হোসাইন মো: শফীকুর রহমান
নরম কোমল উর্বর মাটির এই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস অনেক পুরনো, শত-সহস্র বছরের। তাত্ত্বিক সুভাষণ নয় বরং প্রায়োগিক অর্থেই বুদ্ধরা অত্যন্ত বিনম্র স্বভাবের ও শান্তিবাদী। অন্তত আমাদের এই বঙ্গে এটা সংশয়াতীত প্রমাণিত সত্য। ধর্মীয় পরিচয় ও স্বাতন্ত্র্যে আমাদের মানবিকতার বোধ ও চৈতন্যে কখনো চিড় ধরার নজির নেই। আমরা সহাবস্থানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর কিছু না হলেও জাতি হিসেবে আমাদের এটুকু গর্ব করার আছে। গৌতম বুদ্ধ শান্তির অমিয় বাণী প্রচার করেছিলেন। অহিংসা এবং শান্তির মূলমন্ত্রেই তিনি মানব জাতিকে উজ্জীবিত করেছেন। মানবজাতির নবী হজরত মুহাম্মদ সা: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সংহতি, ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতেই মদিনা চার্টার বা সনদ ঘোষণা করেছিলেন। বিদায় হজের ভাষণে মহানবী সা: মানবজাতির রক্তকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে বিচারবহির্ভূত কাউকে হত্যা করে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল।’ এসব উদ্ধৃতি দিয়ে খুব স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, বৌদ্ধ কী মুসলিমÑ কেউই সহিংস হতে পারে না। ধর্মীয় পরিচয়ে ভিন্ন কোনো জাতির প্রতিই বিদ্বেষ মনোভাব অধার্মিকতা, অবৈধ। সবচেয়ে বড় কথা, দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভেতর দিয়ে আমরা পুষ্ট হয়েছি। আমাদের মনন তৈরি হয়েছে। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান আমরা প্রায় পরিবারভুক্ত সদস্য হয়ে বাস করে আসছি। দেশের অন্যান্য বিচ্ছিন্ন ঘটনার মতোই দু-চারটি বিচ্ছিন্ন ধর্মীয় সহিংসতার নজির থাকলেও তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করার সুযোগ কখনো পায়নি। প্রতিবেশীর প্রতি প্রতিবেশীর সহমর্মিতা নিয়েই এসব কিছুর শান্তিপূর্ণ সমাধান খুব দ্রুতই হওয়ার নজির রয়েছে। বৌদ্ধরা আমাদের পড়শি। আমাদের আপনজন। আমরা এক সমাজভুক্ত অতি কাছের মানুষ। কী দুর্ভাগ্য আমাদের। আমরা আমাদের আত্মীয় প্রতিবেশীর বাড়ি উপাসনালয় রক্ষা করতে পারিনি। তাদের আর্ত চিৎকারের সময়, ধ্বংসলীলা চলার সময় আমরা ছুটে গিয়ে প্রতিরোধ করতে পারিনি। জাতি হিসেবে এ লজ্জা আমাদের। আমাদের মাথা নিচু হয়ে গেছে।
কী করে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল তা কি শুধু ভাসা ভাসা চোখে দেখলেই চলবে, নাকি এর পোস্টমর্টেম করে বিষয়টির উৎস খোঁজা দরকার? এ ধরনের একটা বর্বরোচিত হিংস্র ঘটনা কী করে ঘটল তা খতিয়ে দেখার আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিরোধী দলকে দায়ী করলেন। এটা যেন সরকারের জন্য একটা চমৎকার আশীর্বাদ রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য। আমাদের প্রশ্নÑ রাষ্ট্র কি এতটাই অনিরাপদ যে, এ রকম বিরাট একটি ঘটনা ঘটে গেল অথচ কেউ টেরই পেল না? যদি এমনটা সম্ভব বলে কল্পনা করা হয়, তা হলেও বলতে হবে এটা একটা বিশৃঙ্খলা, চরম নৈরাজ্য আক্রান্ত জনপদ। জোর যার মুল্লুক তার নীতিই চলছে, এখানে কোনো আইনের শাসন কার্যকর নেই। রামুতে যে বিভীষিকা ঘটে গেল, রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন মহল কোনোভাবেই এর দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। ঘটনাটি এমন নয় যে, কোনো দুষ্ট খেয়ালি বালক পথে কারো বরই গাছে ঢিল ছুড়েছে হঠাৎ করেই। রামুর ঘটনাদৃশ্যে মনে হয়, এটা রীতিমতো ধ্বংসযজ্ঞ-তান্ডবলীলা।
মহাসমারোহে শত শত লোক উল্লাসের সাথে এই ধ্বংসলীলা চালায়। এরূপ ঘটনা আকস্মিক, কেউ বুঝে ওঠার আগেই ঘটানো সম্ভব নয়। বরং এ জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা, লোক জমায়েত করা এবং উসকানি দেয়া। তারপর তো হামলা। এতক্ষণ রাষ্ট্রের প্রশাসন এবং অন্য এজেন্সিগুলো অজানিত থাকবে, কোনোরূপ আঁচই করতে পারবে না, তা-ও কি ভাবা যায়? আর যদি এটাই সত্যি হয়, প্রশাসন রাষ্ট্র সরকার সম্পূর্ণ বেখবর ছিলÑ তাহলে তো প্রশ্ন উঠবেÑ রামুর ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অথবা এই রাষ্ট্রযন্ত্র কোনোভাবে কাজ করে না। এটি একটি বিকল মেরুদন্ডহীন রাষ্ট্র, যার কোনো সার্বভৌম চরিত্র, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নেই। আমরা কি সে দিকেই এগোচ্ছি? যে পুরনো খাসলত রয়েছেÑ কোনো ঘটনা ঘটলেই সরকারি দল বিরোধী দল কিংবা বিরোধী দল সরকারি দলকে দায়ী করার মওকা পেয়ে যায়, সে জন্য ভিকটিম ন্যায়বিচারের কাছাকাছি আসতে পারে না। রাষ্ট্রকে সব শক্তি দিয়ে তার নাগরিকের জীবন ও সম্পদ, উপাসনালয় রক্ষা করতে হবে। যে মানুষটি এই মাটিতে জন্মেছে, এই আলো বাতাসে যার রয়েছে পূর্ণ অধিকার, সে কী করে নিজেকে অনিরাপদ ভাবতে পারে। আর রাষ্ট্রের প্রধান কাজই হচ্ছে আন্ত:ধর্মীয় সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করা। আমাদের সংবিধান নাগরিকের মৌলিক অধিকার ঘোষণা করেছে। বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’
সংবিধানের অনন্য মৌলিক অধিকার হচ্ছে ‘আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’
বৌদ্ধরা আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রকৃতপক্ষে তারা এ দেশের নাগরিক, এ ভূখন্ডের অধিবাসী। রাষ্ট্রকে অবশ্যই কুৎসিৎ ঘৃণ্য রাজনীতির খেলায় অবতীর্ণ হওয়া চলবে না। সরকারকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে, কারা প্রকৃত অপরাধী, কারা এর পেছনে মদদদাতা। দুষ্কৃতকারীদের আইনের মুখোমুখি দাঁড় করানোই প্রধান কাজ।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধিজীবী বিষয়টিকে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বলে ইসলাম ও মুসলমানদের কলঙ্কিত করার প্রয়াস পাচ্ছেন। ইসলামকে মৌলবাদ বলে, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদতত্ত্ব শত-সহস্রবার প্রচার করে কী ক্ষেত্র তারা প্রস্তুত করতে চাচ্ছেন বুঝতে পারি না। বাংলাদেশের ধর্মতাত্ত্বিকেরা যদি সুনির্দিষ্টভাবে মুসলমান ও ইসলামি ব্যক্তিত্বকে ধরা হয়, তাহলে মানতেই হবে, তারা অন্য জাতির প্রতি অসহিষ্ণু নন। কখনো তারা হিংসাত্মক, উসকানিমূলক আচরণ, বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে উসকে দেন না। যেসব ব্যক্তি মুসলিম বংশীয় হয়ে অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়কে আঘাত করে, খুঁজলে দেখা যাবে তারা কেউই ধর্মীয় আচরণে অভ্যস্ত নয়। কায়েমি স্বার্থের হিংস্রতা থেকে সুযোগ সন্ধানীরাই এহেন অধর্মীয়, সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজে প্রবৃত্ত হয়। সরকার বারবারই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কথাও বলেছে। তাহলে সরকার কেন বিষয়টির গভীরে না গিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রাখছে? সরকার কোনোভাবেই বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে না, উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে পরিস্থিতিকে নানা মাত্রিক উপসর্গকে আমন্ত্রণ জানাতে পারে না।
এরপরে যে কথাটি বলতে চাই তা হচ্ছেÑ রামুর ঘটনাকে কেউ কেউ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ইস্যুর সাথে মিলিয়ে বিচার করতে চাইছেন, যা কোনো বিচারেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মিয়ানমারে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক, হতাশাব্যঞ্জক, ক্ষতবিক্ষত। সম্ভব সব ধরনের প্রতিবাদ আমরা জানাচ্ছি এবং আরো জানাব। কিন্তু তাই বলে রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানের সাথে যদি আমাদের প্রতিবেশী ভাই বৌদ্ধদের ভাগ্যকে জড়িত করে ফেলি, তাহলে বৌদ্ধরা কখনো নিজেদের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে নিরাপদ ভাবতে পারবে না।
যে ফেসবুককে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত, তাকে সমাধিস্থ করে বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করলে দোষীরা কখনোই আইনের আওতায় আসবে না। কথিত উত্তম বড়–য়া কোথায়, কেউ এখন পর্যন্ত জানে না। ইসলাম-কুরআন অবমাননার প্রতিক্রিয়ায় যে সংক্ষোভের বহ্নি জ্বলে উঠেছে, তাতে কিন্তু উত্তম বড়–য়ার বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়নি, পরিবারও অক্ষত আছে। এখানেই এখন সব যুক্তবাদী বিবেকবান মানুষের মনোযোগ। উত্তম বড়–য়া কি তাহলে অশরীরি দানবের ছায়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল? ড. সুকোমল বড়–য়া স্পষ্টতই বলেছেন, ‘বুদ্ধ পূর্ণিমার আনন্দঘন দিনে ফেসবুককে ইস্যু করে যে বিক্ষোভ মিছিল হয় পুলিশি উপস্থিতি সেখানে ছিল এবং তারা বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে প্রথমে আশ্বস্তও করেছিল কিন্তু ধ্বংসযজ্ঞ চলাকালে পুলিশ কোনো সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি, এমনকি ওসিকে বারবার ফোন করলেও তিনি ফোন কেটে দিয়েছিলেন। এসপি সাহেবও রেসপন্স করেননি। ড. সুকোমল বড়–য়া আরো বলেছেন, বিক্ষোভ মিছিলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বিশেষ করে মৎস্যজীবী নেতার নেতৃত্ব দেয়ার কথা বলেছেন এবং স্থানীয় পত্রপত্রিকা ছাড়াও জাতীয় মিডিয়াগুলোও সবিস্তারে একই কথা বলেছে। এসব বিষয় থেকে বোঝা যাচ্ছে, বিষয়টি অত্যন্ত রহস্যজনক। প্রশ্ন হচ্ছে, ইনসালটিং ইসলাম বা ফেসবুক স্ক্যান্ডাল সৃষ্টি করে আমাদের জাতীয় সংহতির জায়গাগুলোতে চূড়ান্ত আঘাত করে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার সব পথ রুদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে কি-না। উত্তম বড়–য়া সৃষ্টি করে আমাদের জাতীয় মেরুদন্ড ভেঙে দেয়া হচ্ছে কি-না ভেবে দেখার বিষয়। সরকার ঘটনার দিকে সোজাসুজি দৃষ্টিপাত না করে বিরোধী দলকে দায়ী করে তুমুল হইচই, ঢাক পিটিয়ে এক প্রকৃত ঘটনাকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে চাইছে। কিন্তু কেন! ষড়যন্ত্রকারী যেই হোক, তারা কি তাদের উদ্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে। আসলে কী লক্ষ্যই তাদের ছিল? নাকি হিতে বিপরীত হয়েছে। এসব প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মনে।
সবশেষে এতটুকু বলব, বৌদ্ধদের কাছে আমরা ঋণী। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, এখানকার সভ্যতা বিনির্মাণে বৌদ্ধদের অবদান অবিস্মরণীয়। তাদের অবমাননা মানে আমাদের অস্তিত্বের অন্তমূলে ছুরিকাঘাত। আমরা আশা করব, আবার তারা প্রাণের হিল্লোলে স্পন্দিত হবে, রক্তাক্ত ক্ষত জীবনে বিস্মৃত হবে বেদনার্ত বিভীসিকাময় মুহূর্তগুলো।
লেখক : প্রাবন্ধিক
hosoinshafir@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন