বুধবার, ৩ অক্টোবর, ২০১২

ছাত্রলীগের অস্ত্রবাজি : শাসন করার কেউ নেই!



রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের একচ্ছত্র খবরদারি বহাল রাখতে আবার অস্ত্রবাজি করেছে ছাত্রলীগ। এর আগেও একাধিকবার ছাত্রলীগের হামলায় রক্তলাঞ্ছিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। অকাট্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তথা ক্ষমতাসীন সরকার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা না নেয়ায় ছাত্রলীগের তাণ্ডব নানা মাত্রায় ছড়িয়েছে শিক্ষাঙ্গন ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে। এক পর্যায়ে তাদের কর্মকাণ্ডে নাখোশ প্রধানমন্ত্রী কড়া ভাষায় ছাত্রলীগকে শাসিয়েছেন। দেশের সব জাতীয় সংবাদপত্র ছাত্রলীগকে সামলানোর তাগিদ দিয়ে সম্পাদকীয়সহ বিস্তর সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কিন্তু ছাত্রলীগের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কোনোই পরিবর্তন ঘটেনি। বরং তারা আরও মারমুখো হয়েছে। এর আগে দেখা গেছে, প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় পুলিশ যেন তাদের প্রায় ব্যূহ রচনা করে সুরক্ষা দিয়েছে। এবার দেখা গেল, ছাত্রশিবিরের শোডাউনে আক্রমণ করার সময় তারা পুলিশের চোখের সামনেই গুলি ছুড়ছে, পিস্তলে গুলি ভরছে। পুলিশ না দেখার ভান করে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে অন্য দিকে। সাংবাদিকদের ক্যামেরাবন্দি হয়েছে এসব ভয়ঙ্কর দৃশ্য এবং প্রকাশিত হয়েছে পত্র-পত্রিকায়।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওপর ছাত্রলীগের এই গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২ অক্টোবর সকাল সাড়ে এগারোটায়। ক্যাম্পাসে শিবির ও ছাত্রলীগের শোডাউনকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত। প্রাপ্ত তথ্য মতে, সংঘর্ষ চলাকালে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা ও ক্যাডাররা অর্ধশতাধিক গুলি ছুড়েছে। সংঘর্ষে আহত হয়েছে উভয় পক্ষের ৩০ নেতাকর্মী। ঘণ্টাব্যাপী স্থায়ী এ সংঘর্ষে এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও সহকারী প্রক্টর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কোপে পড়ে লাঞ্ছিত হয়েছেন। এমনকি প্রক্টরের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করেনি ছাত্রলীগের বীরপুঙ্গবরা। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি বাস ও উপাচার্যের বাসভবনেও ভাংচুর চালিয়েছে। পুলিশের উপস্থিতিতে এসব ঘটলেও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত হামলাকারী সশস্ত্র ছাত্রলীগের কারও হদিস পায়নি পুলিশ। যে বারোজনকে আটক করা হয়েছে তারা সবাই শিবিরের কর্মী। কথাটা দাঁড়াল এই, ছাত্রলীগের লোকজন কেবল নিরাপদে-নির্বিঘ্নে অস্ত্রবাজিই করেনি, একইভাবে দৃশ্যপটের আড়ালেও চলে যেতে সক্ষম হয়েছে। এ ধরনের গল্প এর আগেও বহুবার শোনা গেছে। যারা মারে তাদের টিকির নাগাল পায় না পুলিশ। অন্যদিকে যারা মার খায় তারাই গ্রেফতার হয়। অনেকটা পাতানো খেলা আর কী! শেষ পর্যন্ত বরাবর যা করে তাই করেছে পুলিশ, তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের বিভিন্ন ছাত্রাবাসে (মেসে)। এসময় যাদের আটক করেছে তারা কেউ এ সংঘর্ষে জড়িত নয় বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। আটককৃতদের মধ্যে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীও রয়েছে। প্রসঙ্গত, একই দিনে চট্টগ্রামে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নিজেরাই দু’দলে ভাগ হয়ে মারামারি করেছে। এই আত্মঘাতী সংঘর্ষে আহত হয়েছে ১৫ জন। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে মতানৈক্য দেখা দেয়ায় এর আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
সবাই জানেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ছাত্রলীগ প্রচণ্ড বেপরোয়া হয়ে ওঠে। চর দখলের মতো তারা দখল করে নেয় বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হল। তাদের সশস্ত্র হামলায় সবক’টি বড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রক্ত ঝরেছে, শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, ছাত্রলীগ স্রেফ প্রতিপক্ষকে দমন করতে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে কয়েক মাস আগে। শাসনের চেয়ে সোহাগ বেশি পেলে যে তার ফলাফল ভয়ানক পরিণতির দিকে ধেয়ে যায়, তার অনেক ইঙ্গিত রেখেছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের ক্যাডাররা শুধু এবারই শিক্ষক তথা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের গায়ে হাত তোলেনি, তাকে টেনে-হিঁচড়ে উপাচার্যের বাসভবনে নিয়ে গেছে। এর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক শিক্ষককে তারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছিল। তার কোনো বিচার হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। কাজেই ছাত্রলীগের ক্যাডাররা প্রতিপক্ষের ওপর গুলি চালাবে, শিক্ষকদের অপদস্থ করবে—এটা কোনো নতুন খবর নয়। নতুন খবর হচ্ছে, এখন তারা শুধু পুলিশের সামনে মারপিটেই লিপ্ত হচ্ছে না, তাদের সামনে পিস্তলেও গুলি ভরছে। সেই গুলি বর্ষিত হচ্ছে প্রতিপক্ষের ওপর। এরপর নৈরাজ্যের আর কী বাকি থাকে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে ছাত্রলীগের অভিভাবক আওয়ামী লীগের দায়দায়িত্ব নিয়েই সংশয় জাগে। আর এ সংশয়ের জন্ম হয়েছে প্রধানমন্ত্রী তথা আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর সতর্কবাণী উপেক্ষা করার মধ্য দিয়ে। ছাত্রলীগ তার নির্দেশকেও মান্য করেনি। অর্থাত্ তারা পূর্বাপরের অবস্থান থেকে নড়েনি একচুলও। বরং মারদাঙ্গায় আরও বেশি সক্রিয়তার প্রমাণ রাখছে।
আমাদের প্রত্যাশা, ছাত্রলীগের অভিভাবকরা ছাত্রলীগের অস্ত্রবাজির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতা রক্ষার বিহিত করবেন। আমরা আবার তাদের প্রতি অনুরোধ রাখছি— ছাত্রলীগকে সামলান।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads