শা হ আ হ ম দ রে জা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে অনির্ভরযোগ্য নেতার নাম বলতে বলা হলে সচেতন মানুষমাত্রই নিঃসন্দেহে একজনের নামই বলবেন। তিনি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখলকারী এই সাবেক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেই ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে ‘বড় সাধের’ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। দীর্ঘ সে আন্দোলনের কথা স্মরণ করলে পরবর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই মুহূর্তের পরিস্থিতি এবং নিকট ভবিষ্যতের সম্ভাবনা তো অনেক বেশি আশঙ্কাজনক। রাজনীতি যেভাবে এগোচ্ছে তার ফলে আগামী তথা দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মনেও সংশয় শুধু বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি বাড়ছে গুজবের ডালপালা। আরো একটি ১/১১ ঘটতে পারে ধরনের কথাবার্তা তো এখন মানুষের মুখে মুখেই ঘুরছে। একই কারণে জেনারেল (অব.) এরশাদকে নিবন্ধের বিষয়বস্তু বানাতে হয়েছে। এরশাদ শুধু গণতন্ত্র হত্যাকারী হিসেবে নিন্দিত সাবেক স্বৈরশাসক নন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানও। এজন্যই তার এমন সব বক্তব্যকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াটা অনুচিত, যেগুলো খুবই তাত্পর্যপূর্ণ। গত ৯ অক্টোবরের কথাই ধরা যাক। জাতীয় ছাত্রসমাজের এক অনুষ্ঠানে এরশাদ একদিকে আগামী সংসদ নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কিনা সে ব্যাপারে গভীর সংশয় প্রকাশ করেছেন, অন্যদিকে আবার এ ঘোষণাও দিয়েছেন যে, নির্বাচন হলে তার দল জাতীয় পার্টিই ক্ষমতায় আসবে। আসবেও ‘এককভাবেই’।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কথাগুলোকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বিশেষ কিছু কারণে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে না নিয়ে পারেননি। সংবিধান ও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশে যখন সংকট ঘনীভূত হচ্ছে, ঠিক সে সময় অনেকটা হঠাত্ করে তাকে নড়েচড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। নিজেদের মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছেন তিনি। বলে চলেছেন, মহাজোটকে ক্ষমতায় বসিয়ে জনগণ নাকি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে এবং সে কারণে এই সরকারকে নাকি হটানো দরকার। জনগণকে তারপর কী করতে হবে, তারও পরামর্শ দিয়েছেন এরশাদ। নিজের বুকের ওপর আঙুল ঠেকিয়ে বলেছেন, তাকে ছাড়া নাকি জনগণের উপায় নেই! অর্থাত্ এরশাদকেই ক্ষমতায় বসাতে হবে। কীভাবে ক্ষমতায় আসবেন তিনি সে সম্পর্কে জানাতে গিয়ে চলতি বছরের প্রথম দিকেই এরশাদ জানিয়ে রেখেছেন, ‘যথাসময়ে অ্যাটাক’ করবেন তিনি। পাছে ‘অন্য রকম’ অর্থ করা হয় সে চিন্তা থেকে কথাটার ব্যখ্যা দিতে গিয়ে এরশাদ বলেছিলেন, মহাজোট থেকে তিনি বেরিয়ে যাবেন এবং আগামী নির্বাচনে তার দল এককভাবে তিনশ’ আসনে প্রার্থী দেবে। সাম্প্রতিক সময়ে এগিয়েছেনও তিনি সেভাবেই। যেমন মহাজোটে থাকা অবস্থাতেই কিছুদিন আগে হঠাত্ একশ’র বেশি আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছেন এরশাদ। তখন মনে করা হয়েছিল, তিনি হয়তো প্রধানমন্ত্রীর তথা আওয়ামী লীগের সঙ্গে দরকষাকষি করার কৌশল নিয়েছেন। কিন্তু অন্য দু-একটি কারণে তাকে সিরিয়াস মনে না করে পারা যায়নি। এর মধ্যে একটি হলো তার ভারত সফর। পবিত্র রমজানের শেষদিকে কোনো পর্ব ঘোষণা ছাড়াই তিনি দিল্লি গিয়েছিলেন। সেখানে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংসহ ভারতীয় প্রায় সব মন্ত্রী ও প্রধান নেতার সঙ্গেই তার বৈঠক হয়েছে। তাকে অঘোষিতভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সম্মানও দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা গেছে, ভারতের নীতিনির্ধারক তথা ক্ষমতাসীনরা নাকি ‘সব ডিম’ আর শেখ হাসিনার একার ‘বাস্কেটে’ রাখতে চাচ্ছেন না। প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের জনপ্রিয়তা দ্রুত শূন্যের দিকে নেমে যাচ্ছে বলেই ভারতীয়রা কিছু ‘ডিম’ অন্য দু-একজনের ‘বাস্কেটেও’ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই তালিকায় মনোনীত হয়েছেন বলেই জেনারেল (অব.) এরশাদকে এত খাতির-যত্ন করেছেন মনমোহন সিংরা। এরশাদও ধন্য হয়ে গেছেন। রীতিমত ঢাকঢোল পেটাতে পেটাতে দেশে ফিরেছেন তিনি। বলেছেন, ভারত তাকে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে ‘সাহায্য’ করবে এবং তিনি ক্ষমতায় এলে ভারতীয় নেতারা ‘খুশি’ হবেন।
এটা গত আগস্টের কথা। সেই থেকে এককালের স্বৈরশাসককে অনেকাংশে এককভাবে চলতে দেখা যাচ্ছিল। এরই মধ্যে জাতীয় ছাত্রসমাজের সমাবেশে কিছু বক্তব্য রেখে নতুন পর্যায়ে আলোড়ন তুলেছেন এরশাদ। মূলকথায় তিনি আগামী নির্বাচন নিয়ে গভীর সংশয় প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তার পরই বলেছেন, নির্বাচন হলে তিনিই এককভাবে ক্ষমতায় আসবেন। বিচ্ছিন্নভাবে জেনারেল (অব.) এরশাদের কথাগুলোকে শুনলে মনে হতে পারে যেন সরকারের ব্যর্থতায় সত্যিই তিনি ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। বাস্তবে তার এই ভূমিকার প্রকৃত কারণ কিন্তু অন্য রকম। প্রসঙ্গক্রমে পাঠকরা এরশাদের সেই ‘অ্যাটাক’ করার হুমকির কথা স্মরণ করতে পারেন। গত জানুয়ারিতে এমন একসময়ে তিনি হুমকিটি দিয়েছিলেন, যখন সেনাসদর থেকে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের অতি নাটকীয় কিন্তু ভীতিকর একটি খবর জানানো হয়েছিল। এর ফলে সে সময় এরশাদের অবৈধ অভ্যুত্থানের কথাও স্মরণ না করে পারা যায়নি। ১৯৮২ সালে অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রাক্কালে সেনাপ্রধান হিসেবে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’কে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারকে তুলোধুনো করেছিলেন তিনি। সেটা ছিল এক নজিরবিহীন ঘটনা। পরবর্তীকালে আরও অনেক নাটকীয় ও রক্তক্ষয়ী ঘটনারই জন্ম দিয়েছেন এরশাদ। বিশেষ করে গুজব রটিয়ে দেয়ার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারসহ বিভিন্ন প্রতিপক্ষকে নির্মূল করে দেয়ার ব্যাপারে তো রেকর্ডই করেছেন তিনি।
‘অ্যাটাক’বিষয়ক পর্যালোচনাতেও দেখা গিয়েছিল, বেছে বেছে এমন একসময়ে তিনি মাঠে নেমেছিলেন যখন বিএনপি ও জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলোর রোডমার্চ ও মহাসমাবেশগুলোতে লাখ লাখ মানুষ অংশ নিচ্ছিল; যখন নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও নরসিংদীর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের লজ্জাকর পরাজয় ঘটেছিল এবং যখন জনমত জরিপে সরকারের জনসমর্থন এমনকি ৩০-৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে বলে জানা যাচ্ছিল। এমন অবস্থার পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। একথা অন্তত পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী মহাজোটের পক্ষে ক্ষমতায় ফিরে আসা সম্ভব হবে না। আর ঠিক সেজন্যই কৌশল হিসেবে আগেভাগে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এরশাদ। তাই বলে উদ্দেশ্যও আবার মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাওয়া ছিল না। তিনি আসলে মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কৌশল নিয়েছিলেন। এমন অবস্থার ফায়দা কারা নিয়েছে সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই বলার দরকার পড়ে না।
ঘটনাপ্রবাহে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে এসেছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যকার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক বন্ধুত্বের এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার। ১৯৮২ সালের মার্চে সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল এরশাদ যখন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তখন আওয়ামী লীগ তাকে সমর্থন জুগিয়েছিল। ক্ষমতা থেকে বিএনপির বিদায়ে উল্লসিত হয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি ‘আনহ্যাপি’ নন। দলটির মুখপত্র দৈনিক ‘বাংলার বাণী’ প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল (২৫ মার্চ, ১৯৮২)। অবৈধ সামরিক শাসনের পরবর্তী নয় বছরে নানা কৌশলে এরশাদকে রক্ষাও করেছিল আওয়ামী লীগ। বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে এটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, ২১ মার্চ গভীর রাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার একদিন আগেও শেখ হাসিনা বলেছিলেন, পাঁচ দফার ভিত্তিতে চলমান আন্দোলনকে পাশ কাটিয়ে যারা স্বৈরাচারীর নির্বাচনে অংশ নেবে, তাদের ‘জাতীয় বেইমান’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু নিজেই নিজের সে ঘোষণার উল্টো কাজ করেছিলেন শেখ হাসিনা। সেবার সংসদে ৭৬টি আসনসহ আওয়ামী লীগ পেয়েছিল প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান। শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রা হয়েছিলেন এবং এরশাদের অবৈধ শাসনকে বৈধতা দিতে সাহায্য করেছিলেন। ১৯৯১-৯৬ সময়কালে জাপা ও আওয়ামী লীগ একযোগে আন্দোলন করেছে, ২০০১ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে এরশাদ চারদলীয় জোটের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভূমিকা পালন করেছেন। অর্থাত্ আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার সম্পর্ক অনেক পুরনো।
লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাস থেকে ডিজিটাল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারেও দল দুটি খুবই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে। বর্তমান পর্যায়ে আসার জন্য আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা হয়েছিল ২০০৮ সালের জুলাই মাসে। ঘটনাস্থল ছিল লন্ডন। সেবার ঢাকায় ফিরে এরশাদ বলেছিলেন, শেখ হাসিনাকে তিনি ‘বোন’ ডেকেছেন। সুতরাং ‘বোনের’ সঙ্গে ‘ভাইয়ের’ বৈঠক হয়ে থাকলে তাতে ‘দোষের’ কিছু থাকতে পারে না! এরশাদ একই সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, মহাজোট বিজয়ী হলে তিনিই রাষ্ট্রপতি হবেন। এ শুধু তার ইচ্ছা নয়, শেখ হাসিনাও তাকে রাষ্ট্রপতি পদে মেনে নিতে রাজি হয়েছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে হাসতে হাসতে এরশাদ বলেছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতি হতে ‘প্রস্তুত’ আছেন! সে সময় অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা, জনপ্রিয়তা ও উদ্দেশ্যসহ নানাদিক নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। কারণ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ‘বড় দল’ আওয়ামী লীগ খুব সহজে কারও সঙ্গে হাত মেলায়নি। চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিকে এসে সে দলটিই যখন আগ বাড়িয়ে নামসর্বস্ব কয়েকটি বাম দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল তখন আর বুঝতে বাকি থাকেনি যে, জোট না করে আওয়ামী লীগের কোনো উপায় ছিল না। এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব অর্জন করেছিল এরশাদের জাতীয় পার্টি। এর কারণ নির্বাচনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গী অন্য দলগুলোর তুলনায় জাতীয় পার্টি ছিল সম্ভাবনাময় একটি দল। অষ্টম সংসদেও জাতীয় পার্টির ১৪ জন এমপি ছিলেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যে দলগুলোকে নিয়ে ১৪ দলীয় জোট করেছিল সে দলগুলোর প্রধান নেতারাও কখনও নির্বাচিত হয়ে সংসদে যেতে পারেননি। পরিস্থিতির সুযোগে বাম দলগুলো বরং আওয়ামী লীগের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে সংসদে যেতে এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ক্ষমতার অংশীদার হতে চেয়েছিল। কিন্তু সম্পূর্ণ নেতিবাচক চিন্তা ও পরিকল্পনার ভিত্তিতে গঠিত ১৪ দলকে আওয়ামী লীগ যথেষ্ট মনে করেনি। দলটি সঠিকভাবেই বুঝেছিল, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার পথে ১৪ দল উল্টো বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এজন্যই আওয়ামী লীগ এরশাদের দিকে হাত বাড়িয়েছিল। এরশাদও সুযোগ নিতে ছাড়েননি, যদিও শেষ পর্যন্ত তাকে প্রবীণ নেতা জিল্লুর রহমানের কাছে পরাস্ত হতে হয়েছিল। ‘প্রস্তুত’ থাকলেও লন্ডনের সমঝোতা অনুযায়ী শেখ হাসিনা এরশাদকে রাষ্ট্রপতি বানাননি।
এর পর থেকেই বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে এদিক-সেদিক করার চেষ্টা চালিয়ে এসেছেন এরশাদ। একটির বেশি মন্ত্রিত্ব না দেয়ার কারণকে অজুহাত বানাতে চেয়েছেন তিনি। কখনও কখনও আবার জাতীয় পার্টির প্রতি চরম অবহেলার বিরুদ্ধে নেতা-কর্মীদের ক্ষোভকে ব্যবহার করে মহাজোট ত্যাগ করার হুমকিও দিয়েছেন এরশাদ। কিন্তু কোনোবারই তাকে বেশি দূর এগোতে দেখা যায়নি। এর প্রধান কারণটি অবশ্য কৌতূহলোদ্দীপক। শোনা যায়, এরশাদ যখনই এদিক-সেদিক করার চেষ্টা করেছেন, তখনই তাকে নাকি তার বিরুদ্ধে বিদ্যমান বিভিন্ন মামলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব মামলার কোনো কোনোটিতে এরই মধ্যে তিনি জেলের ভাতও খেয়ে এসেছেন। সরকারের অনুগ্রহে এখন রয়েছেন জামিনে। সত্যি এদিক-সেদিক করতে চাইলে তাকে যে আবারও জেলের ভাতই খেতে হবে এবং ঘটনাক্রমে বিএনপি ক্ষমতায় এলে যে জীবনের বাকি বছরগুলো তাকে জেলেই কাটাতে হবে—এসব বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই বোঝানো হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা একই সঙ্গে উচ্চ আদালতের সর্বশেষ একটি রায়ের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট দেয়া দ্বৈত বেঞ্চের রায়ে বলা হয়েছে, এরশাদ রাষ্ট্রপতিকে অপসারণসহ বাংলাদেশ পেনাল কোডের ১২১ (ক), ১২৪ এবং ১২৪ (ক) ধারায় অপরাধ করেছেন। মাননীয় বিচাপতিরা বলেছেন, এসব অভিযোগে এরশাদের বিচার হওয়া উচিত। ‘মোশতাক-জিয়া চক্র’কে একাকার করে রায়ে আরও বলা হয়েছিল, ওই দু’জনের মতো এরশাদও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করেছেন। ‘ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে’ সাবেক এই রাষ্ট্রপতির বিচার হওয়া উচিত। মাননীয় বিচারপতিরা জোর দিয়ে বলেছিলেন, এরশাদের মতো একজন স্বৈরশাসককে ক্ষমা করা হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
উচ্চ আদালতের এমন অভিমত নিঃসন্দেহে তাত্পর্যপূর্ণ। বলা বাহুল্য, এরশাদের বিচার না হওয়ার কারণ আসলে তার প্রতি আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতা। মূলত বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ প্রথম থেকে এরশাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসেছে। এতদিন পর বিচারপতিরা যাকে ‘ষড়যন্ত্র’ ও ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, এরশাদের সে অবৈধ অভ্যুত্থানকেও আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিল। ক্ষমতা দখলের সময় শুধু নয়, ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্তও এরশাদের প্রতি আওয়ামী লীগের মনোভাব ও কৌশলে পরিবর্তন ঘটেনি। এরশাদকে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছে শেখ হাসিনার প্রথম সরকার। তার কোনো মামলারই সুষ্ঠু বিচার করা হয়নি। সেই থেকে শেখ হাসিনা এবং এরশাদ সব সময় একযোগে কাজ করে এসেছেন। এজন্যই সর্বোচ্চ আদালত বললেও এরশাদকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের এই মনোভাব ও অবস্থানে পরিবর্তন ঘটতে পারে—এরশাদ যদি সত্যিই মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ নেন। তেমন ক্ষেত্রে ভারতই এরশাদের জন্য প্রধান ভরসা। এখন দেখার বিষয়, এরশাদ আসলেও এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার কথাটা ‘মিন’ করেছেন কি না। কারণ এরশাদই আবার এ কথাও জানিয়ে রেখেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কিনা সে ব্যাপারে তার গভীর সংশয় রয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক
shahahmadreza@yahoo.com
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কথাগুলোকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বিশেষ কিছু কারণে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে না নিয়ে পারেননি। সংবিধান ও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশে যখন সংকট ঘনীভূত হচ্ছে, ঠিক সে সময় অনেকটা হঠাত্ করে তাকে নড়েচড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। নিজেদের মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছেন তিনি। বলে চলেছেন, মহাজোটকে ক্ষমতায় বসিয়ে জনগণ নাকি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে এবং সে কারণে এই সরকারকে নাকি হটানো দরকার। জনগণকে তারপর কী করতে হবে, তারও পরামর্শ দিয়েছেন এরশাদ। নিজের বুকের ওপর আঙুল ঠেকিয়ে বলেছেন, তাকে ছাড়া নাকি জনগণের উপায় নেই! অর্থাত্ এরশাদকেই ক্ষমতায় বসাতে হবে। কীভাবে ক্ষমতায় আসবেন তিনি সে সম্পর্কে জানাতে গিয়ে চলতি বছরের প্রথম দিকেই এরশাদ জানিয়ে রেখেছেন, ‘যথাসময়ে অ্যাটাক’ করবেন তিনি। পাছে ‘অন্য রকম’ অর্থ করা হয় সে চিন্তা থেকে কথাটার ব্যখ্যা দিতে গিয়ে এরশাদ বলেছিলেন, মহাজোট থেকে তিনি বেরিয়ে যাবেন এবং আগামী নির্বাচনে তার দল এককভাবে তিনশ’ আসনে প্রার্থী দেবে। সাম্প্রতিক সময়ে এগিয়েছেনও তিনি সেভাবেই। যেমন মহাজোটে থাকা অবস্থাতেই কিছুদিন আগে হঠাত্ একশ’র বেশি আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছেন এরশাদ। তখন মনে করা হয়েছিল, তিনি হয়তো প্রধানমন্ত্রীর তথা আওয়ামী লীগের সঙ্গে দরকষাকষি করার কৌশল নিয়েছেন। কিন্তু অন্য দু-একটি কারণে তাকে সিরিয়াস মনে না করে পারা যায়নি। এর মধ্যে একটি হলো তার ভারত সফর। পবিত্র রমজানের শেষদিকে কোনো পর্ব ঘোষণা ছাড়াই তিনি দিল্লি গিয়েছিলেন। সেখানে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংসহ ভারতীয় প্রায় সব মন্ত্রী ও প্রধান নেতার সঙ্গেই তার বৈঠক হয়েছে। তাকে অঘোষিতভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সম্মানও দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা গেছে, ভারতের নীতিনির্ধারক তথা ক্ষমতাসীনরা নাকি ‘সব ডিম’ আর শেখ হাসিনার একার ‘বাস্কেটে’ রাখতে চাচ্ছেন না। প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের জনপ্রিয়তা দ্রুত শূন্যের দিকে নেমে যাচ্ছে বলেই ভারতীয়রা কিছু ‘ডিম’ অন্য দু-একজনের ‘বাস্কেটেও’ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই তালিকায় মনোনীত হয়েছেন বলেই জেনারেল (অব.) এরশাদকে এত খাতির-যত্ন করেছেন মনমোহন সিংরা। এরশাদও ধন্য হয়ে গেছেন। রীতিমত ঢাকঢোল পেটাতে পেটাতে দেশে ফিরেছেন তিনি। বলেছেন, ভারত তাকে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে ‘সাহায্য’ করবে এবং তিনি ক্ষমতায় এলে ভারতীয় নেতারা ‘খুশি’ হবেন।
এটা গত আগস্টের কথা। সেই থেকে এককালের স্বৈরশাসককে অনেকাংশে এককভাবে চলতে দেখা যাচ্ছিল। এরই মধ্যে জাতীয় ছাত্রসমাজের সমাবেশে কিছু বক্তব্য রেখে নতুন পর্যায়ে আলোড়ন তুলেছেন এরশাদ। মূলকথায় তিনি আগামী নির্বাচন নিয়ে গভীর সংশয় প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তার পরই বলেছেন, নির্বাচন হলে তিনিই এককভাবে ক্ষমতায় আসবেন। বিচ্ছিন্নভাবে জেনারেল (অব.) এরশাদের কথাগুলোকে শুনলে মনে হতে পারে যেন সরকারের ব্যর্থতায় সত্যিই তিনি ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। বাস্তবে তার এই ভূমিকার প্রকৃত কারণ কিন্তু অন্য রকম। প্রসঙ্গক্রমে পাঠকরা এরশাদের সেই ‘অ্যাটাক’ করার হুমকির কথা স্মরণ করতে পারেন। গত জানুয়ারিতে এমন একসময়ে তিনি হুমকিটি দিয়েছিলেন, যখন সেনাসদর থেকে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের অতি নাটকীয় কিন্তু ভীতিকর একটি খবর জানানো হয়েছিল। এর ফলে সে সময় এরশাদের অবৈধ অভ্যুত্থানের কথাও স্মরণ না করে পারা যায়নি। ১৯৮২ সালে অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রাক্কালে সেনাপ্রধান হিসেবে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’কে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারকে তুলোধুনো করেছিলেন তিনি। সেটা ছিল এক নজিরবিহীন ঘটনা। পরবর্তীকালে আরও অনেক নাটকীয় ও রক্তক্ষয়ী ঘটনারই জন্ম দিয়েছেন এরশাদ। বিশেষ করে গুজব রটিয়ে দেয়ার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারসহ বিভিন্ন প্রতিপক্ষকে নির্মূল করে দেয়ার ব্যাপারে তো রেকর্ডই করেছেন তিনি।
‘অ্যাটাক’বিষয়ক পর্যালোচনাতেও দেখা গিয়েছিল, বেছে বেছে এমন একসময়ে তিনি মাঠে নেমেছিলেন যখন বিএনপি ও জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলোর রোডমার্চ ও মহাসমাবেশগুলোতে লাখ লাখ মানুষ অংশ নিচ্ছিল; যখন নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও নরসিংদীর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের লজ্জাকর পরাজয় ঘটেছিল এবং যখন জনমত জরিপে সরকারের জনসমর্থন এমনকি ৩০-৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে বলে জানা যাচ্ছিল। এমন অবস্থার পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। একথা অন্তত পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী মহাজোটের পক্ষে ক্ষমতায় ফিরে আসা সম্ভব হবে না। আর ঠিক সেজন্যই কৌশল হিসেবে আগেভাগে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এরশাদ। তাই বলে উদ্দেশ্যও আবার মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাওয়া ছিল না। তিনি আসলে মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কৌশল নিয়েছিলেন। এমন অবস্থার ফায়দা কারা নিয়েছে সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই বলার দরকার পড়ে না।
ঘটনাপ্রবাহে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে এসেছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যকার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক বন্ধুত্বের এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার। ১৯৮২ সালের মার্চে সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল এরশাদ যখন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তখন আওয়ামী লীগ তাকে সমর্থন জুগিয়েছিল। ক্ষমতা থেকে বিএনপির বিদায়ে উল্লসিত হয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি ‘আনহ্যাপি’ নন। দলটির মুখপত্র দৈনিক ‘বাংলার বাণী’ প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল (২৫ মার্চ, ১৯৮২)। অবৈধ সামরিক শাসনের পরবর্তী নয় বছরে নানা কৌশলে এরশাদকে রক্ষাও করেছিল আওয়ামী লীগ। বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে এটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, ২১ মার্চ গভীর রাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার একদিন আগেও শেখ হাসিনা বলেছিলেন, পাঁচ দফার ভিত্তিতে চলমান আন্দোলনকে পাশ কাটিয়ে যারা স্বৈরাচারীর নির্বাচনে অংশ নেবে, তাদের ‘জাতীয় বেইমান’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু নিজেই নিজের সে ঘোষণার উল্টো কাজ করেছিলেন শেখ হাসিনা। সেবার সংসদে ৭৬টি আসনসহ আওয়ামী লীগ পেয়েছিল প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান। শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রা হয়েছিলেন এবং এরশাদের অবৈধ শাসনকে বৈধতা দিতে সাহায্য করেছিলেন। ১৯৯১-৯৬ সময়কালে জাপা ও আওয়ামী লীগ একযোগে আন্দোলন করেছে, ২০০১ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে এরশাদ চারদলীয় জোটের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভূমিকা পালন করেছেন। অর্থাত্ আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার সম্পর্ক অনেক পুরনো।
লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাস থেকে ডিজিটাল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারেও দল দুটি খুবই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে। বর্তমান পর্যায়ে আসার জন্য আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা হয়েছিল ২০০৮ সালের জুলাই মাসে। ঘটনাস্থল ছিল লন্ডন। সেবার ঢাকায় ফিরে এরশাদ বলেছিলেন, শেখ হাসিনাকে তিনি ‘বোন’ ডেকেছেন। সুতরাং ‘বোনের’ সঙ্গে ‘ভাইয়ের’ বৈঠক হয়ে থাকলে তাতে ‘দোষের’ কিছু থাকতে পারে না! এরশাদ একই সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, মহাজোট বিজয়ী হলে তিনিই রাষ্ট্রপতি হবেন। এ শুধু তার ইচ্ছা নয়, শেখ হাসিনাও তাকে রাষ্ট্রপতি পদে মেনে নিতে রাজি হয়েছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে হাসতে হাসতে এরশাদ বলেছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতি হতে ‘প্রস্তুত’ আছেন! সে সময় অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা, জনপ্রিয়তা ও উদ্দেশ্যসহ নানাদিক নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। কারণ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ‘বড় দল’ আওয়ামী লীগ খুব সহজে কারও সঙ্গে হাত মেলায়নি। চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিকে এসে সে দলটিই যখন আগ বাড়িয়ে নামসর্বস্ব কয়েকটি বাম দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল তখন আর বুঝতে বাকি থাকেনি যে, জোট না করে আওয়ামী লীগের কোনো উপায় ছিল না। এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব অর্জন করেছিল এরশাদের জাতীয় পার্টি। এর কারণ নির্বাচনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গী অন্য দলগুলোর তুলনায় জাতীয় পার্টি ছিল সম্ভাবনাময় একটি দল। অষ্টম সংসদেও জাতীয় পার্টির ১৪ জন এমপি ছিলেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যে দলগুলোকে নিয়ে ১৪ দলীয় জোট করেছিল সে দলগুলোর প্রধান নেতারাও কখনও নির্বাচিত হয়ে সংসদে যেতে পারেননি। পরিস্থিতির সুযোগে বাম দলগুলো বরং আওয়ামী লীগের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে সংসদে যেতে এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ক্ষমতার অংশীদার হতে চেয়েছিল। কিন্তু সম্পূর্ণ নেতিবাচক চিন্তা ও পরিকল্পনার ভিত্তিতে গঠিত ১৪ দলকে আওয়ামী লীগ যথেষ্ট মনে করেনি। দলটি সঠিকভাবেই বুঝেছিল, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার পথে ১৪ দল উল্টো বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এজন্যই আওয়ামী লীগ এরশাদের দিকে হাত বাড়িয়েছিল। এরশাদও সুযোগ নিতে ছাড়েননি, যদিও শেষ পর্যন্ত তাকে প্রবীণ নেতা জিল্লুর রহমানের কাছে পরাস্ত হতে হয়েছিল। ‘প্রস্তুত’ থাকলেও লন্ডনের সমঝোতা অনুযায়ী শেখ হাসিনা এরশাদকে রাষ্ট্রপতি বানাননি।
এর পর থেকেই বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে এদিক-সেদিক করার চেষ্টা চালিয়ে এসেছেন এরশাদ। একটির বেশি মন্ত্রিত্ব না দেয়ার কারণকে অজুহাত বানাতে চেয়েছেন তিনি। কখনও কখনও আবার জাতীয় পার্টির প্রতি চরম অবহেলার বিরুদ্ধে নেতা-কর্মীদের ক্ষোভকে ব্যবহার করে মহাজোট ত্যাগ করার হুমকিও দিয়েছেন এরশাদ। কিন্তু কোনোবারই তাকে বেশি দূর এগোতে দেখা যায়নি। এর প্রধান কারণটি অবশ্য কৌতূহলোদ্দীপক। শোনা যায়, এরশাদ যখনই এদিক-সেদিক করার চেষ্টা করেছেন, তখনই তাকে নাকি তার বিরুদ্ধে বিদ্যমান বিভিন্ন মামলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব মামলার কোনো কোনোটিতে এরই মধ্যে তিনি জেলের ভাতও খেয়ে এসেছেন। সরকারের অনুগ্রহে এখন রয়েছেন জামিনে। সত্যি এদিক-সেদিক করতে চাইলে তাকে যে আবারও জেলের ভাতই খেতে হবে এবং ঘটনাক্রমে বিএনপি ক্ষমতায় এলে যে জীবনের বাকি বছরগুলো তাকে জেলেই কাটাতে হবে—এসব বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই বোঝানো হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা একই সঙ্গে উচ্চ আদালতের সর্বশেষ একটি রায়ের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট দেয়া দ্বৈত বেঞ্চের রায়ে বলা হয়েছে, এরশাদ রাষ্ট্রপতিকে অপসারণসহ বাংলাদেশ পেনাল কোডের ১২১ (ক), ১২৪ এবং ১২৪ (ক) ধারায় অপরাধ করেছেন। মাননীয় বিচাপতিরা বলেছেন, এসব অভিযোগে এরশাদের বিচার হওয়া উচিত। ‘মোশতাক-জিয়া চক্র’কে একাকার করে রায়ে আরও বলা হয়েছিল, ওই দু’জনের মতো এরশাদও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করেছেন। ‘ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে’ সাবেক এই রাষ্ট্রপতির বিচার হওয়া উচিত। মাননীয় বিচারপতিরা জোর দিয়ে বলেছিলেন, এরশাদের মতো একজন স্বৈরশাসককে ক্ষমা করা হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
উচ্চ আদালতের এমন অভিমত নিঃসন্দেহে তাত্পর্যপূর্ণ। বলা বাহুল্য, এরশাদের বিচার না হওয়ার কারণ আসলে তার প্রতি আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতা। মূলত বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ প্রথম থেকে এরশাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসেছে। এতদিন পর বিচারপতিরা যাকে ‘ষড়যন্ত্র’ ও ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, এরশাদের সে অবৈধ অভ্যুত্থানকেও আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিল। ক্ষমতা দখলের সময় শুধু নয়, ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্তও এরশাদের প্রতি আওয়ামী লীগের মনোভাব ও কৌশলে পরিবর্তন ঘটেনি। এরশাদকে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছে শেখ হাসিনার প্রথম সরকার। তার কোনো মামলারই সুষ্ঠু বিচার করা হয়নি। সেই থেকে শেখ হাসিনা এবং এরশাদ সব সময় একযোগে কাজ করে এসেছেন। এজন্যই সর্বোচ্চ আদালত বললেও এরশাদকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের এই মনোভাব ও অবস্থানে পরিবর্তন ঘটতে পারে—এরশাদ যদি সত্যিই মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ নেন। তেমন ক্ষেত্রে ভারতই এরশাদের জন্য প্রধান ভরসা। এখন দেখার বিষয়, এরশাদ আসলেও এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার কথাটা ‘মিন’ করেছেন কি না। কারণ এরশাদই আবার এ কথাও জানিয়ে রেখেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কিনা সে ব্যাপারে তার গভীর সংশয় রয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক
shahahmadreza@yahoo.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন