বুধবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১২

২৮ অক্টোবর, ইতিহাসের এক জঘন্য দিন


ইতিহাসের এক জঘন্য দিন
২৮ অক্টোবর (২০০৬) বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। চারদলীয় জোটের ক্ষমতা হস্তান্তরের শেষ দিনের ঘটনা। ওই দিন আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করতে সকাল থেকে লগি-বৈঠা, বাঁশের লাঠি, অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোটের ওপর। সারা দেশে সাধারণ নিরীহ মানুষসহ ২০টি তাজা প্রাণের সংহার করেছিল রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা। শত শত মানুষ আহত হয়েছিল। বিশেষ করে ঢাকার পল্টন, দৈনিক বাংলা মোড়, মুক্তাঙ্গন, জাতীয় প্রেস ক্লাব ছিল যেন জীবন্ত কারবালা। বিরোধী মতের অপরাধে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে হত্যাকারীদের উন্মত্ত উল্লাস প্রকাশ আদিম বর্বর, অসভ্য যুগের ইতিহাসকেও হার মানিয়েছে।
সে দিন ১৮ বছরের কয়েকজন তরুণ যুবককে আঘাতের পর আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে তার লাশের ওপর দাঁড়িয়ে তাণ্ডব নৃত্যের সেই দৃশ্য ইলেকট্রিক মিডিয়ার বদৌলতে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করে। আওয়ামী প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা অপরাধের শাস্তি পেয়েছিল জীবনের বিনিময়ে। ২৮ অক্টোবরের ওই নৃশংস ঘটনার শিকার প্রায় সবাই ছিল ছাত্র। রাজনীতির অলিগলি বুঝে ওঠার আগেই তাদের পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হলো।
আগেই বলেছি, সে দিনই ছিল চারদলীয় জোটের ৫ বছর মেয়াদের শেষ কর্মদিবস। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নয়াপল্টনে বিএনপি ও ক্রীড়া পরিষদের সামনের রাস্তায় জামায়াতের সমাবেশ পূর্বনির্ধারিত ছিল। কিন্তু প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলে ঘৃণ্য মানসিকতা থেকে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীর সোনার ছেলেরা সকাল থেকে লগি-বৈঠা নিয়ে প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার নির্দেশই সে দিন ইতিহাসের এ কলঙ্কজনক দিনের সূচনা করেছিল। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র, লগি-বৈঠা নিয়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যেই ভিডিও ফুটেজের  মাধ্যমে সেই দৃশ্য সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। একটি দেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মী কর্তৃক অন্য রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের ওপর পাশবিক ও পৈশাচিক অত্যাচারের দৃশ্য দেখে বিদেশীরাও হতবাক হয়ে পড়েছিল।
আধুনিক সভ্যতার এই যুগে মানুষকে মানুষ এভাবে যে পিটিয়ে হত্যা করতে পারে ২৮ অক্টোবরের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার আগে তা কল্পনার বাইরে ছিল। ’৭১-এর পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতাকে ম্লান করে দিয়েছে ২৮ অক্টোবরের ওই দিনের পৈশাচিকতা। ওই দিন শুধু কি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাদের টার্গেট ছিল? যারা ওই দিনের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা দেখেছেন কিভাবে সাধারণ মানুষসহ স্কুল ফেরত শিশুরাও রেহাই পাইনি সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে। মহিলারাও নিগৃহীত হয়েছিলেন, অপদস্থ ও অপমানিত তাদের সেই দিশেহারা চেহারা আর অসহায়ত্ব দেখে সন্ত্রাসীরা পুলকিত হয়েছিল।
ইতিহাসের সেই কলঙ্কজনক ঘটনার ৬ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার তো দূরের কথা একজনকেও গ্রেফতার করা হয়নি। তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হয়নি। সে দিনের সেই কুখ্যাত সন্ত্রাসীরা এখন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে দাপটের সাথে। এমন জঘন্য নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর যদি অপরাধের বিচার পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয় গণতন্ত্র, স্বাধীন বিচার, আইনের শাসনের যে বড় বড় কথা আমরা বলি তা কাদের জন্য প্রযোজ্য ? যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতির সমর্থক আইনের শাসনের কি তারা ঊর্ধ্বে? ২৮ অক্টোবরের ঘটনা-পরবর্তী অপরাধীদের অবাধ বিচরণ তাই তো প্রমাণ করে।
২৮ অক্টোবরের হত্যাকাণ্ড অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে ক্ষমতাসীন দলটি যদি খুনিদের বিচারের ব্যবস্থা করতেন তাহলে ভবিষ্যতে কোনো দলই এ জঘন্য ঘটনা ঘটানোর সাহস পেত না। তবে ভবিষ্যতে যদি আওয়ামী লীগ এমন নৃশংস ঘটনার শিকার হন তখন তাদের অবস্থান কী হবে? তারা কি কখনো তা ভেবে দেখেছেন? যারা অতীত থেকে শিক্ষা নেয় না, ইতহাসে তাদের করুণ পরিণতির এমন অনেক নজির আমরা দেখেছি।
বর্তমান সরকারের কাছ থেকে এ জঘন্য হত্যাযজ্ঞের বিচার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তারা ক্ষমতাসীন হয়ে ৭ হাজারের বেশি মামলা প্রত্যাহার করেছে। সে মামলার মধ্যে খুন, ধর্ষণ, হত্যার মতো জঘন্য অপরাধের মামলা রয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তি বর্তমান রাষ্ট্রপতিও খুনও ধর্ষণের মতো মামলার আসামিকে তার এখতিয়ারে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তবে আশা করি, ভবিষ্যতে যারা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাবেন তারা রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে পশুশ্রেণীর যেসব দানব দেশব্যাপী মানুষ হত্যার এ জঘন্য উন্মাদনায় মেতে উঠেছিল তাদের বিচার করে শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। সে দিনের অপেক্ষায় আমার মতো স্বপ্ন দেখছে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত স্বজনহারা সেই পরিবারগুলো।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads