বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৩

জাতীয়তাবাদী আবেগ ও ইসলামের যুক্তি



মাঝে মাঝে জাতীয়তাবাদী আবেগ সব কিছুকে প্রবলভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ইসলামেরও মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে এমনই একটি প্রতিকূল পরিস্থিতি চলছে। শাহবাগের জাতীয়তাবাদী আবেগ নাস্তিক্যবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা দর্শন দিয়ে সব কিছুতে পদানত করতে চাচ্ছে। তখন জাতীয়তাবাদী আবেগকে ইসলামের যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা ও আত্মস্থ করার প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় মিথ্যাকে পরাজিত করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টির। বাংলাদেশ এখন ইতিহাস সৃজনের যুগসন্ধিক্ষণে।
ইতিহাস থেকে আমরা দেখেছি, সূচনা থেকেই ইসলামকে প্রতিপক্ষীয় মতবাদের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রাক-ইসলামী যুগের ‘আসাবিয়্যাহ’ বা গোত্রবাদের সঙ্গে লড়তে হয়েছে। আসাবিয়্যাহ হলো এমন একটি আদর্শ, যা আধুনিক জাতীয়তাবাদের পূর্বসূরী। আসাবিয়্যাহ হলো গোত্রের প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্য আর জাতীয়তাবাদ হলো ক্ষুদ্রতর গ-িতে জাতিগত আনুগত্য।
ইসলাম তীব্রভাবে আসাবিয়্যাহর ধারণাকে নিন্দা করে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মহান বাণী অনুযায়ী যে আসাবিয়্যাহর জন্য যুদ্ধ করে বা এর প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে, সে ‘আমার দলের অন্তর্ভুক্ত না।’ (মুসলিম, ইমারাহ, ৫৭) গোত্রের পরিবর্তে ইসলাম নিজেই একটি প্রধান আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। একটি একত্রীকরণ শক্তি। সামষ্টিক সুসংঘবদ্ধতার মূলভিত্তি। সেজন্য, পবিত্র কোরআন অনুযায়ী মুসলমানগণ একে অপরের ভাই, অন্য কিছু নয় (৪৯:১০)। এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই ধারাবাহিকতায় বলেছেন যে, মুসলমানরা অন্যের মোকাবিলায় ‘একহস্ত’ (আবু দাউদ, জিহাদ, ১৪৭)।
বস্তুত পক্ষে, তাওহিদ বা একাত্মবাদের উপর ভিত্তি করে বিশ্বজনীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা মুসলিম উম্মাহর মৌলিক মিশন। গোত্র বা ক্ষুদ্র জাতিগত স্বার্থ হাসিল ইসলামের মূলনীতি নয়। ইসলাম হলো এমন এক উম্মাহ বা জাতি, যার অস্তিত্ব নিজের জন্য না হয়ে ‘সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য’ (৩:১১০)। এই উম্মাহর মিশন হলো আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত রাখা, সত্য ও সুবিচারের সাক্ষী হওয়া, অনবরত কল্যাণের সম্প্রসারণ ও অনিষ্টের বিরোধিতা করা। এই মিশনকে পূর্ণ করতে মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য স্থাপন করা জরুরি। যারা মুসলিম ঐক্যের বিরোধী, তাদেরকে চিহ্নিত ও বর্জন করাও জরুরি।
মনে রাখা দরকার, ইসলাম শুধুমাত্র মুসলিমদের জীবন ও ধর্ম বিশ্বাসই শুধু নয়, বরং নিজ নিজ পিতৃভূমি ও জাতীয়তাকেও রক্ষা করে। সকল ইসলামী ভূখ-ই হলো ইসলামী পিতৃভূমি। প্রতিটি ক্ষুদ্র ভূখ-, যেখানে কোরআনে বিশ্বাসী একজন মুসলিম ভ্রাতা বাস করে, সেটা একই ইসলামী পিতৃভূমির একটি অংশ। মুসলিম ভূমির কোনও একটি অংশ আক্রান্ত হওয়া মানে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব আক্রান্ত হওয়া। এ কারণেই প্রথমত প্রত্যেক মুসলিমের একটি বৃহৎ ও একটি সাধারণ জাতীয়তা রয়েছে। প্রথমটি হলো ইসলামী জাতীয়তা। এটা খুবই মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ। আর দ্বিতীয়ত যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে সে বসবাস করে তাদের প্রতি দায়িত্ব। ইসলাম প্রত্যেক ব্যক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে তার স্বদেশের কল্যাণের জন্য কাজ করতে এবং যে জাতির মধ্যে বাস করছে, সেটার উন্নতি বিধানে। এজন্য একজন মুসলিম হলেন সুগভীর দেশপ্রেমিক এবং স্বজাতিপ্রেমিক। কিন্তু তার প্রেম উগ্র আবেগের বিষয় নয়। ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদী উন্মাদনাও নয়। তার প্রেম খোদাপ্রেমের অংশ এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর প্রেমের প্রাথমিক শর্ত। ফলে তাওহিদপন্থী মুসলিম বিশ্বমুসলিম উম্মাহকে ভালোবাসার কারণে একই সঙ্গে আন্তর্জাতিকবাদী এবং নিজের সমাজকে ভালোবাসার কারণে জাতীয়তাবাদী।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বর্তমানের আবেগনির্ভর ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদ নিয়ে। এর উৎপত্তি ইউরোপে। পশ্চিমা জগত যে জাতীয়তাবাদের কথা বলে, সেখানে আর কারও স্থান নেই। জার্মান জাতি যেভাবে সবাইকে ধ্বংস করে বিশ্ব দখল করতে চেয়েছিল। এই জাতীয়তাবাদ খ্রিস্টধর্মকে লালন ও প্রসার করে। মুসলিমদের ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিক হতে বাধ্য করে। আরেক ধরনের জাতীয়তাবাদ চর্চা করে সমাজতন্ত্রীরা। তারাও নিজেদের ছাড়া অন্যকে ধ্বংস করতে চায়। যেমন করেছিল লেনিন-স্ট্যালিন। এরাও নাস্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষ। এই উভয় ধরনের জাতীয়তাবাদীরাই নাস্তিক্যবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের অস্ত্র হাতে নিয়ে ইসলামকে আক্রমণ করে। বাংলাদেশের শাহবাগে এমনটি হয়েছে। তারা জাতীয়তাবাদ ও ইসলামকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ইসলাম ও স্বাধীনতার মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করছে। এর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক ইসলামী প্রতিরোধস্বরূপ হেফাজতে ইসলামের যে আন্দোলন গড়ে ওঠেছে, সেটার প্রেক্ষাপট ও লক্ষ্য সকলেরই জানা। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবির মধ্যে এই জাতীয়তাবাদীদের উগ্র-আবেগসর্বস্ব ইসলাম বিরোধিতার প্রতিষেধক রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, ইসলাম ও জাতীয়তাবাদের সংঘাতের অবসান কিভাবে সম্ভব? দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনার রঙে জাতীয়তাবাদকে রাঙিয়েই সেটা সম্ভব। বাইরে থেকে প্রভুদের কাছ থেকে আনা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও নাস্তিক্যবাদ এভাবেই বিতাড়ন করা যাবে। ইসলামী আন্তর্জাতিকতাবাদ বা উম্মাহর চেতনায় পৌঁছার পূর্বে বাংলাদেশের নিজস্ব জাতীয়তাবাদকেও আবর্জনামুক্ত করা দরকার। আমার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী জাতীয়তাবাদের মধ্যে কোনওভাবেই দ্বন্দ্ব আসতে পারে না। আমি একই সঙ্গে দুটিই ধারণ করি। আমি এক ও অভিন্ন বিশ্বাস থেকেই পথ চলি। এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে আমার ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি ও স্বাধীনতা। অতএব এখানে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি করা চক্রান্তকারীদের কুকাজ।
কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমানদের আজ বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। এটা করছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও নাস্তিক্যবাদী অপশক্তি। এদের সঙ্গে জোট মিলিয়েছে তাওহিদের পরিপন্থী শিরক-বিদআত-ফিসকবাদী ভ্রান্ত আলেম। অতি সংখ্যালঘু তারা। কিন্তু পশ্চিমা খ্রিস্টবাদ এবং ভারতীয় পৌত্তলিক/মুশরিকবাদ এদের সার্বিক সাহায্য করছে। অর্থ ও মিডিয়া দিয়ে এদেরকে শক্তি যোগাচ্ছে। তৃণকে দেখানো হচ্ছে তালগাছরূপে। এরা বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদকে ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিক্যবাদী করতে চায়। এদের শিক্ষা অনুসরণ করা হলে এদেশের মুসলমানদের তাওহিদ, ঈমান, আকিদা নস্যাৎ হয়ে যাবে।
অতএব বিদ্যমান সঙ্কটে ইসলামের আদর্শিক ও ব্যবহারিক বিষয়গুলোকে সুউচ্চে তুলে ধরতে হবে। বাঙালি জাতিসত্ত্বা, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে ইসলামের মহান শিক্ষায় মুসলিম উম্মাহর আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যেতে হবে। এই কাজ নতুন নয়। শাহবাগের প্রতিক্রিয়ায় হয়েছে, এমনও নয়। মুঘল বাদশাহ আকবরের বিরুদ্ধে মুজাদ্দেদী আলফেসানী এ কাজ করেছেন। ইংরেজের বিরুদ্ধে বালাকোটের মুজাহিদগণ করেছেন। হাজী শরীয়াতুল্লাহ ও তীতুমীর করেছেন। পাকিস্তানী শাসকদের ইসলামকে রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আলেম সমাজ করেছেন। বাংলাদেশ আমলে ধর্মনিরপেক্ষবাদী-নাস্তিক অপশক্তির বিরুদ্ধে ইসলামী আন্দোলনের ছাত্র, যুব, জনশক্তি ও হাক্কানী ওলামা-মাশায়েখগণ করছেন। এই লড়াই ইসলাম ও জাহিলিয়াতের চলমান ঐতিহাসিক সংগ্রামের অংশ।
বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাদের পচন আর সমাজতন্ত্রের পতনের পর ইসলামই হলো মানবমুক্তি, স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার একমাত্র রক্ষাকবচ। বিশ্বের দিকে দিকে ইসলামের বিজয় কাঁপিয়ে দিয়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ইসলাম বিরোধী শক্তিকে। আরব বিশ্বের জাগরণকে বহু ষড়যন্ত্র করেও ঠেকানো যায় নি। মিসর, তুরস্ক হয়ে সিরিয়া, জর্ডান, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়ায় উড়ছে ইসলামের পতাকা। এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপের কোনও কোনও অংশ ইসলামী জাগরণের পদধ্বনিতে মুখর। সেই ধ্বনির বাস্তব প্রতিধ্বনি আজ বাংলাদেশে। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ ও জাতিসত্ত্বাকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও নাস্তিক্যবাদের কবল থেকে বাঁচাতে আজ উত্থান ঘটেছে ইসলামী নবজাগরণে। এই জাগরণের জোয়ারে জেগে ওঠবে নতুন প্লাবন; লিপিবদ্ধ হবে মুক্ত মানুষের নতুন ইতিহাস। পৃথিবী সেই নবযুগের অপেক্ষায়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads