউদ্দিন আহমেদের সরকার ও তাদের চক্রান্তে ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার সরকার তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাদের দুর্নীতির কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। তারপরেও তাদের বির”দ্ধে অবিরাম দোষারোপের কোনো কমতি নেই। শেখ হাসিনাসহ তার মন্ত্রী এমপি-নেতানেত্রীরা সে গীত অবিরাম গেয়েই যাচ্ছেন। আর তাদের বির”দ্ধে নতুন নতুন মামলা দিয়েই যাচ্ছেন। সরকার কতোটা নির্লজ্জ হলে এটা সম্ভব হচ্ছে, সেটা বোধকরি জনগণকে বুঝিয়ে বলার দরকার হবে না। এ রকম নির্লজ্জ সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল। অতএব তার কাছ থেকে খুব বেশি কিছু আশা করা বাতুলতা মাত্র।
বাংলাদেশে এখন লুটেরাদের রাজত্ব চলছে। হলমার্ক যখন সোনালী ব্যাংক ও আরও কয়েকটি ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লুটে নিল আর সে খবর যখন প্রকাশিত হয়ে পড়লো, তখন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তুড়ি মেরে সে অভিযোগ উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন। যেভাবে সৈয়দ আবুল হোসেনের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হওয়ার পর শেখ হাসিনা একেবারে সঙ্গে সঙ্গে আবুল হোসেনের পক্ষ নিয়ে বাগাড়ম্বর শুর” করে দিলেন। সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগের পর শেখ হাসিনা আবুল হোসেনকে বিরাট কর্মবীর আর মহান দেশপ্রেমিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। একইভাবে অর্থমন্ত্রী হলমার্ক দুর্নীতির মহানায়কের পক্ষে দাঁড়িয়ে বললেন, সরকারের কাছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা কোনো টাকাই নয়। এটা তো হতেই পারে। তাই যদি হয় তাহলে কারোরই পাঁচ-দশ কোটি টাকা আত্মসাতের জন্য এদেশে কোনো মামলাই দায়ের হওয়া উচিত না। অথচ জিয়া পরিবারের বির”দ্ধে তাদের দায়ের করা মামলায় দুর্নীতির ভুয়া অভিযোগেও এত বড় অংকের কথা বলা হয়নি। জিয়া পরিবারের কেউ কোনো দুর্নীতি করেছেন এসব কথা কেবলই ঢাকের বাদ্য। কিন্তু হলমার্ক যে জালিয়াতি করেছে ব্যাংকের পাতায় পাতায় তার প্রমাণ আছে।
তারপর সরকার জনমতের চাপে হলমার্কের তানভীর মাহমুদ ও তার স্ত্রী জেসমিন মাহমুদকে আটক করে। সেটা যে লোক দেখানো ছিল, তা আর এখন কাউকে বলে দিতে হচ্ছে না। গত ২৭ মার্চ অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘হলমার্ক যে টাকা নিয়ে গেছে তা জনগণের টাকা। এই টাকা উদ্ধার করতে হবে। উদ্ধারের জন্য দরকার কারখানা চালু করা। আর সে জন্যই ওদের দরকার আরও ঋণ।’ হলমার্কের এমডি ও চেয়ারম্যান কারাগারে। তাহলে এই ঋণ তারা কীভাবে নেবে? এই প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন,‘তাদের জামিনে বের করে আনার চিন্তা রয়েছে।’ সরকার জামিন দিতে পারে কিনা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন,‘হলমার্কের শ্রমিক-কর্মকর্তারা আমার কাছে দরখাস্ত করেছে। আর সরকার কেন জামিন দেবে? জামিন দেবে আদালত। আদালত সবসময়ই যৌক্তিক আচরণ করেন।’ এখানে শুধু দুর্নীতির পক্ষেই দাঁড়ানোই হলো না বরং অর্থমন্ত্রীর কথায় এটাও প্রমাণিত হলো যে, সরকার চাইলে আদালত জামিন দেবে।
এ নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এই কেলেঙ্কারি শুধু ব্যাংক খাত নয়, গোটা অর্থনীতিরই ক্ষতি করেছে। আর এটা কেমন চিন্তা যে, যারা দোষী তাদের হাতেই সবকিছু ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখার”জ্জামান বলেন, ‘হলমার্কের আবেদনে সরকারের এই সম্মতি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে। যে টাকা চলে গেছে তা উদ্ধার হওয়া যেমন জর”রি একইভাবে জর”রি অপরাধীদের শাস্তি দেয়া। এ নিয়ে সমাজে ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে তোলপাড় শুর” হয়ে যায়। তারা বলেন,‘ হলমার্ক যে টাকা জালিয়াতি করে নিয়েছে এটা কোনো ঋণ নয়। জালিয়াতির অর্থ পুনঃতফসিলের কোনো বিধান দেশে নেই।’ এসব কথা বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর দেশরতœ শেখ হাসিনা নিয়োজিত সালেহ উদ্দিন আহমেদ এবং এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি একে আজাদ। দুদক তথ্য পেয়েছে যে, জালিয়াতির মাধ্যমে এই বিপুল অংকের ঋণ নিতে তাদের তিনশ’ কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। আইনী প্রক্রিয়ায় হলমার্ক উদ্যোক্তাদের সাজা হলে ঘুষ গ্রহণকারীদের তথ্য বেরিয়ে পড়তে পারেÑ এই আশঙ্কায় অর্থমন্ত্রী এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারেন। তবে কি অর্থমন্ত্রীও এর সঙ্গে জড়িত? এ  প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তা তিনি যতই রাবিশ বলুন না কেন।
অর্থমন্ত্রী আবুল মালের বেসামাল কথার ধারা এটাই নতুন নয়। মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করার পর থেকেই তিনি হেন্ করেঙ্গা তেন্ করেঙ্গা টাইপ কথাবার্তা বলেই যাচ্ছেন। নিজের যোগ্যতার বিষয়টি আঁচ না করে তিনি বরং হলমার্ক সিদ্ধান্তের সমালোচনাকারীদের একহাত নিয়ে নিয়েছেন। বলেছেন, হলমার্ক নিয়ে বুদ্ধিজীবীরা হৈচৈ শুর” করেছেন। ঐ বুদ্ধিজীবীদের চরিত্রই হৈচৈ করা। যারা এই চিৎকার চেঁচামেচি করেন, তারা দেশের মঙ্গল চান না। এরা দেশের শত্র” (ভাগ্য ভাল, তবু এদের তিনি যুদ্ধাপরাধী বলে অভিহিত করেননি)। বুদ্ধিজীবী ও ব্যাংকারদের এসব কথাবার্তাকে তিনি ‘রাবিশ’, ‘বোগাস’ উল্লেখ করে বলেন, যে যাই বলুক বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে ভাল সময়। আবুল মাল বলেন, দুষ্টু প্রতিষ্ঠান হলমার্ক জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করেছে। হলমার্কের এমডি জেলে রয়েছে। তার শাস্তি হবেই। এর পর তিনি বলেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী যা যা করছেন তা দেশের স্বার্থে নয়। এটা পুরোপুরি দেশের সঙ্গে শত্র”তা। খালেদা জিয়া জঙ্গি, হিংস্র, সন্ত্রাসীগোষ্ঠী জামাত-শিবিরের পৃষ্ঠপোষক, রক্ষাকর্তা ও আশ্রয়দাতা হিসেবে কাজ করছেন। আওয়ামী লীগে এটা একটি সাধারণ ধারা। চুরি, ডাকাতি, খুন, গুম, গণহত্যা চালিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে গালি দেয়া। তাহলেই সব সাফসূত্র হয়ে গেল। সব মাফ।
কিন্তু মানব জমিন পত্রিকা গত ৩১ মার্চ তাদের প্রধান শিরোনাম করেছে ‘লুট’। রিপোর্টে বলা হয়, রাজকীয় লুট এখন চলছে দেশে। হলমার্ক, ডেসটিনি, ইউনিপেট্ইুউ, বিসমিল্লাহ গ্র”প, আইসিএল, সর্বশেষ ম্যাক্সিম গ্র”প এই ছয়টি প্রতিষ্ঠান লুটে নিয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। ব্যাপক এই লুটপাটের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতার জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন ঐ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তাদের তলবও করেছে। ঐ টাকা ছাড়াও পদ্মাসেতুর নকশা কেলেঙ্কারি করে হাতিয়ে নিয়েছে রাজস্ব খাতের একশ’ ষোল কোটি টাকা। বিপুল অংকের ঐ টাকার বেশির ভাগ পাচার হয়েছে বিদেশে। লুটপাটের হোতারাও বেশির ভাগ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। দুবাই-মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যের পসরা খুলে নির্বিঘেœ বাণিজ্য করছে। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, কেবল ডেসটিনিরই কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে অর্থ গচ্ছিত রাখার প্রমাণ মিলেছে। এ পর্যন্ত হলমার্ক লুট করেছে ৩৬শ’ কোটি টাকা, ইউনিপেটুইউ ৩৬শ’ কোটি টাকা,  ডেসটিনি ৩৩শ’ কোটি টাকা, বিসমিল্লাহ গ্র”প ১২শ’ কোটি টাকা, এমএলএমআইসিএল ৩৭শ’ কোটি টাকা ও ম্যাক্সিম গ্র”প ১৫শ’ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টিতে এর সমালোচকরা নাকি রাবিশ ও বোগাস। এই ‘উন্মাদ’ ব্যক্তির বোধ করি অর্থমন্ত্রী থাকার কোনো অধিকারই নেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads