সোনালী ব্যাংকের সদ্যবিদায়ী পরিচালক কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের পরিবেশ ও বনবিষয়ক সম্পাদক সিরাজগঞ্জের সবুজ কানন হাইস্কুলের শিক্ষিকা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী এখন অঢেল সম্পদের মালিক। তার বিপুল অর্থসম্পদের তথ্যপ্রমাণ হাতে পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
জানা যায়, বহুল আলোচিত-সমালোচিত জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী আগের মতোই সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। তবে টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার জিপ ছেড়ে রিকশায় চলাচল করছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন তার অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি তদন্তে নামলে টয়োটা ল্যান্ডক্রুজারটি লুকিয়ে রেখেছেন। এখন আর তাকে এই জিপে চলাচল করতে দেখা যায় না। এ দিকে হেনরী বলছেন, তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রতিপক্ষরা এ অপপ্রচার চালাচ্ছেন। তিনি নিজ দল ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন বলে জানান।
সিরাজগঞ্জের প্রবীণ রাজনীতিবিদ মরহুম মোতাহার মাস্টারের পুত্রবধূ হওয়ার সুবাদে জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ সদর-কামারখন্দ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পান। কিন্তু দলীয় কোন্দলে চারদলীয় জোট প্রার্থী সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর সহধর্মিণী রুমানা মাহমুদের কাছে পরাজিত হন। ক্ষমতায় আসে মহাজোট সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুপারিশে তিনি সোনালী ব্যাংকের অন্যতম পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর তার ভাগ্য পরিবর্তন হতে থাকে। মাত্র সাড়ে তিন বছরেই হয়ে ওঠেন শত কোটি টাকার মালিক। সেই থেকে তার উত্থান শুরু।
ক্ষমতার দাপট আর প্রভাবে মাত্র সাড়ে তিন বছরে সিরাজগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেত্রী জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী আওয়ামী লীগ রাজনীতির পাশাপাশি শহরের সবুজ কানন হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে চাকরি করতেন। সিরাজগঞ্জের প্রবীণ রাজনীতিবিদ মোতাহার মাস্টারের পুত্রবধূ হওয়ায় ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পান। সেই সময় নির্বাচনের হলফনামায় তিনি তার মাসিক বেতন ১০ হাজার টাকা ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি মিলে ১৩ লাখ টাকার সম্পদের হিসাব দেখান। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সদানন্দপুর এলাকায় নিজ নামে সাড়ে ১৭ শতাংশ কৃষিজমি (৩৪ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের), পৌরসভার ভাঙ্গাবাড়ী এলাকায় দশমিক ৩৬ শতাংশ সেমিপাকা বাড়ি (দুই লাখ টাকা মূল্যের), ২০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, নগদ দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা, বার্ষিক আয় এক লাখ ২২ হাজার টাকা এবং স্বামীর নামে কৃষিজমি তিন বিঘা (দুই লাখ টাকা মূল্যের), অকৃষি জমি ছয় শতাংশ (দুই লাখ টাকা মূল্যের) ও নগদ দুই লাখ টাকার হিসাব উল্লেখ করেন।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সোনালী ব্যাংকের পরিচালক নির্বাচিত হওয়ায় ঋণ দেয়া, চাকরিবাণিজ্য, কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও বদলি, ঋণ মওকুফ করাসহ বিভিন্ন তদবিরবাণিজ্য করে সাড়ে তিন বছরে হেনরী শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। বাসায় বসে তিনি তালিকা করে বিভিন্ন তদবির ও বদলিবাণিজ্য করতেন। সব কিছুই হতো অর্থের বিনিময়ে। এ ছাড়া ক্ষমতার দাপটে স্কুলে শিক্ষকতা না করেই তিনি নিয়মিত বেতনভাতা তুলছেন। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি এবং হেনরীর বিপুল অর্থসম্পদের কথা এখন সিরাজগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মুখে মুখে।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার গজারিয়াতে সাত বিঘা জমির ওপর শ্বশুর-শাশুড়ির নামে সখিনা-মোতাহার ফ্লাওয়ার মিলের কাজ শুরু করেছেন। সদানন্দপুর এলাকায় তার পৈতৃক বাড়িতে শিক্ষক বাবা আবদুল হামিদের মালিকানায় হেনরীর সহযোগিতায় একটি পাঁচতলা বাণিজ্যিক ভবন ও শহরের চৌরাস্তায় একটি বহুতল মার্কেটের নির্মাণকাজ চলছে। এ ছাড়া ঢাকার রূপনগর আবাসিক এলাকায় রজনীগন্ধা নামের বাড়িতে তার একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, ঢাকার উত্তরায় পাঁচ কাঠার প্লট, ৮৭ লাখ টাকার একটি টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার (ঢাকা মেট্রো-ঘ ১১-১৭৫৫) জিপ, একটি প্রাইভেট কার (ঢাকা মেট্রো-ঘ ২৭-৩৬০০), ঢাকা-সিরাজগঞ্জ রুটে দু’টি অত্যাধুনিক বাস রয়েছে। ডেসটিনিতে এক কোটি টাকার শেয়ার ছাড়াও বিভিন্ন কোম্পানির তিন কোটি টাকার শেয়ারসহ আরো সম্পদ রয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলার পাবনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের প্রথম দিকে জান্নাত আরা তালুকদার হেনরীর অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। সে পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলার পাবনা কার্যালয় থেকে জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী, তার স্বামী শামীম তালুকদার লাবু ও পালিত মেয়ে মুনতাহা হৃদয়ীর ব্যাংক হিসাব ও বর্তমান স্থিতিসংক্রান্ত তথ্য চেয়ে সিরাজগঞ্জের সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক প্রধান শাখার ব্যবস্থাপকদের কাছে পত্র দেন। ব্যাংকগুলো থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী ওই তিনজনের হিসাবে বড় অঙ্কের টাকার লেনদেনের বিষয়ে দুদক নিশ্চিত হয়। পরে দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলার পাবনা কার্যালয় থেকে নথিপত্র গত ৩০ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়।
সিরাজগঞ্জ সবুজ কানন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা শাহনাজ মাহফুজা পারভীন জানান, সংসদ নির্বাচনের পর জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী দুই বছরের ছুটি নেন। সেই থেকে তার পরিবর্তে তার চাচাতো বোন অলিদা পারভীন জলিকে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু হেনরীর নামে প্রতি মাসে বেতন দেয়া হয়েছে। স্কুলে না এসে কিভাবে বেতন পেলেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান শিক্ষিকা আর কোনো তথ্য দিতে পারবেন না বলে জানান। তবে তিনি বলেন, হেনরীকে মৌখিকভাবে বেতনের টাকা ফেরত দিতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জান্নাত আরা তালুকদার হেনরীর সাথে ফোনে (০১৭১২-১৪১২২৫) যোগাযোগ করা হলে তিনি তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন। তিনি সিরাজগঞ্জ চৌরাস্তায় একটি বহুতল মার্কেটের নির্মাণ, রজনীগন্ধা নামের বাড়িতে একটি ফ্ল্যাট, ঢাকার উত্তরায় পাঁচ কাঠার প্লট, একটি টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার জিপ থাকার কথা অস্বীকার করে বলেন, সদানন্দপুর এলাকায় তার বাবা আবদুল হামিদ মাস্টারের মালিকানায় একটি পাঁচতলা বাণিজ্যিক ভবনের নির্মাণকাজ চলছে, তবে এর সাথে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা অপপ্রচার চালিয়ে তার ও তার শ্বশুর প্রবীণ রাজনীতিবিদ মরহুম মোতাহার হোসেন তালুকদারের পরিবারের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষণœ করছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলার পাবনা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো: আবদুল করিমের সাথে ফোনে (০১৭১২-৯৭৭৭২৭) যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, হেনরীর ব্যাপারে এখন দুর্নীতি দমন কমিশন ঢাকা প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো: জাহাঙ্গীর আলম তদন্ত করছেন। এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না বলে তিনি জানান।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন