দুর্নীতির তদন্ত না করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থছাড় না করার ঘোষণায় অটল রয়েছে বিশ্বব্যাংক। দুর্নীতি তদন্ত অগ্রগতি খতিয়ে দেখতে ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড প্রসিকিউশনে দক্ষ তিন সদস্যের একটি প্যানেল অব ইনভেস্টিগেটিভ এক্সপার্ট গঠন করেছে সংস্থাটি। ১৩ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে রয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সাবেক প্রধান প্রসিকিউটর লুই গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পো। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন—হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক কমিশনার টিমোথি টং ও যুক্তরাজ্যের গুরুতর প্রতারণা দমন কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অল্ডারম্যান। বিশ্বব্যাংকের ওয়াশিংটন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশন সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সংস্থার বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের পরিচালক অ্যালেন গোল্ডস্টেইন বলেছেন, তদন্তের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে সমঝোতা চূড়ান্ত করতে বিশ্বব্যাংকের যে প্রতিনিধি দল আসার কথা ছিল, তারা এ মাসের মাঝামাঝিতে আসবেন।
দুর্নীতির তদন্তের পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নের নতুন রূপরেখা চূড়ান্ত করতে আরও একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসবে বলে জানিয়েছিল অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। তবে দ্বিতীয় প্রতিনিধিদল গঠনের বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি বলে ইআরডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। প্রথম প্রতিনিধিদলের প্রতিবেদন পাওয়ার পরই আর একটি প্রতিনিধিদল গঠন করা হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞদের এ প্রতিনিধিদল গঠন করা হয়েছে। এ প্রতিনিধিদল পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি তদন্ত করতে সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে। কমিটির সুপারিশের আলোকে সেতু প্রকল্পে অগ্রসর হওয়ার কথা চিন্তা করবে বিশ্বব্যাংক।
লুই গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বাধীন প্যানেল অব ইনভেস্টিগেটিভ এক্সপার্টদের পর্যবেক্ষণ পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে বলে আশাবাদী বিশ্বব্যাংকের প্রধান জিম ইয়ং কিম। তিনি বলেন, এ প্যানেলের পর্যবেক্ষণ বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি বড় সুযোগ, যা তদন্তে স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতার অন্তরায়গুলো দূর করবে।
তবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থার প্রেসিডেন্ট বিবৃতিতে বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ। প্রকল্পের বাস্তবায়ন কার্যক্রমে আমরা সব ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করতে প্রতিশ্রুতিশীল। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে এ প্রতিনিধিদল সম্পর্কে তথ্য দেয়া হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের তদন্ত স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং পূর্ণাঙ্গতা পর্যবেক্ষণ করতে সরকারের সহায়তাও চাওয়া হয় বিবৃতিতে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, প্যানেলের প্রধান ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ৬১ বছর বয়সী মোরেনো ওকাম্পো নিজ দেশ আর্জেন্টিনায় সামরিক সরকারের দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। বুয়েন্স আয়ারেস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও হার্ভার্ড ল স্কুলেও অধ্যাপনা করেন তিনি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যও ছিলেন মোরেনো ওকাম্পো। বিশ্বব্যাপী মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে তার প্রধান প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান মোরেনো ওকাম্পো। নেদারল্যান্ডসের হেগভিত্তিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের জেরা করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক দুদকের সঙ্গে তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড প্রসিকিউশন এ দক্ষ তিন সদস্যের একটি প্যানেল অব ইনভেস্টিগেশন এক্সপার্ট গঠনের প্রস্তাব আগেই দিয়েছে। কমিশন তদন্তে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সঠিকতার স্বার্থে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতার প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। সে অনুযায়ী দুদকের তদন্ত টিমকে পুনর্গঠনও করা হয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান একাধিকবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন, প্যানেল অব এক্সপার্টদের সঙ্গে দুদক কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছে। তারা যেসব বিষয়ে পরামর্শ দেবেন দুদক সে অনুযায়ী কাজ করবে। তবে কমিশনের আইন বিধিমালা, কমিশনের স্বাধীনতা নিরপেক্ষতা ও মামলার সম্ভাব্য বিচারিক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সহযোগিতার প্রভাব বিষয়ে কমিশন সচেতন রয়েছে বলে জানান গোলাম রহমান।
এদিকে ইআরডি সূত্র জানিয়েছে, প্রতিনিধি দল চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে আসবে। এ সময়ের মধ্যে বহুজাতিক সংস্থাটির আস্থা অর্জনে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হলেই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে অগ্রসর হবে। এক মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের আস্থা অর্জন করতে না পারলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থ পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণের টাকা পেতে এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটি ‘লেটার অব ইনটেম্লট (আগ্রহপত্র)’ সই করেছে সরকার। এ সমঝোতায় বিশ্বব্যাংকের সুনির্দিষ্ট চারটি শর্ত পালন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে এসব সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন করতে সরকারকে ৩০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এ সময়সীমার মধ্যে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ কমিটি দুর্নীতির তদন্তে সহায়তাসহ অন্যান্য শর্ত পরিপালনে সরকারের ভূমিকা পর্যবেক্ষণ করবে।
সূত্র জানায়, এসব শর্ত মেনে লেটার অব ইনটেম্লট সই করার পর বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে একটি টার্ম অব রেফারেন্সের খসড়া ধরিয়ে দেয়া হয়। এতে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে সরকারের কর্তৃত্ব কমিয়ে বিশ্বব্যাংকের ক্ষমতা বৃদ্ধি, ক্রয় প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকের অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ানোসহ বেশ কয়েকটি নতুন শর্ত দেয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে এসব শর্ত মেনে নেয়া হয়েছে।
এ দিকে চলতি মাসের শুরুতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে দাতাদের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরের কথা ছিল। বিশ্বব্যাংকের কর ডাইরেক্টর জেক স্টেইনের নেতৃত্বে পদ্মা প্রকল্পের অন্য দুই সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (জাইকা) প্রতিনিধি থাকার কথা ছিল। তবে এ সময়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি না পেয়ে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর এক দিনের মাথায় বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রকাশিত একটি বিবৃতিতে বলা হয়, দুর্নীতির তদন্ত সম্পন্ন হলেই কেবল পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করা হবে। বিবৃতিতে গোটা বাংলাদেশে বিদ্যমান দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
এর আগে চলতি বছরের শুরুতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়নের নতুন রূপরেখা চূড়ান্ত করতে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল আসার কথা ছিল। এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিশ্বব্যাংক নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করায় বিশ্বব্যাংক এ প্রতিনিধি দলের সফর স্থগিত করে। পরে সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন ও দুর্নীতির তদন্ত করতে পৃথক দল আসবে বলে বিবৃতিতে জানায় সংস্থার বাংলাদেশ অফিস। তবে অর্থায়নের কমিটির ঘোষণা না দিয়ে অবশেষে দুর্নীতির তদন্ত কমিটির ঘোষণা দিল বিশ্বব্যাংক।
উল্লেখ্য, প্রায় ২৯৭ কোটি ডলারের প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণ দেয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ১৪ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার চুক্তি করেছে। বাকি অর্থের জোগান দেবে সরকার। কিন্তু প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দিয়ে চারটি শর্ত দেয় বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশ সরকার শর্তগুলো পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় গত ২৯ জুন ঋণ চুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাক। এর পর সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়। সৈয়দ আবুল হোসেনকে প্রথমে মন্ত্রণালয় থেকে ও পরে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের মন গলাতে সংস্থাটির মূল দাবিগুলো পূরণে কাজ করে সরকার। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) একটি বিশেষ তদন্ত ও বিচারিক টিম গঠন। সরকারি ব্যক্তিদের (আমলা ও রাজনীতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত) ছুটি দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকেও সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
কমিটিকে স্বাগত জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী : পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির তদন্ত পর্যবেক্ষণে বিশ্বব্যাংক গঠিত প্যানেলকে স্বাগত জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনায় প্যানেলকে সহযোগিতা করা হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন। গতকাল শিল্পকলা একাডেমীতে বিশ্বব্যাংক আয়োজিত আঞ্চলিক চিত্রকলা প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি কমিটিকে সহায়তার ঘোষণা দেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগেই বিশ্বব্যাংকের কমিটির ঘোষণা আসে। এ কমিটি গঠনের প্রতিক্রিয়ায় অর্থমন্ত্রী বলেন, এটা খুবই ভালো। আমাদের দুদকও তদন্ত করছে। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।
এসব প্রক্রিয়া সেরে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করতে দেরি হবে কি না- জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, না দেরি হবে না। আমরা যেভাবে বলেছিলাম, সেভাবেই হবে। তিনি এর আগে বলেছিলেন, আগামী এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হবে।
তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশন সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সংস্থার বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের পরিচালক অ্যালেন গোল্ডস্টেইন বলেছেন, তদন্তের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে সমঝোতা চূড়ান্ত করতে বিশ্বব্যাংকের যে প্রতিনিধি দল আসার কথা ছিল, তারা এ মাসের মাঝামাঝিতে আসবেন।
দুর্নীতির তদন্তের পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নের নতুন রূপরেখা চূড়ান্ত করতে আরও একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসবে বলে জানিয়েছিল অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। তবে দ্বিতীয় প্রতিনিধিদল গঠনের বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি বলে ইআরডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। প্রথম প্রতিনিধিদলের প্রতিবেদন পাওয়ার পরই আর একটি প্রতিনিধিদল গঠন করা হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞদের এ প্রতিনিধিদল গঠন করা হয়েছে। এ প্রতিনিধিদল পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি তদন্ত করতে সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে। কমিটির সুপারিশের আলোকে সেতু প্রকল্পে অগ্রসর হওয়ার কথা চিন্তা করবে বিশ্বব্যাংক।
লুই গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বাধীন প্যানেল অব ইনভেস্টিগেটিভ এক্সপার্টদের পর্যবেক্ষণ পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে বলে আশাবাদী বিশ্বব্যাংকের প্রধান জিম ইয়ং কিম। তিনি বলেন, এ প্যানেলের পর্যবেক্ষণ বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি বড় সুযোগ, যা তদন্তে স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতার অন্তরায়গুলো দূর করবে।
তবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থার প্রেসিডেন্ট বিবৃতিতে বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ। প্রকল্পের বাস্তবায়ন কার্যক্রমে আমরা সব ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করতে প্রতিশ্রুতিশীল। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে এ প্রতিনিধিদল সম্পর্কে তথ্য দেয়া হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের তদন্ত স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং পূর্ণাঙ্গতা পর্যবেক্ষণ করতে সরকারের সহায়তাও চাওয়া হয় বিবৃতিতে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, প্যানেলের প্রধান ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ৬১ বছর বয়সী মোরেনো ওকাম্পো নিজ দেশ আর্জেন্টিনায় সামরিক সরকারের দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। বুয়েন্স আয়ারেস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও হার্ভার্ড ল স্কুলেও অধ্যাপনা করেন তিনি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যও ছিলেন মোরেনো ওকাম্পো। বিশ্বব্যাপী মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে তার প্রধান প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান মোরেনো ওকাম্পো। নেদারল্যান্ডসের হেগভিত্তিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের জেরা করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক দুদকের সঙ্গে তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড প্রসিকিউশন এ দক্ষ তিন সদস্যের একটি প্যানেল অব ইনভেস্টিগেশন এক্সপার্ট গঠনের প্রস্তাব আগেই দিয়েছে। কমিশন তদন্তে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সঠিকতার স্বার্থে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতার প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। সে অনুযায়ী দুদকের তদন্ত টিমকে পুনর্গঠনও করা হয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান একাধিকবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন, প্যানেল অব এক্সপার্টদের সঙ্গে দুদক কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছে। তারা যেসব বিষয়ে পরামর্শ দেবেন দুদক সে অনুযায়ী কাজ করবে। তবে কমিশনের আইন বিধিমালা, কমিশনের স্বাধীনতা নিরপেক্ষতা ও মামলার সম্ভাব্য বিচারিক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সহযোগিতার প্রভাব বিষয়ে কমিশন সচেতন রয়েছে বলে জানান গোলাম রহমান।
এদিকে ইআরডি সূত্র জানিয়েছে, প্রতিনিধি দল চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে আসবে। এ সময়ের মধ্যে বহুজাতিক সংস্থাটির আস্থা অর্জনে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হলেই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে অগ্রসর হবে। এক মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের আস্থা অর্জন করতে না পারলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থ পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণের টাকা পেতে এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটি ‘লেটার অব ইনটেম্লট (আগ্রহপত্র)’ সই করেছে সরকার। এ সমঝোতায় বিশ্বব্যাংকের সুনির্দিষ্ট চারটি শর্ত পালন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে এসব সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন করতে সরকারকে ৩০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এ সময়সীমার মধ্যে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ কমিটি দুর্নীতির তদন্তে সহায়তাসহ অন্যান্য শর্ত পরিপালনে সরকারের ভূমিকা পর্যবেক্ষণ করবে।
সূত্র জানায়, এসব শর্ত মেনে লেটার অব ইনটেম্লট সই করার পর বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে একটি টার্ম অব রেফারেন্সের খসড়া ধরিয়ে দেয়া হয়। এতে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে সরকারের কর্তৃত্ব কমিয়ে বিশ্বব্যাংকের ক্ষমতা বৃদ্ধি, ক্রয় প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকের অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ানোসহ বেশ কয়েকটি নতুন শর্ত দেয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে এসব শর্ত মেনে নেয়া হয়েছে।
এ দিকে চলতি মাসের শুরুতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে দাতাদের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরের কথা ছিল। বিশ্বব্যাংকের কর ডাইরেক্টর জেক স্টেইনের নেতৃত্বে পদ্মা প্রকল্পের অন্য দুই সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (জাইকা) প্রতিনিধি থাকার কথা ছিল। তবে এ সময়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি না পেয়ে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর এক দিনের মাথায় বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রকাশিত একটি বিবৃতিতে বলা হয়, দুর্নীতির তদন্ত সম্পন্ন হলেই কেবল পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করা হবে। বিবৃতিতে গোটা বাংলাদেশে বিদ্যমান দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
এর আগে চলতি বছরের শুরুতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়নের নতুন রূপরেখা চূড়ান্ত করতে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল আসার কথা ছিল। এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিশ্বব্যাংক নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করায় বিশ্বব্যাংক এ প্রতিনিধি দলের সফর স্থগিত করে। পরে সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন ও দুর্নীতির তদন্ত করতে পৃথক দল আসবে বলে বিবৃতিতে জানায় সংস্থার বাংলাদেশ অফিস। তবে অর্থায়নের কমিটির ঘোষণা না দিয়ে অবশেষে দুর্নীতির তদন্ত কমিটির ঘোষণা দিল বিশ্বব্যাংক।
উল্লেখ্য, প্রায় ২৯৭ কোটি ডলারের প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণ দেয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ১৪ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার চুক্তি করেছে। বাকি অর্থের জোগান দেবে সরকার। কিন্তু প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দিয়ে চারটি শর্ত দেয় বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশ সরকার শর্তগুলো পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় গত ২৯ জুন ঋণ চুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাক। এর পর সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়। সৈয়দ আবুল হোসেনকে প্রথমে মন্ত্রণালয় থেকে ও পরে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের মন গলাতে সংস্থাটির মূল দাবিগুলো পূরণে কাজ করে সরকার। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) একটি বিশেষ তদন্ত ও বিচারিক টিম গঠন। সরকারি ব্যক্তিদের (আমলা ও রাজনীতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত) ছুটি দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকেও সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
কমিটিকে স্বাগত জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী : পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির তদন্ত পর্যবেক্ষণে বিশ্বব্যাংক গঠিত প্যানেলকে স্বাগত জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনায় প্যানেলকে সহযোগিতা করা হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন। গতকাল শিল্পকলা একাডেমীতে বিশ্বব্যাংক আয়োজিত আঞ্চলিক চিত্রকলা প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি কমিটিকে সহায়তার ঘোষণা দেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগেই বিশ্বব্যাংকের কমিটির ঘোষণা আসে। এ কমিটি গঠনের প্রতিক্রিয়ায় অর্থমন্ত্রী বলেন, এটা খুবই ভালো। আমাদের দুদকও তদন্ত করছে। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।
এসব প্রক্রিয়া সেরে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করতে দেরি হবে কি না- জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, না দেরি হবে না। আমরা যেভাবে বলেছিলাম, সেভাবেই হবে। তিনি এর আগে বলেছিলেন, আগামী এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন