শুক্রবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১২

মুঠোফোনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতেও থ্রিজি চর্চা চাই




গত ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের মোবাইল ফোন থ্রিজি’র যুগে সংযুক্ত হলো। বিশ্বের অনেক দেশ অনেক আগে থেকেই থার্ড জেনারেশন সেবায় অভ্যস্ত ছিল। বিলম্বে হলেও একটা দরিদ্র দেশ হয়েও আজ বিজ্ঞানের অভিযাত্রায় বাংলাদেশ আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল—এটা অনেক বড় কথা। যদিও এ সুযোগ আপাতত কেবল সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন টেলিটক গ্রাহকরা (ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে) পাবেন। অবশ্য এজন্য কিছুটা দামি মুঠোফোন সেট কিনতে হবে। এখন থ্রিজি গ্রাহক মুঠোফোনে অপর প্রান্তের কথককে দেখতে পাবেন। টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখতে পাবেন। কোথা থেকে কথা হচ্ছে তাও শনাক্ত করা যাবে। আমরা আশা করছি, দেশের মানুষ উন্নত বিশ্বের অনেকের মতো বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের সুন্দর সুন্দর সেবা উপভোগ করতে পারবেন।
বলা নিষ্প্রয়োজন, দ্রুত বিজ্ঞানের অনেক অবদান তথ্য-প্রযুক্তির বদৌলতে বাংলাদেশে পৌঁছে যাচ্ছে। দেশ এগিয়ে চলছে। এক সময় একটিমাত্র ‘সিটিসেল’ ছিল মুঠোফোনের জগতে। তখন সেটা সহজলভ্য, বহুল কার্যকর ছিল না। ছিল অনেক ব্যয়বহুল। এরপর গ্রামীণফোনসহ একাধিক সংস্থা গড়ে ওঠে। গ্রামীণফোন প্রথম সারা দেশে তার নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করায় মানুষের জন্য ধীরে ধীরে মুঠোফোন একটা অত্যাবশ্যক উপাদানে পরিণত হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ডক্টর ইউনূসের এখানেও একটা যুগান্তকারী ভূমিকা রয়েছে। গ্রামীণ চাষী, দুধ বা মত্স্য দূরের ব্যবসায়ী বাজারের মূল্য জেনে মধ্যস্বত্বভোগীর কব্জা থেকে বেরিয়ে আসার পথ পেয়েছে। ষোল কোটি লোকের দেশে দশ কোটি মোবাইল সিম—এটা কম কথা নয়। যদিও ছয়শ’ কোটি বাসিন্দার বিশ্বে এখন ছয়শ’ কোটি সিম ব্যবহৃত হচ্ছে। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, পৃথিবীর সবাই এক-একটি সিম ব্যবহার করছেন। কেউ কেউ একাধিক ব্যবহার করছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানে মুঠোফোন ব্যবহার করা হচ্ছে ল্যান্ডফোনের পাশাপাশি। তথ্যপ্রবাহের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। সহজও হয়েছে। এর মধ্যে থ্রিজি সেবার কার্যক্রম শুরু হওয়াতে গ্রাহকরা আরও একটু এগিয়ে যাবেন। দেশের মানুষ থ্রিজি প্রযুক্তিকে স্বাগত জানায়।
তবে এদেশের মানুষ অধিকতর আনন্দিত হতো, বিমুগ্ধ হতো যদি সামাজিক, বিশেষ করে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে থ্রিজি জাতীয় আধুনিক সংস্কৃতির প্রচলন ঘটত। থ্রিজি সেবার বা চর্চার প্রথম কথাই হলো—নতুনকে পুরনোর সম্মান ও মর্যাদা প্রদান। আমাদের সমাজে ধন ও শারীরিক শক্তি থাকা অব্দি নব প্রজন্মকে অগ্রজরা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেন না। পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অগ্রজরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। অথচ প্রবীণদের সঙ্গে সঙ্গে নবীনরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখতে পারলে সংসার অধিকতর সুন্দর হতে পারত। রাজনীতিতেও একই অবস্থা। রাজনীতিতে নবপ্রজন্মের নবচেতনার উন্মেষ ঘটতে দেয়া হচ্ছে না। বক্তৃতায় আমরা গণতন্ত্র, ন্যায়-নীতি, সমতা যাই বলি না কেন, দলীয়ভাবে তার চর্চা নেই। চর্চা নেই নতুনকে গ্রহণ করার। যোগ্য বা আধুনিককে বরণ করার। নিজ দলে পরমতসহিষ্ণুতার স্থান নেই। কোনো ধরনের সমালোচনা বরদাশথ করা হয় না। নেতার ভুল কর্মীদের ধরিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। ফলে নেতা কীর্তন ছাড়া এখন আর কিছুই হয় না। নেতা যা চান, কর্মীরা সেদিকেই ছাতা ধরেন। নবীনদের অধিকাংশই ব্যক্তিগতভাবে অন্যকে সম্মান দেখিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। অথচ কেবল দলীয় কারণে অন্য দলের নেতাকে শ্রদ্ধা করে না। আর এই অভ্যাসের কারণে একসময় ওই নবীন নিজ দল, নিজ স্বার্থ ছাড়া অন্য কিছু বুঝে না। নিজের স্বার্থে বা দলের স্বার্থে হানাহানিতে মেতে থাকে। নিজ দলে নেতা নির্বাচনে গণতন্ত্র থাকে সুদূরপরাহত। নির্বাচন দিলে বিশৃঙ্খলা হতে পারে, তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন দলীয় প্রধান। অথচ দু’বার-চারবার নির্বাচন করার পর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি আর হতো না, গণতান্ত্রিক চর্চায় অভ্যস্ত হতে পারত। সেটা জানার পরও তার চর্চা হচ্ছে না। এজন্যই থ্রিজি’র চর্চা হচ্ছে না। আর এই চর্চা না হওয়াতে ব্যক্তিবিশেষের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। গণতন্ত্র পরাভূত হচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞান বলে, পজিটিভ-নেগেটিভ মিলিতভাবেই কাঙ্ক্ষিত কাজটি সফল হয়। বৈদ্যুতিক তারের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, পজিটিভ-নেগেটিভ বা লাল-নীল তার সবসময় নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় পৃথকভাবে অবস্থান করলেও বিশেষ অবস্থায় বিশেষ ব্যবস্থায় একত্রিত হয়ে একটি আলোর সৃষ্টি করে। আমাদের সমাজে দুটি ভিন্ন দল একসঙ্গে চলে না। ভালো কিছুর জন্য মিলিত হয় না। বৈদ্যুতিক তারের যেমন অনিয়ন্ত্রিত সংস্পর্শে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা ঘটে, তেমনিভাবে রাজনীতিতে বিপরীত মেরুর কর্মীরা একত্রিত হলে সংঘাত বা সংঘর্ষ বাধে। অথচ এটা হওয়ার কথা নয়। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান তা বলে না। বলে সহনশীলতার কথা। আধুনিক রীতিতে নেতৃত্বের প্রধান শর্ত হলো পরমতসহিষ্ণুতা। অন্যের কথা ধৈর্য ধারণ করে শোনা। আমরা তা করি না। ফলে রাজনীতি থেকে যতটা সুফল পাওয়ার কথা তা জনগণ পায় না। ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, কিন্তু জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। অথচ দরিদ্র দেশে ক্ষমতার পালাবদল খুবই স্বাভাবিক। বিষয়টা বুঝলে দেশের উপকার হতো। দেশ অশান্তি থেকে মুক্তি পেত। সম্মিলিত প্রয়াস নিতে পারলে অনেক সঙ্কট কেটে যেত। আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস কাটিয়ে আস্থাশীল হওয়া যেত। থার্ড জেনারেশনের শিক্ষাই এটা। বিজ্ঞানের জ্ঞানকে কেবল উপভোগের কাজে ব্যবহার না করে নৈতিক বিকাশের কাজে ব্যবহার করতে হবে। ব্যবহার করতে হবে নিজের আচার-আচরণে। সমাজকে অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে হলে বিজ্ঞানের মাধ্যমে অর্জিত সেবাকে বিবেকের শাণিত শক্তি দিয়ে পরিশুদ্ধ করতে হবে। পরিশুদ্ধ সমাজ ছাড়া শান্তি-আনন্দ উপভোগ করা যায় না। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads