বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৩

গণজাগরণ মঞ্চ বন্ধ করে দেয়ার কথা বলছে সরকারি দলও



শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের এখন বেহাল দশা। কথামালার আড়ালে ওদের রাজনীতিটা বেশিদিন ঢাকা থাকেনি। মুখোশ উন্মোচনের পর থেকেই ওদের জনসমর্থনে ভাটা লাগে। এখন তো ধিক্কারের পালা। সরকারের প্রশ্রয়ে ও সরকারি দলের জামাই আদরে শাহবাগিদের বক্তৃতা-বিবৃতি ও বিনোদন কর্মকা- ভালোই চলছিল। তবে ব্লগারদের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের হঠকারী বক্তব্য ও বিভিন্ন আদেশ জারি জনগণের কাছে বেশ দৃষ্টিকটু ঠেকেছে। অনেককেই বিরক্ত হয়ে বলতে শোনা যায়, কেউ চাইলেই জাতীয় নেতার মত আদেশ জারি করতে পারে না। পতাকা উঠানো-নামানোর নিয়ম আছে, কেউ চাইলেই জাতীয় পতাকা উত্তোলনের আদেশ দিতে পারে না। তারপরও ইমরান সরকার আদেশ জারি অব্যাহত রেখেছে। মানুষের ট্র্যাজেডি হলো, সুসময়ে সে নিজের সীমাবদ্ধতার কথা বুঝতে পারে না। দেশের সাধারণ মানুষই শুধু গণজাগরণ মঞ্চ ও ইমরান এইচ সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেনি, এখন গণজাগরণ মঞ্চ বন্ধ করে দেয়ার কথা বলছে সরকারি দলও। প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে মত ব্যক্ত করা হয়েছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে। এ মঞ্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মঞ্চ গুটিয়ে ফেলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। গত রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত বৈঠকে মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতারা ইমরান এইচ সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। তারা বলেন, সরকারকে হুমকি দিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন ইমরান।  তিনি বলেছেন, ‘সরকারের এত স্পর্ধা কোথায় যে আমাদের দাবি মানছে না। এ ভাষায় তিনি কথা বলতে পারেন না। ভাবতে অবাক লাগে, সরকারের কর্তাব্যক্তিরা আজ ব্লগারদের মুখপাত্র ইমরান সরকারের কঠোর সমালোচনা করছেন। অথচ গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সরকারের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়েই ইমরান এইচ সরকারসহ ব্লগার এক্টিভিস্টরা শাহবাগ মঞ্চে আন্দোলন করে আসছে। সরকার তাদের শুধু পুলিশ প্রটেকশনই দেয়নি, তাদের কথামত আইনও প্রণয়ন করেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে শাহবাগিদের প্রতি সমর্থন প্রদান করেছেন এবং বিচারপতিদের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন শাহবাগিদের মনোভাবের গুরুত্ব দিতে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে শাহবাগিদের বেপরোয়া করে তুলেছিলেন, আজ তাদের গণজাগরণ মঞ্চ বন্ধ করার কথা বলতে হচ্ছে। এ কারণেই হয়তো বিজ্ঞজনরা বলে গেছেন, বাড়াবাড়ি কিংবা সীমালঙ্ঘনের পরিণাম কখনো ভাল হয় না।
সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা যে কোনো মহৎ ভাবনায় গণজাগরণ মঞ্চ বন্ধের কথা বলছেন, তা কিন্তু নয়। এতদিনে সরকার হয়তো উপলব্ধি করতে পেরেছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে গণজাগরণ মঞ্চের মাধ্যমে সরকার যে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চেয়েছিল তা বুমেরাং হতে চলেছে। গণজাগরণ মঞ্চের ব্লগাররা এখন সরকারের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে- না গিলতে পারছে না ফেলতে পারছে। শাহবাগ মঞ্চের ব্লগারদের অনেকেরই আমলনামা খুবই মারাত্মক। তাদের আচার-আচরণ ও ইসলামবিরোধী বক্তব্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর দেশের জনমনে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ। এর পরিণতি যে সরকারের জন্য শুভ হবে না, ইতোমধ্যে তা তারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। বিশেষত হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন দেখে সরকার এখন আপোসের চিন্তা-ভাবনাও শুরু করেছেন। সরকার একজন মন্ত্রীকে দূত হিসেবে পাঠিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীর কাছে। মন্ত্রী ৬ই এপ্রিলের লংমার্চ স্থগিতের আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু আল্লামা শফী স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, এখন আর তা সম্ভব নয়। গত সোমবার হেফাজতে ইসলামের উদ্যোগে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আয়োজিত শানে রিসালাত সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে আল্লামা শফী বলেন, ইসলাম ও রাসূল (সা:)-এর অবমাননাকারী ব্লগারদের শাস্তিসহ ১২ দফা দাবিতে এবং দেশে ক্রমবর্ধমান ইসলাম বিদ্বেষী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে ৬ই এপ্রিলের লংমার্চ মুসলমানদের জন্য জিহাদ। তিনি শহীদ হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে মুসলমানদের লংমার্চে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। সম্মেলনে আল্লামা শফী আরো বলেন, আমি আশা করি সরকার আমাদের বাধা দেবে না বরং সবরকম সহযোগিতা করবে। কারণ এ সরকার মুসলমান সরকার। কিন্তু যদি তারা লংমার্চে বাধা দিয়ে ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক-মুরতাদদের পক্ষ নেয় তাহলে আমরা আর এ সরকারকে ‘মুসলমান সরকার’ মনে করবো না। তাদের ‘নাস্তিক সরকার’ বলতে বাধ্য হবো। তিনি বলেন, কপালে থাকলে আল্লাহ, রাসূল ও দ্বীনের জন্য শাহাদাত বরণ করবো। এ থেকে এক চুলও পিছপা হবো না। তিনি আরো বলেন, যে দেশে আল্লাহ, মহানবী হযরত মুহম্মদ (স:) ও কুরআনের অবমাননা করা হয়, দ্বীনের সম্মান রক্ষা হয় না, সেদেশে আমরা বেঁচে থাকতে চাই না। তিনি লংমার্চে সবাইকে সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।
লালদীঘির সম্মেলনে ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক মুরতাদদের বিরুদ্ধে ৬ই এপ্রিলের লংমার্চকে যেভাবে আল্লামা শাহ আহমদ শফী জেহাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং মুসলমানদের শহীদ হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, তা কেউ কেউ খানিকটা বিস্ময় প্রকাশ করতে পারেন। বলতে পারেন পরিস্থিতি কি এতটা গুরুতর? আসলে সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামবিরোধী কর্মকা- যেভাবে বেড়ে চলেছে, সে ব্যাপারে যারা অবগত নন তাদের মধ্যেই এমন বিস্ময়ভাব জাগাতে পারে। পরিস্থিতি আসলেই গুরুতর। আল্লাহ, রাসূল ও ইসলাম অবমাননার কুৎসিত কর্মে মুসলিমনামধারী কতিপয় নাস্তিক ও মুরতাদ মুসলিমই শুধু জড়িত হয়নি, এই অপকর্মে সুযোগ বুঝে যোগ দিয়েছে অন্য ধর্মাবলম্বী ব্লগাররাও। বিভিন্ন ব্লগে যেসব কুৎসা ও অমার্জনীয় বক্তব্য রাখা হয়েছে, তাতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যে কোনো বিবেকবান মানুষ বিস্মিত হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুসন্ধান কমিটির কাছে আইটি বিশেষজ্ঞসহ আলেমরা তথ্য প্রদান করেছেন যে, আল্লাহ, মহানবী (সা.) এবং নামায, রোযাসহ ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধানের বিরুদ্ধে সামহোয়্যারইনসহ ১৭টি ব্লগে মিথ্যাচার অব্যাহত রয়েছে। ইমলাম বিদ্বেষী ঐসব ব্লগে আপত্তিকর মন্তব্য করে চলেছে স্বঘোষিত নাস্তিক ব্লগাররা। আইটি বিশেষজ্ঞ আরিফুর রহমানের অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, সরকারের নমনীয় মনোভাবের কারণেই কুখ্যাত নাস্তিক ব্লগাররা বছরের পর বছর ধরে রাসূল (সা.) ও পবিত্র দ্বীন ইসলামের বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য করে আসছে। তারা তসলিমা নাসরিন, সালমান রুশদি ও দাউদ হায়দারকেও হার মানিয়েছে। শাহবাগ আন্দোলনের অন্য উদ্যোক্তা আসিফ মহিউদ্দিনকে ইসলাম বিদ্বেষী ব্লগার হিসেবে চিহ্নিত করে অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক হিসেবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত আসিফ মহিউদ্দিন। নাস্তিকদের মধ্যে আসিফই একমাত্র ব্যক্তি যে নিজেকে খোদা হিসেবে দাবি করেছে। মসজিদ সম্পর্কে এ নাস্তিক লিখেছে, ঢাকা শহরের সব মসজিদ পাবলিক টয়লেট বানানো উচিত (নাউযুবিল্লাহ)। পবিত্র ইসলাম সম্পর্কে মিডিয়ায় বিদ্বেষ, অপপ্রচার, অপবাদ কুৎসা রটনা এবং অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ অশালীন ভাষায় কটূক্তি করা সর্বাপেক্ষা সমালোচিত ব্লগ সাইটটি হলো ‘ধর্মকারী’ এই ধর্মকারীর অন্যতম লেখক আসিফ মহিউদ্দিন। অভিযোগে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশকে একটি সমকামী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য ‘মুক্তমনা’ ও ‘সামহোয়্যারইন ব্লগে আসিফ মহিউদ্দিন বেশ কিছু উক্তি করেছিলো, যা এখনও রয়েছে। নাস্তিক ব্লগারদের কুৎসিত বক্তব্য ও অপকর্মের বর্ণনা আর বাড়াতে চাই না। এদের বক্তব্য পড়া বা উদ্ধৃত করা যে কোনো বিবেকবান মানুষের রুচিতেই বাধে। কোনো ধার্মিকের পক্ষেই ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগারদের বক্তব্য সহ্য করা সম্ভব নয়। তাহলে বাংলাদেশের আলেম-ওলামা ও ধর্মপ্রাণ মানুষরা কি করে নাস্তিক শাহবাগী ব্লগারদের কুৎসিত বক্তব্য সহ্য করবেন? দেশের আইনেও ঐ সব বক্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু সরকারের নীরবতায় ইসলামবিরোধী ঐসব অপকর্ম দীর্ঘদিন ধরেই চালিয়ে যাচ্ছিলো নাস্তিক ব্লগাররা। এখন হয়তো সবাই উপলব্ধি করতে পারবেন, ‘হেফাজতে ইসলাম’ কেন নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে ৬ই এপ্রিল লংমার্চের ডাক দিয়েছে। কেন তারা তাদের লংমার্চকে জেহাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
দেরীতে হলেও সরকার হয়তো উপলব্ধি করতে পেরেছে, শাহবাগীদের সাথে আর থাকা যায় না। সরকার চাইছে, শাহবাগী ব্লগাররা যেন গণজাগরণ মঞ্চ বন্ধ করে দেয়। সোমবার রাতে পুলিশ অভিযুক্ত তিন ব্লগারকে গ্রেফতারও করেছে। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে এতদিন সরকারের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে লালিত শাহবাগী ব্লগারদের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার। গণমাধ্যমে তিনি বলেছেন, তিন ব্লগারকে গ্রেফতারের ঘটনা সরকারের জন্য একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ। তিনি আরো বলেছেন, কারো চক্ষুকে গণজাগরণ মঞ্চ ভয় পায় না, আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব। ইমরান এইচ সরকারের ঔদ্ধত্য এমন বক্তব্যের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায় গণজাগরণ মঞ্চের আসল লক্ষ্য কী? যুদ্ধাপরাধ বিচারের ইস্যুকে কেন্দ্র করে ইমরান এইচ সরকারের সাথে যেসব নাস্তিক ব্লগার জড়িত হয়েছে, তাদের আসল লক্ষ্য যে পবিত্র ধর্ম ইসলামকে নির্মূল করা তা বুঝতে আর কারো বাকি নেই। সরকার হয়তো তাদের সাময়িকভাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, কিন্তু তাদের আসল মন্ত্রণাদাতা সেই রহস্য উদঘাটন এখন জাতির জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের মাধ্যমে সেই রহস্য উদঘাটিত হয় কিনাÑ সেটাই দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads