বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৩

দেশের অস্থিরতা কাটবে কবে?


অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দেশ গভীর সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিয়ে সংবাদমাধ্যম, আলোচনা, গোলটেবিল বৈঠক ও টক শোগুলোতে অভিজ্ঞ মহল সংশয় ও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। বিদেশী প্রবাসীদের মধ্যেও দেশের পরিস্থিতি নিয়ে চরম উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের সার্বিক ভয়াবহ পরিস্থিতি অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক চরম অবনতি থেকে শুরু করে বিচার ও প্রশাসনেও এক সীমাহীন দুর্গতি লক্ষ করা যাচ্ছে। রাষ্ট্রের সর্বস্তরে দীনতা ও দেউলিয়াত্ব বিরাজ করছে। এখন সব দিক দিয়েই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের ধর্মীয় ও আদর্শগত বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানা হয়েছে।

এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যে অসঙ্গতির সৃষ্টি হয়েছে, তা বোঝার জন্য সংবিধান বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। একটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের কথা বলা হয়েছে ২ক অনুচ্ছেদে। আবার সংবিধানের একই সংশোধনীর মাধ্যমে দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১২ অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য ক. সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, খ. রাষ্ট্র কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, গ. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, ঘ. কোন বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।’ এখানে ওই দু’টি অনুচ্ছেদের বৈপরীত্ব বিদ্যমান। এর মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যে বিশ্বাস, তাকে কৌশলে খর্ব করা হয়েছে। এমনকি এক দিকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের কথা বলা হয়েছে আবার অন্য দিকে মূলনীতি থেকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস বাদ দেয়া হয়েছে। এ দেশের মানুষের মধ্যে মুসলিম ছাড়াও অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষ রয়েছেন, তারাও পরকাল বিশ্বাস করেন। অথচ ধর্মনিরপেক্ষতার মূল দাবি হচ্ছে পরকালবিমুখতা। সংশোধনীর মাধ্যমে নিজ নিজ ধর্মের প্রতি আস্থাশীল এ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে একেবারে অস্বীকার করা হয়েছে। কেননা ধর্মনিরপেক্ষতার মূল চেতনা হচ্ছে ধর্মবিরোধী ভাবাদর্শ। যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকবে সেখানে কোনো ধর্মের অস্থিত্ব কল্পনা করারও কোনো সুযোগ নেই।
গুম ও হত্যার মতো জঘন্যতম ঘটনা আজ চরমপর্যায়ে পৌঁছেছে। এতে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও প্রতিহিংসার কারণেই বেশি ঘটেছে। বিরোধী জোটের বিভিন্ন নেতাকর্মীকে গুম ও হত্যার রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি এক চরম অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ গুম ও হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে বিদেশী কূটনীতিক, শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী, সাংবাদিক, মসজিদের ইমাম, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকসহ নানা পেশার লোক রয়েছেন। আজকে গুম ও হত্যা আতঙ্কে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত কর্নেল ড. অলি আহমদ বলেছেন, বর্তমান সরকারের অত্যাচার-নির্যাতন পাক হানাদার বাহিনীকেও ছাড়িয়ে গেছে।
প্রশাসনের নির্দেশেই আজকে অন্যায়ভাবে রিমান্ড দেয়া হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের। আবার যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগের বিষয়টি স্বয়ং একজন বিচারপতির স্কাইপ সংলাপ থেকে বেরিয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা ও মানবাধিকার কর্মীরাও এ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মিনা ফারাহ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠক ও সুলেখিকা। তিনি ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে বলেন, ‘সন্দেহাতীত সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকলে বিচার নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘সম্প্রতি শাহবাগ থেকে যেসব দাবি করা হয়েছে তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। তা বিচারব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কিছু নয়।’ এ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধীদের বিচার কার্যক্রমের কঠোর সমালোচনা করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট। তারা বলেছে, ট্রাইব্যুনালের বিচার বাংলাদেশের বিচারিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে দূষিত করেছে।
সংখ্যালঘু নির্যাতন করে এবং উৎসাহ দিয়ে কিছু মানুষ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বিনষ্টের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এরা খুবই নীচ ও স্বার্থবাদী। সম্পদের লোভে তাদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা করছে। আবহমানকাল থেকে এ দেশের সব ধর্মবিশ্বাসের মানুষ সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সাথে বসবাস করে আসছে। এ দেশের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নেই বললেই চলে। সম্প্রতি যা ঘটছে তা সুদূর ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। শহীদ মিনারে হামলাকারী হাতেনাতে ধরা পড়লে দেখা যায়, সে সরকারদলীয় কর্মী। অবশ্য পরে তাকে পাগল বলে ছেড়ে দেয়া হয়। কিছু দিন আগে সরকারদলীয় লোকদের নেতৃত্বে বৌদ্বমন্দিরে হামলা করা হয়। এসব হামলা মিছিলের ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও তাদের কোনো দোষ নেই। কিন্তু যারা এসবের সাথে ন্যূনতম সম্পৃক্ত নয়, তাদেরকে একমাত্র বিরোধী দলের হওয়ার কারণেই গ্রেফতার করছে।
আজকে আরেকটি বিষয় যা ধর্মপ্রাণ মানুষকে চরমভাবে পীড়া দিচ্ছে তা হচ্ছে, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর ফটক বন্ধ করে দেয়া। কী অজুহাত বা কোন সে অসৎ উদ্দেশ্যে মসজিদের গেটে তালা দেয়া হয়েছে তা স্পষ্ট না করলে জনগণই এর সমুচিত জবাব দিতে বাধ্য হবে। মসজিদ আল্লাহর ঘর। সেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার সংরক্ষণের অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি। সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ৪১ অনুচ্ছেদে সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা ও পালনের অধিকার দেয়া থাকলেও মসজিদের একপাশে তালা ঝুলিয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা খর্ব করার দায়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাজারপূজারী ডিজিকে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
ইসলামের ওপর আঘাত হানার এক হীন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা নামের ধর্মবিদ্বেষী, সরকারি টেক্সট ও পাঠ্যপুস্তকে শরিয়াবিরোধী মতাদর্শমূলক বিবৃতি, নাস্তিক ব্লগার চক্র, পুরাতন কিছু জ্ঞানপাপী বুদ্ধিজীবী এবং কিছু ইসলামবিদ্বেষী সংবাদমাধ্যম মহান আল্লাহ, রাসূল সা:, ইসলাম ও ইসলামি নিদর্শনের বিরুদ্ধে অতি সন্তর্পণে এসব অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে এরা আরো বল্গাহীন হয়ে উঠেছে। আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে। বিশেষ করে হেফাজতে ইসলামের প্রধান, দেশের শীর্ষ আলেম, কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের সম্মানিত চেয়ারম্যান, চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক ও ওস্তাজুল আসাতেজা হজরত আল্লামা শাহ আহমদ শফীর বিরুদ্ধে যে ভাষায় কথা বলছে তা খুবই নিন্দনীয় ও গর্হিত।
সুতরাং বলতে চাই, দেশকে আগে বাঁচাতে হবে। দেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিশ্বাসগত ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে আগে মুসলিম। আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে বাঙালি। জাতীয় চেতনার দিক দিয়ে বাংলাদেশী। এর শিকড় হাজার বছরের। সৌর্যবীর্যের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ। তাই আসুন, রাজনৈতিক ভেদাভেদ ও প্রতিহিংসা ভুলে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করার লক্ষ্যে একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলি আমাদের চিন্তা, মনন, মানস, স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করি এ চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads