শুক্রবার, ৩১ মে, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

দেশপ্রেমিক বীর জিয়াউর রহমানের মূল্যায়ন


৩০ মে ছিল মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮১ সালের এই দিনে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হয়েছিলেন। মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপিসহ অনেক দল সংগঠনের পক্ষ থেকে নানা আয়োজনের মাধ্যমে তাকে যেমন স্মরণ করা হয়েছে তেমনি তার ভূমিকা ও অবদানের মূল্যায়নও করেছেন অনেকে। বর্তমান নিবন্ধের কারণ অবশ্য অন্য রকম। আমরা জানি, বিখ্যাত মানুষদের বিপদের শেষ নেই। মরে গেলেও বেঁচে যেতে পারেন না তারা। মৃত্যুর পর বরং তাদের নিয়ে গবেষণা, মূল্যায়ন ও বিচারের নামে ঘাঁটাঘাঁটি অনেক বেশি হয়। জিয়াউর রহমানও ব্যতিক্রম হতে পারেননি। বিএনপি যেহেতু এখনও, এত দমন-নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের পরও দেশের প্রধান জনপ্রিয় একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থানে রয়ে গেছে সেহেতু দলটির পাশাপাশি জিয়াউর রহমানকে ধরেও টানাটানি চলছে বিরামহীনভাবে। মৃত্যুবার্ষিকীর ঠিক প্রাক্কালে কোনো এক বিশেষ মহল থেকে কঠোর ভাষায় তার নিন্দা-সমালোচনা করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞজনেরা বলেছেন, তিনি নাকি একজন ‘খলনায়ক’! কোথায়, কোন উপলক্ষে এবং কারা বলেছেনÑ সে সম্পর্কে পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণ করিয়ে দেয়ার দরকার পড়ে না। ওই বিশেষ প্রসঙ্গে অবশ্য কথা বাড়াতে যাওয়াটাও উচিত নয়। তা সত্ত্বেও জিয়াউর রহমানকে বিষয়বস্তু বানানোর কারণ, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার ভূমিকা ও কর্মকা-ের মূল্যায়ন করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য।
বলা দরকার, ঘটনাক্রমে রাজনীতি করেছেন এবং বিএনপি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন বলেই জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কঠোর সমালোচনা রয়েছে। সমালোচনা এখনও চলছে বিরামহীনভাবেই। যেমন কিছু বিশেষ মহলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জিয়াউর রহমান সংবিধানের মূলস্তম্ভ  ভঙ্গ করেন, এরশাদ এই ভাঙা স্তম্ভ নিয়ে দেশ শাসন করে গেছেন। অন্যদিকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু এমন ঢালাও মন্তব্যকে সমর্থন করে না। কারণ, ওই বিশেষজ্ঞজনেরাই আবার বলেছেন, ‘প্রথম সামরিক শাসন’ জারি করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং বাকশাল মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য। অর্থাৎ সামরিক শাসন জারি এবং মুজিব-উত্তর ক্ষমতার রদবদলে জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা ছিল না। বাস্তবে ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর সংঘটিত সিপাহী-জনতার যে বিপ্লব দেশের মানুষকে বাকশালসৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছিল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছিলেন সেই বিপ্লবকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। জিয়া ওই বিপ্লবের স্রষ্টা ছিলেন না।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে ওই দিনগুলোর ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। কারণ, ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর স্মরণীয় হয়ে আছে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য। ৭ নবেম্বরের এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছিল ছাত্র-জনতার সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর মিলিত প্রতিরোধ ও পদক্ষেপের ফলে। বহুদিন পর এদেশের ছাত্র-জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর ঐক্য গড়ে ওঠার বিষয়টিও ছিল এক অসাধারণ ঘটনা। এই ঐক্যের মধ্য দিয়ে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছিল, দেশ ও জাতির যে কোনো দুঃসময়ে দেশপ্রেমিকরা ঐক্যবদ্ধ হন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ-বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এজন্য তারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা অন্য কোনো মহলের দিক থেকে সিদ্ধান্ত বা আহবানের অপেক্ষা করেন না। ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বরও নিজেদের তাগিদেই তারা ঐক্যবদ্ধভাবে পা বাড়িয়েছিলেন বলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করা এবং বাংলাদেশকে দেশ বিশেষের পদানত করে ফেলা সম্ভব হয়নি।
সবকিছু ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ৬-৭ নবেম্বর। সে বছরের ১৫ আগস্ট এক অভ্যুত্থানে একদলীয় বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি পদটিতে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন শেখ মুজিবেরই সহকর্মি খন্দকার মোশতাক আহমদ। শেখ মুজিবের মন্ত্রীদের নিয়েই মোশতাক সরকার গঠন করেছিলেন। ৩ নবেম্বর অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ও মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গ্রেফতার করে তিনি সেনা প্রধানের পদ দখল করেছিলেন। মোশতাককে বঙ্গভবনে বন্দী করা হয়েছিল। খালেদ মোশাররফের এই অভ্যুত্থান বাকশালী শাসনে ফিরিয়ে নেয়ার ভারতপন্থী পদক্ষেপ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ওদিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বি। ফলে জনগণের পাশাপাশি সেনাবাহিনীতেও খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে চরম বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। ৬ নবেম্বর রাত থেকে শুরু হয়েছিল সিপাহী-জনতার বিপ্ল¬ব। এই বিপ্ল¬¬¬বে কয়েকজন সহযোগীসহ খালেদ মোশাররফ মারা গিয়েছিলেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান মুক্তি পেলেও জাসদের নেতৃত্বাধীন একটি গোষ্ঠীর উদ্যোগে সেনা অফিসারদের হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। অফিসার মাত্রই খালেদ মোশাররফের সমর্থকÑ এমন এক প্রচারণায় সৈনিকরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে বেশ কিছু অফিসারের মৃত্যু ঘটেছিল। কয়েকদিন পর্যন্ত অফিসাররা পালিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছিলেন জিয়াউর রহমান।
বস্তুত ১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৭ নবেম্বর পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে শুধু নয়, পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট অনেকের স্বীকারোক্তি এবং তথ্য-প্রমাণেও সুনির্দিষ্টভাবেই জানা গেছে, বাংলাদেশকে ভারতের অধীনস্থ করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিভক্তি ঘটানোর এবং হানাহানি সৃষ্টি করার ভয়ংকর পদক্ষেপ নিয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। যে চেইন অব কমান্ড সশস্ত্র বাহিনীর অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য, ষড়যন্ত্রকারীরা তা ভেঙে ফেলতে শুরু করেছিল। সিপাহীরা গরীবের সন্তান ও অল্প শিক্ষিত বলে ধনীর সন্তান অফিসাররা তাদের ওপর নির্যাতন চালান এবং সিপাহী ও অফিসারের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকা অন্যায়Ñ এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক স্লে¬¬াগান তুলেছিল তারা। এর ফলে সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ছিল। কেউ কারো নির্দেশ মানছিল না। শুধু তা-ই নয়, একযোগে অফিসার মাত্রকেই হত্যা করার নিষ্ঠুর অভিযানও শুরু হয়েছিল। সকল বিষয়ে নির্দেশনা আসছিল একটি বিশেষ কেন্দ্র থেকে। সেখানে নেতৃত্বের আসনে ছিলেন জাসদের তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খান। তার সঙ্গে ছিলেন সেনাবাহিনী থেকে বিদায় নেয়া পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা অফিসার লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহের বীর উত্তম। কর্নেল তাহের নিজেকে বঞ্চিত মনে করতেন। তার এ মানসিক বৈকল্যেরই সুযোগ নিয়েছিল জাসদসহ ষড়যন্ত্রকারীরা। কর্নেল তাহেরকে সামনে রেখে তারা এমনভাবেই অফিসার হত্যা চালাতে চেয়েছিল যার পরিণতিতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে একমাত্র তাহের ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি অফিসার থাকতে পারতেন না। আর তাহের নিজে যেহেতু জাসদের মাধ্যমে ভারতীয় ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছিলেন, সেহেতু ধরে নেয়া যায়, স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের সশস্ত্র বাহিনী অফিসারবিহীন হয়ে পড়তো। পরিণতিতে সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়া ভারতের জন্য কোনো ব্যাপারই হতো না। এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রÑ যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল জাসদসহ বিশেষ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। এতে আওয়ামী লীগের ভূমিকা সম্পর্কে কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, সে বছরের ১৫ আগস্ট বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন অফিসার শেখ মুজিবকে হত্যা করলেও আওয়ামী লীগ গোটা সেনাবাহিনীকেই শত্রু মনে করতো। তারা চাইত না, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী টিকে থাকুক এবং শক্তিশালী হোক।
কিন্তু জাতির ভাগ্য ভালো, সিপাহী এবং নন-কমিশন্ড অফিসারদের সমন্বয়ে সেনাবাহিনীরই একটি অংশ সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিলেন। তার নেতৃত্বের প্রতি তাদের আস্থাও ছিল সীমাহীন। ফলে জেনারেল জিয়া সম্পর্কে সশস্ত্র বাহিনীতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যায়নি। জেনারেল জিয়াও বলিষ্ঠতার সঙ্গেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে ঝটিকা সফরে গেছেন তিনি। বলেছেন, তার এবং সিপাহী ও নন-কমিশন্ড অফিসারদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সবাই একই মাতৃভূমির জন্য কাজ করছেন তারা। জিয়াউর রহমানের মতো একজন জনপ্রিয় জেনারেলের এ ধরনের তৎপরতা ও বক্তব্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অনতিবিলম্বে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছিল। ষড়যন্ত্র বুঝতেও তাদের দেরি হয়নি। ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে অনেকের আবার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও ছিল। যেমন একজন সুবেদার মেজর জানিয়েছিলেন, লালমাটিয়ার একটি বাড়িতে কর্নেল তাহেরের উদ্যোগে আয়োজিত এক সভায় তিনি ভারতীয় হাই কমিশনের ডিফেন্স এডভাইজারকে উপস্থিত থাকতে দেখেছিলেন। এ থেকেই তার মনোভাব পাল্টে গিয়েছিল। তার মতো অভিজ্ঞতা হয়েছিল আরো অনেকেরই। ফলে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেও দ্রুত প্রচারিত হয়েছিল যে, অফিসার হত্যার অভিযানে ভারতের ভূমিকা রয়েছে। ভারত কেন অফিসারদের হত্যা করতে চায়Ñ সেকথা তাদের বুঝিয়ে বলতে হয়নি। মূলত এ ধরনের বিভিন্ন ঘটনা ও কারণে জেনারেল জিয়াউর রহমান সশস্ত্র বাহিনীতে নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে পেরেছিলেন। সকল ক্যান্টনমেন্টে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল। পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চেইন অব কমান্ড। সবচেয়ে বড় কথা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী সশস্ত্র বাহিনীকে নির্মূল করে ফেলা সম্ভব হয়নি। একথা সত্য, দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করার কারণে কর্নেল তাহেরকে শেষ পর্যন্ত ফাঁসিতে প্রাণ হারাতে হয়েছিল, কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে সম্ভাবনার অন্য দিকটি ছিল অনেক বেশি মারাত্মক। তাহেররা যদি সফল হতেন তাহলে জিয়াউর রহমানসহ শত শত অফিসারকে প্রাণ হারাতে হতো। দেশের সশস্ত্র বাহিনীও নির্মূল হয়ে যেতো। সে কারণে দেশ ও জাতির স্বার্থের দিক থেকে কর্নেল তাহেরের পরিণতি ছিল অনিবার্য।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল জিয়াউর রহমানের প্রধান অবদান। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন সরকার ‘বাকশাল’ নামে একটি মাত্র দল রেখে অন্য সকল দলকে নিষিদ্ধ করেছিল। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। সরকারী কর্মকর্তা, সাংবাদিক, শিক্ষক ও ব্যবসায়ী থেকে সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার পর্যন্ত প্রত্যেকের জন্য বাকশালের সদস্য হওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। এ ব্যবস্থায় সর্বময় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল শেখ মুজিবের হাতে। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে রাতারাতি তিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেছিলেন। বাকশালেরও চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। বাকশালের গঠনতন্ত্রে সকল ক্ষমতা এই চেয়ারম্যানের হাতে দেয়া হয়েছিল কিন্তু চেয়ারম্যান কিভাবে নির্বাচিত হবেন তার কোনো উল্লে¬¬খ পর্যন্ত ছিল না। অর্থাৎ শেখ মুজিবকে একই সঙ্গে দেশের স্থায়ী প্রেসিডেন্ট এবং বাকশালের আজীবন চেয়ারম্যান বানানো হয়েছিল। তাকে সরানোর বা সরকার পরিবর্তন করার কোনো ব্যবস্থাই রাখা হয়নি। ফলে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভয়ঙ্কর ধরনের অসামরিক স্বৈরশাসন। শেখ মুজিবের তো প্রশ্নই ওঠে না, বাকশাল বা সরকারের বিরুদ্ধেও তখন টুঁ শব্দটি করার উপায় ছিল না। এই সুযোগে আওয়ামী-বাকশালীরা দেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং সম্ভাব্য বিরোধিতাকারীদের উচ্ছেদের জন্যও একযোগে নিষ্ঠুর অভিযান শুরু হয়েছিল। ওই দিনগুলোতে ৩৭ হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। বড় কথা, কোনো হত্যা বা নির্যাতনের বিরুদ্ধেই তখন প্রতিবাদ জানানোর উপায় ছিল না। সমগ্র জাতি বন্দি হয়ে পড়েছিল।
১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর দেশ ও দেশের মানুষকে ওই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আগত জেনারেল জিয়াউর রহমান বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন। তিনি সেই সঙ্গে খুলে দিয়েছিলেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের দরোজা। এই পথ ধরেই বাতিল হয়ে যাওয়া দলগুলো আবারও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ফিরে আসার এবং তৎপরতা চালানোর সুযোগ পেয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের নামে শেখ মুজিব ইসলামী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল মাত্রকেই নিষিদ্ধ করেছিলেন। জিয়াউর রহমান সে দলগুলোকে রাজনীতি করার অনুমতি দিয়েছিলেন। কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে আওয়ামী লীগকে ফিরে আসার সুযোগ দেয়াও ছিল জিয়াউর রহমানের এক অনন্য অবদান। শেখ হাসিনাকেও দেশে ফিরে আসতে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান।
জিয়ার এ উদার নীতির সুযোগেই মুসলিম লীগ থেকে শুরু করে ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ পর্যন্ত বেশ কিছু ইসলামী দলের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আবির্ভাব ঘটেছিল। পরবর্তীকালে জামায়াতে ইসলামীও পুনর্গঠিত হয়েছিল জিয়াউর রহমানের উদার ও সঠিক নীতির সূত্র ধরে। শুধু বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তার আমলেই প্রথমবারের মতো দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে (১৯৭৮), তার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচন এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বলেই সংবিধানের শুরুতে জিয়াউর রহমান ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সংযোজন করেছেন। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় সকল কাজের ক্ষেত্রে ‘সর্বশক্তিমান আল¬াহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’কে বাধ্যতামূলক করাও ছিল জিয়াউর রহমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
বিষয়টি নিয়ে কোনো কোনো মহল পানি ঘোলা করার চেষ্টা করলেও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা অবাধে দেশে ফিরে আসতে এবং বসবাস করতে পারেন। জিয়া এই ঘোষণার পরই নয়াদিল্লী থেকে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল (১৭ মে, ১৯৮১)। প্রেসিডেন্ট জিয়া শুধু শেখ হাসিনাকেই ফিরিয়ে আনেননি, নিজে উদ্যোগী হয়ে তাকে তার পৈত্রিক বাসভবনটিও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার নির্দেশে বাসভবনের প্রতিটি জিনিসের বিস্তারিত তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। সে তালিকায় শেখ মুজিবের পাইপ ও চশমা, শেখ কামাল ও শেখ জামালের সোনার মুকুট, অলংকার, নগদ টাকা, মার্কিন ডলার, ভারতীয় রূপী, ব্রিটিশ পাউন্ড এবং কাপড়-চোপড় ও আসবাবপত্র যেমন ছিল, তেমনি ছিল লাইসেন্সবিহীন কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র, সেগুলোর গুলী এবং কিছু গ্রেনেডও ছিল। শেখ হাসিনা প্রতিটি জিনিস তালিকার সঙ্গে একটি একটি করে মিলিয়ে ও যাচাই করে তারপর লিখিতভাবে বুঝে নিয়েছিলেন। স্বর্ণকার দিয়ে সোনার মুকুট ও প্রতিটি স্বর্ণালংকার পরীক্ষা ও ওজন করিয়ে এবং রীতিমতো বাজিয়ে বাজিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি শুধু আগ্নেয়াস্ত্রগুলো বুঝে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। এর ক’দিন পরই চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট  জিয়া (৩০ মে, ১৯৮১)। (পাঠকরা ১৭ মে এবং ৩০ মেÑ এই তারিখ দুটির মধ্যকার ব্যবধান মিলিয়ে দেখতে পারেন। প্রথম তারিখে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সদিচ্ছায় শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছিলেন, দ্বিতীয় তারিখে ব্যর্থ অভ্যুত্থানে মৃত্যু ঘটেছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, প্রেসিডেন্ট জিয়ার সদিচ্ছা ও উদারতায় যিনি দেশে আসার সুযোগ ও পৈত্রিক বাসভবন ফিরে পেয়েছিলেন সে নেত্রী শেখ হাসিনাই এবার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্ত্রী ও সন্তানদের ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে উৎখাত করেছেন।)
শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ সবই সম্ভব হয়েছিল ৭ নবেম্বরের কারণে। ছাত্র-জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও সফল বিপ্লবই এসব পরিবর্তনের ভিত্তি ও পথ নির্মাণ করেছিল। সব মিলিয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর তাই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য দিক-নির্দেশনা হয়ে রয়েছে, যার নেতৃত্বে ছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু দুঃখ ও ক্ষোভের বিষয় হলো, জাতীয় জীবনের অমন একটি দিক-পরিবর্তনকারী দিবসকে নিয়েও দেশে কূটিল রাজনীতি করা হচ্ছে। দিনটিকে কেন্দ্র করে দেশবাসীকে বিভক্ত করা হয়েছে। এরও সূচনা করেছে আওয়ামী লীগ। এই কূটিল রাজনীতি সত্ত্বেও সব মিলিয়ে প্রমাণিত সত্য হচ্ছে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে দিয়ে গেছেন জিয়াউর রহমান। অন্যদিকে এরশাদ ছিলেন সকল ব্যাখ্যাতেই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী। সুদূরপ্রসারী অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এমনভাবে জিয়ার পদাংক অনুসরণের অভিনয় করেছিলেন, যাতে জিয়াকে নিন্দিত করা যায়। জিয়াকে খলনায়ক বানাতে গিয়ে বিশেষজ্ঞজনেরাও এরশাদের সে কৌশলের জালেই আটকে গেছেন। এজন্যই তারা এমন এক বিচিত্র ব্যাখ্যা হাজির করেছেন, যা পড়ে যে কারো মনে হবে যেন জিয়া ও এরশাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই! অথচ ইতিহাসের সঠিক ব্যাখ্যায় দেখা যাবে, জিয়ার সঙ্গে কোনোদিক থেকেই এরশাদের তুলনা চলে না। ‘মোশতাক-জিয়া চক্র’ ধরনের উল্লেখ ও মন্তব্যও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এখানে স্মরণ করা দরকার, সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট ঘোষিত একটি রায়ে (যা পূর্ণাঙ্গ আকারে প্রকাশিত হয়েছিল সে বছরের ২৯ ডিসেম্বর) দু’জন মাননীয় বিচারপতি বলেছেন, ‘ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে’ সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের বিচার হওয়া উচিত। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বিচারপতিদের মন্তব্য ছিল, এরশাদের মতো একজন স্বৈরশাসককে ক্ষমা করা হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
সর্বোচ্চ আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ ও অভিমত নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যদিকে বাস্তব অবস্থা কিন্তু খুবই নৈরাশ্যজনক। কারণ, এরশাদের বিচার না হওয়ার পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা। বর্তমান সময়ে তো বটেই, মূলত বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ প্রথম থেকেই এরশাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসেছে। এতদিন পর বিচারপতিরা যাকে ‘ষড়যন্ত্র’ ও ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এরশাদের সে অবৈধ অভ্যুত্থানকেও আওয়ামী লীগই প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিল। ক্ষমতা থেকে বিএনপির বিদায়ে আনন্দে উল্লসিত হয়ে শেখ সেলিমের মালিকানাধীন দলটির মুখপত্র দৈনিক ‘বাংলার বাণী’ প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল (২৫ মার্চ, ১৯৮২)। অবৈধ সামরিক শাসনের পরবর্তী নয় বছরে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়াসহ নানা কৌশলে এরশাদকে রক্ষাও করেছে আওয়ামী লীগ। এরশাদ এমনকি নিশ্চিত পতনের মুখে এসেও টিকে গেছেন কয়েকবার। ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্তও এরশাদের প্রতি আওয়ামী লীগের মনোভাব ও কৌশলে পরিবর্তন ঘটেনি। এরশাদকে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছে শেখ হাসিনার প্রথম সরকার। তার কোনো মামলারই সুষ্ঠু বিচার করা হয়নি। সেই থেকে শেখ হাসিনা এবং এরশাদ একযোগে কাজ করে এসেছেন। এরশাদের জাতীয় পার্টি আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরীক দল হিসেবে ক্ষমতাসীন হয়েছে। এরশাদের ভাই জিএম কাদের এখনও শেখ হাসিনার মন্ত্রী।
এ জন্যই মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করার এবং অমন একজন দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রপতিকে ‘খলনায়ক’ হিসেবে চিহ্নিত করার আগে সমগ্র প্রেক্ষাপট মনে রাখা দরকার। নাহলে ব্যক্তি জিয়ার প্রতি তো বটেই, বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিও চরম অবিচার করা হবে।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সে সুযোগও হাতছাড়া হয়ে গেছে


আগামী নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে এবং কোন সরকারের অধীনে হবে তা নিয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষ এখন পর্যন্ত দেশের মানুষকে আশার বাণী শোনাতে পারেননি। স্ব-স্ব পক্ষ নিজ নিজ অবস্থানেই অটল রয়েছেন। সরকার পক্ষে আদালতের রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল ঘোষণার পর তাদের পক্ষে বিরোধী পক্ষের কেয়ারটেকার সরকারের দাবী মেনে নেয়া সম্ভব নয়। বিরোধী পক্ষের দাবী হচ্ছে উচ্চ আদালতের রায় সরকারের ফরমায়েসী রায় তাই তারা সে রায় মানতে কোন ভাবেই বাধ্য নন এবং সুশীল সমাজেও আদালতের রায় নিয়ে চরম বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, ঘোষিত রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশে যা বলা হয়েছিল তা পূর্ণাঙ্গ রায়ে সম্পূূর্ণ অনুপস্থিত। আবার পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা হয়েছিল প্রধান বিচারপতির অবসরকালীন সময়ে। উল্লেখ্য যে, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক একবার রায় লিখে জমা দেয়ার পর তা আবার ফেরৎ নিয়ে সংশোধন করে তা আবার জমা দিয়েছেন। বিষয়টি বিরোধী দল ও অভিজ্ঞ মহল ভালো চোখে দেখেননি। অর্থাৎ উচ্চ আদালতের রায় দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি বরং দেশে অনাকাংখিত বিতর্ক সৃষ্টি করে নতুন রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দিয়েছে। এমতাবস্থায় বিরোধী দলের পক্ষে সরকারের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে সাজানো ও পাতানো নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা কোন ভাবে দূরদর্শিতার পরিচয় হবে না বলেই অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।
সৃষ্ট এই পরিস্থিতিতে বিরোধী দল সব সময়ই আওয়ামী লীগের অধীনে যেকোন নির্বাচন বরাবরই অস্বীকার করে আসছে এবং ঘটনার ধারাবাহিকতায় তার যথেষ্ট কারণ ও যৌক্তিকতাও রয়েছে। আদালতের রায়কে উদ্ধৃত করে সরকারের বক্তব্য হলো কোন অনির্বাচিত সরকার নির্বাচিত সরকারের বিকল্প হতে পারে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের স্মরণ থাকা উচিত তারা একটি অনির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ১৭৩ দিন হরতাল করেছিল। অনেক প্রাণহানিসহ ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সম্পদের ধ্বংসও হয়েছিল এবং তারা যে সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসে এসব আপ্তবাক্য জাহির করছেন সে সরকারও ছিল অনির্বাচিত। মজার ব্যাপার হলো বিচারপতি কে এম হাসানের দলীয় সম্পৃক্ততার অভিযোগে তাকে কেয়ারটেকার সরকার প্রধান হিসাবে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল এবং সারাদেশে ব্যাপক নৈরাজ্য চালিয়ে ১/১১ প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল তারা কোন মুখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দিবা স্বপ্ন দেখেন তা দেশের মানুষের কাছে বোধগম্য নয়। আর সরকার যে আদালতের রায় ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলছে তাও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিযাত্রা সাংবিধানিক পদ্ধতিতে হয়নি। ১৯৯০ সালের বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সরাসরি সংবিধান লংঘন করে। তিনি প্রধান বিচারপতি পদে বহাল থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে শপথ গ্রহণ করেছিলেন। রাষ্ট্রের লাভজনক পদে বা সরকারি চাকুরিতে বহাল থেকে ভাইস প্রেসিডেন্টের মত সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত হওয়া সংবিধানের পরিপন্থী। কিন্তু ডকট্রিন অব নেসেসিটি হিসাবে বিচারপতি শাহাবুদ্দীনকে এই দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। পরে জাতীয় সংসদে বিষয়টিকে অনুমোদন করে নিতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে বিএনপি সংবিধান সংশোধন করে যে কেয়ারটেকার সরকারের বিধান সংবিধানে সংযোজন করেছিল দেশের উচ্চ আদালত তো সেটিকেও অসাংবিধানিক বলেছে। সর্বশেষ সেনা সমর্থিত যে জরুরি সরকার দেশে ২ বছর শাসন ক্ষমতা চালিয়েছিল তা তো সরাসরি সংবিধান লংঘন করে। মোদ্দা কথা এ পর্যন্ত যে কয়টি কেয়ারটেকার সরকার এসেছে তার সবকটিই অসাংবিধানিক পন্থায়; ডকট্রিন অব নেসেসিটি হিসাবে এবং সেসব নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকারগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সব সরকারই মেয়াদ পূর্ণ করেছে। তাহলে দেশের চলমান সংকট নিরসনে সংবিধানে সংশোধনী আনতে বাধা কোথায় ?
একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, আওয়ামী সরকার কর্তৃক সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধন ও উচ্চ আদালতের রায়ে দেশে এক নতুন সংকটের জন্ম দিয়েছে। রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণীত হয় গণমানুষের কল্যাণে এবং দেশের আদালতগুলোর দায়িত্ব হলো গণমানুষের অধিকার সংরক্ষণের। তাই সংবিধানে কোন ধারা যখন গণমানুষের জন্য অকল্যাণকর মনে হয় তখনই সংবিধানে সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। আর সে জন্যই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের সংবিধান ১৫ বার সংশোধন করা হয়েছে। দেশের সংবিধান ও আদালতের রায় মোতাবেক যদি আগামী নির্বাচন হয় তাহলে দেশে সংঘাত অনিবার্য এবং দেশে মারাত্মক গৃহযুদ্ধেরও সম্ভাবনা অভিজ্ঞ মহল উড়িয়ে দিচ্ছেন না। যে সংবিধান ও উচ্চ আদালতের রায় দেশে সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে তা দেশের মানুষ মানতে বাধ্য নয়। আদালতকে এ অধিকার কেউ দেয়নি। আর সে সংবিধান দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে,  সে সংবিধান শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই সংশোধন হওয়া উচিত।
দেশে এই ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটের সমাধান বিরোধী দল কেয়ারটেকার সরকারের মাধ্যমেই খুঁজছে। কিন্তু সরকারি মহল থেকে একেক সময় একেক কথা বলা হচ্ছে। তারা ইতোপূর্বে বলে এসেছে সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। গত কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, নির্বাচনকালীন সময়ে সরকার প্রধান বিরোধী দলের সাথে আলোচনা করে ঠিক করা হবে। কয়েক দিন আগে এক টিভি টক-শো আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ রাষ্ট্রপতির অধীনে অন্তর্বর্তী সরকারের ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ কী রাষ্ট্রপতিকে বিতর্কিত করে ছেড়েছে? ২০০৬ সালে তো রাষ্ট্রপতির অধীনেই কেয়ারটেকার সরকার গঠিত হয়েছিল। সে সরকার কী আওয়ামী লীগ মেনে নিয়েছিল? তারা তো রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দীনকে ‘ইয়েস উদ্দীন’ এবং ‘ইয়াজিদ্দা’ আখ্যা দিয়ে অপদস্থ করেছিলেন। একজন রাষ্ট্র প্রধানকে এভাবে যারা অপদস্থ করতে পারে তাদের বিবেক-বুদ্ধি কতখানি প্রসন্ন তা বিচারের ভার দেশের মানুষের কাছেই ছেড়ে দেয়া হলো। এখানেই শেষ নয় তারা বঙ্গভবনে অক্সিজেন বন্ধেরও হুমকি দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ যদি সে সময় রাষ্ট্রপতিকে বিতর্কিত না করতো তাহলে বর্তমান সংকট উত্তরণ খুবই সহজ হতো। কিন্তু সে সুযোগটা নষ্ট আওয়ামী লীগই করেছে। তাই বিরোধী দলের পক্ষে তা মেনে নেয়া কোন ভাবেই সম্ভব বলে মনে হয় না।
সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে যে, সরকার নাকি নির্বাচনকালীন সময়ে স্পিকারকে সরকার প্রধান করতে চায়। কিন্তু বিরোধী দলের দাবি হলো দল নিরপেক্ষ লোককে সরকার প্রধান করতে হবে। যেহেতু স্পীকার আওয়ামী লীগের টিকেটে সংরক্ষিত কোটায় নির্বাচিত তাই এর মাধ্যমে বিরোধী দলের নির্দলীয় সরকারের দাবি পূরণ হয় না। বিরোধী দলীয় নেতারা স্পষ্টতই বলে দিয়েছেন যে আওয়ামী লীগের কোন নেতাকে সরকার প্রধান করে তারা কোন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবেন না। তাহলে সমস্যা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেল। বিরোধী দল  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পীকার শিরিন শারমিন চৌধুরীর মধ্যে পার্থক্য দেখবে বলে মনে হয় না। তাই সরকারের এ ফর্মূলাও বিরোধী দল মেনে নেবে বলে মনে করার কোন কারণ নেই। তবে সংকট সমাধানের একটা মোক্ষম সুযোগ তৈরি হয়েছিল। সরকারের অহমিকার কারণে সে সুযোগটাও হাতছাড়া হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত করতে পারলে রাষ্ট্রপতির অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারতো। আবার স্পীকার নির্বাচনেও যদি সরকার বিরোধী দলের সাথে আলোচনা করতো এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে সে পদে আনা হতো তাহলে সংবিধানও রক্ষা হতো এবং বিরোধী দলও তা গ্রহণ করতো। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই এই মহাসুযোগটা কাজে লাগানো হয়নি। কারণ, আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য সংবিধান বা আদালতের রায় মান্য করা নয় বরং নির্বাচনকালীন সরকারে তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখা। 
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে

জিয়াউর রহমান ছিলেন স্বনামধন্য একজন সামরিক ব্যক্তিত্ব। লেফটেন্যান্ট থেকে শুরু করে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদবির অধিকারী হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান মনে করতেন দেশ জয় বা দেশ রক্ষায় সামরিক প্রশাসন জরুরি। কিন্তু দেশ পরিচালনায় গণতান্ত্রিক বেসামরিক প্রশাসন প্রয়োজন। রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে বেসামরিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সামরিক ব্যক্তিত্ব জিয়াউর রহমানের অবদান যুগান্তকারী।
৭৫-এর ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তন, ৩ নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থান, ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লবের পর রাষ্ট্রীয় বৃহত্তর স্বার্থে সিপাহিরা সেনাপ্রধান জিয়াকে বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে এনে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসান। জিয়া প্রথমে ডেপুটি চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হন। পরে ২১ এপ্রিল ১৯৭৬ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ এস এম সায়েম জিয়ার হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দিয়ে নিজে সরে পড়েন। ১৯৭৬ সালের ২১ এপ্রিল থেকেই লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি ও চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে বাংলাদেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর ৭৫-এ দেশে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা, বাকশালবিরোধী সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থানে সদ্য স্বাধীন দেশের সামরিক ও বেসামরিক অঙ্গন তছনছ হয়ে যায়। জিয়া সর্বপ্রথম সামরিক বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দূর করে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর যে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য মুক্তিযুদ্ধ, সে বহুদলীয় গণতন্ত্র দেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন রাষ্ট্রনেতা জিয়া।
জনগণই ক্ষমতার উৎস। জনগণ ক্ষমতায় বসান। জনগণ ক্ষমতা থেকে নামান। সিপাহি-জনতাই দেশপ্রেমিক জিয়াকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়া পর্যায়ক্রমে জাতিকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে নিবেদিত হন। প্রথমে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশবাসী তাকে মানেন কি না, হ্যাঁ-না ভোট দিয়ে জাতির কাছে প্রশ্ন রাখেন। ৩০ নভেম্বর ১৯৭৭ অনুষ্ঠিত গণভোটে জাতি ৯৮ শতাংশ হ্যাঁ ভোট দিয়ে জিয়ার প্রতি সমর্থন জানায়।
উচ্চপর্যায় থেকে যে রাজনৈতিক সেবাকার্যক্রম শুরু হয় স্থানীয় সরকারই তা গ্রামগঞ্জের জনগণের হাতে পৌঁছে দেয়। হ্যাঁ-না ভোটে বিজয়ী হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি জিয়ার সম্মুখে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আবশ্যক হয়ে পড়ে। প্রয়োজনের তাগিদে জিয়া সরকার ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে চার হাজার ৩৫২টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও আগস্ট মাসে ৭৮টি পৌরসভা নির্বাচন সম্পন্ন করেন। এরপর উন্নয়নের রাজনীতি নামে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে দলবল নিয়ে ছুটে যান গ্রামগঞ্জে। শুষ্ক মওসুমে ক্ষেতে পানি সেচের সুবিধার জন্য শুরু করেন খাল খনন কার্যক্রম। উৎসাহ প্রদানে কোথাও কোথাও নিজেও কোদাল ধরেন। গ্রাম থেকে গ্রামে, বাড়ি থেকে বাড়িতে হেঁটে গিয়ে কৃষকসমাজকে জাগিয়ে তোলেন স্বনির্ভরতা অর্জন করতে। একই সাথে কলের লাঙ্গল, সার, কীটনাশকও পৌঁছে দেন গ্রামগঞ্জে। পাশাপাশি জিয়া মিল-কারখানায় ছুটে গিয়ে সমস্যা সমাধান করে দিয়ে মিল-কারখানায় উৎপাদনের চাকা সচল করে দেন। প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে নতুন নতুন মিল-ইন্ডাস্ট্রিজ গড়ে তুলেন বিপ্লবী জিয়া।
উৎপাদনহীন শুধু রাজনীতি, শুধু নির্বাচন  জিয়ার পছন্দ ছিলোনা । তাই তিনি রাজনীতিকে শহর থেকে নিয়ে আসেন গ্রামগঞ্জে, মাঠে-ঘাটে, কলে-মিলে। দেশব্যাপী উৎপাদনের জোয়ার সৃষ্টি করেন রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান। এর ফাঁকে ফাঁকে গণতান্ত্রিক ধাপগুলোকে পূর্ণ করে তুলেন তিনি। রাষ্ট্রপতি জিয়া তৃণমূল নির্বাচন শেষে হাতে ধরে জাতিকে উৎপাদনে লাগিয়ে দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের দিকে পা  বাড়ান ৭৫ থেকে লাগানো রাজনৈতিক জট একে একে খুলে দেন তিনি।
জিয়া সরকার ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই রাজনৈতিক দল বিধি (পিপিআর) জারি করেন। পিপিআর জারির ফলে প্রথমে ২১টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধন লাভ করে। পরে আরো নতুন পুরাতন দল ছাড়পত্র পায়। এ সুযোগে  আওয়ামী লীগও পুনর্জন্ম লাভ করে। জিয়ার হাতের ছোঁয়ায় আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম ইতিহাসের একটি মাইলফলক ঘটনা। জিয়ার চিন্তাচেতনায় গঠিত জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দলও  আত্মপ্রকাশ করে। জিয়া সরকার এসব রাজনৈতিক দলকে প্রাথমিকভাবে ঘরোয়া রাজনীতি করার অনুমতি দেন। ১৯৭৮ সালের ১ মে থেকে পিপিআর উঠিয়ে দেয়া হয়। এর দরুন দেশব্যাপী ঘরে-বাইরে মাঠে-ময়দানে অবাধ রাজনীতির দুয়ার খুলে যায়। এভাবে বাকশালী আইনে কেড়ে নেয়া বহুদলীয় গণতান্ত্রিক অধিকার রাষ্ট্রপতি জিয়া আবার জাতিকে ফিরিয়ে দেন। এ ধারাবাহিকতায় জিয়া সরকার দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘোষণা করেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে জাগদলকে কেন্দ্র করে (ন্যাপ ভাসানী)সহ ছয়টি দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট। জিয়া ছিলেন ফ্রন্ট মনোনীত রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী। অপর দিকে জেনারেল ওসমানীর উদ্যোগে জাতীয় জনতা পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল নিবন্ধন লাভ করে। আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সামনে রেখে জনতা পার্টিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগসহ ছয়টি পার্টির সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠিত হয়। ঐক্যজোট মনোনীত রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্র্থী হন জেনারেল এম এ জি ওসমানী। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ও গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট ছাড়াও আরো কয়েকটি দল অংশ নেয়। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় জেনারেল ওসমানী ও লে. জেনারেল জিয়ার মধ্যে। জিয়া ছিলেন আমাদের মহান স্বাধীনতার ঘোষক। তদুপরি তিনি ছিলেন এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার, পরে জেড ফোর্সের অধিনায়ক। আর ওসমানী ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা ও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের Commander in Chief (C In C),  দুজনই জাতির কাছে পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে ৩ জুন ১৯৭৮-এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জাতি বিপুলভাবে ভোট দিয়ে জিয়াকেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে। জেনারেল ওসমানীও নির্বাচনের এ রায় শ্রদ্ধাভরে মেনে নেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরই আসে সংসদ নির্বাচনের পালা। দেশজুড়ে শুরু হয় সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড়।
এবার রাষ্ট্রপতি জিয়া জাগদলের পরিবর্তে নিজস্ব চিন্তাচেতনার রাজনৈতিক দল গঠনে উদ্যোগী হন। জিয়া ছিলেন ৭০-এর দশক থেকে মওলানা ভাসানীর ভক্ত। পরিস্থিতির প্রয়োজনে রাজনীতিতে আসার পর থেকে জিয়াকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানান মওলানা ভাসানী। জিয়াকে সুপরামর্শ দিয়েও মওলানা ভাসানী দেশকে এগিয়ে নিতে চান। ১৯৭৬-এ জিয়া হাসপাতালে অসুস্থ ভাসানীকে দেখতে গেলে মওলানা ভাসানী জিয়াকে রাজনৈতিক দল গঠন করলে, দলের নামের মাঝে Nationalist  শব্দটি রাখলে দলীয় সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন। জিয়াউর রহমান ঘনিষ্ঠজনদের সাথে পরামর্শ করে জাগদলের চেয়েও আধুনিক এবং নিজস্ব নেতৃত্বাধীন Bangladesh Nationalist Party (BNP) নামে দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। উচ্চপর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা ভাসানীর গড়া সংগ্রামী দেশপ্রেমিক মানুষগুলো এসে বিএনপিতে যোগদান করেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও মুসলিম লীগের সংস্কারপন্থী কয়েকজন নেতাকেও জিয়া টেনে আনেন বিএনপিতে। তদুপরি জিয়াউর রহমান সাবেক সেনা অফিসার সাবেক আমলা-কূটনীতিক, ঝানু আইনজ্ঞ, ঝানু অর্থনীতিবিদ, এমনি অন্যান্য অঙ্গন থেকেও দেশপ্রেমিক বিজ্ঞজন বেছে বেছে এনে বিএনপির পতাকা তলে শরিক করেন। জিয়ার প্রচেষ্টায় দেশপ্রেমিক, ইসলামপ্রিয়,  জাতীয়তাবাদী এবং স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার শক্তি হিসেবে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ থেকে আত্মপ্রকাশ করে  বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল।
রাষ্ট্রপতি জিয়া চূড়ান্তভাবে দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ৩১টি দল অংশ নেয়।  এ থেকে ৩০০ আসনের মধ্যে বিএনপি লাভ করে ২০৭টি আসন। আওয়ামী লীগ দুই  গ্রুপ মিলে পায় ৩৯+২+৪১টি আসন, মুসলিম লীগ ও আইডিয়েল মিলে পায় ২০টি আসন, জাসদ পায় আটটি  আসন, ন্যাপ (মোজাফফর) পায় একটি আসন, অন্যান্য দল পায় সাতটি আসন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দখল করে ১৬টি আসন। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি নির্বাচনে অংশ নিলেও কোনো আসন  লাভ করতে পারেনি।
১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনের পর একক সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হিসেবে বিএনপি সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে।  এ সংসদ নির্বাচনের পর ২ এপ্রিল ৭৯ থেকে প্রথম সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। এ প্রথম সংসদ অধিবেশনে ৬ এপ্রিল ৭৯ তারিখে দেশ থেকে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। দীর্ঘ চড়াই উৎরাইয়ের পর দেশে শুরু হয় বেসামরিক শাসনব্যবস্থা।
রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোস্তাক আহমদের জারি করা মার্শাল ল ক্ষমতাসীন হয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়া দেশ থেকে উঠিয়ে দেন। রাষ্ট্রপতি জিয়ার হাত ধরে ৬ এপ্রিল ১৯৭৮ থেকে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দেশে পুনরায় যাত্রা শুরু করে। তাই বলা হয়, বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পূর্ব প্রবর্তক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।


0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রাষ্ট্র অত্যাচারী হয়ে ওঠে সরকারের দমননীতির কারণে

রাষ্ট্র যেকোনো সময় অত্যাচারী হয়ে উঠতে পারে। নিজ নাগরিকদের ওপর অত্যাচার করার অধিকার নাগরিকেরাই রাষ্ট্রকে দিয়েছে। রাষ্ট্রকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য নাগরিকেরা স্বেচ্ছায় অনেক অধিকারকে সারেন্ডার করেছে। রাজনীতিকেরা বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দেশ বা রাষ্ট্র বড়। এ বাক্য দ্বারা মানুষ বা নাগরিকদের রাষ্ট্রের অধীনে আনা হয়েছে। ফলে জগতের অনেক নির্বাচিত বা অনির্বাচিত শাসক রাষ্ট্রের সীমাহীন মতা ব্যবহার করে স্বেচ্ছাচারী ও অত্যাচারী হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন গণতন্ত্র আর বাক স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। বছরের পর বছর জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। তিনিই শেষপর্যন্ত একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করেছিলেন। সরকারি কাগজ ছাড়া সব কাগজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি যে, বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের কল্যাণ চাইতেন। তিনি দেশের মানুষের জন্য ভাবতেন। তার সারল্য ও দেশপ্রেমকে ব্যবহার করে মস্কোপন্থী বাম ও ভারতপন্থী দলগুলো তাকে ভুল বুঝিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করিয়েছে। এর আগে ৭৪ সালে দুর্ভিরে কারণে তার জনপ্রিয়তা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। তাকে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল বিরোধীদের মুখ বন্ধ করে দিলে উন্নয়নের পথ সুগম হবে। এ জন্যই দেশের মানুষের স্বার্থেই দরকার একদলীয় শাসন। ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আমলে রাজনৈতিক কারণে বহুলোককে হত্যা করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ কখনোই সমাজতান্ত্রিক দল ছিল না। যে দলটি ৭০ সালেও ঘোর মার্কিনপন্থী ছিল, সেই দলটিই রাতারাতি সমাজতান্ত্রিক হয়ে গেল। আসলে বঙ্গবন্ধু কখনোই সমাজতান্ত্রিক ছিলেন না। ভারত ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সরকারকে বাধ্য করেছিল সমাজতান্ত্রিক নীতিগ্রহণ করতে। যদিও ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ওয়াদা ছিল তারা কখনোই কুরআন সুন্নাহ বিরোধী আইন করবে না। তখনো দলটি জানত না তারা মতায় যেতে পারবে কি না এবং পূর্বপাকিস্তান স্বাধীন হয়ে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে কি না। এ অঞ্চলে অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা ছিল ভারতের রাজনৈতিক কর্মসূচি। এ কাজে তারা বামপন্থীদের ব্যবহার করেছে। ৪৭ সালেই ভারত পাকিস্তান ভেঙে ফেলার কর্মসূচি হাতে নেয়। তাদের সেই কর্মসূচি তারা ৭১-এ জুলফিকার আলী ভুট্টোর সহযোগিতায় বাস্তবায়ন করে।
শুধু একবার ভেবে দেখুন তো,যদি ইয়াহিয়া খান বা পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে মেনে নিয়ে (যা মানা বাধ্যতামূলক ছিল) মতা হস্তান্তর করত, তাহলে কী হতো? বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খান ও তার সাঙ্গোপাঙ্গকে বিশ্বাস করেছিলেন বলেই সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না ভারতের কী পরিকল্পনা ছিল। এমনকি তিনি ২৫ মার্চ বিকেল পর্যন্ত অপো করেছিলেন সমঝোতাপত্রে দস্তখত করার জন্য। আসলে সমঝোতা হয়েছিল ভুট্টো আর ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে। তারা দুজন ছিলেন ভাই-বোনের মতো। এসব কথা একদিন সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হবে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে বাংলার তরুণ, কৃষক,শ্রমিক, ছাত্র-যুবক, পুলিশ, ইপিআর, আনসার ও বাঙালি সৈনিক ও অফিসারেরা প্রতিহত করেছেন। জীবন দিয়েছেন। ৭০-এর নির্বাচনের ফলাফলকে ব্যবহার করে দিল্লি মুজিবনগর সরকার গঠনে সাহায্য ও সমর্থন দিতে থাকে। মুজিবনগর সরকারের কর্তৃত্ব চলে যায় দিল্লির হাতে। এর আগে ২৬ মার্চ বাঙালি সেনা অফিসার মেজর জিয়া সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বিশ্ববাসীকে উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানালেন সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য। মুজিবনগর সরকার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে ১৭ এপ্রিল। ভারত সরকারের দলিল দস্তাবেজেও রয়েছে মেজর জিয়ার নাম স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে। ইন্দিরা গান্ধী জানতেন, পাকিস্তানের সামরিক জান্তা যেকোনো সময় শেখ সাহেবের সাথে সমঝোতা করে ফেলতে পারে। তাই ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ব জনমত সৃষ্টির জন্য এবং বিশ্ব নেতাদের সমর্থন লাভের জন্য বিদেশ সফরে বেরিয়েছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব ও এ কে খোন্দকার সাহেবও স্বীকার করেছেন, তারা মেজর জিয়ার ঘোষণা শুনেছেন। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতে ঘোষণা নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি।
এতণ প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে পেছনের কথাগুলো উল্লেখ করেছি। আজকের প্রধান বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রের নিপীড়ন ও দমনমতা নিয়ে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ক্রমাগত অত্যাচারী হয়ে উঠেছে। ৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে বাগে আনার জন্য বা বাধ্যতামূলকভাবে অনুগত করার জন্য সব ধরনের সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছে। হয়তো তাদের বিশ্বাস ছিল, দমনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আত্মসমর্পণ করবে। তাদের সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সামরিক জান্তা হয়তো সুযোগ পেয়ে পাকিস্তানকে টুকরো করার জন্যই আক্রমণ চালিয়েছে। হয়তো তারা পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছিল।
আমাদের ভূগোলটা হয়তো স্বাধীন হয়েছে। কারণ এর একটা ভূগোল আছে, জাতীয়সঙ্গীত আছে, জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ আছে, বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু নাগরিকেরা সত্যিকার অর্থে কখনোই স্বাধীন হয়নি। এ দেশের সংবিধান গণ-আস্থা ধারণ করেনি। এখানে পুলিশ হলো রাষ্ট্র। নাগরিক হলো পুলিশের প্রজা।
বাংলাদেশ কখনোই ভারত, চীন, আমেরিকার মতো স্বাধীন নয়। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তেমন কোনো নীতি এ রাষ্ট্র্র নিতে পারেনি শুধু শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে। আমরা মাহাথির, লি কুয়াং, পার্ক চুং হি বা মাওয়ের মতো নেতা পাইনি, এটা হয়তো আল্লাহরই ইচ্ছা। আরেকটি কারণ হলো আইনগতভাবেই আমরা তেমন স্বাধীন দেশ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইনি। ভারতের মতো একটি সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসী রাষ্ট্র পাশে থাকলে বাংলাদেশের মতো একটি দুর্বল রাষ্ট্রের অবস্থা কী হতে পারে, তা আমাদের নেতারা কখনোই বোঝার চেষ্টা করেননি। বরং বঙ্গবন্ধু ও জিয়া ছাড়া সব সরকারই দিল্লিকে খুশি রেখে বা নগ্ন আনুগত্য স্বীকার করে দেশ চালানোর চেষ্টা করেছে। জেনারেল এরশাদ ও বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা প্রকাশ্যেই ভারতের অনুগত ছিলেন। এ দুজন সম্পর্কে ভারতীয় মিডিয়ার বিশ্লেষণ দেখলেই বুঝা যায় যে, তারা কখনোই বাংলাদেশের মর্যাদা নিয়ে ভাবেননি। খালেদা জিয়াকে ভারত কখনোই ষোলআনা মিত্র মনে করেনি। বিষয়টা জানা সত্ত্বেও খালেদা জিয়া ভারতের ব্যাপারে একটা নমনীয় নীতি অনুসরণ করে এসেছেন। অপর দিকে তিনি চীন, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও আরব দেশগুলোর সাথে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারেননি। তাই বিএনপি ও খালেদা জিয়ার সাথে শত ভাগ বন্ধুত্ব আছে এমন একটি দেশও নেই। ২০০৬ সাল ও পরবর্তী ঘটনাবলির পথ ধরে ১/১১র সরকার আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, তিনি যাদের আপন লোক মনে করে কাছে টেনে নিয়েছিলেন তারা সবাই তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ১/১১র সরকার ছিল মূলত দিল্লির এক্সটেনশন। পিনাক রঞ্জনরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত। আমেরিকা ও তার মিত্ররা এক হয়ে ভারতকে এ সুযোগটা করে দেয়। ওই সুযোগেই ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ও এর জোটভুক্ত দলগুলো মতায় এসেছে জাতীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের চেয়েও বেশি সিট দখল করে। ৭৩ সালেও এরকম একটি নির্বাচন হয়েছিল। তখন ভারত বা আর্মির কোনো প্রয়োজন হয়নি। তখন বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। তখন আওয়ামী লীগ সিট পেয়েছিল ২৯০ বা ২৯৩। আর যায় কোথায়? ওই সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে বঙ্গবন্ধু একজন সিভিল ডিক্টেটরে পরিণত হন। সামান্য সমালোচনাও তিনি সহ্য করতে পারতেন না। সে সময়ে ডানপন্থী ও ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
এখন দেশে এমন এক পরিস্থিতি ও পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যাতে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল ও দলের নেতাকর্মীরা শঙ্কিত। একটি নির্বাচিত সরকার জনগণের ওপর কেমন করে এমন নিষ্ঠুর অত্যাচার করতে পারে। প্রশ্ন হলো, কেন সরকার দমননীতির দিকে এমন ঝুঁকে পড়েছে। যারা দেশে বিদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন, খোঁজখবর রাখেন বা লেখেন তারা অবশ্যই জানেন, কেন সরকার রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আমরা যারা বিগত ৫০ বছর ধরে খবরের কাগজের সাথে জড়িত তারা এমন দমনব্যবস্থা পাকিস্তান আমলেও দেখিনি। তাহলে সরকার এমন নিষ্ঠুর দমননীতির আশ্রয় নিয়েছে কেন? এর উত্তর পেতে হলে মিসরের মোবারক, ফিলিপাইনের মার্কোস, ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো, লিবিয়ার গাদ্দাফি ও সালাজার ফ্রাংকোর দিকে একবার তাকান। ওরা বহু বছর মতায় ছিল। বঙ্গবন্ধুও এদের মতো কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। তার আমলে জাসদের হাজার হাজার কর্মী নিহত হয়েছেন। সেই জাসদের ইনু এখন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী। এই ইনুরাই গণবাহিনী গঠন করে বহু সেনা অফিসারকে হত্যা করেছেন। বারবার সেনাবাহিনীতে গোলযোগ সৃষ্টি করেছেন। দমননীতি গ্রহণ করে মতায় টিকে থাকাটাও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একটি পদ্ধতি। যেমন আমেরিকা সারা পৃথিবীকে ভয় দেখিয়ে,শক্তি প্রয়োগ করে নিজের প্রভাব জারি রেখেছে। এমনকি অন্য দেশে জোর প্রবেশ করে সে দেশের নেতা বা সরকার প্রধানদের ধরে জেলে বন্দী করে রেখেছে। উদ্দেশ্য বিশ্ববাসীকে দেখানো বিরুদ্ধে গেলে কী অবস্থা হতে পারে। ভয় বা শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিপকে অবনত ও অনুগত করা।
বাংলাদেশে সরকার ও আওয়ামী লীগ সেই দমননীতির পথ গ্রহণ করেছে। গত কয়েক মাসে নানা কারণে কয়েক শ নাগরিক নিহত হয়েছেন। সরকারপ্রধান হত্যার অপরাধ চাপিয়ে দিচ্ছেন বিরোধী দলের ওপর। সরকার প্রধান অনবরত বলে চলেছেন, মানুষ হত্যা করে মতায় আসতে পারবেন না। আওয়ামী লীগের কর্মী, বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া প্রধানমন্ত্রীর মতোই নীতি গ্রহণ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর কোনো দোষই নেই। তিনি গণতন্ত্র, দেশের উন্নতি, স্বাধীনতার জন্য কাজ করছেন। তিনি মনে করেন, সংসদে মেজরিটি সিটই আসল কথা। যেভাবেই হোক বেশি সিট নিয়ে মতায় থাকতে পারলেই হলো। গণতন্ত্রও থাকবে, দেশের উন্নতিও হবে। বিশ্বের সব সিভিল ডিক্টেটররাই তাই মনে করেন। মার্কোসও সেভাবেই মতায় ছিলেন এবং নিজ দেশের মানুষের ওপর অত্যাচার চালিয়ে গেছেন।
যেসব রাষ্ট্র বা সরকার ভয় দেখিয়ে দেশ শাসন করে বা নাগরিকদের অনুগত রাখে তারাই এখন সরকার প্রধানের প্রধান পরামর্শক উপদেষ্টা। তাদের পরামর্শ হলো দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্বার্থে দমন ও নিপীড়ননীতি গ্রহণ করা জায়েজ। রাষ্ট্রের অত্যাচারী মতা সরকারকে এ অধিকার দেয়। তাদের উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশকে অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত করা। গণতন্ত্রের লেবাস পরিয়ে একটি শক্তিশালী অনুগত রাজনৈতিক দলকে মতায় রাখা এবং বিনিময়ে নিজেদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ল্য হাসিল করা। এ জন্য কী করতে হবে? ভয় দেখিয়ে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নিজস্ব চিন্তাচেতনা ও স্বাধীন থাকার স্পৃহাকে ভোতা করে দেয়া। বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী হলো দরিদ্র মুসলমান। ইংরেজরা যেমন ভারতের মুসলমানদের অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়ে দমিয়ে রেখেছিল, ঠিক তেমনি। একই পদ্ধতি গ্রহণ করেছে এ সরকার। দমন করো, অত্যাচার করো, খুন করো, গুম করো। দেখবে, একদিন তোমার প্রতিপ কান্ত হয়ে গেছে। চীন ও রাশিয়ায় ৭০ বছর মুসলমানদের মসজিদ ও ধর্মকর্ম বন্ধ ছিল। যখন বন্ধ রাখার নীতি প্রত্যাহার হলো তখন দেখা গেল মুসলমানেরা নামাজ পড়া ভুলে গেছে। এখনো সেসব দেশে শত শত মসজিদ বন্ধ রয়েছে। ভারতেও বহু মসজিদ বন্ধ রয়েছে। বহু রাজ্যে মাইকে আজান দেওয়া যায় না, প্রকাশ্যে কোরবানি করা যায় না। ৪৭ সালের আগে পূর্ববাংলায় কোনো কোনো অঞ্চলে কোরবানি করতে জমিদারের অনুমতি লাগত। নদীয়ার মহারাজা মুসলমানদের দাড়ির ওপর খাজনা বসিয়েছিলেন। হিন্দুদের পূজায় মুসলমানদের কর দিতে হতো। বাংলাদেশে এখন দাড়ি টুপিওয়ালারা ভয়ে আতঙ্কিত। মসজিদের ইমামেরা কুরআনের নির্দেশনা মোতাবেক তাফসির করতে সাহস পান না। কুরআনে বর্ণিত ফেরাউন, নমরুদ, সাদ্দাদের বিরুদ্ধেও বয়ান করতে পারবেন না। সরকারের নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। মসজিদে মসজিদে সরকারি বেসরকারি গোয়েন্দাদের আনাগোনা। সরকারের দৃশ্য অদৃশ্য পরামর্শকেরা এতে বেশ খুশি। কারণ, এটাই তাদের টার্গেট। মানুষ ভীত হয়ে গেলে অনুগত হয়ে যাবে। ভয়ে নিয়মিত ভোট দিয়ে যাবে। যুগের পর যুগ মতায় থাকা যাবে। যেমন নির্বাচনের মাধ্যমেই মতায় ছিলেন মার্কোস ও মোবারক।
যে সামরিক কেয়ারটেকার সরকার এ সরকারকে মতায় বসিয়েছে দুই-তৃতীয়াংশ সিট দিয়ে, সেই ব্যবস্থার ওপর তাদের এখন কোনো আস্থা নেই। তারা নিজে মতায় থেকে নির্বাচন করবেন। প্রধানপন্ত্রীর পদে থেকে এমপির জন্য নির্বাচন করবেন জোর করে। কারণ মতায় থাকলে রাষ্ট্র শক্তি তার হাতে থাকবে। তার কাছে এটাই গণতন্ত্র। অদৃশ্য পরামর্শক ও উপদেষ্টারা বলছেন, ধর্মহীন (অনেকেই বলেন ধর্মনিরপে) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এ সরকারকে অবশ্যই মতায় থাকতে হবে আরো অনেক বছর। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের নতুন ডকট্রিন হলো মতায় থাকার গণতন্ত্রের লেবাস অবশ্যই পরতে হবে। জনগণের সমর্থন না থাকলেও সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সিট থাকলেই হলো। তাহলে দেখবেন, সারা বিশ্ব আপনাকে সমর্থন জানাবে। তথাকথিত মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনের জন্য আমেরিকার কাছ থেকে কোটি কোটি ডলার মাগনা পাবেন। কাশ্মিরে ভারত ৬৫ বছর ধরে দমননীতি চালিয়ে হাজার হাজার কাশ্মিরি মুসলমানকে হত্যা করছে। বিশ্ববাসী একটি কথাও বলে না। গণতন্ত্রের লেবাস পরে দমনের মাধ্যমে মতা স্থায়ীকরণ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি নতুন কৌশল। নিরীহ নিরস্ত্র হোফাজতের কর্মীদের গভীর রাতে ফ্যাশ আউট করার পরামর্শও ছিল ইসলামবিরোধী শক্তির। সে রাতের ঘটনাকে সরকার বেমালুম গায়েব করে দিয়েছে। এ ব্যাপারে মিডিয়া হচ্ছে সরকারের সহযোগী। এখন সরকার কথায় কথায় বলে হেফাজতের কথা ভুলে যাবেন না। আজ এখানেই শেষ করছি পবিত্র আল কুরআনের একটি আয়াত দিয়ে। সূরা আল ইমরানের ৫৪ নম্বর আয়াত। ওয়া মাকারু, ওয়া মাকারাল্লাহু, ওয়াল্লা খায়েরুল মাকেরিন। বাংলা তরজমা, আর তাহারা গোপন ষড়যন্ত্র করিল এবং আল্লাহ তায়ালা গোপন কৌশল করিলেন, আর আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন শ্রেষ্ঠতম কৌশলী।


বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

উৎপাদনের রাজনীতি ও জিয়াউর রহমান


পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসব্যাপী রক্তয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর আওয়ামী লীগ মতায় গিয়ে শাসনকার্য পরিচালনায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল। পরে সেনাবাহিনীর একাংশের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। এতে সপরিবারে শেখ মুজিব নিহত হন। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫-এর এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া বন্দী হন। কিন্তু ৭ নভেম্বর সাধারণ সেনাসদস্যরা তাকে মুক্ত করেন। এরপর জিয়া মতাকে আরো সুসংহত করেছিলেন। এ সময় জিয়া উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ লাভ করেন। পরবর্তীকালে এক ঘোষণার মাধ্যমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জিয়াবিরোধী কয়েকটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান সত্ত্বেও সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এতে জনগণের  মধ্যে তার একটি ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। ১৯৭৬-এর জুলাই মাসে দেশ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিকাশের এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। এক বছর বিরতির পর সামরিক সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের কর্মতৎপরতা পুনরায় শুরু করার অনুমতি দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতি সায়েম কর্তৃক ঘোষিত রাজনৈতিক দল বিধির অধীনে দলগুলোকে দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনাসহ দলের ল্য, উদ্দেশ্য, কর্তব্য এবং বাস্তব সম্ভাবনা সুস্পষ্টভাবে সরকারের সামনে উপস্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়।
১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় মতায় অধিষ্ঠিত হন এবং ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ এবং অর্থনীতি পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতি জিয়ার বিভিন্ন পদপে দেশ ও বিদেশে প্রশংসিত হয়।
জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন, রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। তিনি সব সময় ভাবতেন, কিভাবে নিজস্ব আঙ্গিকে জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলা যায়।
তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সৈনিক নেতা, অর্থনৈতিক েেত্র বৈপ্লবিক সংস্কারক ও সর্বোপরি রাষ্ট্রনায়কোচিত ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিলেন। দেশের উন্নয়নের ল্েয যে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, তার আলোকেই দ্বিবার্ষিক অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রণীত হয়েছিল। এর উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৭৮ সাল থেকে কার্যকর হওয়া পরিকল্পনা কমিশনের দলিলে। বিএনপি গঠনের পর ১৯ দফাকে দলীয় কর্মসূচি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৯ দফা কর্মসূচি এখানে তুলে ধরা হলো :
সর্বতোভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রা। ২. সংবিধানের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক আস্থা ও বিশ্বাস, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলিত করা। ৩. সর্ব উপায়ে নিজেদেরকে আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলা। ৪. প্রশাসনের সর্বস্তরে উন্নয়ন কার্যক্রমে ও আইনশৃঙ্খলা রার ব্যাপারে জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ৫. সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতিকে জোরদার করা। ৬. দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং কেউ যেন ভুখা না থাকে তার ব্যবস্থা করা। ৭. কাপড়ের উৎপাদন বাড়িয়ে সবার জন্য অন্তত মোটা কাপড় সরবরাহ নিশ্চিত করা। ৮. কোনো নাগরিক যেন গৃহহীন না থাকে তার ব্যবস্থা করা। ৯. দেশকে নিররতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা। ১০. সকল দেশবাসীর জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। ১১. সমাজে নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং যুবসমাজকে সুসংহত করে জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করা। ১২. অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দান। ১৩. শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি সাধন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে সুস্থ শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। ১৪. সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে জনসেবা ও দেশ গঠনের মনোবৃত্তি উৎসাহিত করা এবং তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন। ১৫. জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ। ১৬. সকল বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বিশেষ জোরদার করা। ১৭. প্রশাসন ও উন্নয়ন ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা। ১৮. দুর্নীতিমুক্ত ন্যায়নীতি ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। ১৯. ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরণ করা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করা।
১৯ দফা কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য ছিল : উন্নয়নের হার বাড়ানো, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ল্েয পরনির্ভরশীলতা কমানো, আয়ের সুষম বণ্টন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। এ জন্য দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ, নিররতা দূরীকরণ, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও রফতানি আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জন। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রামের জনগণকে সম্পৃক্ত করে গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নত করা ছিল পরিকল্পনার অন্যতম ল্য। বাংলাদেশের একটি স্বতন্ত্র শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের অগ্রণী ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। এ ছাড়াও ব্যাপক খাল খনন কর্মসূচি, স্বনির্ভর প্রকল্প এবং বৃরোপণ কর্মসূচিরও তিনি ছিলেন প্রধান প্রবক্তা।
গ্রামকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন : জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তাধারার উৎস ছিল গ্রামবাংলা। এ চিন্তাধারা থেকেই তিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সূচনা করেন। তার পদেেপই গ্রামসরকার, ভিডিপি, যুব কো-অপারেটিভ কমপ্লেক্স নামক গ্রামকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যক্রম শুরু করে। পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। এর ফলে গ্রামকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সূচিত হয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
বিশেষ ঋণ বিতরণ কর্মসূচি : পল্লীর সাধারণ মানুষের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য জিয়ার আগ্রহে ১৯৭৭ সালের ফেব্রয়ারিতে বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য কৃষকদের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ১০০ কোটি টাকার বিশেষ ঋণ বিতরণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। একজন কৃষক নির্ধারিত ঋণ পরিশোধ করে বছরে তিনটি ফসলের জন্য ঋণ নিতে পারতেন। এই কর্মসূচির বৈশিষ্ট্য ছিল, ঋণ নেয়ার জন্য জমি ব্যাংকে দেয়ার প্রয়োজন হতো না এবং বর্গাচাষিসহ জমির মালিক চাষিও এ ঋণ নিতে পারতেন।
স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচি : ভিুকের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একটি জাতীয় আন্দোলন হিসেবে ১৯৭৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচির সূচনা।
খাল খনন কর্মসূচি : জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির েেত্র এক শান্তিপূর্ণ বিপ্লব হিসেবে দেশ ও বিদেশে অভিহিত হয়েছিল। এর আওতায় তিনি খাল খনন কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা, সেচের পানির স্বল্পতা, পানিসম্পদ সংরণ এবং উপযুক্ত ব্যবহারের অভাব ইত্যাদি দৃষ্টিকোণ েেত্র খাল খনন কর্মসূচি ছিল অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী পদপে। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে জিয়াউর রহমান সারা দেশে এ কর্মসূচির সূচনা করেন।
গ্রামসরকার প্রতিষ্ঠা : গ্রামসরকার শহীদ জিয়ার গ্রামকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনারই বহিঃপ্রকাশ। ১৯৭৬ সালে গ্রাম পরিষদ গঠন করা হলেও তা পার্লামেন্টারি অ্যাক্ট ৯-১এর আওতায় ১৯৮০ সালে গ্রামসরকার হিসেবে কাজ শুরু করে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে জিয়া গ্রামকে মৌলিক ইউনিট হিসেবে চিহ্নিত করে গ্রামসরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
শহীদ জিয়াউর রহমানের গ্রামকেন্দ্রিক এ ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচিকে বিশ্লেষকেরা উৎপাদনের রাজনীতি হিসেবে অভিহিত করে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে তা ব্যাপক অবদান রেখেছিল বলে জিয়ার প্রশংসা করেছিলেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জনকল্যাণমূলক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ফলে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা ও  গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসে। এ জন্য দেশ ও বিদেশে তার শাসনামল যথেষ্ট প্রশংসিত হয়।


0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মানবাধিকার ও নির্যাতন


সাম্প্রতিক সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ চতুর্দিকে উচ্চারিত হতে শোনা যাচ্ছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পোশাক শিল্প, নারী, সংখ্যালঘুসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিবরণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কর্মরত মানবাধিকার সংগঠন কর্তৃক প্রকাশিতও হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে নানা মাত্রার প্রকাশ্য ও গোপন; শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের চিত্রও উদ্ভাসিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মানবাধিকার ও নির্যাতন সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক আলোচনা সময়োপযোগী ও যথার্থ হবে।
মানবাধিকার হলো মানুষের সেই সব একান্ত চাহিদা যেগুলো মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি, ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা, উদ্যমশীলতা ও সৃজনশীলতাকে বিকশিত করে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে। অর্থাৎ যে সকল একান্ত চাহিদা পূরণ ছাড়া মানুষ নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না- সেই একান্ত চাহিদাগুলোই হচ্ছে মানবাধিকার। যেমন খাদ্যের চাহিদা, শিক্ষার চাহিদা, বাসস্থানের চাহিদা। অন্যদিকে নিরাপত্তার চাহিদা, ধর্মপালনের চাহিদা, জীবন ধারণের চাহিদা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার চাহিদা, নির্যাতন থেকে মুক্তির চাহিদা, বাক-ব্যক্তি-সংবাদপত্রের মাধ্যমে মত প্রকাশের চাহিদা ইত্যাদি।
মানবাধিকারের উৎস ও আইনগত ভিত্তি কোথায় আছে, তা-ও স্পষ্ট। মূলত বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ বিশেষত মুসলমানদের জীবন ব্যবস্থা স্বরূপ বিশ্ব মানবের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা প্রদত্ত পবিত্র কুরআন মানব মুক্তি ও মানব অধিকারের উজ্জ্বল সনদ। বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতি ও ইতিহাসেও মানবাধিকারের কিছু দিক-নির্দেশনা রয়েছে। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় মানবাধিকারের স্বীকৃতি বিধৃত।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সংবিধান হলো মানবাধিকারের উৎস।
মানবাধিকার বুঝতে হলে প্রথমেই জানতে হবে যে, নির্যাতন কি? নির্যাতন সম্পর্কে এক কথায় প্রদত্ত কোনও সংজ্ঞা নেই। নির্যাতন তখন হবে, যখন, কোন কাজ যা দৈহিক বা মানসিক ব্যথা বা দুর্ভোগ বৃদ্ধি করে; কোন মানুষ বা তৃতীয় কারো কাছ থেকে কোন তথ্য বের করার কাজে বা স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করা হয়; নির্যাতিত ব্যক্তি বা তৃতীয় কোন ব্যক্তি কোন অপরাধ করে থাকলে বা করেছে বলে সন্দেহবশতঃ শাস্তি প্রদান করা হলে; অথবা ভয় দেখানোর জন্য বা মানবিক আতংক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কার্যক্রম গ্রহণ করা হলে; কোন সরকারি কর্মকর্তার নির্দেশে, সম্মতিক্রমে বা অন্যকোন পন্থায় এ ধরনের যন্ত্রণা চাপিয়ে দেয়াকে নির্যাতন বলা হয়, যা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
আরও ব্যাপক ব্যাখ্যায় নির্যাতন হলো অতিরিক্ত মাত্রায় ইচ্ছাকৃতভাবে নিষ্ঠুর, অমানবিক, অবমাননাকর আচরণ এবং শাস্তি। মানব গোষ্ঠীকে নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক  অথবা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তিরোধ কল্পে জাতিসংঘ ঘোষণা রয়েছে।  এছাড়াও  নিয়মতান্ত্রিক বা অনিয়মতান্ত্রিকভাবে; কোন ব্যক্তির ইচ্ছায় বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে; কোন তথ্য উদঘাটনের জন্য অথবা অন্য কোন অসৎ উদ্দেশ্যে শারীরিক বা মানসিক কষ্ট দেয়াকে নির্যাতন ও মানবাধিকারের খেলাপ কাজ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্য এক ব্যাখ্যায়, কাউকে মারাত্মক ব্যথা বা যন্ত্রণাদায়ক শারীরিক ও মানসিক কষ্ট দেয়াকে নির্যাতন বলে, যা সংজ্ঞায়িত করেছে ইউরোপিয়ান মানবাধিকার কমিশন। তদুপরি, নির্যাতন-এর ক্ষেত্রে এমন কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করা, যার মাধ্যমে নির্যাতিতের ব্যক্তিত্ব ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দেয়া হলে এবং তার শারীরিক অথবা মানসিক শক্তিকে লুপ্ত করা হলে মানবাধিকারের চরম অবমাননা হয়। মানবাধিকার আর নির্যাতন এক সঙ্গে চলতে পারে না। কারণ, নির্যাতনের ফলে দৈহিক অঙ্গহানি ঘটে; মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়; অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতি হয়; নির্যাতিত ব্যক্তি নিজের/ পরিবারের/ সমাজের কাছে বোঝা হয়।
সাধারণত নির্যাতন কিভাবে সংঘটিত হতে পারে, তারও বহুবিধ চিহ্নিত ক্ষেত্র  রয়েছে। যেমন: নির্যাতন শারীরিক অথবা মানসিক দিক থেকে হতে পারে; পুলিশ বা সরকারি বাহিনীর হেফাজতে হতে পারে; অথবা বিশেষ কারও নিয়ন্ত্রণেও হতে পারে ।
ফলে নির্যাতন আধুনিক আইন ও মানবতায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ধারা-৫ অনুযায়ী কাউকে নির্যাতন অথবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক অথবা অবমাননাকর আচরণ অথবা শাস্তি ভোগে বাধ্য করা চলবে না। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি ১৯৬৬-এর ধারা ৭ অনুযায়ী কাউকে নির্যাতন অথবা কারো প্রতি নিষ্ঠুর ও অমানুষিক কিংবা মর্যাদাহানিকর আচরণ করা যাবে না, অথবা অনুরূপ শাস্তি প্রদান করা চলবে না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান-এর অনুচ্ছেদ ৩৫(৫) অনুযায়ী কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দ- দেয়া যাবে না কিংবা কারও সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, ২৬ জুন নির্যাতিতের সমর্থনে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক দিবস। কেন এই দিবস, সেটা অনেকেই জানেন না। মূলত ১৯৮৭ সালের ২৬ জুন থেকে নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তি বিরোধী আন্তর্জাতিক চুক্তি-ক্যাট, ১৯৮৪ কার্যকর হয় বলে ২৬ জুন নির্যাতিতদের সমর্থনে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক দিবস । ১৯৮৭ সালের ২৬ জুন ২০তম সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে ডেনমার্ক এই চুক্তি অনুমোদন করেন। এক্ষেত্রে কোনগুলি শারীরিক নির্যাতন, সেটাও উল্লিখিত হয়েছে। যেমন, যেটা ক্ষত সৃষ্টি করে, যেটা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ ঘটায়, শরীরের কোন অংশ ভেঙ্গে দেয়া, করোটিতে আঘাত করা, পায়ের তালুতে বেত্রাঘাত করা, বিভিন্ন পদ্ধতিতে শরীর পুড়িয়ে দেয়া, যেমন সিগারেটের আগুনে, ইলেকট্রিক শক দ্বারা, উল্টো করে শরীরটাকে মাটি থেকে অনেক উচুঁতে ঝুলিয়ে রাখা, বিভিন্নভাবে শ্বাসরুদ্ধ করা, নখ ও দাঁত উপড়ে ফেলা, যৌন আক্রমণ, যেমন, ধর্ষণ অথবা যৌনাঙ্গে কোন বস্তু ঢুকিয়ে দেয়া, সাবমেরিন পদ্ধতি ব্যবহার করা অর্থাৎ বন্দীদের মুখোশ পরিয়ে ময়লা পানিতে মুখ চুবানো, শরীরের বিভিন্ন অংশে লাঠি দিয়ে আঘাত করা, লাথি মারা, দম বন্ধ করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালানো, হাত, পা বেঁধে পুকুরে সাঁতার দিতে বলা, শরীরের বিভিন্ন অংশে সুঁচ ঢুকিয়ে দেয়া, বুকের পাঁজর ভেঙ্গে দেয়া ইত্যাদি।
বস্তুতপক্ষে, নির্যাতন হচ্ছে একটি ইচ্ছাকৃতভাবে অর্পিত অমানবিক আচরণ, যার মাধ্যমে খুবই মারাত্মক ও নিষ্ঠুর যন্ত্রণাকে বুঝায়। মানবাধিকার প্রসঙ্গে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিক নির্যাতনের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণভাবে চলে আসে। মানসিক নির্যাতন হচ্ছে যেখানে দেহকে আঘাত করা ছাড়াই একটি যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। এ রকম মানসিক নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে, ফাঁসি দেয়ার ভান করা, জানালা বা উচ্চস্থান থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার হুমকি প্রদর্শন করা, গালিগালাজ করা ও অপমানজনক ভাষা ব্যবহার করা, মাথায় আঘাত করা বা বমি মেখে দেয়া, জেল অভ্যন্তরে আলাদা সেলে রেখে খাদ্য পানীয় এবং পয়ঃ নিষ্কাশন করা থেকে বঞ্চিত রাখা, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, অথবা বন্ধুদের প্রতি অমানবিক অথবা অন্যায় আচরণ অবলোকন করতে বাধ্য করা, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু- বান্ধবের উপর সহিংসতামূলক আচরণ করা হবে বলে হুমকি প্রদর্শন করা, দেহ থেকে অঙ্গ কেটে ফেলার ভান করা, দীর্ঘদিন ধরে নির্জন কারাগারে আটক রাখা, এমন পরিবেশ তৈরি করা যেখানে বন্দি অবস্থায় এমন কিছু শুনবে বা দেখবে যেগুলো আসলে বাস্তব নয় এবং ভীতি-উৎপাদনমূলক, মুখের মধ্যে অস্ত্র ধরা, পার্শ্ববর্তী বন্দিকে এমনভাবে নির্যাতন করা যেন সে শুনতে পেয়ে মানসিক চাপ ও উৎকণ্ঠায় নিপতিত হয়, দীর্ঘদিন নির্জন কারাবাস দেয়া এবং হত্যার জন্য হুমকি প্রদর্শন করতে থাকা, দীর্ঘসময় ধরে অনিশ্চিতভাবে আটকে রাখা, আত্মীয়-স্বজনদের নির্যাতন অথবা হুমকি দেয়া, নির্জন জায়গায় ফাঁসির দৃশ্য দেখিয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা, আত্মীয়-স্বজন থেকে অদৃশ্য করে ফেলা ইত্যাদি।
এমতাবস্থায় কিভাবে নির্যাতনের প্রতিকার সম্ভব, সেটাও ভেবেছেন মানবতাবাদীরা। এইক্ষেত্রে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে প্রাথমিক প্রতিকার করা হয়। তাছাড়া শারীরিক চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে, মানসিক চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে, আইনগত কাউন্সেলিং প্রদান করে, আইনগত সহায়তা  ও আদালতে ক্ষতিপূরণ মামলা দায়েরের মাধ্যমে, সামাজিক সম্মান প্রদান করে, পেশা পরিবর্তনের দ্বারা সম্মানিত করে, প্রশিক্ষণ ও অর্থনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে, ক্ষতিপূরণ প্রদানের মাধ্যমে, সম্মান ফিরিয়ে দেয়ার দ্বারা, নির্যাতনকারীর শাস্তি বিধান ও প্রকাশ্যে জন সম্মুখে মাফ চাওয়ার মাধ্যমে, পুনরায় এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে, তার নিশ্চয়তা প্রদানের মাধ্যমে প্রতিকারের চেষ্টা করা হয়, যদিও শারীরিক ও মানসিক প্রতিকার পুরোপুরি পাওয়া একটি অসম্ভব ব্যাপার।
সাম্প্রতিক ইতিহাসে গুয়ানতানামো নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারাগারে নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সারা দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। এটি বন্দিদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত। এই কারাগারে বন্দিদের বিনাবিচারেও আটক রাখা হত এবং তথ্য আদায়ের নামে বিভিন্ন আইন বহির্ভূত নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনের তীব্রতার কারণে এটাকে ‘দুনিয়ার নরক’ নাম দেয়া হয়। বর্তমানে বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত মানুষের প্রতিও ক্ষমতাসীনরা নির্যাতনের নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। মানবাধিকার সেখানে ভুলুণ্ঠিত। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দেশে-বিদেশে যেসব প্রতিবেদন ও রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, সেগুলোও আশাব্যঞ্জক নয়। মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য মানবাধিকারের স্বীকৃতি ও নির্যাতনের অবসান জরুরি। এ ব্যাপারে সকলকে মনোযোগী হতে হবে।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মাওলানা বাবুনগরীর মারাত্মক অসুস্থতার প্রশ্ন


হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর জীবন নিয়ে গভীর সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, নানা ধরনের জটিল ও মারাত্মক রোগে আক্রান্ত অবস্থায় গত বুধবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরও আগে সরকার তড়িঘড়ি করে তার জামিন মঞ্জুর করিয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, গত ৫ মে ঢাকা অবরোধ এবং ৬ মে গভীর রাতে কথিত গণহত্যার পরপর মাওলানা বাবুনগরীকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তার নামে মামলাও দেয়া হয়েছিল ২৬টি। এসবের মধ্যে ছিল পুলিশ হত্যা, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের মতো ভয়ংকর কিছু অভিযোগ, যেগুলো মাওলানা বাবুনগরীর মতো একজন প্রবীণ আলেমের পক্ষে কল্পনাও করা যায় না। অবিশ^াস্য এ মামলাগুলোতে দুই দফায় ১৩ দিন এবং তারও পর দুটি বিশেষ মামলায় তাকে ১৮ দিনের রিমান্ডে নিয়েছিল পুলিশ। অভিযোগ উঠেছে, রিমান্ডে নেয়ার পর বৈদ্যুতিক শক দেয়াসহ অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছে তার ওপর। তার বরাতে বিচিত্র ধরনের অনেক স্বীকারোক্তির কথাও প্রচার করেছে আওয়ামী মিডিয়া। অন্যদিকে নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মাওলানা বাবুনগরী। শোনা যায়, প্রচ- নির্যাতনে জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। হাসপাতালে নেয়ার পর তার সারা শরীরে অসংখ্য কালো দাগ দেখেছেন চিকিৎসকরা। পা’সহ শরীরের একাধিক স্থানে পচনও ধরেছে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে তার দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে পড়েছে, যার কারণে ডায়ালিসিস করতে হয়েছে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে বলে সুফল পাওয়া যায়নি। এ অবস্থাতেই চিকিৎসকরা তার অস্ত্রোপচার করেছেন। কিন্তু সফল হননি। ফলে চিকিৎসকরা আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, মাওলানা বাবুনগরীর একটি পা কেটে ফেলতে হতে পারে। অর্থাৎ এই যাত্রা কোনোভাবে বেঁচে গেলেও তাকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হতে পারে। চিকিৎসকরা অবশ্য বৃহস্পতিবার পর্যন্তও তার সম্ভাবনা সম্পর্কে কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেননি। সুতরাং ধরে নেয়া যায়, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা বাবুনগরীর জীবন এখনো শংকামুক্ত নয়। একই কারণে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে হেফাজতের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে সরকার মাওলানা বাবুনগরীর জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। আমরাও দেশের উচ্চ পর্যায়ের একজন সম্মানিত আলেমের ওপর সরকারের চালানো নিষ্ঠুর নির্যাতনের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। একথা বলাও আমরা দায়িত্ব মনে করি যে, সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হলেও বাস্তবে হেফাজতে ইসলাম কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডে জড়িত ছিল না। প্রথম থেকে মাওলানা বাবুনগরীসহ হেফাজতের নেতারা প্রতিটি ভাষণে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির কথাই বলে এসেছেন। ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডে জড়িত হওয়ার বিরুদ্ধেও কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন তারা। কর্মীদের সতর্ক করে দিয়েছেন। বড় কথা, ঢাকা অবরোধের কোনো পর্যায়েও হেফাজতের কাউকে কোথাও ধ্বংসাত্মক বা বেআইনি কোনো কর্মকা- চালাতে দেখা যায়নি। হেফাজতের কর্মীদের পাশাপাশি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ওপর হামলা চালানোর আগে পর্যন্ত একদিকে হেফাজতের নেতারা ভাষণ দিয়েছেন অন্যদিকে সমবেত মুসলমানরা ভাষণ শুনেছেন, আল্লাহর কালাম উচ্চারণ করেছেন এবং দরুদ পড়েছেন। সমাবেশের দৃশ্য বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে। কোনো পর্যায়েই সমাবেশের কাউকে কোনো রকম উস্কানিমূলক বা আক্রমণাত্মক ভূমিকায় দেখা যায়নি। সুতরাং এমন অভিযোগ মোটেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না যে, হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ে লিপ্ত হয়েছিলেন বলেই সরকারকে কথিত একশনে যেতে হয়েছে। বাস্তবে বরং প্রথম থেকে উস্কানি এসেছিল ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। এই উস্কানি দিয়েছিল পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি। তাদের আগে-পরে আওয়ামী ক্যাডাররা তো ছিলই। হামলাও তারাই চালিয়েছে, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ থেকে ধ্বংসাত্মক প্রতিটি কর্মকা-েও তাদেরকেই বেশি তৎপর দেখা গেছে। পিস্তল হাতে রহস্যময় ও অচেনা অন্য অনেককেও দেখা গিয়েছিল। রাজধানীর সাধারণ মানুষও এসবের সাক্ষী হয়ে রয়েছেন। অন্যদিকে নিজেদের অপকর্মের সব দোষ সরকার চাপিয়েছে নিরীহ হেফাজতীদের ওপর। সম্পূর্ণ বানোয়াট সে অভিযোগেই সরকার একদিকে রাতের বেলায় গণহত্যা চালিয়েছে অন্যদিকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করেছে মাওলানা বাবুনগরীকে। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে সরকার যে কাউকে গ্রেফতার করতেই পারে। কিন্তু হেফাজত নেতার ক্ষেত্রে রিমান্ডে নেয়ার এবং নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানোর মাধ্যমে সরকার আইনের অনেক বাইরে চলে গেছে। কারণ, রিমান্ড প্রসঙ্গে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে, তিনদিনের বেশি কাউকে রিমান্ডে নেয়া যাবে না এবং জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে অভিযুক্তের আইনজীবীর সামনে। তাছাড়া রিমান্ডে নেয়ার আগে ও পরে চিকিৎসক দিয়ে শরীর পরীক্ষা করাতে হবে এবং প্রয়োজনে ওষুধপত্র ও চিকিৎসা দিতে হবে। অন্যদিকে মাওলানা বাবুনগরীর ক্ষেত্রে সরকার উচ্চ আদালতের নির্দেশনার প্রতি উপেক্ষা দেখিয়েছে। একজন প্রবীণ মানুষকেও প্রথমে ১৩ দিনের এবং পরে ১৮ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। নি¤œ আদালত যে সরকারের ইচ্ছাই পূরণ করেছে তার প্রমাণ তো তড়িঘড়ি করে জামিন মঞ্জুর করার ঘটনাতেই প্রমাণিত হয়েছে। এসব ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি আমরা মনে করি, এভাবে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নিয়ে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দমন-নির্যাতন চালানো বন্ধ করা দরকার। সরকারের উচিত সময় একেবারে পেরিয়ে যাওয়ার আগেই গণতন্ত্রসম্মত অবস্থানে ফিরে আসা এবং বিশেষ করে ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের ব্যাপারে সংযত হওয়া।

বুধবার, ২৯ মে, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

কুতর্ক ও নিষ্ঠুর আচরণের দিনলিপি


দেশের রাজনীতি যদি দেশের পক্ষে না থাকে, তবে সেই রাজনীতির কোনো প্রয়োজন আছে কি জনগণের? তারপরও মঞ্চ কাঁপিয়ে আমাদের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও রাজনীতিবিদরা উচ্চকণ্ঠে বলে যাচ্ছেন তাদের রাজনীতি নাকি দেশ ও জনগণের জন্য! এমন অদ্ভুত নাটক বোধহয় পৃথিবীর আর কোনো রাজনৈতিক মঞ্চে মঞ্চস্থ হয় না। ‘দেশের জনগণ’ তো অনেক বড় কথা! যারা সমগোত্রের লোকদের সাথেই ন্যূনতম মানবিক আচরণে অক্ষম, তারা জনগণের স্বার্থ রক্ষায় সক্ষম হবে কেমন করে?
আমরা জানি রাজনীতিতে পালাবদল আছে। একবার সরকার গঠন করলেই কোনো দল চিরদিন সরকারে থাকতে পারে না। নির্বাচনে পরাজিত হলে দোর্দ- প্রতাপশালী সরকারকেও গদি ছেড়ে বিরোধী দলের আসনে বসতে হয়। এমন চিত্র সামনে থাকলে তো কোনো সরকার বিরোধী দলের সাথে যাচ্ছেতাই আচরণ করতে পারে না। কিন্তু বর্তমান সরকার যেন ইতিহাসের পাঠ ভুলে গেছে। বিরোধী দলের সাথে তারা এমন নির্মম-নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ করে যাচ্ছে, যাতে মনে হয় তারা যেন আর কোনকালে বিরোধী দল হবেন না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কেউ ক্ষমতায় চিরকাল থাকতে পারে না এবং ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়াও তাকে ভোগ করতে হয়।
আমাদের রাজনীতি এখন কোন পর্যায়ে অবস্থান করছে তার একটি চিত্র পাওয়া যায় দৈনিক ইত্তেফাকের ২৮ মে তারিখের একটি প্রতিবেদনে। ‘জামিন নেই বিরোধী নেতাদের, পেলেও মুক্তি মিলছে না’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বর্তমানে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা রাজনীতি সংশ্লিষ্ট মামলায় নি¤œ আদালত থেকে জামিন পাচ্ছেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। এমনকি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও নি¤œ আদালতে জামিনের ধারাবাহিকতা থাকছে না। অসুস্থ, বয়ষ্ক বা সংসদ সদস্যের জামিন পাওয়ার বিশেষ অধিকার থাকলেও নি¤œ আদালতে সে অধিকারও লঙ্ঘিত হচ্ছে। এদিকে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও বিরোধী দলের নেতাদের মুক্তি মিলছে না। মুক্তি পাওয়া মাত্রই জেল গেটে তাদের অন্য মামলায় শ্যোন-এ্যারেস্ট দেখানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই দেখা যাচ্ছে সাদা পোশাকের পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে, কি মামলায় কোথায় নেয়া হচ্ছে তাও জানা যায় পরে। মামলার এজাহারে নাম না থাকলেও শুধুমাত্র পুলিশের একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নি¤œ আদালত ঢালাওভাবে আসামীকে কারাগারে আটক রাখার নির্দেশ দিচ্ছেন। গত এক মাসে কেন্দ্রীয় নেতাসহ দুই শতাধিক নেতা-কর্মীকে কারা ফটকে আটক করে অন্য মামলায় পুনরায় জেলে পুরেছে পুলিশ। ফলে উচ্চ আদালতের নেয়া জামিনও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য যে, দেশের বিভিন্ন থানায় প্রায় দশ হাজার মামলায় বিরোধী দলের কয়েক লাখ নেতা-কর্মী হয় কারাগারে, না হয় ফেরার জীবন কাটাচ্ছেন। ইত্তেফাকের এই প্রতিবেদনে যে চিত্রটি উঠে আসলো, তা যে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য কোনো সুখকর বিষয় নয় তা আমরা জানি, কিন্তু যারা এখন ক্ষমতায় আছেন বিষয়টি কি তাদের জন্যও সুখকর? পরিণামের কথা চিন্তা করলে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে এখন দমন-পীড়ন, জুলুম-নির্যাতনের যেসব কলাকৌশল চলছে তার অনুমোদন সরকার দিতে পারতো না। কারণ ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া বলে একটা কথা আছে। বর্তমান গণতান্ত্রিক (!) সরকারের আমলে বিরোধী দলের প্রতি যেসব মন্দ আচরণের উদাহরণ সৃষ্টি করা হচ্ছে, ক্ষমতায় গেলে তারাও যদি ঐসব মন্দ আচরণ পরবর্তী বিরোধী দলের প্রতি ফিরিয়ে দেয়, তাহলে তাদের বলার কিছু থাকবে কি? বিশেষ করে এখন সরকারি দলের মধ্যে যারা অসুস্থ ও বয়ষ্ক আছেন তারা তখন কি করবেন? দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এখন আমাদের যেসব কথা লিখতে হচ্ছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজের জন্য শোভা পায় না। কিন্তু দেশ ও জনগণের স্বার্থে এবং গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে তিক্ত কথাও তুলে ধরতে হয়। শুধু ব্যক্তি মানুষের জন্য নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও রুচিবোধ, মূল্যবোধ ও উচ্চতর মানবিক চেতনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসবের অভাব ঘটলে রাজনীতির সাথে সাথে রাজনীতিবিদরাও মর্যাদা ও গুরুত্ব উভয়টাই হারান। এখন অপরাধী ও সন্ত্রাসীরাও তাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস পায়। এমন পরিস্থিতিতে অপরাধ জগতকে নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনের’ একটি প্রতিবেদনে তেমন একটা চিত্রই যেন ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, সারাদেশে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতা, শিক্ষাঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে খুন, ডাকাতি, ছিনতাই কাজেও অবৈধ অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীর কাছে যে ধরনের অত্যাধুনিক অস্ত্র শোভা পাচ্ছে, এলাকার উঠতি কিশোর অপরাধীর কাছেও মিলছে সেই অস্ত্র। বৈধ অস্ত্রও এখন অবৈধ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে পুলিশের কাছ থেকে খোয়া যাওয়া অস্ত্রগুলো এখন চলে গেছে অপরাধীদের হাতে। আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় অবৈধ অস্ত্রের চাহিদাও বেড়ে গেছে। রাজনৈতিক ক্যাডার ও শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসীরা নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান ধরে রাখতে অস্ত্রের মজুত ধরে রাখছে। অস্ত্র ব্যবসায়ীরাও ভীষণ তৎপর। নজরদারি না থাকায় অন্তত ১৫০টি সিন্ডিকেট দেশের ৬০টি পয়েন্ট দিয়ে অস্ত্রের অবৈধ চালান আনছে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তা ছড়িয়ে দিচ্ছে সারাদেশে। এমনকি দেশের বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র তৈরির কারখানাও গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের ২৪ মে সংখ্যায় অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি ও এর ব্যবহারের যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তাতো কোনো গণতান্ত্রিক সমাজের চিত্র হতে পারে না। গণতান্ত্রিক সমাজে তো অস্ত্রের প্রতিযোগিতা হয় না, সেখানে প্রতিযোগিতা হয় জ্ঞান, মেধা, সৃজনশীলতা, সহিষ্ণুতা ও কর্মের। গণতান্ত্রিক সমাজে গণআকাক্সক্ষার অনুকূলে সৃজনশীল কর্মতৎপরতার প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হতে হয়। এমন তৎপরতায় তো অবৈধ অস্ত্র ও সন্ত্রাসীদের কোনো প্রয়োজন হয় না। তাই কোনো সমাজে যদি এসব আবর্জনার কদর বাড়তে থাকে তাহলে সেই সমাজকে কি গণতান্ত্রিক সমাজ বলে অভিহিত করা যায়? জানি না, আমাদের সরকার এবং রাজনীতিবিদরা এ প্রশ্নের কী জবাব দেবেন? আসলে আমাদের সমাজের গণতন্ত্রের বহুল উচ্চারণ আছে, কিন্তু গণতান্ত্রিক আচরণ নেই। বাকসর্বস্ব এমন রাজনীতি যেমন দেশের জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে পারে না, তেমনি রক্ষা করতে পারে না জাতীয় মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব। রাজনীতিবিদরা যদি অষ্টপ্রহর ক্ষমতার লোভ ও কুতর্কে ব্যস্ত থাকে, তাহলে তারা দেশের স্বার্থরক্ষা করবেন কেমন করে? কোনো দেশের রাজনীতি এমন মন্দ অবস্থায় থাকলে বাইরের শক্তি সে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কোনো গরজ অনুভব করে না। এমন একটি চিত্রই যেন প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সংগ্রামের ২৪ মে সংখ্যায়। ‘টার্মিনাল পোর্ট নারায়ণগঞ্জে, নির্মাণের টেন্ডার দিয়েছে ভারত সরকার দিল্লীতে শিরোনামের রিপোর্টে বলা হয়, সরকারের অগোচরে নারায়ণগঞ্জে অভ্যন্তরীণ নৌ-কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত সরকার। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নারায়ণগঞ্জ শহরে খানপুরের কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের ৪৬ একর জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে এই টার্মিনাল। এরই মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণে কারিগরি ও বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য দরপত্রও আহ্বান করেছে। দরপত্র জমা দেয়ার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ৭ জুন বিকেল ৫টা পর্যন্ত। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, সমুদ্র, পরিবহন অধিদফতর (ডিজিশিপিং) ও বিনিয়োগ বোর্ড কারো অনুমোদন নেই। এমন কি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখাসহ বন্দর শাখাও এ বিষয়ে কোনো কিছুই জানে না। এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ বোর্ডেও এ বিষয়ে কোনো আবেদন জমা পড়েনি। এ ধরনের ঘটনাকে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। আসলে হুমকির মধ্যেই যেন এখন আমাদের বসবাস। গণতান্ত্রিক চেতনা ও আচরণের অভাবে বিরোধী দলের রাজনীতি এখন দমন-অবদমন ও নিপীড়নের যাঁতাকলে পিষ্ট। বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়ামূলক সহিংস আচরণের ফলে রাজপথে লক্ষ্য করা যায় ভাংচুর ও ককটেলের ধোঁয়া। আর আশাভঙ্গের কারণে জনগণ এখন ¤্রয়িমাণ। রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশৃঙ্খলা ও উদ্দামহীন জনগণের দেশে আগ্রাসন চালাতে বাইরের শক্তির তো ভয় পাওয়ার কথা নয়। এমন চিত্রই তো এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমরা এখনও বিশ্বাস করতে চাই, আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে আত্মমর্যাদা ও দেশপ্রেম আছে। তবে এখন সময় এসেছে কথার বদলে জনগণের স্বার্থ ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার বাস্তব উদাহরণ পেশ করার। এ ক্ষেত্রে সরকারের সাথে সাথে বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও আমরা যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত আচরণ আশা করছি। তবে শপথের মাধ্যমে সরকার যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে, তাতে উদাহরণ সৃষ্টির দায়িত্বটা প্রথমে সরকারের ওপরেই বর্তায়। সরকার সে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসে কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়।

Ads